বেদে কি আল্লাহর নাম উল্লেখ আছে? |
ইসলামি বক্তা জাকির নায়েক মিথ্যাচার করতে এক্সপার্ট এটা আমাদের আর অজানা নয়। এখনো তারই সেই মিথ্যাচারের ভিডিও দেখিয়ে তার ভক্তরা সনাতনীদের অযথাই বিভ্রান্ত করার চেষ্টা করে বেড়ায় । তার মধ্যে একটা ভিডিওতে দেখা যায়, জাকির নায়েক এক হাস্যকর দাবী করছেন যে- বেদে আল্লাহ শব্দটা রয়েছে। এর পক্ষে ৩টি রেফারেন্স দিয়েছেন। যথা-
i. ঋগ্বেদ- ২নাম্বারার গ্রন্থ/১অনুচ্ছেদ/১১পরিচ্ছেদ
ii. ৩নাম্বার গ্রন্থ/৩০অনুচ্ছেদ/১০পরিচ্ছেদ
iii. ৯নাম্বার গ্রন্থ/৬৭অনুচ্ছেদ/৩০পরিচ্ছেদ।
( ভিডিওটি দেওয়া হলো দেখে নিন)
এইবার সমীক্ষা করা যাক, জাকির নায়েক ঋগ্বেদের নাম করে যে-.. নাম্বার গ্রন্থ/অনুচ্ছেদ/পরিচ্ছেদ বলেছেন তা আদৌতে ঋগ্বেদে নেই, অন্য বেদেও নেই। জাকির নায়েকের যে কি যোগ্যতা বেদ সম্পর্কে তার রেফারেন্স দেওয়ার ধরন দেখেই অনুমান করা যায়। যদ্যপি ভুল বলেছে তথাপিও তার দেওয়া রেফারেন্স এর সংখ্যা অনুযায়ী যদি খুঁজি তাহলে আমরা পাই -
ঋগ্বেদ-২/১/১১, ৩/৩০/১০, ৯/৬৭/৩০। মন্ত্রগুলোতে আল্লাহ শব্দ আছে কি নেই স্বয়ম্ দেখে নেওয়া যাক।
ঋগ্বেদ-২/১/১১-
পদার্থ : হে (দেব) প্রকাশমান (অগ্নে) বিদ্যা প্রদানকারী বিদ্বান্! (ত্বম্) তুমি (দাশুষে) দানশীল শিষ্যের জন্য (অদিতিঃ) অন্তরিক্ষ প্রকাশের ন্যায় বিদ্যা গুণ প্রকাশকারী (ত্বম্) তুমি (হোত্রা) গ্রহণ করার যোগ্য (ভারতী) বিদ্যা ধারণকারী বালিকার ন্যায় হয়ে (গিরা) সুন্দর শিক্ষা ও বিদ্যাযুক্ত বাণী দ্বারা (বর্দ্ধসে) বৃদ্ধি প্রাপ্ত হও (ত্বম্) তুমি (দক্ষসে) বিদ্যা বল প্রদানের জন্য (শতহিমা) শত বর্ষ আয়ু যাহার, সেই (ইলা/इळा) স্তুতিযোগ্য অধ্যাপিকার ন্যায় (অসি) হও, হে (বসুপতে) ধনের স্বামী! (ত্বম্) তুমি (বৃত্রহা) মেঘহন্তা সূর্যের সমান তথা (সরস্বতী) প্রজ্ঞান বিজ্ঞানযুক্ত বাণী বাণীর ন্যায়॥
ভাবার্থ : এই মন্ত্রে বাচকলুপ্তোপমালঙ্কার রয়েছে। উত্তম বিদ্যার অধ্যাপক/অধ্যাপিকা, শাস্ত্রের পারঙ্গত বিদ্বান্ জন মাতার ন্যায় পালন করেন এবং সর্ব বিষয় হইতে উত্তম গুণ প্রদান করেন, তা দ্বারা শিষ্যজন শীঘ্র বিদ্যাবলযুক্ত হয়।
[সংস্কৃতে বা দেবনগরীতে বর্ণ সংখ্যা ৬৩, আর আমাদের বাংলা বর্ণ বা অক্ষর সংখ্যা ৫০টি (৯) যোগ করলে ৫১টি, সেজন্য বেদমন্ত্রের প্রত্যেকটি অক্ষরের বাংলা অক্ষর উপলব্ধ নয়। দেখা যায় - ळा বর্ণটির স্থানে অনেকে ল/ড আদি ব্যবহার করেন। এক্ষেত্রে আমরা মূল মন্ত্রটিও দিয়েছি এবং মূল পদ সহ ব্যবহার করছি।]
জাকির নায়েক মন্ত্রোক্ত "इळा" পদটিকেই আল্লাহ শব্দ রয়েছে বলে মিথ্যাচার করেছেন। সামান্য ব্যক্তিও বুঝবে যে "আল্লাহ শব্দে "इळा" পদের তুলনায় বেশি বর্ণ রয়েছে। আল্লাহ শব্দ মন্ত্রের কোথাও নেই এমন সম্পূর্ণ বেদের কোন মন্ত্রেই নেই। তাছাড়াও "इळा" পদের অর্থ আল্লাহ হয়না এবং কেহ এই অর্থ করেওনি, হরফ প্রকাশনী থেকে প্রকাশিত বেদের অনুবাদেও নয়। তিনি বলছেন সংস্কৃত ডিকশনারিতে বলা হয়ে আল্লাহ ঈশ্বরের একটি নাম, কিন্তু আমরা তা খুঁজেও পেলাম না, পাওয়ার কথাও নয় কেননা এই শব্দটি সংস্কৃত শব্দ নয়। যদি "इळा" পদের অর্থ খুঁজতে গিয়ে বেদাঙ্গ আদি গ্রন্থে আমরা যে অর্থগুলো পেয়েছি-
১.इळा পৃথিবীনাম (নিঘন্টু-১/১)
[জাকিরের মতে পৃথিবীই কি তাহলে আল্লাহ? ]
২.इळा বাঙ্নামানি (নিঘন্টু-১/১১)
৩.इळा অন্ননামানি (নিঘন্টু-২/৭)
৪.इळा গোনামানি (নিঘন্টু-২/১১) [জাকিরের মতে इळा/ইলা অর্থাৎ গো (গরু)ই কি তাহলে আল্লাহ? জাকির এবং তার ভক্তরা ডিকশনারির এই অর্থ মেনে নিলে আমাদের আপত্তি নাই ]
৫. इळा পদনাম (নিঘন্টু-৫/৫)
৬. অন্নং বা इळा (ঐ. ব্রা.-৮/২৬, কৌ. ব্রা.-৩/৭)
এমন অসংখ্য রেফারেন্স দেওয়া যাবে কিন্তু কোনটাতেই আল্লাহ অর্থ পাওয়া যায়না, অতঃ জাকির নায়েকের দাবীকৃত পরবর্তী মন্ত্রটি দেখা যাক-
ঋগ্বেদ-৩/৩০/১০-
ভাষ্য : (অলাতৃণঃ বলঃ) বিদ্যুৎ আঘাতকারী আকাশে ব্যাপক মেঘ (গৌঃ ব্রজঃ) অতি বেগবতী বিদ্যুতের আশ্রয়। বা (গৌঃ ব্রজঃ) গৌকে আশ্রয় দেওয়ার ন্যায়ই পৃথিবী নিবাসিনী প্রজাদের জীবনাশ্রয় হয়। (ভয়মানঃ হন্তোঃ পুরা ব্যার) ভয়ভীত শত্রু যেরূপ বলবান্ আঘাতের ভয়ে প্রথমেই দূর হয়ে যায় সেরূপ সেও (ভয়মানঃ=উভয়মানঃ) অন্তরিক্ষ ও পৃথিবী উভয়ের মধ্যে গর্জন করে (হন্তো পুরঃ) পৃথিবীতে জল বিদ্যুৎ আদির আঘাত করার জন্য বিবিধপ্রকারে বিস্তৃত হয়ে যায়, বিবিধ মার্গে যায়। (পুরুহূতম্ ধমন্তী বাণীঃ) বিদ্যুৎকে প্রদীপ্ত করতে থেকে দীপ্তিকে বা গর্জনকে বহুজনের ইষ্ট জলকে ধ্বনিতকারী গর্জনকে সুরক্ষিত রাখে। (নিরজে) সম্পূর্ণ জল ঢেলে দেওয়ার জন্য বা নিষ্কাশন করার জন্য সুগম মার্গ তৈরি করে নেয়। (গাঃ প্র অবন্) ভূমি নিবাসী বহু প্রজাদের রক্ষা করে।
যদি তিনি 'অলাতৃণঃ' পদ দ্বারা আল্লাহ বুঝে থাকেন তাহলে তা সঠিক নহে, কেননা 'অলাতৃণঃ' পদের/শব্দের এহেন অর্থই হয়না আর কেহ করেওনি। যে অর্থগুলো পাওয়া যায় তার মধ্য থেকে কয়েকটি অর্থ নিম্নরূপ -
১.অলাতৃণঃ পদনাম (নিঘণ্টু-৪/৩)
২.অলাতৃণ: = ছেদনযোগ্য (নিরুক্ত-৬/২)। ছেদনযোগ্য মেঘ পক্ষেই উপরোক্ত ভাষ্য করা হয়েছে।
৩.অলাতৃণঃ বলঃ = কৃপণ বলাসুর [বল অসুর] (শ্রীপাদ দামোদর সাতবলেকর) [জাকির নায়েকের মতে উক্ত ভাষ্যার্থা অনুযায়ী আল্লাহ কৃপণ বলাসুর হয়]
আমরা এই মন্ত্র কিংবা মন্ত্রার্থেও আল্লাহ শব্দ কিংবা নাম পাইনি। অতঃ তৃতীয় রেফারেন্সকৃত মন্ত্রটি দেখা যাক-
ঋগ্বেদ-৯/৬৭/৩০-
পদার্থ : (সোম)হে পরমাত্মন্! (দেব) দিব্যগুণসম্পন্ন!(অলায়্যস্য) সর্বত্র ব্যাপ্ত শত্রুর যে (পরশুঃ) অস্ত্র আছে,(তম্) সেই (আখুঞ্চিত্) সর্বঘাতক অস্ত্রকে (ননাশ) নাশ করুন! (দেব) হে পরমাত্মন্! (আপবস্ব) আপনি আমাদের পবিত্র করুন॥
ভাবার্থ : পরমাত্মা যার মধ্যে দৈবী সম্পত্তির গুণ বিচার করেন,তাকে বুদ্ধিযুক্ত করেন এবং যার মধ্যে আসুরিক
ভাব সম্পন্ন অবিদ্যাজনিত গুণ বিচার করেন,তাকে নাশ করেন।
উক্ত মন্ত্রে আল্লাহ শব্দ নাই তা পরিষ্কার বুঝা যাচ্ছে। যদি "অলায়্যস্য" পদটিকে আল্লাহ মনে করে থাকে তাহলে বোকামি ছাড়া আর কিছুই হবেনা। পণ্ডিত চন্দ্রশেখর উপাধ্যায় এবং প.অনিল কুমার উপাধ্যায়কৃত বৈদিক কোষে 'অলায়্য' পদের অর্থ দিয়েছেন- ১.অরায়্য (অলক্ষ্মী) ২.ক্ষমা, ধন আদি দেওয়ার অযোগ্য অর্থাৎ শত্রু [উপরোক্ত ভাষ্যে সেই শত্রুর অস্ত্র ধ্বংস করার প্রার্থনা করা হয়েছে] ৩.অধিকার বঞ্চিতকারী।
জাকির নায়েকের মতে যদি কেহ মেনে নেয় যে উপরোক্ত মন্ত্রে আল্লাহর নাম রয়েছে তাহলে এর অর্থ হয় - আল্লাহ অলক্ষী, আল্লাহ শত্রু, আল্লাহ অধিকার বঞ্চিতকারী, এই অর্থগুলো কি আপনারা মেনে নিয়েছেন বা নিবেন?
🖋️ অমৃতস্য পুত্রাঃ