বেদার্থের মানদণ্ড

0

বেদার্থের মানদণ্ড

বেদ ঈশ্বরীয় জ্ঞান, অপৌরুষেয়, নিত্য তথা সৃষ্টিনিয়মের অনুকূল। অতএব বেদের অর্থ করার সময় সেসব মানদণ্ড যথার্থরূপে জ্ঞাত হওয়া অনিবার্য, যা এই পূর্বোক্ত কথনসমূহের বিরোধ না করে, অতএব বেদার্থের দৃষ্টি দ্বারা সংক্ষেপে তাহার নিরূপণ করি - 

১. বেদে সার্বভৌম নিয়মসমূহের প্রতিপাদন হওয়া উচিত, যাহা মানব সমাজে পরস্পর বিরোধ উৎপন্নকারী হবে না।

২.কোনো দেশ বা জাতি বিশেষের সম্বন্ধ তাতে হওয়া উচিত নয়।

৩. ঈশ্বরের গুণ, কর্ম তথা সৃষ্টিনিয়মসূহের যেন বিরোধ না হয়।

৪. "সর্বজ্ঞানময়ো হি সঃ" বেদ সমস্ত সত্য বিদ্যার পুস্তক, তা দ্বারা এটি যেন অবশ্য বিদিত হয়।

৫. মানবজীবনের প্রত্যেক অঙ্গের ওপর প্রকাশ ফেলে, অর্থাৎ মানবের জ্ঞানসম্বন্ধী সকল আবশ্যকতাসমূহকে পূর্ণ করে।

৬. ন্যায় প্রভৃতি শাস্ত্রসমূহের নিয়মগুলোর যেন বিপরীত না হয়, অন্য শব্দে তর্কের কাঠগড়াতে যেন সঠিকভাবে দাড়ায়, অর্থাৎ তর্কসম্মত যেন হয়।

৭. যাহাতে কোনো ব্যক্তিবিশেষের ইতিহাস যেন না থাকে।

৮. ত্রিবিধ অর্থের জ্ঞান যেন করায়।

৯. আপ্তসম্মত যেন হয় এবং ঋষি-মুনিদের ধারণার অনুরূপ যেন হয়। 

১০. যার (বেদের) এক আজ্ঞা অন্য আজ্ঞাকে যেন খন্ডন না করে।

অতি সংক্ষেপে এগুলোকে বেদার্থের মানদণ্ড বলা যেতে পাড়ে। 

১. সর্বতন্ত্র সিধান্ত বা সার্বভৌম-নিয়ম - যেসকল কথা সকলের অনুকূল, সকলের নিকট সত্য, যাহাকে সকলে সবসময়ই মেনে আসছে, মানে এবং মানবে। যার কেহ বিরোধী হবে না, যা প্রাণীমাত্রের জন্যে কল্যাণকারক, এরূপ সর্বতন্ত্র, সর্বমান্য সিধান্ত-ই জগতে সুখ ও শান্তির প্রতিপাদক হতে পাড়ে। বেদ তো স্পষ্ট বলে - 

...... মিত্রস্যা মা চক্ষুষা সর্বাণি ভূতানি সমীক্ষন্তাম্।
...... মিত্রস্য চক্ষুসা সমীক্ষামহে।। (যজু০ ৩৬/১৮)।।
প্রাণীমাত্রকে মিত্রের দৃষ্টিতে দেখো। 
"যস্মিন্তসর্বাণি ভূতান্যাত্মৈবাভূদ্ বিজানতঃ" (যজু০ ৪০/৭), "ভূতেষু ভূতেষু বিচিন্ত্য ধীরাঃ" (কেনোপ০ ২/৫), 
"স্বস্তি গোভ্যো জগতে পুরুষেভ্যঃ" (অথর্ব০ ১/৩১/৪),
বেদের এই মন্ত্রগুলোতে তথা উপনিষদের বচনে স্পষ্টরূপে এই কথার প্রতিপাদন আমরা পাই। এরূপ অবস্থায় যদি কেহ বেদের অর্থ এসবের বিরুদ্ধ করে, তাহলে কিরূপে তা গ্রহণীয় হতে পাড়ে! ঈশ্বরের জ্ঞান বেদ, তারপরেও জাতিতে-জাতিতে, এবং দেশ-দেশে দন্দ সৃষ্টিকারী কথা যদি বলা হয়, তাহলে তা কিভাবে হতে পাড়ে। বেদ তো সমতার প্রতিপাদক, বিষমতার নয়। মানবহৃদয়ের বিষমতা দূর করাই তো বেদের ধ্যেয়। বেদের প্রত্যেক মন্ত্র কোনো না কোনোভাবে সর্বতন্ত্র সিধান্তের প্রতিপাদক, এটা আমার কথা। এই মানদণ্ডগুলোকে নিয়ে প্রত্যেককে বেদ মন্ত্রের অর্থের পরীক্ষণ করা উচিত।

২. কোনো দেশ বা জাতিবিশেষের সম্বন্ধ তাহাতে হওয়া উচিত নয় - এমনটা হলে ঈশ্বরের ওপর পক্ষপাত দোষ সিদ্ধ হবে। দ্বিতীয়ত - যে জাতি বা দেশের বর্ণন বেদে থাকবে, বেদের উৎপত্তি তাহার পড়ে হয়েছে এমনটা মানতে হবে, এভাবে বেদের নিত্যতা আর থাকবে না। ঋ০ ১/৩/১১,১২ - এ 

"চোদয়িত্রী সূনৃতানাং চেতন্তী সুমতীনাম্"।

" ধিয়ো বিশ্বা বি রাজতি"।

বিশ্বের জন্য বুদ্ধি বা জ্ঞান প্রকাশের উপদেশ বেদ করে।

যোগদর্শন (২/৩১) সূত্রেও 

 "জাতিদেশকালসময়ানবচ্ছিন্নাঃ সার্বভৌমা মহাব্রতম।।৩১।। এমনটাই বলা হয়েছে।

৩. ঈশ্বর গুণ, কর্ম ও সৃষ্টিনিয়মসমূহের যেন বিরুদ্ধ না হয় - ঈশ্বর সর্বজ্ঞ, উৎপত্তি, স্থিতি ও সংহারকর্তা, সর্বনিয়ন্তা, সর্বান্তর্যামী আদি গুণযুক্ত। যদি বেদমন্ত্রসমূহের অর্থ এই গুণগুলোর বিপরীত হয় তাহলে এটা বলতে হবে যে, বেদমন্ত্রের সঠিক অর্থ হয়নি, অন্যথা বেদে ঈশ্বরকৃত নয় এরূপ স্বীকার করা যেতে পাড়ে। বেদ বলে - 
বিশ্বতশ্চক্ষুরুত বিশ্বতোমুখঃ।। ঋ০ ১০/৮১/৩।।
য ইমা বিশ্বা ভুবনানি চাক্লৃপে।। অথর্ব০ ৭/৮৭/১।।
প্রজাপতিঃ সসৃজে বিশ্বরূপম্।। অথর্ব০ ১০/৭/৮।।
যস্মিন্ ভূমিরন্তরিক্ষং দ্যৌর্যস্মিন্নধ্যাহিতা।
যত্রাগ্নিশ্চন্দ্রমাঃ সূর্যো বার্তাস্তষ্ঠন্ত্যার্পিতাঃ।। 
অথর্ব০ ১০/৭/১২।।
সকলের স্রষ্টা, ধর্তা, নিয়ন্তা হলো পরমেশ্বর, ইত্যাদি মন্ত্র উপর্যুক্ত মানদণ্ডের সর্বথা অনুরূপ। 
৪. বেদ সমস্ত সত্যবিদ্যার পুস্তক - যখন বেদ ঈশ্বরীয় জ্ঞান সুতরাং তা অবশ্যই পূর্ণজ্ঞান হওয়া উচিত, যা প্রাণীমাত্রের প্রত্যাশিত। অন্যথা বেদের অপূর্ণতা তাহার বেদত্বেরই ব্যাঘাত ঘটাবে। একারণে ঋষি-মুনি " সর্বজ্ঞানময়ো হি সঃ" (মনু০ ২/৭) বেদকে সমস্ত বিদ্যার ভাণ্ডার বলে স্বীকার করেন। যদ্যাপি এই কথাটি এখন অবধি সাধ্যের পর্যায়ে রয়েছে, এবং ততক্ষণ অবধি থাকবে, যতক্ষণ পর্যন্ত না সম্পূর্ণ বিদ্যা জ্ঞাত হয়। বেদ সমস্ত বিদ্যার পুস্তক এই কথাটিকে কেবলমাত্র মহর্ষি দয়ানন্দজীই নয় বরং স্বামী শঙ্করাচার্যও স্বীকার করেছেন - 

"মহত ঋগ্বেদাদেঃ শাস্ত্রস্যানেকবিদ্যাস্থানোপবৃংহিতস্য প্রদীপবৎ সর্বার্থাবদ্যোতিনঃ সর্বজ্ঞকল্পস্য যোনিঃ কারণং ব্রহ্ম। নহীদৃশস্য শাস্ত্রস্যর্গ্বেদাদিলক্ষণস্য সর্বজ্ঞগুণান্বিতস্য সর্বজ্ঞাদন্যতঃ সম্ভবোহস্তি"। (বেদান্ত শাঙ্করভাষ্য ১/১/৩)। 

অর্থাৎ- অনেক বিদ্যার স্রোত ঋগ্বেদাদির কর্তা সর্বজ্ঞ জগদীশ্বর বিনা অন্যকেহ হতে পাড়ে না।

৫. মানব জীবনের প্রত্যেক অঙ্গের ওপর প্রকাশ যেন ফেলে - এই নিয়ম অনুযায়ী চার বর্ণ এবং চার আশ্রমের সকল ধর্মের উপদেশ বেদেতে থাকা অনিবার্য। 

" ব্রাহ্মণোহস্য মুখমাসীৎ" (যজু০ ৩১/১১) - 

ইত্যাদি মন্ত্র চার বর্ণের কর্তব্যসমূহের উপদেশ করে থাকে, একইভাবে  চার আশ্রমের কর্তব্যসমূহের নিরূপণকারী ব্রহ্মচর্যসূক্ত (অথর্ব০ ১১/৫) তথা গৃহস্থাশ্রম (অথর্ব ১৪/২৩) আদির প্রকরণ বেদের অনেকস্থলে রয়েছে।

৬. তর্কসম্মত যেন হয় - "বুদ্ধিপূর্বা বাক্যকৃতির্বেদে" (বৈশে০ ৬/১/১) সূত্রানুসারে বেদে তর্কবিরুদ্ধ কোনো কিছু থাকতে পাড়ে না। "তর্ক এব ঋষিঃ" (নিরু০ ১৩/১২) ঋষিদের এই বচনের আধারে আমাদের স্বীকার করতে হবে যে বেদের কোনো মন্ত্র তর্কের অবহেলা করতে পাড়বে না। এই কথন এখন বেদের মর্মজ্ঞ বিদ্বানদের ব্যতীত অন্য সাধারণ মানুষের জন্যে তো প্রায় সাধ্যের পর্যায়তেই বলা যেতে পাড়ে। 

৭. ব্যক্তিবিশেষের ইতিহাস যেন না থাকে - ইন্দ্র-কণ্ব-অঙ্গিরঃ প্রভৃতি শব্দের আগে তরপ্-তমপ্ (Comparative তথা Superlative degree) প্রত্যয় আমাদের বেদে (ঋ০ ৭/৭৯/৩ তথা ১/৪৮/৪) স্পষ্ট পরিলক্ষিত হয়। তরপ-তমপ্ প্রত্যয় বিশেষণবাচী শব্দসমূহেরই আগে প্রযুক্ত হয়, ব্যক্তিবিশেষের নামের আগে যুক্ত হয় না। এ থেকে আমরা বোঝতে পাড়ি যে, ইন্দ্র-কণ্ব-অঙ্গিরঃ প্রভৃতি শব্দ বিশেষণবাচী, কোনো ব্যক্তিবিশেষের নাম নয়। স্থালীপুলাক-ন্যায় দিয়ে আমি এতটুকু লিখাই পর্যাপ্ত মনে করি। 

৮. ত্রিবিধ অর্থের জ্ঞান যেন হয় বেদার্থ থেকে - নিরুক্তকার যাস্ক মুনির মতে বেদের প্রত্যেক মন্ত্রের  ত্রিবিধঅর্থ হওয়া উচিত, এমনটা ঋগ্বেদের ভাষ্যকার স্কন্দস্বামীও বলেছেন নিরুক্তের প্রমাণ দিয়ে। এরূপ দশাতে আমাদের যেকোনো ব্যক্তির কৃত অর্থ সামনে আসলে পড়ে আমাদের দেখতে হবে যে সেই অর্থ কি ত্রিবিধ অর্থকে প্রকাশ করে, বা তিন অর্থের মধ্যে কোনো একটিকে, বা তিন অর্থ হতে ভিন্ন কোনো কিছু বলছে। এই মানদণ্ডসমূহের ওপর আমাদের বেদার্থকারীর যোগ্যতার খবরও তৎকাল হয়ে যাবে যে তার বেদার্থের বিষয়ে জ্ঞানের গভীরতা কতদূর!!

৯. ঋষি-মুনিদের ধারণার যেন অনুকূল হয় - যেমনটা আমি যাস্কের মত উপরে দেখিয়েছি, এভাবেই যাস্কমুনির অন্য ধারণাগুলো তথা অনান্য ঋষিদের বেদার্থবিষয়ে যে ধারণা রয়েছে, সেসব ধারণাসকল নিয়ে বেদার্থের পরীক্ষা করতে হবে। যখন যাস্কমুনি প্রত্যেক মন্ত্রের ত্রিবিধ অর্থ স্বীকার করেছেন, সুতরাং আমাদের বাধিত হয়ে তেমনই বেদের অর্থ যে গ্রাহ্য তা বোঝতে হবে, ভিন্ন কিছু নয়। 

১০. যার(বেদের) এক আজ্ঞা অন্য আজ্ঞাকে যেন খণ্ডিত না করে - বিপ্রতিষিদ্ধ(বিরুদ্ধ) কথা হয় পাগলে বলে নয় অজ্ঞানী ব্যক্তি। আর ঈশ্বরের থেকে মহান জ্ঞানী আর কেই বা হতে পাড়ে! অতএব তাহার জ্ঞানও কখনো পরস্পর বিরোধী হতেপাড়ে না। এই কথা বেদের ওপর সম্পূর্ণভাবে প্রযুক্ত হয়। অতএব বেদের অর্থতে এমন কোনো বিপ্রতিষিদ্ধতার অর্থাৎ পরস্পর বিরোধীতার সম্ভাবনা হতে পাড়ে না বা অসম্ভব। 

[বেদার্থের মানদণ্ড সমূহ অতিসংক্ষেপে নির্দেশ-মাত্র বর্ণণা করা হলো ]

🖋️ বাঁধন চক্রবর্তী (সদস্য, অমৃতস্য পুত্রাঃ)

আর্য প্রতিনিধি সভা বাংলাদেশ

Post a Comment

0Comments

Please Select Embedded Mode To show the Comment System.*