বর্ণসঙ্কর বিষয় নিয়ে সনাতনীদের মধ্যে ভ্রান্তধারণার বিদ্যমানতা দেখা যায়। বিভিন্নজন বিভিন্নভাবে ব্যাখা করার প্রয়াস করে যার মধ্যে খুবই প্রতিকূলতা দেখা যায়। বর্ণসঙ্কর বিষয়ে গীতায় বিষাদগ্রস্ত অর্জুন বলেছেন -
স্ত্রীষু দুষ্টাসু বার্ষ্ণেয় জায়তে বর্ণসঙ্করঃ॥ গীতা-১/৪০
পদার্থ : হে কৃষ্ণ! (অধর্মাভিভবাৎ) অধর্মের প্রভাব বৃদ্ধির কারণে (কুলস্ত্রিয়ঃ প্রদুষ্যন্তি) কুলস্ত্রীগণ দূষিত হয়ে যায় (স্ত্রীষু দুষ্টাসু) স্ত্রীগণ দুষ্ট হলে (বার্ষ্ণেয়) হে যাদবকুলোদ্ভব (জায়তে বর্ণসঙ্করঃ) বর্ণসঙ্কর উৎপন্ন হয়।
সরলার্থ : হে কৃষ্ণ! অধর্মের প্রভাব বৃদ্ধির কারণে কুলস্ত্রীগণ দূষিত হয়ে যায়, স্ত্রীগণ দুষ্ট হলে, হে যাদবকুলোদ্ভব, বর্ণসঙ্কর উৎপন্ন হয়।
যাজ্ঞবল্ক্যস্মৃতিতে বলা হয়েছে - "মৃতে জীবতি বা পত্যৌ যা নান্যমুপগচ্ছতি। সেহ কীর্তিমবাপ্নোতি " (আচারাধ্যায়-৭৫)
অর্থাৎ পতি জীবিত থাকা অবস্থায় অথবা মৃত্যুর পশ্চাৎ যে স্ত্রী অন্য পুরুষের সহিত সঙ্গ করেনা সে এই লোকে কীর্তি প্রাপ্ত হয়।
কুলবতী স্ত্রীর একটি লক্ষণ স্বামী ব্যতীত অন্য পুরুষের সঙ্গ না করা কিন্তু সারা কুল যখন অধর্মের প্রভাবে অধর্মের বশীভূত হয়ে যায় তখন স্ত্রীগণের আচরণ দুষিত হয়ে যায়। আচার, বিনয়, বিদ্যা, প্রতিষ্ঠা, নিষ্ঠা, বৃত্তি, তপ, দান আদিযুক্ত উত্তম কুলের গুণ ধারণ হইতে ভ্রষ্ট হয়ে যায়। স্বেচ্ছাচারিণী হয়ে মনের বশে থেকে মনে যাকে চায় তার সাথেই সম্পর্ক স্থাপন করে নেয়। এরূপ জ্ঞানরহিত, দায়িত্ব কর্তব্যরহিত সম্পর্কের ফলস্বরূপ বর্ণসঙ্কর উৎপন্ন হয়। শ্রীকৃষ্ণ এই বিষয়ে তৃতীয় অধ্যায়ে বলেছেন - তা শেষে উল্লেখ করা হয়েছে।
পতন্তি পিতরো হ্যেষাং লুপ্তপিণ্ডোদকক্রিয়াঃ॥ গীতা-১/৪১
পদার্থ : (সঙ্করঃ) বর্ণসঙ্কর (কুলঘ্নানাং) কুলঘাতকদের (চ) এবং (কুলস্য নরকায় এব) কুলকে নরক [দুঃখ] প্রাপ্ত করায় (এষাম্) এদের (পিতরঃ) পিতাদি (লুপ্তপিণ্ডোদকক্রিয়াঃ) অন্ন জল ভোজনাদি প্রাপ্ত না হওয়ার কারণে (হি) নিশ্চই (পতন্তি) পতিত হয়।
সরলার্থ : বর্ণসঙ্কর কুলঘাতকদের এবং কুলকে নরক[দুঃখ] প্রাপ্ত করায়। এদের পিতা আদি [সেবাশুশ্রূষা কর্তব্য লুপ্ত হওয়ার কারণে] অন্ন জল ভোজনাদি প্রাপ্ত না হওয়ার কারণে নিশ্চই পতিত হয়।
"পিতরঃ" শব্দ দ্বারা কেহ কেহ মৃত পিতৃপিতামহগণ বুঝিয়ে থাকেন এবং "লুপ্তপিণ্ডোদকক্রিয়া" শব্দের অর্থ মৃতকশ্রাদ্ধ করেন। সেজন্য কেহ কেহ এই শ্লোকটিকে প্রক্ষিপ্ত বলে থাকেন। কিন্তু তাদের ঐ অর্থ শাস্ত্রসংগত নহে। শাস্ত্রে "পিতর" বলতে জীবিত পিতৃপুরুষ এবং পিতৃতুল্যদের বুঝিয়েছেন। যেমন -
"আধত্ত পিতরো গর্ভকুমার পুষ্করসৃজম্" (যজুর্বেদ-২/৩৩)
--(যজুর্বেদ-১৬/৪৮) একটি মন্ত্রে বলাই হয়েছে যে-
"মানী বধী পিতরঃ মীত মাতরম্" (যজুর্বেদ-১৬/১৫)
অর্থাৎ আমাদের মাতা-পিতাকে বধ করোনা।
উপরোক্ত মন্ত্র দ্বারা স্পষ্ট যে পিতর জীবিতদের বুঝায়। চাণক্যনীতিতে বলা হয়েছে -
অন্নদাতা ভয়ত্রাতা পঞ্চেতে পিতরঃস্মৃতাঃ।।
----চাণক্যনীতি-৪/১৯
অনুবাদ : পিতা আচার্য (যজ্ঞোপবীত প্রদানকর্তা) অধ্যাপক, অন্নদাতা এবং ভয় ত্রাণ কর্তা, এই পাঁচ জনকে পিতর বলে।
মৃতকশ্রাদ্ধও বৈদিক শাস্ত্রসংগত নহে। বেদে অন্ত্যেষ্টিক্রিয়াকেই সর্বশেষ সাংস্কার বলা হয়েছে -
ওম্ ক্রতো স্মর। ক্লিবে স্মর। কৃতং স্মর॥ (যজুর্বেদ-৪০/১৫)
পদার্থঃ- হে (ক্রতো) কর্মশীল জীব! দেহান্তের সময় (ওম্) ওঁ এই নামবাচ্য ব্রহ্মকে (স্মর) স্মরণ করো। (ক্লিবে) আপন সামর্থ্য কে প্রাপ্তির জন্য পরমাত্মা এবং আপন স্বরূপ কে (স্মর) স্মরণ করো। (কৃতম্) আপন কৃত কর্মকে (স্মর) স্মরণ করো। এখানে বিদ্যমান (বায়ুঃ) ধনঞ্জয়াদিরূপ বায়ু (অনিলম্) কারণরূপ বায়ু কে (অমৃতম্) নাশরহিত কারণ কে ধারণ করেন। (অথঃ) অতঃপর (ইদম্) এই (শরীরম্) চেষ্টাদির আশ্রয় বিনাশী শরীর (ভস্মান্তম্) অন্তে ভস্ম হয়, এইরূপ জানো।
ভাবার্থঃ- হে মনুষ্য! মৃত্যুর কালে ওঁ কে স্মরণ করো, আপন কৃত কর্ম স্মরণ করো। সকলের অন্তে এই অনিত্য শরীর ভস্মীভূত হয়ে যাবে, সমগ্র বায়ুর সাথে মিলিয়ে যাবে প্রাণবায়ু। ভস্মসাৎ ক্রিয়ার পর এই শরীরের কোন সংস্কার কর্তব্য আর বাকী থাকে না। জীবনভর সেই এক পরমেশ্বরের আজ্ঞা পালন করবে, তাঁহার উপাসনা এবং নিজ সামর্থ্য কে বৃদ্ধি করবে। কৃত কর্ম কখনো বিফল হবে না এরূপ বুঝে ধর্মের পথে রুচি এবং অধর্মে অপ্রীতি রাখবে।
তাছাড়াও শাস্ত্রে জীবিতদের শ্রাদ্ধ করতে বলা হয়েছে (মনু.৩/৮২)। সুতরাং মৃতক শ্রাদ্ধ দ্বারা মৃত পিতৃপিতামহগণকে আহার করনোর পরিবর্তে এক্ষেত্রে "লুপ্তপিণ্ডোদকক্রিয়াঃ" শব্দ দ্বারা জীবিত পিতা আদির ভোজনাদি দ্বারা সেবা করার অর্থই গ্রহণীয়।
উৎসাদ্যন্তে জাতিধর্মাঃ কুলধর্মাশ্চ শাশ্বতাঃ॥ গীতা-১/৪২
পদার্থ : (বর্ণস্করকৈঃ) বর্ণসঙ্কর সৃষ্টিকারী (কুলঘ্নানাং) কুলঘাতকদের (এতৈঃ দোষৈঃ) উক্ত দোষে (জাতিধর্মাঃ) জাতির ধর্ম (চ) এবং (কুলধর্মাঃ) কুলধর্ম (শাশ্বতাঃ) নিরন্তর (উৎসাদ্যন্তে) নাশ হয়ে যায়।
সরলার্থ : বর্ণসঙ্কর সৃষ্টিকারী কুলঘাতকদের উক্ত দোষে জাতির ধর্ম এবং কুলধর্ম নিরন্তর নাশ হয়ে যায়।
সঙ্করস্য চ কর্ত স্যামুপহন্যামিমাঃ প্রজাঃ॥ গীতা-৩/২৪
পদার্থ: হে অর্জুন! (চেৎ) যদি (অহম্) আমি (কর্ম) বেদ বিহিত কর্ম/আচরণ (ন কুর্যাম্) না করি [তাহা হইলে] (ইমে লোকাঃ উৎসীদেয়ু) এই লোকসকল উৎসন্ন হইয়া যাইবে [এইজন্য আমি] (সঙ্করস্য কর্তা স্যাম) বর্ণসঙ্করাদির কর্তা হইব (চ) এবং (ইমাঃ প্রজাঃ উপহন্যাম্) এই প্রজাগণের ধ্বংসের কারণ হইব।
সরলার্থ : যদি আমি বেদবিহিত কর্ম/আচরণ না করি তাহা হইলে এই লোকসকল উৎসন্ন হইয়া যাইবে। এজন্য আমি বর্ণ-সঙ্করাদি সামাজিক বিশৃঙ্খলার হেতু হইব এবং ধর্মলোপহেতু প্রজাগণের বিনাশের কারণ হইব।
বর্ণ বলতে গীতায় চাতুর্বর্ণ্য বুঝানো হয়েছে। চাতুর্বর্ণ্যের সৃজন করা হয়েছে সমাজের শান্তি সমৃদ্ধি এবং প্রগতির জন্য (মনু.১/৩২) গুণ-কর্মের ভিত্তিতে (গীতা-৪/১৩) সঠিক কর্ম ব্যবস্থার জন্য। আর এই ব্যবস্থা লুপ্ত হয়ে যখন অব্যবস্থা হয়ে যায়,অর্থাৎ যা করার গুণ যার নেই সে সেই কর্ম করতে থাকে, যে শাস্ত্রবিহিত ব্রাহ্মণ নয় বরং শূদ্র কিন্তু তবুও ব্রাহ্মণের কর্ম ত্রুটিপূর্ণভাবে করে, এইরূপ অব্যবস্থাকেই বর্ণসঙ্কর বলা হয়। শ্রীকৃষ্ণ ছিলেন মুক্তাত্মা, তিনি কর্মবন্ধনমুক্ত ছিলেন, কোন কর্ম বাকি ছিলনা যা শ্রীকৃষ্ণের করা কর্তব্য (গীতা-৩/২২) কিন্তু তবুও শ্রীকৃষ্ণ কর্ম করতেন কেননা বেদে বলা হয়েছে-
(ঋগ্বেদ-১০/১৯১/২)
অর্থাৎ পূর্বকালীন মহাজ্ঞানী পুরুষেরা যেরূপ কৰ্ত্তব্য কৰ্ম সম্পাদন করিয়াছে তোমরাও সেই রূপ কর।
তাই গীতায় শ্রীকৃষ্ণও বলেছেন -
অর্থাৎ শ্রেষ্ঠ পুরুষ যেরূপ আচরণ করেন, সাধারণ মনুষ্যও সেরূপ আচরণ করে। সেই পুরুষ যা প্রমাণ বলে স্বীকার করে,আদর্শ মেনে চলেন লোকেরা তারই অনুসরণ করে।
এরূপ কারণাদির জন্য শ্রীকৃষ্ণ কর্ম করতেন কেননা শ্রীকৃষ্ণ কর্ম না করিলে শ্রীকৃষ্ণের অনুসারীও কর্ম না করিয়া বর্ণব্যবস্থা যথাবৎ রাখিবেন না যার ফলস্বরূপ কর্মের অব্যবস্থা হয়ে যাবে। শ্রীকৃষ্ণও স্বয়ম্ বলেছেন -
মম বর্ত্মানুবর্তন্তে মনুষ্যাঃ পার্থ সর্বশঃ।। (গীতা-৩/২৩)
হে পার্থ, যদি অনলস হইয়া কর্মানুষ্ঠান না করি, তবে মানবগণ সর্বপ্রকারে আমার পথের অনুবর্তী হইবে (কেহই কর্ম করিবে না)।
©️অমৃতস্য পুত্রাঃ
