ইসকনের অশাস্ত্রীয়তা
যদি বৈদিক দৃষ্টিতে দেখা হয় তাহলে ইসকন প্রায় সম্পূর্ণতই অশাস্ত্রীয় কেননা তারা যা আধার করে নিয়মাদি পালন ও প্রচারাদি করে তা অবৈদিক। তবে এই আর্টিকেলে সম্পূর্ণ অবৈদিক বলেই সীমাবদ্ধ না থেকে কিছু প্রমাণ উপস্থাপন করবো যা দ্বারা সামান্য হলেও সকলের নিকট পরিষ্কার হবে যে ইসকন অশাস্ত্রীয় প্রচার করে কিনা।
যেহেতু "বেদোऽখিলো ধর্মমূলম্" (মনু০২/৬) বেদ সকল ধর্মের মূল, তাই বেদ দিয়েই শুরু করি। প্রথমে দেখি বেদ মন্ত্রসংখ্যা কত সেই সম্পর্কে তারা কি জানে এবং প্রচার করে-
প্রভু জী প্রচার করতেছেন যে - বেদে একশতকোটি শ্লোক রয়েছে। আদৌ কি তা সঠিক? ইস্কন সদস্যরা বেদ ও বৈদিক শাস্ত্র না পড়েই মনগড়া প্রচার করেন যার প্রকৃষ্ট উদাহরণ এই ভিডিওটি। প্রথমত বেদে কোন শ্লোক নেই, বেদে রয়েছে মন্ত্র। মন্ত্র এবং শ্লোক এক নয়।
দ্বিতীয়ত বেদে একশতকোটি মন্ত্র নেই। তাহলে কয়টি আছে?
বেদের মন্ত্রসংখ্যা হলো– ঋগ্বেদ - ১০,৫৫২, যজুর্বেদ - ১৯৭৫, সামবেদ - ১৮৭৫, অথর্ববেদ - ৫,৯৭৭
সবগুলো যোগ করলে - ১০,৫৫২+১৯৭৫+১৮৭৫+৫,৯৭৭ = ২০৩৭৯ হয়।
সুতরাং বেদে ২০৩৭৯ টি মন্ত্র রয়েছে।
ইসকন প্রভুর বলা বেদে একশতকোটি শ্লোক রয়েছে তা সঠিক নয়। আরেকজন প্রভু বলতেছেন যে-
বেদ প্রথমে একটিই ছিলো, পরবর্তীতে ব্যাসদেব চারভাগে বিভক্ত করেছেন। এই বক্তব্য সরাসরি বেদের বিরুদ্ধে। বেদেই বলা হয়েছে যে-
তস্মাদ্ যজ্ঞাৎ সবর্বহুত ঋচঃ সামানি জজ্ঞিরে।
ছন্দাংসি জজ্ঞিরে তস্মাদ্যজুস্তস্মাদজায়ত।।
(ঋগ্বেদ - ১০/৯০/৯, যজুর্বেদ-৩১/৭, অথর্ববেদ-১৯/৬/১৩)
পদার্থঃ- (তস্মাৎ সর্বহুতঃ যজ্ঞাৎ) সেই সর্বহুত সঙ্গমনীয় পরমাত্মা হইতে (ঋচঃ সামানি জজ্ঞিরে) ঋগ্বেদের মন্ত্র, সামবেদের মন্ত্র উৎপন্ন হয়েছে (তস্মাৎ ছন্দাংসি জজ্ঞিরে) তাঁহার হইতে অথর্বেদের মন্ত্র উৎপন্ন হয়েছে (তস্মাৎ যজু অজায়ত) সেই পরমাত্মা হইতেই যজুর্বেদ উৎপন্ন হয়েছে।
ভাবার্থঃ- পরমাত্মা - ঋগ্বেদ, যজুর্বেদ, সামবেদ এবং অথর্ববেদ উৎপন্ন করেছেন।
এই মন্ত্রে বলা হয়েছে পরমাত্মা হইতেই চারটি বেদ উৎপন্ন হয়েছে। এমন আরো প্রমাণ দেওয়া যাবে। যেখানে বেদে চার বেদের নাম উল্লেখ আছে এবং সেই চার বেদ পরমাত্মা হইতে প্রকাশিত হয়েছে বলা আছে তারপরেও ইসকন প্রভু কিভাবে বলেন যে বেদ একটি ছিলো আর তা ব্যাসদেব চারভাগে বিভক্ত করেছেন? এর স্বপক্ষে তিনি যে প্রমাণই দেখান না কেন তা বেদের বিরুদ্ধ প্রমাণিত হবে। আর শাস্ত্রে বলা হয়েছে- "ধর্ম্মং জিজ্ঞাসমানানাং প্রমাণং পরমং শ্রুতিঃ" (মনু০ ২/১৩)। ধর্ম জানার ইচ্ছে করে তার জন্য পরম প্রমাণ পবিত্র বেদ। আরোও বলা হয়েছে -
উৎপদ্যন্তে চ্যবন্তে চ যান্যতোহন্যানি কানিচিৎ।
তান্যর্বাক্কালিকত্যা নিষ্ফলান্যনৃতানি চ।। (মনুস্মৃতি- ১২/৯৬)
অনুবাদঃ- এই সমস্ত বেদ বিরুদ্ধ গ্রন্থ যাহা রচিত হইতেছে, সে সমস্ত আধুনিক বলিয়া শীঘ্র নষ্ট হইয়া যায়, এ-সকল গ্রন্থ মান্য করা নিষ্ফল ও মিথ্যা।
পুরাণের অন্তর্গত দেবী গীতায়ও বলা হয়েছে-
অন্যেষাং শাস্ত্রকর্ত্তৃণামজ্ঞানপ্রভবত্বতঃ।
অজ্ঞানদোষদুষ্টত্বাত্তদুক্তে ন প্রমাণতা।
তস্মান্মুমুক্ষুর্ধর্ম্মার্থং সর্ব্বদা বেদমাশ্রয়েৎ।।
(দেবী গীতা-৯/১৯)
অনুবাদঃ- বেদ ভিন্ন অন্ন শাস্ত্রকর্ত্তৃদিগের বাক্য অজ্ঞান সম্ভূত, সুতরাং তাহাতে অজ্ঞানদোষ বর্ত্তমান আছে, অতএব তাহার প্রামাণ্য হইতে পারে না। এই কারণে মুমুক্ষু ব্যক্তি ধর্ম্মজ্ঞানের নিমিত্ত সর্ব্বদা বেদকেই আশ্রয় করিবেন।
অতএব ইসকন প্রভু ভুল প্রচার করেছেন তা প্রমাণিত হয়েছে এবং প্রমাণিতই থাকবে। আরো একটি ভিডওতে দেখা যায় যে-
ইসকন প্রভু বলতেছেন- বেদ আদি গ্রন্থ, প্রধান নয়, কোন গ্রন্থে নাকি প্রধান বলা হয়নি বেদকে। কিছু শাস্ত্রব্যক্য উপস্থিত করছি-
- বেদশাস্ত্রং সনাতনম্ (মনু০১২/৯৯) বেদ সনাতন শাস্ত্র, নিত্য শাস্ত্র, সর্বদা প্রয়োজনীয় শাস্ত্র।
- নাস্তি বেদাৎ পরং শাস্ত্রং (অত্রিস্মৃতি- ১৪৯) বেদ হইতে উৎকৃষ্ট শাস্ত্র নেই, অর্থাৎ বেদই প্রধান বেদই শ্রেষ্ঠ।
- বেদোক্তঃ পরমো ধর্মঃ (মহা০,অনুশাসনপর্ব -১৪১/৬৫) প্রথমেই বেদোক্ত ধর্ম, যা সব থেকে উৎকৃষ্ট (শ্রেষ্ঠ)।
- বেদঃ অখিলঃ ধর্মমূলম্ (মনু০-২/৬) বেদ সব ধর্মের মূল।
সনাতন ধর্মের সনাতন শাস্ত্রকেই প্রভুজী প্রধান বলে মানছেন না। আবার তিনি প্রচারও করতেছেন যে বেদকে কোন শাস্ত্রে প্রধান বলা হয়নি। উপরোক্ত প্রমাণ দ্বারা কি সিদ্ধ হয়নি যে তিনি শাস্ত্রবিরোধী প্রচার করতেছেন? আর এরূপ অসংখ্য প্রমাণ দেওয়া যাবে। আমরা অন্য একটি ভিডিও দেখার চেষ্টা করি -
প্রভুজীর নিকট কেহ একজন প্রশ্ন করেছে যে- বেদ হলো হিন্দুদের প্রধান আদি গ্রন্থ। যদি বেদই আদিগ্রন্থ হয় তাহলে ধর্মীয় অনুষ্ঠানে বেদ পাঠ নয়, গীতা পাঠ করা হয় কেন?
ইসকন প্রভু উত্তর প্রদানের সময় বিবিধ কথার মধ্যে এও বলেন যে-
- নারদ মুনি বেদ পড়তে নিষেধ করেছেন।
- বেদের সারাংশ গীতা।
- বেদ রচনাকারী ব্যাসদেব, বেদ রচনা করে মনে শান্তিপাননি, তাই বেদ পড়লে আমাদের ভিতরেও অনেক সন্দেহ হয়। তাই নারদমুনি গীতা ভাগবত লিখতে নির্দেশ দিয়েছেন।
- ভগবান্ শ্রীকৃষ্ণ গীতার দ্বিতীয় অধ্যায় এবং নবম অধ্যায়ে বেদ পড়তে নিষেধ করেছেন। ..............।
1.মহাভারতে পড়লে জানা যায় যে নারদ মুনি বেদের প্রতি খুবই একনিষ্ঠ ছিলেন, তিনি বেদ পড়তে নিষেধ তো দূরের কথন বরং বলেছেন –
যে বেদং প্রাপ্য দুর্ধর্ষা বাগ্মিনো ব্রহ্মচারিণঃ ।
যাজনাধ্যাপনে যুক্তা নিত্যং তান্ পূজয়াম্যহম্ ॥
(মহা০ অনু০ ৩১/১৩)
অনুবাদ : যে বেদ অধ্যয়ন করে দুর্ধর্ষ এবং কথা বলায় কুশল হয়ে গেছে, ব্রহ্মচর্য পালন করে এবং যজ্ঞ করাতে তথা বেদ পড়ানোর কার্যে রত থাকে, আমি তাকে সদা পূজা করি।
2. গীতা বেদের সারাংশ নয়। বেদে ভৌতিক বিদ্যা এবং আধ্যাত্মিক বিদ্যার বিবিধ বিষয়ের জ্ঞান আছে যার সাথে গীতার তুলনা করে গীতাকে মহান বানানো হয়না বরং তুচ্ছ করা হয়। গীতা আদরণীয় গ্রন্থ গীতার স্থানে, এর জন্য বেদের সাথে তুলনা করতে হয়না।
3. বেদ রচনা করে ব্যাসদেব শান্তিপাননি তাই নারদ মুনির উপদেশে গীতা ভাগবত লিখেছে এটি নিছক কল্পনা মাত্র। গীতা মহাভারতের অংশ। শুকদেবজী পরিক্ষিতজীর ইতিহাস দেখলেও ভাগবতের বিষয়টা পরিষ্কার বুঝা যায় কিন্তু সেই বিস্তৃত বিষয়ে না গিয়ে এটা প্রমাণ করবো যে, তিনি যে শ্রীমদ্ভাগবত পুরাণের কথা বলছেন, সেই ভাগবতের উল্লেখই অন্যান্য পুরাণে উল্লেখিত অষ্টাদশ মহা পুরাণের লিস্টে নাই। শ্রীমদ্-দেবীভাগবত নামে যে ভাগবত পুরাণ আছে তাতে বলা হয়েছে-
দেবীভাগবত, পূর্বার্ধ-১/১/১৬ভাগবত পুরান পঞ্চম পুরাণ। আর এখানে ভাগবত বলতে দেবীভাগবতকে বুঝানো হয়েছে। অপরদিকে স্বয়ম্ শ্রীমদ্ভাগবত পুরাণে –
স্বয়মকে অষ্টম পুরাণ হিসেবে উল্লেখ করেছে। সেই অনুযায়ী যদি অন্যান্য পুরাণে উল্লেখিত লিস্ট দেখি - কূর্মপুরাণ-১/১৩-১৫
(কূর্মপুরাণ অধ্যায় ১ শ্লোক ১৩, ১৪, ১৫) – ১.ব্রহ্ম, ২.পদ্ম, ৩.বিষ্ণু, ৪.শিব, ৫.ভাগবত, ৬.ভবিষ্য, ৭.নারদ, ৮.মার্কণ্ডেয়, ৯.অগ্নি, ১০. ব্রহ্মবৈবর্ত্ত, ১১.লিঙ্গ, ১২.বারাহ, ১৩.স্কন্দ, ১৪.বামন, ১৫.কূর্ম, ১৬.মৎস্য, ১৭ গরুড, ১৮ বায়ু ।
(লিঙ্গপুরাণ, পূর্বার্দ্ধ -৩৯/৬১,৬২,৬৩ এবং মার্কণ্ডেয়পুরাণের মাহাত্ম্য)– ১.ব্রহ্ম (২) পদ্ম, (৩) বিষ্ণু, (৪) শিব, (৫) ভাগবত, (৬) নারদ, ( ৭ ) মার্কণ্ডেয়, (৮) অগ্নি, (৯) ভবিষ্য, (১০) ব্রহ্মবৈবর্ত, (১১) লিঙ্গ, (১২) বারাহ, (১৩) স্কন্দ, (১৪) বামন, (১৫) কূর্ম, (১৬) মৎস্য, (১৭) গরুড়, (১৮) ব্রহ্মাণ্ড ।
(শিবপুরাণ বায়ুসংহিতা [অ০] ১ শ্লোক ৩৮-৩৯-৪০)– (১) ব্রাহ্ম, (২) পদ্ম, (৩) বিষ্ণু, (৪) শিব, (৫) ভাগবত, (৬)ভবিষ্য, (৭)নারদীয়, (৮) মার্কণ্ডেয়, (৯) অগ্নি, (১০) ব্রহ্মবৈবর্ত, (১১) লিঙ্গ, (১২) বারাহ, (১৩) স্কন্দ, (১৪) বামন, (১৫) কূর্ম, (১৬) মৎস্য, (১৭) গরুড়, (১৮) ব্রহ্মাণ্ড ।
পঞ্চম পুরাণ ভাগবতের অর্থাৎ দেবীভাগবতের উল্লেখ পাচ্ছি কিন্তু শ্রীমদ্ভাগবতে উল্লেখিত অষ্টম পুরাণ ভাগবতের উল্লেখই নাই। অতঃ পুরাণের লিস্ট অনুযায়ীই শ্রীমদ্ভাগবত পুরাণ অষ্টাদশ মহাপুরাণের লিস্টেই নাই তাই এটা নিয়ে আর কিছু বলতে হবে বলে মনে হচ্ছে না।
4. শ্রীকৃষ্ণ গীতার দ্বিতীয় অধ্যায় ও নবম অধ্যায় তো দূরের কথা, গীতার কোথাওই বেদ পড়তে নিষেধ করেননি। দ্বিতীয় অধ্যায়ের কিছু শ্লোক নিয়ে অনেকে ভ্রান্তধারণা পোষণ করে যা ঠিক নয়। সেই শ্লোকগুলো নিয়ে আমাদের এই ব্লগেই আর্টিকেল আপলোড করা হয়েছে, লিংক ক্লিক করে দেখে নিতে পারেন-
https://aryapsbd.blogspot.com/2023/06/blog-post_5.html
আমরা পরবর্তী ভিভিওতে দেখি কি বলেন ইসকন প্রভুজী -
ইসকন কেন বেদ পাঠ করেন না সেই প্রশ্নের জবাবে, বিভিন্ন কারণ উল্লেখ করেছেন। ভিডিওতে অনেক কিছুই ভুল প্রচার করেছেন তিনি কিছুমাত্র উল্লেখ করছি। বেদ পাঠ না করার প্রথম কারণ বলেছেন–
1. বেদের বিশাল সম্ভার
জবাব : চার বেদে মোট- ২০৩৭৯টি মন্ত্র রয়েছে। আর অষ্টাদশ মহাপুরাণের শ্লোকসংখ্যা–
- ১/ মৎস্য পুরাণ - ১৪,০০০
- ২/ মার্কেণ্ডয় পুরাণ - ৯০০০
- ৩/ ভবিষ্য পুরাণ - ১৪,৫০০
- ৪/ভাগবত পুরাণ - ১৮,০০০
- ৫/ ব্রহ্মপুরাণ - ১০,০০০
- ৬/ ব্রহ্মাণ্ড পুরাণ - ১২,১০০
- ৭/ ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণ - ১৮,০০০
- ৮/বামন পুরাণ -১০,০০০
- ৯/ বায়ু পুরাণ - ২৪,৬০০
- ১০/ বিষ্ণু পুরাণ -২৩,০০০
- ১১/ বারাহ পুরাণ - ২৪,০০০
- ১২/ অগ্নি পুরাণ -১৬,০০০
- ১৩/ নারদ পুরাণ- ২৫,০০০
- ১৪/ পদ্মপুরাণ - ৫৫,০০০
- ১৫/ লিঙ্গপুরাণ - ১১,০০০
- ১৬/ গরুড় পুরাণ - ১৯,০০০
- ১৭/ কুর্ম পুরাণ - ১৭,০০০
- ১৮/ স্কন্দ পুরাণ - ৮১,০০০