পুরাণ বিমর্শ - সপ্তম পর্ব (ত্রিদেব)

    পুরাণ বিমর্শ - সপ্তম পর্ব
     "ত্রিদেব" প্রথম অংশ

(ব্রহ্মা, বিষ্ণু এবং শিবজীকে নিয়ে এই 'ত্রিদেব' লেখনীতে যে অশ্লীলতা আদির তথ্য দেওয়া হবে তা প্রচলিত পুরাণে উল্লেখিত অসত্য কাহিনী হতে, তাই কেহ ভাববেন না যে আমি তাঁদের অসম্মান করছি। শুধু দর্শানোর চেষ্টা করছি যে পুরাণে কি আছে এবং কেন পুরাণকে প্রামাণিক শাস্ত্র হিসেবে মান্য করিনা) 

পৌরাণিক মান্যতায় ব্রহ্মা-বিষ্ণু-শিব এই তিন দেবকে একত্রে ত্রিদেব বলা হয়, তাঁদের আবার বিভিন্ন নামে অভিহিত করা হয়, যেমন শিবজীকে- মহাদেব, রুদ্র, শঙ্কর....ইত্যাদি । বৈদিক মান্যতায় পরমাত্মার অসংখ্য গুণবাচক নাম রয়েছে, যার মধ্যে- ব্রহ্মা, বিষ্ণু, শিব, মহাদেব, রুদ্র আদিও রয়েছে। 

(বৃহ বৃহি বৃদ্ধৌ) এই সকল ধাতু হতে 'ব্রহ্মা' শব্দ সিদ্ধ হয়। 'য়োऽ খিলং জগন্নির্মাণেন বর্হতি (বৃংহতি) বর্দ্ধয়তি স ব্রহ্মা।' যিনি সম্পূর্ণ জগৎ রচনা করে বিস্তৃত করেন, সেকারণে সেই পরমেশ্বরের নাম 'ব্রহ্মা'।

(বিষ্লৃ ব্যাপ্তৌ) এই ধাতুর সহিত 'নু' প্রত্যয় যোগে 'বিষ্ণু' শব্দ সিদ্ধ হয়, 'বেবেষ্টি ব্যাপ্নোতি চরা চরং জগৎ স বিষ্ণুঃ পরমাত্মা' চর এবং অচর রূপ জগতে ব্যাপক বলে পরমাত্মার নাম 'বিষ্ণু'

(শিবু কল্যাণে) এই ধাতু হইতে 'শিব' শব্দ সিদ্ধ হয়। 'বহুলমেতগ্নিদর্শনম্ ইহা দ্বারা 'শিবু' ধাতু গ্রহণ করা হয়। যিনি কল্যাণস্বরূপ ও কল্যাণকারী এইজন্য সেই পরমেশ্বরের নাম 'শিব'

(ডুকৃঞ্ করণে) 'শম্' পূর্বক এই ধাতু হতে 'শঙ্কর' শব্দ সিদ্ধ হয়। 'য় শঙ্কল্যাণং সুখং করোতি স শঙ্করঃ' যিনি কল্যাণ অর্থাৎ সুখকারী, এইজন্য সেই পরমেশ্বরের নাম 'শঙ্কর'

'মহৎ' শব্দ পূর্বক দেব শব্দ হইতে 'মহাদেব' শব্দ সিদ্ধ হয়। 'য়ো মহাতাং দেবঃ স মহাদেবঃ'। যিনি মহান্ দেবগণেরও দেব, অর্থাৎ বিদ্বান্-দেরও বিদ্বান্, সূর্য্যাদি পদার্থ সমূহের প্রকাশক, এইজন্য সেই পরমত্মার নাম 'মহাদেব'

(রুদির্ অশ্রুবিমোচনে) এই ধাতুর সহিত 'ণিচ' (রক্) প্রত্যয় যোগে 'রুদ্র' শব্দ সিদ্ধ হয়। 'য়ো রোদয়ত্যন্যায়কারিণো জনান্ স রুদ্রঃ' যিনি দুষ্কর্মকারীদিগকে রোদন করান, এ কারণ সেই পরমেশ্বরের নাম 'রুদ্র'

'য়ন্মনসা ধ্যায়তি তদ্বাচা বদতি, য়দ্বাচা বদতি তৎ কর্মণা করোতি য়ৎ কর্মণা করোতি তদভিসম্পদ্যতে।'

এটি যজুর্বেদের ব্রাহ্মণের বচন। জীব মনে যা ধ্যান করে, তা বাণী দ্বারা প্রকাশ করে। যা বাণী দ্বারা প্রকাশ করে, তাই কর্মের দ্বারা সম্পাদিত হয়, যা কর্মের দ্বারা সম্পাদিত হয়, তাই ফলরূপে প্রাপ্ত হয়। এতদ্বারা সিদ্ধ হল যে, জীব যেরূপ কর্ম করে, সে সেইরূপই ফল লাভ করে। যখন দুষ্কর্মকারী জীব ঈশ্বরের ন্যায়-ব্যবস্থানুসারে দুঃখরূপ ফল পায়, তখন সে ক্রন্দন করে। এইরূপে ঈশ্বর তাকে রোদন করান বলেই পরমেশ্বরের নাম 'রুদ্র'।

           আপো নারা ইতি প্রোক্তা আপো বৈ নরসুনবঃ।
     তা য়দস্যায়নং পূর্বং তেন নারায়ণঃ স্মৃত॥ মনু০ ১/১০
জল এবং জীবগণের নাম 'নারা' সেই অয়ন অর্থাৎ নিবাস স্থান যাহার। অতএব সর্ব জীবে ব্যাপক পরমাত্মার নাম 'নারায়ণ'

পরমাত্মার এরূপ গুণবাচক অসংখ্য নাম রয়েছে। যার জন্য বেদেও বলা হয়েছে - এক সত্তা পরব্রহ্মকে জ্ঞানীরা ইন্দ্র মিত্র, বরুণ, অগ্নি, দিব্য, সুপর্ণ, গরুত্মান, যম, মাতরিশ্বা আদি বহু নামে অভিহিত করেন। কিন্তু পুরাণে যে ব্রহ্মা, বিষ্ণু, শিবের কথা বলা হয়েছে তারা একই সত্তা নয়। যদিও পৌরাণিকরা বলে যে এই ত্রিদেবের মধ্যে কোন ভেদ নাই, তারা একই। যা পদ্মপুরাণেও বলা হয়েছে - 
   শিবে বিষ্ণৌ ন বা ভেদো ন চ ব্রহ্মমহেশয়োঃ।
                                   (পদ্মপুরাণ, পাতালখণ্ড-১০/৬৯)।
অর্থাৎ – "শিব ও বিষ্ণুতে এবং ব্রহ্ম ও মহেশ এর মধ্যে কোন ভেদ নাই।"

কিন্তু এটাও বলা হয়েছে যে - 
       যস্তু নারায়ণং দেবং ব্রহ্মরুদ্রাদিদৈবতৈঃ।
        সমন্যৈনিরীক্ষেত স পাষণ্ডী ভবেৎ সদা॥
                         (পদ্মপুরাণ, উত্তরখণ্ড-২৩৫/৯..)
অর্থাৎ– "যে বিষ্ণুকে ব্রহ্মা এবং রুদ্রাদি দেবতাদের সমান মনে করে সে সদা পাষণ্ডী।"..

আরো বলা হয়েছে -
        সকৃদেব হি যোঽশ্নাতি ব্রাহ্মণো জ্ঞানদুর্ব্বলঃ।
        নির্ম্মাল্যং শঙ্করাদীনাং স চণ্ডালো ভবেদ্ধ্রুবম্॥
        কল্পকোটিসহস্রাণি       পচ্যতে       নরকাগ্নিন। 
        নির্ম্মাল্যং ভো দ্বিজশ্রেষ্ঠা রুদ্রাদীনাং দিবৌকসাম্॥
        রক্ষোযক্ষপিশাচান্নং    মদ্যমাংসসমং   স্মৃতম্।
        তদ্ ব্রাহ্মণৈর্ন ভোক্তব্যং দেবানাং ভুঞ্জিতং হবিঃ॥
                          (পদ্মপুরাণ,উত্তরখণ্ড-২৫৫/৯৯-১০১)
অনুবাদ- যে জ্ঞান-দুর্ব্বল ব্রাহ্মণ একবারও শঙ্কর প্রভৃতির নির্ম্মাল্য ভক্ষণ করেন, তিনি নিশ্চয় চণ্ডাল হইয়া থাকেন এবং কল্পকোটিসহস্র পর্য্যন্ত নরকানলে পচিতে থাকেন। হে দ্বিজশ্রেষ্ঠগণ! রুদ্রাদি দেবগণের নির্ম্মাল্য এবং যক্ষ, রক্ষ ও পিশাচের অন্ন মদ্য-মাংস তুল্য। সুতরাং ব্রাহ্মণের তাহা ভোক্তব্য নহে। 

অপরদিকে শিবপুরাণে বলা হয়েছে- "অব্রহ্মত্বাত্তদন্যেষাং.." শিব ছাড়া বাকি যে সকল দেবতা রয়েছে তারা সাক্ষাৎ ব্রহ্ম নয়। "অব্রহ্মত্বাচ্চ জীবত্বাত্তথান্যে দেবতাগণাঃ" শঙ্কর ছাড়া অন্য সকল (ইন্দ্র, ব্রহ্মা আদি) দেবতার মধ্যে জীবত্ব আর কেবল শিবে ব্রহ্মত্ত্ব।        (শিবপুরাণ, বিদ্যেশ্বরসংহিতা,পূর্বার্ধ-৫/১৩,১৪)

সৌরপুরাণে বলা হয়েছে–
মহেশস্যেব দাসোঽয়ং বিষ্ণুস্তেনানুকম্পিতঃ। ৫
                                                     (সৌরপুরাণ-৪০)
অর্থাৎ দাস বলিয়া বিষ্ণুকে মহেশ্বর অনুগ্রহ করিয়াছেন। 

তেন তুল্যো যদা বিষ্ণুর্ব্রহ্মা বা যদি গদ্যতে।
ষষ্টিবর্ষসহস্রাণি বিষ্ঠায়াং জায়তে কৃমিঃ ॥১৭
                                             (সৌরপুরাণ-৪০)
অর্থাৎ যে ব্রহ্মা বিষ্ণুকে তাঁহার (শিবের) তুল্য বলিবে সে ৬০হাজার বৎসর বিষ্ঠায় কৃমি হইয়া থাকে।          
               
দেবীভাগবতে বলা হয়েছে–
কিং বিষ্ণুঃ কিং শিবো ব্রহ্মা মঘবা কিং বৃহস্পতিঃ।
দেহবান প্রভবত্যেব বিকারৈঃ সংযুতস্তদা॥
রাগী বিষ্ণু শিবো রাগী ব্রহ্মাপি রাগসংযুতঃ।
রাগবান কিমকৃত্যং বৈ ন করোতি নরাধিপ! ॥
                                      (দেবীভাগবত-৪/১৩/১৫-১৬)
ইন্দ্র হউন, বৃহস্পতি হউন বা ব্রহ্মা, বিষ্ণুই হউন অথবা শিবই হউন দেহধারী তো বিকারযুক্তই হয়। ব্রহ্মা, বিষ্ণু, মহেশ পর্যন্ত আসক্তিগ্রস্ত। (হে রাজন্! আসক্ত প্রাণী কোন্ অনর্থ করে বসেনা [অর্থাৎ কুকর্মাদিও করে বসে])।

কি কুকর্ম করেছে তা তো ক্রমশ প্রকাশ্য। এখানে এটাই লক্ষণীয় যদি তাঁরা একই হতো তাহলে এমন বিভেদ থাকতো না। একই মানলেও পুরাণের বিরোধ করা হবে আবার একই নয় বললেও। দেবীভাগবতের কথায় আসি। ভবিষ্যপুরাণে বলা হয়েছে -........  (চলবে)

📚প্রমাণ সংগ্রহ–
১.সত্যার্থ প্রকাশ-প্রথম সমুল্লাস
২.
ইদ্ৰং মিত্রং বরুণ মগ্নি মাহু, রথো দিব্যঃ স সুপর্ণো গরুত্মান। 
একং সদ্বিপ্ৰা বহুধা বদন্ত্যগ্নিং যমং মাতরিশ্বানমাহুঃ ॥
                                                (ঋগ্বেদ ১/১৬৪/৪৬)
🖋️প্রিয়রত্ন বিদ্যার্থী
©️অমৃতস্য পুত্রাঃ

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Please Select Embedded Mode To Show The Comment System.*

নবীনতর পূর্বতন