বেদে নারীর প্রজ্ঞা

সমর আর্য
0

 বেদে নারীর প্রজ্ঞা 


বেদে নারীর প্রজ্ঞা নিয়ে, প্রায়শই এই ধরনের মিথ্যা প্রচারণা মুসলমান, খ্রিস্টান তথা নব্য বৌদ্ধদের মতো ধর্মবাদীরা ছড়িয়ে বেড়ায় যে, বেদে লেখা আছে "নারীদের বুদ্ধি কম"। আর এটা প্রমাণ করার জন্য এইসকল লোকেরা ঋগ্বেদ (৮.৩৩.১৭) থেকে প্রমাণ দেয়। এখন এই মন্ত্রটি পর্যালোচনা করা যাক।

ভুল অনুবাদ ঋগ্বেদ (৮/৩৩/১৭) 


ঋগ্বেদের এই মন্ত্রে দুটি পদ আছে "ক্রতুং রঘুম্‌" - যা অনেক হিন্দি ভাষ্যকারদের দ্বারা ভুলভাবে ব্যাখ্যা করা হয়েছে যে, নারীদের বুদ্ধি কম। এই কারণে, এই মন্ত্রের ব্যাখ্যার (ভাষ্যের) প্রেক্ষাপটে বৈপরীত্যের পাশাপাশি অন্যান্য বেদ মন্ত্রের সাথে এই ব্যাখ্যারও একটি দ্বন্দ্ব রয়েছে। আসলে, এই মন্ত্রের প্রেক্ষাপট বুঝতে পারলে আমরা এখানে "রঘুম্‌" পদের প্রকৃত অর্থ জানতে পারব।

এই মন্ত্রে লেখা আছে যে, ভগবান ইন্দ্র বলেছেন - "যে কোন ব্যক্তির পক্ষে নারীর মন নিয়ন্ত্রণ করা কঠিন।" এখন আপনারা সবাই ভাবছেন যে, এই মন্ত্রে যদি নারীর বুদ্ধিমত্তাকে ছোট বলা হয় তাহলে কেন লেখা হলো নারীর মনকে নিয়ন্ত্রণ করা কঠিন? 

কারণ আমরা জানি যে, "যে কোনো ব্যক্তির পক্ষে কম বুদ্ধিসম্পন্ন ব্যক্তির মনকে নিয়ন্ত্রণ করা খুব সহজ।" এই কারণে, এখানে "ক্রতুং রঘুম্" এর অর্থ কম বুদ্ধিমত্তা বোঝানো যাবে না কারণ এই ধরনের অর্থ প্রেক্ষাপটের বিপরীত।

"রঘুম্‌" শব্দের প্রকৃত অর্থ 


ঋগ্বেদের (৮.৩৩.১৭) মন্ত্রে - "রঘুম্‌" পদটি "রঘু" মূল শব্দের কর্মকারক দ্বিতীয়া বিভক্তির একবচনে হয়।

কিছু অল্পবুদ্ধিসম্পন্ন লোক এমনটিও বলে যে "রঘু" হতে "রঘুম্‌" পদে পরিবর্তিত হলে এর অর্থেরও পরিবর্তন হয়ে যায়। কিন্তু সংস্কৃত ব্যাকরণে এমন কোন নিয়ম পাওয়া যায় না। একইভাবে, সংস্কৃত ব্যাকরণে "বালক" পদের দ্বিতীয় বিভক্তির একবচনে "বালকম" পদটি হয়, কিন্তু এটি শব্দের আসল অর্থ পরিবর্তন করে না।

মহর্ষি পাণিনির অষ্টাধ্যায়ীতে একটি সূত্র আছে যেটি হলো "কৃপঃ রঃ লঃ"(৮.২.১৮) যেটি মহর্ষি পতঞ্জলি মহাভাষ্যে (৮.২.১৮) এভাবে ব্যাখ্যা করেছেন—

"বালমূললধ্বলমঙ্গুলীনাং বা লো রমাপদ্যত ইতি বক্তব্যম্"

যার অর্থ  "বাল" "মূল" "লঘু" "অলম" এবং "অঙ্গুলী" এর "ল" বর্ণের বিকল্প "র" বর্ণ হয়। উদাহরণস্বরূপ "বাল" হতে  "বার", "মূল" হতে "মূর", "লঘু" হতে "রঘু", "অলম" হতে "অরম" এবং "অঙ্গুলী" হতে "অঙ্গুরী" পরস্পরের বিকল্প। 

সুতরাং "রঘু" পদটি "লঘু" শব্দের সমার্থক কারণ "রঘু" পদটি "লঘু" শব্দ থেকে উদ্ভূত হয়েছে।

[ বার্তিক অষ্টাধ্যায়ীতেও একই বক্তব্য আছে— বালমূললঘ্বসুরালমঙ্গুলীনাং বা রো লমাপদ্যত ইতি বক্তব্যম্॥ বালঃ, বারঃ। মূলম্, মূরম্। লঘু, রঘু। অসুরঃ, অসুলঃ। অলম্, অরম্। অঙ্গুলিঃ, অঙ্গুরিঃ॥ ]

উণাদিসূত্র ১.২৯

পাণিনির উনাদি সূত্র (১.২৯) এবং পাণিনীয় ধাতুপাঠ (ধাতুনং-১০৮) অনুসারে "লঘু" পদটি এসেছে "লঘি গত্যর্থঃ" মূল থেকে যা গতি বা দ্রুত অর্থে ব্যবহৃত হয়। অতএব, মূল শব্দ থেকে যে "রঘুম্‌" শব্দটি এসেছে, তার মূল বা আসল অর্থ হলো দ্রুত।

আমরা যদি সংস্কৃত অভিধান দেখি, তাহলে আমরা "রঘুম" পদের দুটি অর্থ পাই, প্রথমটি ছোট এবং দ্বিতীয়টি তীক্ষ্ণ। সুতরাং প্রসঙ্গানুসারে, এখানে "রঘুম" শব্দের অর্থ "দ্রুত" হবে।

অমরকোষ

একইভাবে অমরকোষ অভিধানেও "লঘু" শব্দের অর্থ দ্রুত বা গতি বলে ব্যাখ্যা করা হয়েছে। 

"রঘুবংশ মহাকাব্যে" - কালিদাস "রঘু" শব্দের মূল অর্থ "দ্রুত" গ্রহণ করে ব্যাখ্যা করেছেন। কালিদাস বলেন (রঘুবংশ মহাকাব্য ৩.২১) - 

"শ্রুতুস্য য়ায়াদয়মন্তমর্থকস্তথা পরেষাং য়ুধিচেতি পার্থিবঃ। অবেক্ষ্য ধাতোর্গমনার্থমর্থবিচ্চকার নামনা রঘুমাত্মসম্ভবম্" - অর্থাৎ, এই বালক সম্পূর্ণ শাস্ত্রে পারঙ্গত হবে তথা শত্রুদের যুদ্ধে নাশ করবে, অতএব শব্দার্থের জ্ঞাতা রাজা দীলিপ  "লঘি" ধাতুর "গতি" অর্থ উপলব্ধি করে বালকের নাম রঘু রাখেন।।২১।।

রঘুবংশ মহাকাব্যম্ (৩.২১)


বাল্মিকী রামায়ণ (১.২৪.১১) 

বাল্মীকি রামায়ণেও এখানে "লঘু" শব্দটি দ্রুত বা গতির অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে। তাই এটি আমার অবস্থানকে আরো দৃঢ় করে তোলে।

সায়ণও এই মন্ত্রে "রঘু" পদটিকে দ্রুতগতির অর্থ হিসেবে ব্যাখ্যা করেছেন।

ঋগ্বেদ (১/৬৮/৭) মন্ত্রের সায়ণ ভাষ্য 

ঋগ্বেদ (৮.৩৩.১৭) মন্ত্রের ওপর আচার্য বেঙ্কট মাধবের ভাষ্য 

 ভাষ্যকার আচার্য বেঙ্কটও এই মন্ত্রে "রঘুম্‌" এর অর্থ "দ্রুত" হিসাবে ব্যাখ্যা করেছেন।

R.L. Kashyap Translation On Rigveda (8.33.17)

আরএল কাশ্যপও রঘুম শব্দের অর্থ গ্রহণ করেছেন দ্রুতগতি (Swift)

ঋগ্বেদ (৮.৩৩.১৭) - পণ্ডিত হরিশরণ সিদ্ধান্তালংকারজীর ভাষ্য 

হরিশরণও এই মন্ত্রের একই ব্যাখ্যা করেছেন যে, নারীদের বুদ্ধি প্রখর বলে তাদের মন নিয়ন্ত্রণ করা যায় না। শুধু তাই নয়, নিম্নলিখিত মন্ত্রে এটাও বলা হয়েছে যে "স্ত্রী হি ব্রহ্মা বভূবিথ" (ঋগ্বেদ ৮/৩৩/১৯), অর্থাৎ একজন নারীর ব্রহ্মা হওয়ার অধিকার রয়েছে।

তাই যে বৈদিক ধর্মে নারীদের যেখানে ব্রহ্মা হওয়ার অধিকার রয়েছে, সেই বৈদিক ধর্মে নারীরা অবশ্যই বুদ্ধিমতী বলে বিবেচিত হবে, বুদ্ধিহীন নয়।

ঋগ্বেদ এবং অথর্ববেদেও নারীরা সর্বোচ্চ বুদ্ধিমতী বলে বিবেচিত হয়েছে।

ঋগ্বেদ (১০.১৫৯.২)

বেদ অনুসারে, নারীদের উচ্চতর বুদ্ধিমত্তা রয়েছে - 
 অথর্ববেদ (১৪/২/৭৫) - আচার্য শ্রীরাম শর্মা 

নারীরা উচ্চ পতাকার মতো উচ্চ জ্ঞানী বা জ্ঞানবতী

এই মন্ত্রে "সুবুধা" এবং "বুধ্যমানা" শব্দগুলো নারীদের জন্য ব্যবহার করা হয়েছে, যার অর্থ নারীর উৎকৃষ্ট জ্ঞানী। এটি স্পষ্টভাবে দেখায় যে বেদে নারীদের উচ্চ বুদ্ধিমত্তার অধিকারী বলে স্বীকার করা হয়েছে।

অথর্ববেদ (১৪.২.৭৫) - পণ্ডিত হরিশরণ সিদ্ধান্তালকার

অথর্ববেদ (১৪/২/৩১)

এমনকি অথর্ববেদে লেখা আছে যে নারীর বুদ্ধিমত্তা দেবী ইন্দ্রানীর সমান। এই মন্ত্রে নারীর জন্যও "সুবুধা" ব্যবহার করা হয়েছে, যার অর্থ উচ্চতর বুদ্ধিমতী নারী।

অথর্ববেদের এই মন্ত্রেও নারীদের বলা হয়েছে "সুমুতি"যার অর্থ অত্যন্ত বুদ্ধিমান। এই মন্ত্রে এটাও লেখা আছে যে, নারীদেরও অন্যান্য বুদ্ধিমান মানুষের মত একই রকম চিন্তাভাবনা থাকে।

অথর্ববেদ (২.৩৬.১)

যজুর্বেদ (২২.২২)

নিরুক্ত (৬/১৩)

যজুর্বেদে নারীদের বলা হয়েছে "পুরন্ধির্য়োষা", যার অর্থ অত্যন্ত বুদ্ধিমান নারী।

পুরন্ধি = পুরঃ + ধি, নিরুক্ত (৬.১৩) তে "পুরন্ধি" পদটিকে "পুরন্ধির্বহুধী" হিসাবে ব্যাখ্যা করা হয়েছে, এখানে "পুরঃ" অর্থ খুব এবং "ধি" অর্থ বুদ্ধিমত্তা।

যাস্কের নিঘন্টু (৩/৯) অনুসারে, "ধি" শব্দটি বুদ্ধিমত্তার একটি নাম। তাই "পুরন্ধি" শব্দের অর্থ অত্যন্ত বুদ্ধিমান ব, এবং "য়োষা" শব্দের অর্থ নারী। তাই "পুরন্ধির্য়োষা" মানে খুবই বুদ্ধিমতী নারী।

শতপথ ব্রাহ্মণ (১৩.১.৯.৬), কৃষ্ণ যজুর্বেদের কাঠক সংহিতাতেও (৫.১৪) একই কথা বলা হয়েছে, কৃষ্ণযজুর্বেদের তৈত্তিরীয় সংহিতা (৭.৫.১৮.১), তৈত্তিরীয় ব্রাহ্মণ (৩.৮.১৩.২) তেও নারীদের "পুরন্ধি" অর্থাৎ অত্যন্ত বুদ্ধিমান বলা হয়েছে।

আচার্য চাণক্য আরও বলেছেন যে, নারীর বুদ্ধি পুরুষের চেয়ে চারগুণ বেশি।

চানক্য নীতি (১.১৭)


অনুবাদক - 




Post a Comment

0Comments

Please Select Embedded Mode To show the Comment System.*