শুদ্ধি বিধি
শুদ্ধিবিধি নিয়ে লিখার পূর্বে এটা লিখা আবশ্যক প্রতীত হয় যে, শুদ্ধি দ্বারা অন্য ধর্মের মনুষ্য সনাতন ধর্মে আসতে পারে কিনা? কেননা তথাকথিত ব্রাহ্মণজন বলেন যে সনাতন ধর্ম ত্যাগ করা যায় কিন্তু সনাতন ধর্মে আসা যায়না, শাস্ত্র বিষয়ে অজ্ঞানতার গভীরে থাকলেই এরূপ বলা যায়।
১. ধর্ম বলতে কি বুঝায়?
'ধর্ম' শব্দ কেবল এক সীমিত অর্থে প্রয়োগ হয়না।'ধর্ম' শব্দের বিবিধ এবং ব্যাপক অর্থ। ধর্ম শব্দের সব থেকে ব্যাপক অর্থ, ব্যাকরণগত মূল ধাতু 'ধৃ' এর উপর আশ্রিত। 'ধৃ' অর্থ ধারণ করা। 'ধৃ' ধাতু দ্বারা নির্মিত হওয়ায় ধর্ম শব্দের অর্থ ধারণকারী। গুণ ও লক্ষণ ধারণ করা ধর্মের অভিপ্রায়। অর্থাৎ মানুষের ধর্ম মনুষ্যত্ত্ব ধারণ করা মনুষ্যের ক্ষেত্রে ইহাই সনাতন ধর্ম, সেজন্য বেদে বলা হয়েছে - "মনুর্ভবঃ" অর্থাৎ মানুষ হও।
২.অন্য ধর্ম বলতে কি? ধর্ম ত্যাগ বলতে কি?
মানুষের জন্য মনুষ্যত্ত্ব ভিন্ন অন্য ধর্ম বলতে অধর্ম বোধ হয়, আর নিজস্ব ধর্ম ত্যাগ করা বলতেও অধর্ম ধারণ করা বুঝায়। বেদে কেবল নিজেকেই মনুষ্য হতে বলেনি বরং বলা হয়েছে - "মনুর্ভব জনয়া দৈব্যং জনম' (ঋগ্বেদ-১০/৫৩/৬)। অর্থাৎ মানুষ হও এবং অন্যকেও মানুষ হিসেবে গড়ে তোল। সুতরাং তথাকথিত অন্যধর্মাবলম্বী বলতে ধর্ম হইতে পতিত অনার্য ব্যক্তি অভিপ্রেত হয়। আর সেই পতিত ব্যক্তিদের পুনঃ সনাতন ধর্ম ধারণ করানোর জন্য বেদে বলা হয়েছে-
ভাবার্থ : যে মনুষ্য সত্য ধর্ম হইতে পতিত হয়েছে তাকে পুনঃ উত্থিত করো, যাহারা পাপকৃত্য করেছে অথবা অপবিত্র হয়ে গেছে তাদেরকে শুদ্ধ করে পুনঃ পবিত্র জীবন দাও।
আরও বলা হয়েছে -
ইন্দ্রং বর্ধন্তো অপ্তুরঃ কৃণ্বন্তো বিশ্বমার্যম্। অপঘ্নন্তো অরাব্ণঃ।। (ঋগ্বেদ-৯/৬৩/৫)
পদার্থ : (ইন্দ্রম্ বর্ধন্তঃ) ঈশ্বরের মহিমাকে বিস্তার কর (অপ্তুরঃ অপঘ্নন্তঃ অরাব্ণঃ) স্বত্বাপহারী অনার্যকে সমুচিত শিক্ষা দাও (কৃণ্বন্তঃ বিশ্বম্ আর্যম্) বিশ্বের সকলকে আর্য করো।
সরলার্থ : হে মনুষ্য! ঈশ্বরের মহিমাকে বিস্তার কর, স্বত্বাপহারী অনার্যকে সমুচিত শিক্ষা দাও, বিশ্বের সকলকে আর্য করো।
অতঃ অন্য মতাবলম্বী সনাতন ধর্ম ধারণ করতে পারবে না ইহা সত্য নহে। এখন শুদ্ধিবিধি নিয়ে বলা যাক -
কোন বিবেকবান্ সদ্গ্রন্থের স্বাধ্যায়, মননাদি অথবা কোন সজ্জন পুরুষের সৎপ্রেরণায় যদি অন্য কোন মত বা পন্থ সম্প্রদায় ভুক্তজন বৈদিক [সনাতন] ধর্ম ধারণ করিতে চায় তাহা হইলে তাহাকে একদিন ব্রত উপবাস থাকিয়া, দ্বিতীয় দিনে (পুরুষকে) ক্ষৌরকর্ম করিবার পর স্নানাদিদ্বারা শুদ্ধ হইয়া স্বচ্ছ বস্ত্র ধারণ করিয়া নিম্ন মন্ত্র পাঠ করিতে হইবে এবং শুদ্ধিকর্তা কিঞ্চিত জল তাহার মস্তকে ছিটাইয়া দিবে-
পুনন্তু বিশ্বা ভূতানি জাতবেদঃ পুনীহি মা ॥১॥
পবিত্রেণ পুনীহি মা শুক্রেণ দেব দীদ্যৎ ।
অগ্নে ক্রত্বা ক্রতূঁরনু ॥২॥
যত্তে পবিত্রমর্চিষ্যগ্নে বিততমন্তরা ।
ব্রহ্ম তেন পুনাতু মা ॥৩॥
(যজুর্বেদ-১৯/৩৯-৪১)
তদনন্তর যজ্ঞবেদীতে পূর্বাভিমুখ বসাইয়া, নিম্নোক্ত মন্ত্র দ্বারা আচমন করাইবে -
"ওম্ শন্নো দেবীরভিষ্টয় আপো ভবন্তু পীতয়ে। শংযোরভিস্রবন্তু নঃ॥ (যজুর্বেদ-৩৬/১২)
তারপর নিম্নোক্ত গায়ত্রী মন্ত্র উচ্চারণ করাইবে-
তৎ সবিতুর্বরেণ্যং ভর্গো দেবস্য ধীমহি।
ধিয়ো যো নঃ প্রচোদয়াৎ ॥ (যজুর্বেদ-৩৬/৩)
বিধিপূর্বক মন্ত্রোচ্চারণ করিয়া যজ্ঞোপবীত প্রদান করিবে এবং তাহার উপকারিতা ও মহত্ত্ব বর্নন করিবে তারপর গায়ত্রী মন্ত্রার্থ সংক্ষেপে শ্রবণ করাইবে। পশ্চাতে আচমন, অঙ্গস্পর্শ, প্রার্থনা মন্ত্র অর্থ পূর্বক স্বস্তিবাচন, শান্তিকরণ পাঠ করিয়া বিধিবৎ সামান্য যজ্ঞ ক্রিয়া করাইবে। তার পর নিম্ন মন্ত্রের দ্বারা আহুতি প্রদান করাইবে -
অগ্নির্মা তস্মাদেনসো বিশ্বান্মুঞ্চত্বঁহসঃ ॥৪॥
যদি দিবা যদি নক্তমেনাঁসি চকৃমা বয়ম্ ।
বায়ুর্মা তস্মাদেনসো বিশ্বান্মুঞ্চত্বঁহসঃ ॥৫॥
যদি জাগ্রদ্যদি স্বপ্নঽএনাঁসি চকৃমা বয়ম্ ।
সূর্যা মা তস্মাদেনসো বিশ্বান্মুঞ্চত্বঁহসঃ ॥৬॥
যদ্গ্রামে যদরণ্যে যৎসভায়াঁয়দিন্দ্রিয়ে ।
যচ্ছূদ্রে যদর্যে যদেনশ্চকৃমা বয়ঁয়দেকস্যাধি
ধর্মণি তস্যাবয়জনমসি ॥৭॥
উপরের মন্ত্র দ্বারা আহুতি প্রদান করিবার পর নিম্নমন্ত্র এবং মন্ত্রার্থ পড়িয়া মনযোগপূর্বক আহুতি প্রদান করাইবে। এই মন্ত্রের অর্থ নিরন্তর চিন্তন ও মনন করিয়া প্রায়শ্চিত্তপূর্বক বেদমার্গে চলিবার জন্য প্রভুর কাছে প্রার্থনা করাইবেন।
যূয়ং নস্তস্মান্মুঞ্চত বিশ্বে দেবাঃ সজোষসঃ ॥৮॥
পদার্থঃ (বিদ্বাংসঃ) হে বিদ্বান্ (অবিদ্বাংসঃ) না জানা অবস্থায় (বয়ম্) আমরা (য়ৎয়ৎ) যা-যা (এনাংসি) পাপ (চকৃম) করিয়াছি। (য়ূয়ম) তুমি (বিশ্বেদেবাঃ) সব বিদ্বান্ (সজোষসঃ) প্রীতির সহিত (তস্মাৎ) সেই পাপ সমুদায় থেকে (নঃ) আমাকে (মুঞ্চত) পৃথক্ করিয়া দাও।
পদার্থ :- (অগ্নে) হে পাপনাশক ঊর্ধ্বপ্রেরক পরমাত্মন্! (ইমাং নঃ) আমাদের এই (শরণিম্) তোমার বেদাদেশের ত্যাগরূপী আত্ম-অপরাধকে (মীমৃষঃ) ক্ষমা করিয়া দাও। (ইমম্ অধ্বানম্) এই ভ্রান্তিযুক্ত মার্গ অবলম্বন করিয়া (য়ম্) যার ওপর আমরা (দূরাৎ) অনেক দূর পর্যন্ত [অনেক সময় পর্যন্ত] (অগাম) যাইতেছিলাম, তাহাকে ক্ষমা করিয়া দাও। হে প্রভূ! তুমি (সোম্যানাম্) সৌম্য জনের (আপিঃ) মিত্র, পিতাও (প্রমতি) শুভ মতি প্রদান কর (মর্ত্যানাম্) মানুষকে (ঋষিকৃৎ) ঋষি করে দাও।
উপরে লিখিত মন্ত্রের সহিত গায়ত্রী মন্ত্র অর্থসহিত সংক্ষিপ্ত উপদেশ দিয়া তার অর্থ বিদিত করিয়া প্রতিদিন অর্থ ও ভাবনা সহিত গায়ত্রী মন্ত্ৰ সুবিধানুসার ১০-২০ বার আবৃত্তিপূর্বক প্রাতঃ সায়ংকালে ব্রত পালনের জন্য নিম্ন মন্ত্র দ্বারা উপদেশ করিবে।
অর্থ :- হে ব্ৰতপতে অগ্নে! আমি ব্রতধারণ করিতেছি যে আমি অসত্যকে ত্যাগ করিয়া সত্যকে জানিয়া, সত্যকে মানিয়া সর্বদা সত্য ব্যবহার করিব। হে প্রভূ! আমাকে এমন সামর্থ্য প্রদান কর যেন আমি এই ব্রত সদা পালন করিতে পারি ।
তৎপশ্চাৎ গায়ত্রী মন্ত্রাহুতি প্রদান করিয়া পূর্ণাহুতি করিবে। পরে যজ্ঞ-প্রার্থনা, ভজন-কীর্তন ও বৈদিক ধর্মের মহত্ব বিষয়ে যোগ্যরীতিতে প্রভাবী উপদেশ প্রদান করিবে।
এভাবেই বৈদিক সনাতন ধর্ম ধারণপূর্বক নবজীবন প্রাপ্ত হবে।
©️ অমৃতস্য পুত্রাঃ
