মহর্ষি দয়ানন্দকৃত বেদভাষ্যের বিশেষতাসমূহ |
প্রসঙ্গতঃ- অতি সংক্ষেপে আমরা এখানে এই বিষয়কে প্রতিফলিত করবো, পাঠক বিশেষ আপনারা মহর্ষি দয়ানন্দজীর ভাষ্য স্বয়ং পড়ে দেখুন।
১. ঈশ্বরে পূর্ণ বিশ্বাসী পূর্ণ যোগাভ্যাসী সাক্ষাৎকৃতধর্মা তপস্বী পক্ষপাতরহিত ঈশ্বরকে সচ্চিদানন্দ সর্বজ্ঞ সৃষ্টিকর্তা আদি গুণের প্রতিপাদক, প্রাচীন ঋষি মুনিদের প্রতি পূর্ণ নিষ্ঠাবান ব্রহ্মা থেকে জৈমিনি মুনি পর্যন্ত ঋষিদের সিদ্ধান্তকে মান্যকারী মহাপুরুষ আচার্য দয়ানন্দ সরস্বতী দ্বারা এই ভাষ্য নির্মাণ করা হয়েছে ,( যতটুকু তিনি পেয়েছেন ) ।
২. বিকাশবাদের সিদ্ধান্তের খন্ডন যা ঋষি দয়ানন্দের গ্রন্থের দ্বারা হয়, তেমনিভাবে তাঁর বেদভাষ্য দ্বারাও পদে পদে হয়।
৩. বেদ অপৌরুষেয়বাদ( ঈশ্বরীয় জ্ঞান ) ধারণার উপর এই ভাষ্য, ইহার বিরুদ্ধ এতে যৎকিঞ্চিৎও পাওয়া যাবে না।
৪. যাস্ক, পাণিনি, পতঞ্জলি তথা তাদেরও পূর্ববর্তী ঋষি মুনি আচার্য্যদের আধারে বেদের শব্দকে লৌকিক শব্দ থেকে ভিন্ন মেনে ভাষ্য করেছেন।
৫. বেদের সকল শব্দকে ধাতুজ মেনে তাদের ব্যুৎপত্তি-নির্বচন মূল-প্রমাণসহ দেখানো হয়েছে। নির্বচনভেদে বৈদিক শব্দের অর্থ এই ভাষ্যে ভিন্ন-ভিন্ন দেখানো হয়েছে। যৌগিক এবং যোগরুঢ়িবাদ এই ভাষ্যের মূলভিত্তি।
৬. সকল মন্ত্রের অর্থ (সায়ণাচার্যের থেকেও ৬০০ বর্ষ পূর্ব প্রসিদ্ধ) ত্রিবিধ প্রক্রিয়া অর্থাৎ সকল মন্ত্রের অর্থ আধ্যাত্মিক, আধিদৈবিক এবং আধিয়াজ্ঞিক প্রক্রিয়ায় হয়, এই সিদ্ধান্তের আধারে করা হয়েছে।
৭. বেদমন্ত্রের অর্থ বেদমন্ত্রের আধারেই দিয়েছেন। (যথা য০ ১/১৩)
৮. অগ্নি, বায়ু, ইন্দ্র, মিত্র, বরুণ, যম, রুদ্র আদি বোধক বাচক নয়, বরং ‘অগ্নি‘ শব্দের নির্বচনের ভিত্তিতে আধ্যাত্মিক আধিদৈবিক প্রক্রিয়ায় পরমেশ্বর, বিদ্বান্, রাজা, রাষ্ট্রপতি, নেতা আদি বিদ্যুৎ, প্রকাশ তথা জঠরাগ্নি আদিও গ্রাহক। অগ্নি, বায়ু আদি শব্দ যেখানে ভৌতিক পদার্থের বাচক, সেখানে মুখ্যবৃত্তি (অভিধাবৃত্তি) দ্বারা ঈশ্বরের বাচক, এই প্রক্রিয়া সম্পূর্ণ ভাষ্যে পাওয়া যাবে। একেই আধার মেনে স্বর্গীয় মহাত্মা শ্রী অরবিন্দ জী দয়ানন্দভাষ্যের ভূরি-ভূরি প্রশংসা করেছেন এবং এই প্রসঙ্গের ভিত্তিতে বেদ সম্বন্ধে গম্ভীর আলোচনা করেছেন।
৯. সকল বেদ মন্ত্রের ষড্জাদি স্বর লিখেছেন [৭টি স্বর], যা যেকোনো ভাষ্যে পাওয়া যায় না। কাব্যের অঙ্গভূত শ্লেষাদি অলঙ্কারের ব্যবহার এই বৈদিক ভাষ্যে সর্বপ্রথম আচার্য দয়ানন্দই করেছেন এবং এই অলঙ্কারের দ্বারা অর্থে বহুবিধ বৈচিত্র্য দেখানো হয়েছে।
১০. বেদে অনিত্য ইতিহাস (ব্যক্তিবিশেষ ইতিহাস) কোথাও মান্য করা হয় নি, বরঞ্চ এমন স্থলগুলোতে খুব সুন্দর ও প্রামাণিক ব্যাখ্যা করেছেন ।
১১. পদপাঠের বিষয়ে মহাভাষ্যকার পতঞ্জলি মুনির সিদ্ধান্ত-
'ন লক্ষণেন পদকারা অনুবর্ত্যাঃ, পদকারৈর্নাম লক্ষণমনুবত্যম্ (মহাভাষ্য) এর আধারে তথা আচার্যস্কন্দ স্বামীর সমান 'তস্মাদবগ্রহোঽনবগ্রহঃ’ এর অনুসারে ঋষি দয়ানন্দ জী অনেক স্থানে ভিন্ন পদ-পাঠ মেনেছেন , যা শাস্ত্র সম্মত।
১২. স্বামী দয়ানন্দ সরস্বতী জীর ভাষ্য দ্বারা 'বুদ্ধিপূর্বা বাক্যকৃতিবেদে’(বৈ০ ৬/১/১) অর্থাৎ বেদের কোনো বিষয় তর্ক বিরুদ্ধ নয়, এই সিদ্ধান্তের ভিত্তিতে বেদার্থ করা হয়েছে।
১৩. দেবতাবাদের বিষয়ে সবানুক্রমণী এবং বৃহদ্দেবতা আদি দ্বারাও ভিন্ন মন্ত্রের দেবতা মানা যেতে পারে,এই সিদ্ধান্ত শাস্ত্র সম্মত, এই বিচার ধারানুসারে স্বামী দয়ানন্দ সরস্বতীর ভাষ্য দেখা উচিৎ।
১৪.মন্ত্রের ছন্দও অনুক্রমণীতে উল্লেখিত ছন্দসমূহ হতে কোথাও কোথাও প্রমাণিত হওয়ায় ভিন্ন মানা হয়।
১৫. 'ব্যত্যযো বহুলম্’ এর সিদ্ধান্ত বেদার্থে অতি আবশ্যক। এই বিষয়টি আচার্য দয়ানন্দের ভাষ্যেই সর্বোত্তম রীতিতে পাওয়া যাবে।।
১৬. 'বাক্যং হি বক্তুরধীনম্’ - এর অনুসারে বেদার্থ এই ভাষ্যে পাওয়া যাবে।
১৭. ‘যজ্ঞ‘ শব্দ দ্বারা আচার্য দয়ানন্দ জী ত্রিবিধ যজ্ঞ গ্রহণ করেছেন। যেখানে শ্রী সায়ণাচার্য শুধু ভৌতিক যজ্ঞপরকই মান্যতা দিয়েছেন, এতটুকুতেই বেদার্থ কোথা থেকে কোথায় পৌঁছে গিয়েছে তা দৃশ্যমান হয়ে উঠেছে।
১৮. বেদ সর্বতন্ত্র-সার্বভৌমিক সিদ্ধান্তের প্রতিপাদক, বিষয়টি এই ভাষ্যের বেদার্থেই পাওয়া যায়।
১৯. দয়ানন্দভাষ্যে নৈরুক্তশৈলীর আধারে অনেক শব্দের নিবর্চন পাওয়া যায়, যার নির্বাচন নিরুক্ত এবং ব্রাহ্মণাদি শাস্ত্রেও পাওয়া যায় না, যা প্রমাণিত।
২০. সবচেয়ে বড় এবং অন্তিম বিশেষতা দয়ানন্দ ভাষ্যের এই যে, তাতে নৈরুক্তশৈলী অনুসারে সংস্কৃত পদার্থ মন্ত্রগত পদসমূহের ক্রমানুসারে রাখা হয়েছে এবং তাতে যত্র-তত্র মন্ত্রগুলোর, তিন প্রকারের অর্থকে লক্ষ্য রেখে নির্বাচন তথা অর্থকে দেখানো হয়েছে , যা অন্বয়ে হতে পারতো না। অন্বয়কে সংস্কৃত পদার্থের একটি অংশ হিসেবে বোঝা উচিৎ এবং এই সংস্কৃত অন্বয়েরই ভাষার্থ করা হয়েছে, যা ভাষার্থকারীদের দ্বারা ঠিকমতো সম্পূর্ণ হতে পারেনি। এই ভাষ্যের এই বিশেষতাকে না বুঝে অনেক ভদ্রলোক ঘাবড়ে যেতে থাকেন। একবার এই প্রকারে বুঝে নিলে কোন জটিলতা থাকতো না। এই বিষয়টি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।।
কোন বিদ্বান বিদ্যার ভিন্ন-ভিন্ন অঙ্গ সম্পর্কে যত বেশি জ্ঞাতা হবেন তথা যোগাদি দিব্যশক্তি সম্পন্ন হবেন, তাঁর বেদার্থের জ্ঞান ততোধিক উত্তমরীতিতে হবে।।
আমরা বিশ্বাস করি বেদার্থ বিষয়ের এই সিদ্ধান্ত সর্বোপরি সিদ্ধান্ত এবং অত্যন্ত উপাদেয়।।
লেখকঃ পদবাক্যপ্রমাণজ্ঞ পণ্ডিত ব্রহ্মদত্ত জী জিজ্ঞাসু
ভাষান্তর:- অমৃতস্য পুত্রাঃ