৩৩ প্রকার দেব-দেবী!

0

৩৩ প্রকার দেব-দেবী!

আমাদের মনে অনেক সময় প্রশ্ন জাগে অথবা অনেক অন্যান্য মতবাদি/ ধর্মীয় মানুষের কাছে আমাদের প্রশ্ন বিদ্ধ/সমূক্ষীণ হতে হয় যে তোমাদের ধর্মে এতো দেব-দেবী, ঈশ্বর,ভগবান,অবতার কেনো? 

কিন্তু যথার্থ ধর্মীয় জ্ঞান না থাকার কারণে আমারা এইসব প্রশ্নের জবাব দিতে পারি না।আর আমাদের ধর্মীয় মহাপুরুষদের সঠিক জীবনী সম্পর্কে ধারণা নেই যার ফলে তাদের নামেও অনেক কূটবাক্য শুনতে হয় কিন্তু তার উত্তর আমরা দিতে পরি না। বিশেষ করে এর জন্য দায়ী পুরাণ রচনাকারী পৌরাণিক তথাকথিত সনাতনী, যারা আমাদের ধর্মের মহাপুরুষ গণদের নাম কলঙ্কিত করে তাদেরকে ঈশ্বর এর বিভিন্ন অবতার হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে। বর্তমান সময়ে "দ্যা কেরোল স্টোরি" নামক একটা মুভি রিলিজ হয়েছে যার মধ্যে দেখেন হয়েছে অনেক সনাতনী মেয়েদের ধর্মান্তরিন করার জন্য একটি মুসলিম মেয়ে বিভিন্ন ভাবে তাদেরকে বিভিন্ন ভাবে প্রশ্নবিদ্ধ করে এবং তার মগজ ধোলাই করে। কিন্তু যথাযথ ধর্মীয় জ্ঞান না থাকার কারণে এক পর্যায়ে নিরুপায় হয়ে মেয়েগুলো ধর্মান্তরিত হয়ে যায়।এই মুভিটি দেখে আমাদের অনেক সনাতনীর মনেও অনেক প্রশ্ন জাগে যে আমাদের ঈশ্বর কি আসলেই অনেক গুলো? আসলেই কি নিরাকার ঈশ্বর এর অবতার হয়?

তো চলুন দেখি আমাদের ধর্মীয় গ্রন্থ/শাস্ত্র কি বলে ! 
আমাদের ঈশ্বর এক নাকি বহু?

প্রশ্ন- ঈশ্বর কাকে বলে?

উত্তর : ঈশ্বরের বিভিন্ন ধরনের সংজ্ঞা হতে পারে। (ঈশ্বর) অসীম এবং শরীরবৃত্তিয় চেতনা জগতের বাইরে হওয়ার কারনে, ঈশ্বর শব্দের অর্থ কয়েকটি শব্দ বা বাক্যে প্রকাশ করাটা কঠিন। মহর্ষি পতঞ্জলিকৃত যোগদর্শনে উক্ত প্রশ্নের উত্তর নিম্নরূপ   

ক্লেশকর্মবিপাকাশয়ৈরপরামৃষ্টঃ পুরুষবিশেষ ঈশ্বরঃ।।
 (যোগদর্শন, সমাধিপাদ-২৪)

সূত্রার্থঃ- অবিদ্যাদি পাঁচটি ক্লেশ, শুভাশুভ মিশ্রিত ত্রিবিধ কর্ম, সুখ-দুঃখ রূপী কর্মফল, সুখ-দুঃখ ভোগের সংস্কার, এই সকল হতে সম্বন্ধ রহিত, জীব হতে ভিন্ন স্বভাবযুক্ত চেতন বিশেষকে "ঈশ্বর" বলা হয়।

প্রশ্ন- কতজন ঈশ্বর রয়েছে ?

উত্তর : ঈশ্বর কেবল এক ও অদ্বিতীয়। বেদেও এই বিষয়ে বলা হয়েছে -

ন দ্বিতীয়ো ন তৃতীয় শ্চতুর্থো নাপ্যুচ্যতে।
ন পঞ্চমো ন ষষ্ঠঃ সপ্তমো নাপ্যুচ্যতে।
নাষ্টমো ন নবমো দশমো নাপ্যুচ্যতে।
য এতং দেবমেক বৃতং বেদ।।
 (অথর্ববেদ-১৩/৪/১৬,১৭,১৮,১৫)

পদার্থ : (ন) নহে (দ্বিতীয়ঃ) দ্বিতীয় (ন) নহে (তৃতীয়ঃ) তৃতীয় (চতুর্থ) চতুর্থ (ন) না (অপি) ও (উচ্যতে) কথিত হয়। (ন) নহে (পঞ্চমঃ) পঞ্চম (ন) নহে (ষষ্ঠঃ) ষষ্ঠ (সপ্তমঃ) সপ্তমঃ (ন) না ( অপি) ও (উচ্যতে) কথিত হয়। (ন) নহে (অষ্টমঃ) অষ্টম (ন) নহে (নবমঃ) নবম (দশমঃ) দশম (ন) না (অপি) ও (উচ্যতে) কথিত হয়। (যঃ) যিনি (এতঃ) এই (দেবং) দেবকে (একবৃতং) শুধু একা বর্তমান বলিয়া (বেদ) জানেন। 

বঙ্গানুবাদ :- পরমাত্মা এক, তিনি ছাড়া কেহই দ্বিতীয়, তৃতীয়, চতুর্থ, পঞ্চম, ষষ্ঠ সপ্তম, অষ্টম, নবম বা দশম ঈশ্বর বলিয়া অভিহিত হয় না। যিনি তাঁহাকে শুধু এক বলিয়া জানেন তিনিই তাঁহাকে প্রাপ্ত হন। এক ঈশ্বর চিন্তন জ্ঞানীর, বহু ঈশ্বরের ধারণা মূর্খের।

প্রশ্ন-ঈশ্বর যদি একজনই হন তাহলে বেদে বিভিন্ন ঈশ্বরের নাম উল্লেখ কেন?

উত্তর: বেদে বিভিন্ন ঈশ্বরের নাম নেই বরং এক ঈশ্বরের বিভিন্ন গুণবাচক নাম রয়েছে যার জন্য বিদ্বানগণ বিভিন্ন নামে অভিহিত করেন। একটি মন্ত্রেই এই বিষয়ে বর্নন করা হয়েছে -

ইদ্ৰং মিত্রং বরুণ মগ্নি মাহু, রথো দিব্যঃ স সুপর্ণো গরুত্মান। একং সদ্বিপ্ৰা বহুধা বদন্ত্যগ্নিং যমং মাতরিশ্বানমাহুঃ ॥
(ঋগ্বেদ ১/১৬৪/৪৬)

পদার্থ :- (ইন্দ্রম্) পরমৈশ্বর্য যুক্ত (মিত্রম্) মিত্র (বরুণম্) শ্রেষ্ঠ (অগ্নিম্) অগ্নি (আহঃ) বলেন (অথ) তারপর (দিব্যঃ) দ্যুলোকস্থিত (সঃ) সেই (সুপর্ণ) সুপালক (গরুত্মান্) মহান্ আত্মাযুক্ত (একম্) এক (সৎ) সত্যকে (বিঃ) মেধাবী পুরুষেরা (বহুধা) বহু প্রকারে (বদন্তি) অভিহিত করেন (অগ্নি) সর্ব্বব্যাপক পরমাত্মাকে (যমম) নিয়ন্তা (মাতারিশ্বনম্) বায়ু (আহঃ) বলেন।

বঙ্গানুবাদ :- এক সত্তা পরব্রহ্মকে জ্ঞানীরা ইন্দ্র মিত্র, বরুণ, অগ্নি, দিব্য, সুপর্ণ, গরুৎন, যম, মাতরিশ্বা আদি বহু নামে অভিহিত করেন।

ভাবার্থ :- ইন্দতি পরমৈশ্বর্যবান্ ভবতীন্দ্রঃ; যিনি পরমৈশ্বর্যবান্ তিনি ইন্দ্র। মেদ্যতি স্নিহাতি স্নিহাতে বা স মিত্রঃ; যিনি সর্ব্বাপেক্ষা অধিক স্নেহ করেন ও প্রীতির পাত্র তিনি মিত্র। বৃণোতি ব্ৰিয়তে বাহসৌ বরুনঃ; যিনি বরণ করেন বা বরণ যোগ্য তিনি বরুণ। যোহঞ্চতি অচ্যতেহ গত্যঙ্গত্যেতি বা সোহয়মগ্নিঃ; যিনি জ্ঞান স্বরূপ, সর্ব্বজ্ঞ, জ্ঞাতব্য, প্রাপ্তব্য ও পূজ্য তিনি অগ্নি। দিবি ভবঃ ইতি দিব্যঃ, যিনি জ্যোতিঃস্বরূপ তিনি দিব্য। শোভনানি পর্ণানি পালনানি যস্য সঃ সুপর্ণ; যিনি উত্তমরূপে পালন করেন তিনি সুপর্ণ। গুর্বাত্মা গরুৎমান্; মহান্ আত্মা যাঁহার তিনি গরুৎমান৷ নিয়ন্তা যমঃ; যিনি নিয়ন্তা তিনি যম। মাতরিশ্বা বায়ুঃ; বাতি, গচ্ছতি, জানাতি বেতি বায়ুঃ; যিনি বেগবান বা জ্ঞান দাতা তিনি বায়ু বা মাতরিশ্বা। এই রূপ অসংখ্য নামে একই পরমাত্মার অসংখ্য গুণ, ক্রিয়া ও স্বভাবের বর্ণনা করা হয়।

এখানে আমরা দেখতে পাই ঈশ্বরের কোনো অবতার হয় না বা অবতার নেওয়ার প্রয়োজন নেই।ঈশ্বর এক এবং অদ্বিতীয়।

এখন প্রসঙ্গ হলো দেবতাবাদ নিয়ে। যে আমাদের ধর্মে দেবতা কতটি?

যজুর্বেদ এর ১৪/৩১ তম মন্ত্রে বলা হয়েছে ৩৩ প্রকার ভৌতিক দেব শক্তির কথা। 

ত্রয়স্ত্রিং শতাস্তুবত ভূতান্য শাম্যন্ প্রজাতিঃ।
পরমেষ্ঠ্যধিপতিরাসিৎ।।
 (যজুর্বেদ ১৪/৩১) 

পদার্থঃ- (ভূতানি অশাম্যন্) যাহার প্রভাবে গতিশীল প্রকৃতি শান্ত হয়, (প্রজাপতিঃ) যিনি প্রজা পালক, (পরমেষ্ঠী) সর্বব্যাপক পরমেশ্বর, (অধিপতিঃ) অধিষ্ঠাতা, (ত্রয়স্ত্রিংশতা) তাহার মহাভূতের তেত্রিশ গুণের, (অন্তবত) কীর্তন কর। 

অনুবাদঃ- যাহার প্রভাবে গতিশীল প্রকৃতি শান্ত হয় তথা যিনি প্রকৃতি শাসক, যিনি প্রজার পালক, যিনি সর্বব্যাপক পরমেশ্বর, যিনি সর্বাধিপতি, সেই পরমাত্মার তেত্রিশ ভৌতিক দেব শক্তির অনুশীলন করো তথা গুণকীর্তন করো। 

এই মন্ত্র দ্বারা প্রমাণ হচ্ছে দেব/দেবী বলতে ঈশ্বরের ভৌতিক দেব শক্তি আদির উল্লেখ করা হয়েছে।

বোঝার সুবিধার্থে ঈশ্বরের ভৌতিক দেব শক্তির নাম গুলো বৃহদারণ্যক উপনিষদ (৩/৯/২-১১) থেকে কিছু রেফারেন্স উদ্ধিত করা হলো :- 

বেদের প্রসিদ্ধ ৩৩ দেবতা কি, তাদের উপসনার সাথে কোনো সমন্ধ আছে না নেই, এই কথার উপর এই কণ্ডিকায় প্রকাশ করা হয়েছে। যাজ্ঞবল্ক্য বিদগ্ধ শাকল্য এর উত্তরে দেবতার সংখ্যা এই প্রকারে বলেছেন:- ৩৩০৬, ৩৩,৬,২,১½ তথা।

পরন্তু দ্বিতীয় কণ্ডিকায় যাজ্ঞবল্ক্য পরিষ্কার প্রকারে বলেন যে দেবতা তো আসলে ৩৩ প্রকারই, এই ৩৩০৬ তো তাদের বিভূতি (মহিমা বিস্তার)? 

এই ৩৩ প্রকার দেবতার বিবরণ এই প্রকার বলা হয়েছে যে-

৮ বসু- অগ্নি, পৃথিবী, বায়ু, অন্তরিক্ষ, আদিত্য, দ্যৌ, চন্দ্রমা এবং নক্ষত্র। 

১১ রুদ্র- ১০ প্রাণ এবং এক জীবাত্মা যা রুদ্র। 

১২ আদিত্য- বছরের ১২ মাস আদিত্য। 

১প্রজাপতি- যজ্ঞ।

 ৩৩- 

(২) ৬ দেবতা- অগ্নি, পৃথিবী, বায়ু, অন্তরিক্ষ, আদিত্য এবং দ্যৌ। অষ্ট বসুতে চন্দ্রমা এবং নক্ষত্র কে বাদ দেওয়ায় যে ৬ বসু বাকী থাকে। একেই ৬ দেবতা বলা হয়েছে।

(৩) ৩ দেবতা- তিন লোক অর্থাৎ পৃথিবী, অন্তরিক্ষ এবং দ্যৌ । ঊপরের দেবতাদের মধ্যে অগ্নি কে পৃথিবী কে বায়ু কে অন্তরিক্ষ কে এবং আদিত্য কে দ্যৌ কে অন্তর্গত বুঝে নেওয়ায় এই ৬ দেবতা এর মধ্যেই এসে যায়।

এর দ্বারা প্রমাণ হচ্ছে দেব/দেবী বলতে ঈশ্বরের কোনো স্বরূপ বা আলাদা কোনো অবতারী সত্তা কে বোঝায় না। বোঝায় ঈশ্বরের ভৌতিক দেব শক্তি আদিকে।

✍️ বিশাল আর্য

© আর্য প্রতিনিধি সভা বাংলাদেশ।

Post a Comment

0Comments

Please Select Embedded Mode To show the Comment System.*