-রথযাত্রা-
সত্যিই কি শুধুমাত্র বছরের একটি দিনই রথ যাত্রা??
আসুন আমরাও সেই যাত্রার যাত্রি হই, সত্যের পথ যাত্রি!!!
"রথস্থ বামনং দৃষ্টা পুনর্জন্ম ন বিদ্যতে।"
এমন মান্যতার বিশ্বাস করেই সনাতনী হিন্দুরা তাই রথরজ্জু ধরে রথটানা মহাপুণ্য কর্ম বলে হিন্দু ধর্মে স্বীকৃতি লাভ করেছে ও কিছু ধর্মীয় সংগঠন প্রচার করে চলছেন।
শাস্ত্রবাক্য হয়তো মিথ্যা নয়। সত্যিই জগন্নাথ দর্শন পুনর্জন্মচক্র থেকে জীবকে রক্ষা করে।
শুধু জানতে হবে যে, "রথ_কি?" "বামন" মানেই বা কি?
তবে বিষয়টা একটু রুপক, দার্শনিক ও আধ্যাত্মিক।
তাই চলুন একটু বেদ উপনিষদের আলোকে ব্যতিক্রমভাবে চিন্তন করি! বাহ্যিক নয়, বরং আধ্যাত্মিক!! আর যারা এই আধ্যাত্মিকতার ভেতরে প্রবেশ করতে সমর্থ তারাই প্রকৃত তত্ত্ব উপলব্ধি করতে পারেন। আসুন চেষ্টা করে দেখি-
आत्मानँ रथितं विद्धि शरीरँ रथमेव तु ।
बुद्धिं तु सारथिं विद्धि मनः प्रग्रहमेव च ॥ ३॥
इन्द्रियाणि हयानाहुर्विषयाँ स्तेषु गोचरान् ।
आत्मेन्द्रियमनोयुक्तं भोक्तेत्याहुर्मनीषिणः ॥ ४॥
(कठपनिषद: १/३/३-४)
"আত্মানম্ রথিনম্ বিদ্ধি শরীরম্ রথমেব তু।
বুদ্ধিম্ তু সারথিম্ বিদ্ধি মনঃ প্রগ্রহমেবচ॥
ইন্দ্রিয়ানি হয়ানাহুর্বিষয়াম্স্তেষু গোচরান।
আত্মেন্দ্রিয়মনোয়োক্তম্ ভোক্তেত্যাহুর্মনীষিনঃ॥"
(কঠপনিষদ: ১/৩/৩-৪)
অন্বয়:- আত্মনম্ ( আত্মাকে অর্থাৎ শরীরী আত্মাকে); রথিং বিদ্ধি (রথী বলে জেনো) শরীরম্ (দেহকে); রথম্ এব তু (রথ বলে জেনো); বুদ্ধিং তু (বুদ্ধিকে) সারথিং বিদ্ধি (সারথি বলে জেনো); মনঃ চ (এবং মনকে); প্রগ্রহম্ এব (বল্পা অর্থাৎ লাগাম বলে জেনো)
ভাবার্থ- আমাদের প্রত্যেকের শরীর হল রথ, আর বামন জগন্নাথ (আত্মা ও পরমাত্মা) হল সেই রথের স্বামী, আমাদের মন হল লাগাম, ঘোড়াগুলি হল ইন্দ্রিয়, এবং মনীষীগণ (যোগীপুরুষ-আমরা) বুদ্ধিরুপী সারথির নিয়ন্ত্রনে মন ও ইন্দ্রিয়কে বশীভূত করে (বিষয়রুপী) জীবন পথে পরিচালনা করে পরমাত্মামুখী যাত্রা (শুদ্ধজ্ঞানের দ্বারা কর্ম) করে উনার আশ্রয় লাভ করে (ঈশ্বরপ্রাপ্তি)।
মহাভারতের উদ্যেগপর্ব বলা হয়েছে-
পুরুষের (মনুষ্যের) শরীর হচ্ছে রথ, আর তার মন হচ্ছে সারথি এবং ইন্দ্রিয়গুলি হচ্ছে অশ্ব। সাবধান ও রথচর্য্যানিপুণ লোক যেমন রথারোহণ করে সুখে গমন করেন, তেমনি সাবধান ও সংসারনিপুণ বুদ্ধিমান লোক সেই ইন্দ্রিয়রূপ সুশিক্ষিত সদশ্বগণদ্বারা শরীররথে সুখে সংসারপথ অতিক্রম করেন ৷
(মহাভারত, উদ্যেগপর্ব :৩৪/৬০)
বেদ বলে-
इच्छन्ति देवाः सुन्वन्तं न स्वप्नाय स्पृहयन्ति।
यन्ति प्रमादमतन्द्राः ॥
(सामवेद» उत्तरार्चिक» मन्त्र संख्या-७२१॥)
ইচ্ছন্তি দেবাঃ সুন্বন্তং ন স্বপ্নায় স্পৃহয়ন্তি।
যন্তি প্রমাদমতন্দ্রাঃ ॥ (সামবেদ » উত্তরার্চিক» ৭২১)
অর্থাৎ বিদ্বানেরা নিজেকে জানার মধ্য দিয়ে ঈশ্বরকে জানার ইচ্ছা প্রকাশ করেন।
আমরা যে রথ স্থুল দৃষ্টিতে দেখি, জ্ঞানীরা আধ্যাত্মিকভাবে তার মধ্যেই আত্মদর্শন করে ব্রহ্মকে প্রাপ্ত হোন। জীব যদি আত্মদর্শনের মধ্য দিয়ে ঈশ্বরদর্শন তথা প্রাপ্ত করে, তবে পুনর্জন্ম হবে কিভাবে?
এটাই হল রথযাত্রার আধ্যাত্মিক মোটিভ। তাই তো ঋগ্বেদ: ও অথর্ববেদে বলা আছে-
यं दे॑वा॒सोऽव॑थ॒ वाज॑सातौ॒ यं शूर॑साता मरुतो हि॒ते धने॑ ।
प्रा॒त॒र्यावा॑णं॒ रथ॑मिन्द्र सान॒सिमरि॑ष्यन्त॒मा रु॑हेमा स्व॒स्तये॑ ॥
"যং দেবাসোহবথ বাজসাতৌ যং শূরসাতা মরুতো হি তে ধন।
ত্রাতযাবাণমং রথমিন্দ্রসানসিম রিষ্যন্তমারুহে মা স্বস্তয়ে।।"
(ঋগ্বেদ: ১০/৬৩/১৪)
বঙ্গানুবাদ- হে উজ্জ্বল দিব্য ধনের অধিকারী বিদ্যান পুরুষ! অন্ন, বল ও হিতকর ধনাদি লাভের জন্য ঈশ্বর লাভের সাধন যে রথকে তোমরা রক্ষা কর, সেই সুগঠিত রথে কল্যাণের জন্য আমরা আরোহন করি।
ভাবার্থ- বিদ্বান পুরুষের নাম মরুত এবং শরীরের নাম রথ। এই রথ শুধু অন্ন, বল, ও ধন লাভেরই সহায়ক নয়- ইহা ঈশ্বর লাভেরও সহায়ক। নীরোগ শরীর রূপী রথকে ব্রাহ্মমুহূর্তে জড়িয়া সন্ধ্যোপাসনায় লাগাইবে।
यस्याश्वा॑सः प्र॒दिशि॒ यस्य॒ गावो॒ यस्य॒ ग्रामा॒ यस्य॒ विश्वे॒ रथा॑सः।
यः सूर्यं॒ य उ॒षसं॑ ज॒जान॒ यो अ॒पां ने॒ता स ज॑नास॒ इन्द्रः॑ ॥
(अथर्बबेद » काण्ड:२०» सूक्त:३४» मन्त्र:७)
যস্যাশ্বা॑সঃ প্র॒দিশি॒ যস্য॒ গাবো॒ যস্য॒ গ্রামা॒ যস্য॒ বিশ্বে॒ রথা॑সঃ।
যঃ সূর্যং॒ য উ॒ষসং॑ জ॒জান॒ যো অ॒পাং নে॒তা স জ॑নাস॒ ইন্দ্রঃ॑ ॥
(অথর্ববেদ » কাণ্ড:২০» সূক্ত:৩৪» মন্ত্র:৭)
পদার্থঃ (য়স্য) যার (প্রদিশি) আজা বা কৃপাতে (অশ্বাসঃ) কর্মেন্দ্রিয় কর্মে নিযুক্ত হয়, (য়স্য) যার আজ্ঞাতে (গাবঃ) জ্ঞানেন্দ্রিয় জ্ঞান প্রাপ্ত করে, (য়স্য গ্রামা) যার আজ্ঞাতে প্রাণসমূহ আপন আপন কর্মে নিযুক্ত এবং (য়স্য বিশ্বে রথাসঃ) যার আজ্ঞাতে শরীররূপ রথ বিশ্বে কর্মশীল, (য়ঃ সূর্যম) যে ভগবান সূর্যকে (য়ঃ উপসম্) এবং প্রভাত বেলা কে (জজান) উৎপন্ন করে (য়ঃ অপামা নেতা) যে ভগবান সর্বত্র জলের প্রেরণকারী। (জনাসঃ) হে মানুষ! (স ইন্দ্ৰঃ) তিনি মহান ঐশ্বর্য্যসম্পন্ন ইন্দ্র।
ভাবার্থ: যেই পরমাত্মার কৃপায় আমাদের কর্মেন্দ্রিয়, জ্ঞানেন্দ্রিয় এবং শরীর নামক রথ গতিশীল বা নিজ নিজ কর্মে নিযুক্ত হয়, যে ভগবান সূর্য এবং প্রভাত বেলাকে সৃষ্টি করেছেন এবং জল কে যে কোন স্থানে প্রেরণ করেছেন, হে মানুষ তিনিই পরমেশ্বর্য্যসম্পন্ন পরমাত্মা ইন্দ্র।।
শরীররূপী প্রকৃত রথকে চিনুন, আর সেই রথের ভেতরে বিদ্যমান রথি (জগতের নাথ জগন্নাথকে) চিনুন, চিনতে পারলে ও তাকে জানতে পারলেই জীবন সার্থক। তাই কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ভাষায় বলতে চাই-
"রথযাত্রা, লোকারণ্য, মহা ধুমধাম,
ভক্তেরা লুটায়ে পথে করিছে প্রণাম।
পথ ভাবে ‘আমি দেব’, রথ ভাবে ‘আমি’,
মূর্তি ভাবে ‘আমি দেব’ হাসে অন্তর্যামী।"
তাই শেষ করার পূর্বে উপনিষদকারের ভাষায় বলতে চাই-
उत्तिष्ठत जाग्रत प्राप्य वरान्निबोधत ।
क्षुरस्य धारा निशिता दुरत्यया दुर्गं पथस्तत्कवयो वदन्ति ॥
(कठ उपनिषद: १/३/१४)
"উত্তিষ্ঠত জাগ্রত প্রাপ্য বারণন্ নিবোধত।
ক্ষুরস্য ধারা নিশিতা দুরত্যয়া দুর্গং পথস্তৎ কবয়ো বদন্তি।।"
(কঠ উপনিষদ: ১/৩/১৪)
সরলার্থ- উঠ, জাগো, শ্রেষ্ঠ আচার্যগণের নিকট গিয়ে তত্ত্ব (সত্য তত্ত্ব) অবগত হও। মেধাবিগণ বলেন যে, ক্ষুরের তীক্ষ্ণীকৃত অগ্রভাগ যেমন দুর্গম, উক্ত পথও সেইরূপ দুর্গম।
তাই প্রতিনিয়ত সকলের রথযাত্রা শুভ হোক, কল্যাণময় হোক, শান্তিময় হোক, আনন্দময় হোক। রথীর নিকট এই কামনাই করি।
ও৩ম্ শান্তিঃ শান্তিঃ শান্তিঃ।
কলমে: চন্দ্র শেখর আর্য ও আর্য শ্রী দিপংকর।