পুরাণ থেকে রাধার বিষয়ে যা
লিখেছিলাম তা দেখে অনেকে বলার চেষ্টা করেন যে, পুরাণ না
হয় ছাড়ুন কিন্তু বেদেও তো রাধার উল্লেখ আছে। এখন বেদ অস্বীকার করবেন কি?
দেখুন বেদে রাধার উল্লেখ
নয়, রাধা শব্দের উল্লেখ আছে। মনে করুন আপনার নাম আনন্দ,
আপনি যদি বেদে খোঁজ করেন, তাহলে আনন্দ
শব্দও পেয়ে যাবেন। যেমন যজুর্বেদ-২০/৯
মন্ত্রে 'আনন্দানন্দৌ', অথর্ববেদ-৯/৭/২৩ মন্ত্রে 'আনন্দঃ', অথর্ববেদ-১১/৮/২৪ মন্ত্রে 'আনন্দাঃ' শব্দের উল্লেখ আছে। এগুলো
ছাড়া আরো অনেক মন্ত্রেই আনন্দ শব্দের উল্লেখ আছে। এখন এর মানে যদি আপনি মনে করেন,
বেদে আপনার উল্লেখ আছে, তাহলে এটা কি
ভুল হবেনা? বেদে আনন্দ শব্দের উল্লেখ আছে কিন্তু আপনার
অর্থাৎ আপনার নামের উল্লেখ নেই। অনুরূপ রাধা শব্দেরও উল্লেখ আছে কিন্তু রাধার
উল্লেখ নেই। বেদমন্ত্রের যে যে মন্ত্রে
রাধা শব্দের উল্লেখ আছে তার কিছু এখানে আমি উদ্ধৃত করছি–
ঋগ্বেদ– ১/২২/৮-'রাধাংসি', ১/৩০/৫-'রাধানাং
পতে', ১/৪১/৭-'রাধাম সখায়ঃ',
১/৮৪/২০-রাধাংসি', ১/১০০/১৭-'সুরাধাঃ', ৩/৩৩/১২-'সুরাধা',
৩/৫১/১০-'রাধানাং পতে', ৪/২/৪-'সুরাধা', ৪/৫/৪-'সুরাধাঃ', ৪/১৬/১৬-'স্পার্হরাধা',
৪/১৭/৮-'সুরাধাঃ', ৪/২৪/২-'সত্যরাধাঃ', ৪/২৯/১-'সত্যরাধাঃ', ৫/৪০/৭-'সত্যরাধাস্তৌ',
৫/৭৯/৬-'রাধাংস্যহ্রয়া', ৫/৭৯/৭-'রাধাংস্যশ্ব্যা', ৬/৪৪/১২-'রাধাংস্যশ্ব্যানি', ৬/৪৮/৯-'রাধাংসি', ৭/১৫/১১-'রাধাংস্যা', ৭/১৬/১০-'রাধাংসি', ৭/৩৭/২-'রাধাংসি',
৭/৩৭/৮-'রাধাংসি', ৮/৬/৪৬-'রাধাংসি', ৮/৮/১৩-'রাধাংস্যহ্রয়া', ৮/৭০/১৩-'রাধাম', ১০/২৯/৭-'সত্যরাধাঃ',
১০/৪৯/১১-'সত্যরাধাঃ'।
যজুর্বেদ– ১৫/৩৪-'রাধো', ২৭/২৭-'রাধঃ',
৩০/৪-'রাধসঃ', ৩৩/১৩-'রাধসা'।
সামবেদ– ৪১-'রাধাংসি', ১৬৫-'রাধানাং
পতে', ৩৩৫-'সুরাধা', ৩৮৬-'রাধাংসি', ৭৩৭-'রাধানাং পতে', ১৫০৯-'রাধাংসি',
১৬০০-'রাধানাং পতে', ১৬২৩-'রাধাংসি', ১৭২৪-'রাধাংসি'।
অথর্ববেদ– ১৯/৭/৩-'রাধে', ২০/৪৫/২-'রাধানাং
পতে', ২০/৭৬/৭-'সত্যরাধাঃ'।
তদ্ভিন্ন অন্যান্য অনেক
মন্ত্রেই এরূপ - রাধঃ, সত্যরাধা, রাধানাং পতে, রাধাম, সুরাধা,
রাধো, রাধাংসি ইত্যাদি শব্দের উল্লেখ
পাওয়া যাবে বা যায়, সবগুলো একত্র করলে কম করে হলেও প্রায় ৪০০
মন্ত্রের রেফারেন্স এখানে দেওয়া যাবে, কিন্তু এর মানে
এই নয় যে, এই শব্দসমূহ দ্বারা পৌরাণিক বৃষভানু কন্যা
রাধার উল্লেখ আছে।
পণ্ডিত চন্দ্রশেখর উপাধ্যায় এবং শ্রী অনিল
কুমার উপাধ্যায়কৃত বৈদিক কোষে রাধঃ অর্থ দেওয়া হয়েছে–
রাধঃ– রাধ (সংসিদ্ধি, রাংধনা) +
অসুন = রাধস্। অর্থ হলো ধন (ধন দ্বারাই সব কার্য সিদ্ধ হয়। বা ধনের সহায়তা দ্বারা
আমরা ভোজন রান্না করি অতঃ রাধস্ অর্থ ধন)
অথবা, রাধ (আরাধনা করা) + অসুন= রাধস্। ধনের
আরাধনা করা হয়ে থাকে। অতঃ ইহাকে "রাধস্" বলা হয়।
বেদ ভাষ্যের অতি নিকটস্থ নিরুক্তে বলা হয়েছে
- 'রাধ ইতি ধননাম'
(নিরুক্ত-৪/৪) অর্থাৎ রাধ হলো
ধনের নাম।
আর এই
অর্থ দেওয়াই হয়েছে বেদ মন্ত্রার্থের জন্য। আর্য বিদ্বানেরা তো এই অর্থই প্রয়োগ
করেছে কিন্তু আর্য সমাজের বিদ্বান ছাড়া অন্য ভাষ্যগুলো যদি দেখি তাতে যা অর্থ করা
হয়েছে তা এরূপ–
১.উদ্গীথাচার্য–
ঋগ্বেদ-১০/২৯/৭ মন্ত্রে আসা 'সত্যরাধা'
শব্দের অর্থ নিয়ে উদ্গীথাচার্য লিখেছেন 'সত্যরাধাঃ সত্যধনঃ' অর্থাৎ সত্য বলতে সত্য আর
রাধা অর্থ ধন।
২.শ্রীঅনির্বাণ–
ঋগ্বেদ-৩/৪১/৬ মন্ত্রে আসা 'রাধসে'
শব্দের বিষয়ে লিখতে গিয়ে শ্রীঅনির্বাণ জী বেদের ভিবিন্ন
রেফারেন্স টানেন, যে মন্ত্রসমূহে 'রাধসে' 'রাধসো' আদি
শব্দ রয়েছে, পরে নিঘণ্টু-২/১০ রেফারেন্স দিয়ে লিখেন - ধন,
অর্থাৎ নিঘণ্টু-২/১০ এ বলা হয়েছে 'রাধঃ
ধনস্য'।আর যা লিখেছে তা এরূপ-
৩.বেঙ্কটমাধব–
ঋগ্বেদ-১/৮৪/২০ মন্ত্রে আসা 'রাধাংসি'
শব্দের অর্থ করতে গিয়ে বেঙ্কটমাধব লিখেছেন 'ধনানি পালনানি'।
ঋগ্বেদ-৩/৫১/১০ মন্ত্রোক্ত 'রাধানাং
পতে', অর্থ করেছেন 'হে ধনানাম্
পতে'।
৪.স্কন্দস্বামী–
ঋগ্বেদ-১/১০০/১৭ মন্ত্রে আসা 'রাধঃ'
শব্দের অর্থ করতে গিয়ে স্কন্দস্বামী- নিঘণ্টু-২/১০ তুলনা করত 'রাধঃ ধননামৈতৎ' লিখেছেন।
ঋগ্বেদ-৩/৫১/১০
মন্ত্রোক্ত
'রাধানাং পতে', অর্থ করেছেন 'হে ধনানাং স্বামিন্'।
৫.সায়ণাচার্য–
ঋগ্বেদ-১/২২/৮ মন্ত্রে আসা 'রাধাংসি'
নিয়ে সায়ণাচার্য লিখেছেন 'রাধাংসি ধনানি'
অর্থাৎ রাধা বলতে ধন বুঝাচ্ছে।
ঋগ্বেদ-১/৩০/৫ মন্ত্রে আসা 'রাধানাং
পতে' অর্থ করেছেন হে ইন্দ্র!'ধনানাং
পালক' অর্থাৎ ধনের পালক বা স্বামী।
সামবেদ-৪১মন্ত্রে আসা 'রাধাংসি'
শব্দেরও একই অর্থ করেছেন।
২৩২নং
মন্ত্রে আসা 'রাধ্যং' অর্থ করেছেন 'স্তুতিমিরারাধনীয়মেব' অর্থাৎ স্তুতি
দ্বারা আরাধনা করার যোগ্য।
৬.জ্বালাপ্রসাদ মিশ্র–
যজুর্বেদ-১৫/৩৪ মন্ত্রে থাকা 'রাধো'
শব্দের, জ্বালাপ্রসাদ মিশ্র 'ধন' অর্থ করেছেন। ২৭/২৭-'রাধঃ' অর্থ ধন, ৩০/৪-'রাধসঃ' অর্থ ধন এবং ৩৩/১৩-'রাধসা' অর্থ হবিলক্ষণশীল অন্ন করেছেন, কোথাও সেই রাধাকে বুঝাননি।
৭.উবট আচার্য–
যজুর্বেদ-১৫/৩৪ মন্ত্রে আসা 'রাধো'
নিয়ে উবট আচার্য লিখেছেন 'রাধো জনানাম্
রাধো ধনং' অর্থাৎ ধনী যজমানের দেবধন।
২৭/২৭-'রাধঃ' অর্থ 'রাধঃ ধনম্', ৩০/৪-'রাধসঃ' অর্থ 'রাধসঃ
ধনস্য' এবং ৩৩/১৩-'রাধসা'
অর্থ 'রাধসা হবির্লক্ষণেন ধনেন' হবিলক্ষণশীল অন্ন করেছেন, তিনি কোথাও কলাবতী
কন্যা রাধাকে বুঝাননি।
৮.মহীধরাচার্য–
যজুর্বেদ-১৫/৩৪ মন্ত্রে আসা 'রাধো'
নিয়ে মমহীধরাচার্য লিখেছেন 'রাধো ধনং'
অর্থাৎ ধনী যজমানের দেবধন।
২৭/২৭-'রাধঃ' অর্থ 'রাধঃ ধনং', ৩০/৪-'রাধসঃ' অর্থ 'রাধসঃ
ধনস্য' এবং ৩৩/১৩-'রাধসা'
অর্থ 'রাধসা হবীরূপেণান্নেন' অর্থাৎ হবিরান্ন করেছেন, তিনিও কোথাও সেই
রায়াণ পত্নী রাধাকে বুঝাননি।
৯.স্বামী করপাত্রী–
যজুর্বেদ-১৫/৩৪ মন্ত্রে আসা 'রাধো'
নিয়ে স্বামী করপাত্রী লিখেছেন 'রাধো ধনং'।
অন্যান্য মন্ত্রোক্ত রাধা দ্বারাও পূর্বে
দেওয়া বিদ্বানদের মতো অর্থই করেছেন তিনি।
১০.স্বামিশ্রীভগবদাচার্য–
তিঁনি সামবেদ-৪১ মন্ত্রোক্ত 'রাধাংসি'
অর্থ 'রাধাংসি ধনানি' করেছেন।
১১.মুদ্গল–
ঋগ্বেদ-১/৩০/৫
মন্ত্রে আসা 'রাধানাং পতে' অর্থ আচার্য মুদ্গল 'ধনানাং পালক' করেছেন।
অন্যান্য মন্ত্রেও অনুরূপ অর্থই দৃষ্ট হয়, কিন্তু প্রায় ৪০০ মন্ত্রের তথ্য দিতে গেলে স্বতন্ত্র এক পুস্তকের আকার
হয়ে যাবে। অল্পপরিমাণ তথ্য উদ্ধৃত করে বুঝানো হয়েছে যে তারাও এই শব্দসমূহ দ্বারা
ধন আদি নিরুক্তে উল্লেখিত বা বৈদিক কোষে উল্লেখিত অর্থের অনুকূল অর্থ করেছেন। কেহ কলাবতী
কন্যা রাধাকে বুঝাননি।
পুরাণেও কোথাও কোথাও রাধা বলতে ধন বুঝানো
হয়েছে–
যেমন– শ্রীমদ্ভাগবত-২/৪/১৪
শ্লোকে আসা 'রাধসা' অর্থ 'ঐশ্বর্য্যেণ' অর্থাৎ ঐশ্বর্য করেছেন, গৌড়ীয় ভাষ্যেও এবং
শ্রীল প্রভুপাদ ভাষ্যেও।
এই যে অনেকে ঋগ্বেদ-১/৩০/৫
মন্ত্রের রেফারেন্স টেনে বলেন, এই মন্ত্রে রাধার উল্লেখ আছে, তারা
কি আদৌ বুঝে বলেন? এই মন্ত্রের দেবতা হলো ইন্দ্র, ভাষ্যকারগণ লিখেছেন - হে ইন্দ্র! ধনের পালনকারী, ধনের
স্বামী ইত্যাদি। কিন্তু সাধারণত যারা এই রেফারেন্স দেন তাদের দৃষ্টি অনুযায়ী এর
অর্থ হয় - হে ইন্দ্র! (তুমি) রাধার
স্বামী। কি আশ্চর্য!