ইসকনের অশাস্ত্রীয়তা

প্রিয়রত্ন বিদ্যার্থী
0

ইসকনের অশাস্ত্রীয়তা


যদি বৈদিক দৃষ্টিতে দেখা হয় তাহলে ইসকন প্রায় সম্পূর্ণতই অশাস্ত্রীয় কেননা তারা যা আধার করে নিয়মাদি পালন ও প্রচারাদি করে তা অবৈদিক। তবে এই আর্টিকেলে সম্পূর্ণ অবৈদিক বলেই সীমাবদ্ধ না থেকে কিছু প্রমাণ উপস্থাপন করবো যা দ্বারা সামান্য হলেও সকলের নিকট পরিষ্কার হবে যে ইসকন অশাস্ত্রীয় প্রচার করে কিনা। 

যেহেতু "বেদোऽখিলো ধর্মমূলম্" (মনু০২/৬) বেদ সকল ধর্মের মূল, তাই বেদ দিয়েই শুরু করি। প্রথমে দেখি বেদ মন্ত্রসংখ্যা কত সেই সম্পর্কে তারা কি জানে এবং প্রচার করে-


 প্রভু জী প্রচার করতেছেন যে - বেদে একশতকোটি শ্লোক রয়েছে। আদৌ কি তা সঠিক? ইস্কন সদস্যরা বেদ ও বৈদিক শাস্ত্র না পড়েই মনগড়া প্রচার করেন যার প্রকৃষ্ট উদাহরণ এই ভিডিওটি।  প্রথমত বেদে কোন শ্লোক নেই, বেদে রয়েছে মন্ত্র। মন্ত্র এবং শ্লোক এক নয়।

দ্বিতীয়ত বেদে একশতকোটি মন্ত্র নেই। তাহলে কয়টি আছে?

বেদের মন্ত্রসংখ্যা হলো– ঋগ্বেদ - ১০,৫৫২, যজুর্বেদ - ১৯৭৫, সামবেদ - ১৮৭৫, অথর্ববেদ - ৫,৯৭৭

সবগুলো যোগ করলে - ১০,৫৫২+১৯৭৫+১৮৭৫+৫,৯৭৭ = ২০৩৭৯ হয়।  

সুতরাং বেদে ২০৩৭৯ টি মন্ত্র রয়েছে। 

ইসকন প্রভুর বলা বেদে একশতকোটি শ্লোক রয়েছে তা সঠিক নয়। আরেকজন প্রভু বলতেছেন যে-

বেদ প্রথমে একটিই ছিলো, পরবর্তীতে ব্যাসদেব চারভাগে বিভক্ত করেছেন। এই বক্তব্য সরাসরি বেদের বিরুদ্ধে। বেদেই বলা হয়েছে যে- 


তস্মাদ্ যজ্ঞাৎ সবর্বহুত ঋচঃ সামানি জজ্ঞিরে।                      

ছন্দাংসি জজ্ঞিরে তস্মাদ্যজুস্তস্মাদজায়ত।।              

(ঋগ্বেদ - ১০/৯০/৯, যজুর্বেদ-৩১/৭, অথর্ববেদ-১৯/৬/১৩)

পদার্থঃ- (তস্মাৎ সর্বহুতঃ যজ্ঞাৎ) সেই সর্বহুত সঙ্গমনীয় পরমাত্মা হইতে (ঋচঃ সামানি জজ্ঞিরে) ঋগ্বেদের মন্ত্র, সামবেদের মন্ত্র উৎপন্ন হয়েছে (তস্মাৎ ছন্দাংসি জজ্ঞিরে) তাঁহার হইতে অথর্বেদের মন্ত্র উৎপন্ন হয়েছে (তস্মাৎ যজু অজায়ত) সেই পরমাত্মা হইতেই যজুর্বেদ উৎপন্ন হয়েছে।

ভাবার্থঃ- পরমাত্মা - ঋগ্বেদ, যজুর্বেদ, সামবেদ এবং অথর্ববেদ উৎপন্ন করেছেন।

এই মন্ত্রে বলা হয়েছে পরমাত্মা হইতেই চারটি বেদ উৎপন্ন হয়েছে। এমন আরো প্রমাণ দেওয়া যাবে। যেখানে বেদে চার বেদের নাম উল্লেখ আছে এবং সেই চার বেদ পরমাত্মা হইতে প্রকাশিত হয়েছে বলা আছে তারপরেও ইসকন প্রভু কিভাবে বলেন যে বেদ একটি ছিলো আর তা ব্যাসদেব চারভাগে বিভক্ত করেছেন? এর স্বপক্ষে তিনি যে প্রমাণই দেখান না কেন তা বেদের বিরুদ্ধ প্রমাণিত হবে।  আর শাস্ত্রে বলা হয়েছে- "ধর্ম্মং জিজ্ঞাসমানানাং প্রমাণং পরমং শ্রুতিঃ" (মনু০ ২/১৩)।  ধর্ম জানার ইচ্ছে করে তার জন্য পরম প্রমাণ পবিত্র বেদ।  আরোও বলা হয়েছে - 


উৎপদ্যন্তে চ্যবন্তে চ যান্যতোহন্যানি কানিচিৎ।            

তান্যর্বাক্কালিকত্যা নিষ্ফলান্যনৃতানি চ।। (মনুস্মৃতি- ১২/৯৬)

অনুবাদঃ- এই সমস্ত বেদ বিরুদ্ধ গ্রন্থ যাহা রচিত হইতেছে, সে সমস্ত আধুনিক বলিয়া শীঘ্র নষ্ট হইয়া যায়, এ-সকল গ্রন্থ মান্য করা নিষ্ফল ও মিথ্যা।

পুরাণের অন্তর্গত দেবী গীতায়ও বলা হয়েছে-

অন্যেষাং শাস্ত্রকর্ত্তৃণামজ্ঞানপ্রভবত্বতঃ।

অজ্ঞানদোষদুষ্টত্বাত্তদুক্তে ন প্রমাণতা।             

তস্মান্মুমুক্ষুর্ধর্ম্মার্থং সর্ব্বদা বেদমাশ্রয়েৎ।।  

(দেবী গীতা-৯/১৯)

অনুবাদঃ- বেদ ভিন্ন অন্ন শাস্ত্রকর্ত্তৃদিগের বাক্য অজ্ঞান সম্ভূত, সুতরাং তাহাতে অজ্ঞানদোষ বর্ত্তমান আছে, অতএব তাহার প্রামাণ্য হইতে পারে না। এই কারণে মুমুক্ষু ব্যক্তি ধর্ম্মজ্ঞানের নিমিত্ত সর্ব্বদা বেদকেই আশ্র‍য় করিবেন।

অতএব ইসকন প্রভু ভুল প্রচার করেছেন তা প্রমাণিত হয়েছে এবং প্রমাণিতই থাকবে। আরো একটি ভিডওতে দেখা যায় যে- 


ইসকন প্রভু বলতেছেন- বেদ আদি গ্রন্থ, প্রধান নয়, কোন গ্রন্থে নাকি প্রধান বলা হয়নি বেদকে। কিছু শাস্ত্রব্যক্য উপস্থিত করছি- 

  • বেদশাস্ত্রং সনাতনম্ (মনু০১২/৯৯) বেদ সনাতন শাস্ত্র, নিত্য শাস্ত্র, সর্বদা প্রয়োজনীয় শাস্ত্র।
  • নাস্তি বেদাৎ পরং শাস্ত্রং (অত্রিস্মৃতি- ১৪৯) বেদ হইতে উৎকৃষ্ট শাস্ত্র নেই, অর্থাৎ বেদই প্রধান বেদই শ্রেষ্ঠ। 
  • বেদোক্তঃ পরমো ধর্মঃ (মহা০,অনুশাসনপর্ব -১৪১/৬৫) প্রথমেই বেদোক্ত ধর্ম, যা সব থেকে উৎকৃষ্ট (শ্রেষ্ঠ)।
  • বেদঃ অখিলঃ ধর্মমূলম্ (মনু০-২/৬) বেদ সব ধর্মের মূল।

সনাতন ধর্মের সনাতন শাস্ত্রকেই প্রভুজী প্রধান বলে মানছেন না। আবার তিনি প্রচারও করতেছেন যে বেদকে কোন শাস্ত্রে প্রধান বলা হয়নি।  উপরোক্ত প্রমাণ দ্বারা কি সিদ্ধ হয়নি যে তিনি শাস্ত্রবিরোধী প্রচার করতেছেন?  আর এরূপ অসংখ্য প্রমাণ দেওয়া যাবে। আমরা অন্য একটি ভিডিও দেখার চেষ্টা করি - 


প্রভুজীর নিকট কেহ একজন প্রশ্ন করেছে যে- বেদ হলো হিন্দুদের প্রধান আদি গ্রন্থ। যদি বেদই আদিগ্রন্থ হয় তাহলে ধর্মীয় অনুষ্ঠানে বেদ পাঠ নয়, গীতা পাঠ করা হয় কেন?

ইসকন প্রভু উত্তর প্রদানের সময় বিবিধ কথার মধ্যে এও বলেন যে- 

  1. নারদ মুনি বেদ পড়তে নিষেধ করেছেন। 
  2. বেদের সারাংশ গীতা। 
  3. বেদ রচনাকারী ব্যাসদেব, বেদ রচনা করে মনে শান্তিপাননি, তাই বেদ পড়লে আমাদের ভিতরেও অনেক সন্দেহ হয়। তাই নারদমুনি গীতা ভাগবত লিখতে নির্দেশ দিয়েছেন। 
  4. ভগবান্ শ্রীকৃষ্ণ গীতার দ্বিতীয় অধ্যায় এবং নবম অধ্যায়ে বেদ পড়তে নিষেধ করেছেন। ..............।

1.মহাভারতে পড়লে জানা যায় যে নারদ মুনি বেদের প্রতি খুবই একনিষ্ঠ ছিলেন, তিনি বেদ পড়তে নিষেধ তো দূরের কথন বরং বলেছেন – 


যে বেদং প্রাপ্য দুর্ধর্ষা বাগ্মিনো ব্রহ্মচারিণঃ ।          

যাজনাধ্যাপনে যুক্তা নিত্যং তান্ পূজয়াম্যহম্ ॥ 

(মহা০ অনু০ ৩১/১৩)

অনুবাদ : যে বেদ অধ্যয়ন করে দুর্ধর্ষ এবং কথা বলায় কুশল হয়ে গেছে, ব্রহ্মচর্য পালন করে এবং যজ্ঞ করাতে তথা বেদ পড়ানোর কার্যে রত থাকে, আমি তাকে সদা পূজা করি। 

2. গীতা বেদের সারাংশ নয়। বেদে ভৌতিক বিদ্যা এবং আধ্যাত্মিক বিদ্যার বিবিধ বিষয়ের জ্ঞান আছে যার সাথে গীতার তুলনা করে গীতাকে মহান বানানো হয়না বরং তুচ্ছ করা হয়। গীতা আদরণীয় গ্রন্থ গীতার স্থানে, এর জন্য বেদের সাথে তুলনা করতে হয়না।  

3. বেদ রচনা করে ব্যাসদেব শান্তিপাননি তাই নারদ মুনির উপদেশে গীতা ভাগবত লিখেছে এটি নিছক কল্পনা মাত্র। গীতা মহাভারতের অংশ। শুকদেবজী পরিক্ষিতজীর ইতিহাস দেখলেও ভাগবতের বিষয়টা পরিষ্কার বুঝা যায় কিন্তু সেই বিস্তৃত বিষয়ে না গিয়ে এটা প্রমাণ করবো যে, তিনি যে শ্রীমদ্ভাগবত পুরাণের কথা বলছেন, সেই ভাগবতের উল্লেখই অন্যান্য পুরাণে উল্লেখিত অষ্টাদশ মহা পুরাণের  লিস্টে নাই। শ্রীমদ্-দেবীভাগবত নামে যে ভাগবত পুরাণ আছে তাতে বলা হয়েছে- 

                       দেবীভাগবত, পূর্বার্ধ-১/১/১৬

ভাগবত পুরান পঞ্চম পুরাণ। আর এখানে ভাগবত বলতে দেবীভাগবতকে বুঝানো হয়েছে। অপরদিকে স্বয়ম্ শ্রীমদ্ভাগবত পুরাণে – 


স্বয়মকে অষ্টম পুরাণ হিসেবে উল্লেখ করেছে। সেই অনুযায়ী যদি অন্যান্য পুরাণে উল্লেখিত লিস্ট দেখি - 

                            কূর্মপুরাণ-১/১৩-১৫

(কূর্মপুরাণ অধ্যায় ১ শ্লোক ১৩, ১৪, ১৫) –  ১.ব্রহ্ম, ২.পদ্ম, ৩.বিষ্ণু, ৪.শিব, ৫.ভাগবত, ৬.ভবিষ্য, ৭.নারদ, ৮.মার্কণ্ডেয়, ৯.অগ্নি, ১০. ব্রহ্মবৈবর্ত্ত, ১১.লিঙ্গ, ১২.বারাহ, ১৩.স্কন্দ, ১৪.বামন, ১৫.কূর্ম, ১৬.মৎস্য, ১৭ গরুড, ১৮ বায়ু ।

          লিঙ্গপুরাণ, পূর্বার্দ্ধ -৩৯/৬১,৬২,৬৩

(লিঙ্গপুরাণ, পূর্বার্দ্ধ -৩৯/৬১,৬২,৬৩ এবং মার্কণ্ডেয়পুরাণের মাহাত্ম্য)– ১.ব্রহ্ম (২) পদ্ম, (৩) বিষ্ণু, (৪) শিব, (৫) ভাগবত, (৬) নারদ, ( ৭ ) মার্কণ্ডেয়, (৮) অগ্নি, (৯) ভবিষ্য, (১০) ব্রহ্মবৈবর্ত, (১১) লিঙ্গ, (১২) বারাহ, (১৩) স্কন্দ, (১৪) বামন, (১৫) কূর্ম, (১৬) মৎস্য, (১৭) গরুড়, (১৮) ব্রহ্মাণ্ড ।

      শিবপুরাণ বায়ুসংহিতা [অ০] ১ শ্লোক ৩৮-৩৯-৪০

(শিবপুরাণ বায়ুসংহিতা [অ০] ১ শ্লোক ৩৮-৩৯-৪০)– (১) ব্রাহ্ম, (২) পদ্ম, (৩) বিষ্ণু, (৪) শিব, (৫) ভাগবত, (৬)ভবিষ্য, (৭)নারদীয়, (৮) মার্কণ্ডেয়, (৯) অগ্নি, (১০) ব্রহ্মবৈবর্ত, (১১) লিঙ্গ, (১২) বারাহ, (১৩) স্কন্দ, (১৪) বামন, (১৫) কূর্ম, (১৬) মৎস্য, (১৭) গরুড়, (১৮) ব্রহ্মাণ্ড ।

পঞ্চম পুরাণ ভাগবতের অর্থাৎ দেবীভাগবতের উল্লেখ পাচ্ছি কিন্তু শ্রীমদ্ভাগবতে উল্লেখিত অষ্টম পুরাণ ভাগবতের উল্লেখই নাই। অতঃ পুরাণের লিস্ট অনুযায়ীই শ্রীমদ্ভাগবত পুরাণ অষ্টাদশ মহাপুরাণের লিস্টেই নাই তাই এটা নিয়ে আর কিছু বলতে হবে বলে মনে হচ্ছে না।

4. শ্রীকৃষ্ণ গীতার দ্বিতীয় অধ্যায় ও নবম অধ্যায় তো দূরের কথা, গীতার কোথাওই বেদ পড়তে নিষেধ করেননি। দ্বিতীয় অধ্যায়ের কিছু শ্লোক নিয়ে অনেকে ভ্রান্তধারণা পোষণ করে যা ঠিক নয়। সেই শ্লোকগুলো নিয়ে আমাদের এই ব্লগেই  আর্টিকেল আপলোড করা হয়েছে, লিংক ক্লিক করে দেখে নিতে পারেন-

  https://aryapsbd.blogspot.com/2023/06/blog-post_5.html 

আমরা পরবর্তী ভিভিওতে দেখি কি বলেন ইসকন প্রভুজী -

ইসকন কেন বেদ পাঠ করেন না সেই প্রশ্নের জবাবে, বিভিন্ন কারণ উল্লেখ করেছেন। ভিডিওতে অনেক কিছুই ভুল প্রচার করেছেন তিনি কিছুমাত্র উল্লেখ করছি। বেদ পাঠ না করার প্রথম কারণ বলেছেন–

1. বেদের বিশাল সম্ভার 

জবাব : চার বেদে মোট- ২০৩৭৯টি মন্ত্র রয়েছে। আর অষ্টাদশ মহাপুরাণের শ্লোকসংখ্যা– 


                       দেবীভাগবত,পূর্বার্ধ-১/৩/৩-১২

দেবীভাগবত অনুযায়ী - 
  • ১/ মৎস্য পুরাণ - ১৪,০০০
  • ২/ মার্কেণ্ডয় পুরাণ - ৯০০০
  • ৩/ ভবিষ্য পুরাণ - ১৪,৫০০
  • ৪/ভাগবত পুরাণ - ১৮,০০০
  • ৫/ ব্রহ্মপুরাণ - ১০,০০০
  • ৬/ ব্রহ্মাণ্ড পুরাণ - ১২,১০০
  • ৭/ ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণ - ১৮,০০০
  • ৮/বামন পুরাণ -১০,০০০
  • ৯/ বায়ু পুরাণ - ২৪,৬০০
  • ১০/ বিষ্ণু পুরাণ -২৩,০০০
  • ১১/ বারাহ পুরাণ - ২৪,০০০
  • ১২/ অগ্নি পুরাণ -১৬,০০০
  • ১৩/ নারদ পুরাণ- ২৫,০০০
  • ১৪/ পদ্মপুরাণ - ৫৫,০০০
  • ১৫/ লিঙ্গপুরাণ - ১১,০০০
  • ১৬/ গরুড় পুরাণ - ১৯,০০০
  • ১৭/ কুর্ম পুরাণ - ১৭,০০০
  • ১৮/ স্কন্দ পুরাণ - ৮১,০০০
সব মিলিয়ে মোট - 401,200 (চারলক্ষ একহাজার দুইশত) 

শ্রীমদ্ভাগবত পুরাণ অনুযায়ী - 

                          শ্রীমদ্ভাগবত-১২/১৩/৪-৯
অষ্টাদশ মহাপুরাণের শ্লোকসংখ্যা ৪,০০০০০ (চার লক্ষ)  অতঃ প্রভুর বলা এই কারণ নিতান্তই শিশুসুলভ ও মিথ্যা।

2. তিনি বেদের পরিচয় দিতে গিয়ে বলেন - বেদের প্রত্যেকটা শ্লোককে বলা হয় একটি করে মন্ত্র, বেশ কয়েকটি মন্ত্র মিলে তৈরি হয় সূক্ত, যেমন পুরুষ সূক্ত মন্ত্র, আবার কিছু সূক্ত মিলে তৈরি হয় সংহিতা, যেমন মনুসংহিতা। শ্রীল ব্যাসদেব বেদকে ৪টি ভাগে ভাগ করেছেন। 

জবাব :  বেদের শ্লোককে বলা হয়না বরং বেদে মন্ত্রই রয়েছে। বেশ কয়েকটি মন্ত্র মিলে সব বেদেই সূক্ত হয়না যেমন যজুর্বেদে ৪০টি অধ্যায় আছে কিন্তু কোন সূক্ত নাই। যজুর্বেদেও পুরুষ অধ্যায় আছে। কিছু সূক্ত মিলে মনু সংহিতা আদি হয়না, এই কথন একদমই অজ্ঞানতার পরিচায়ক। বেদ অপৌরুষেয় আর মনুস্মৃতি পৌরুষেয়। এই স্মৃতি শ্রুতি নিয়ে আপনারা জানেন আশা করি তাই আর বিস্তারিত লিখছিনা।

3. শ্রীল ব্যাসদেব বেদের সার হিসেবে বেদান্তসূত্র রচনা করেছিলেন, এর ব্যাখ্যান টীকা দিয়েছেন ভাগবত নামে। এছাড়াও অন্য অনেক ঋষি এর টীকা দিয়েছেন। যেমন - গৌতম মুনির টীকার নাম ন্যায়দর্শন, কণাদমুনির টীকার নাম বৈশেষিক দর্শন, নাস্তিক কপিলের দেওয়া টীকার নাম সাংখ্যদর্শন, জৈমিনি মুনির দেওয়া টীকার নাম পূর্বমীমাংসা, পতঞ্জলি মুনি দিয়েছেন যোগদর্শন। আর ভাগবত ছাড়া বাকি পাঁচটি টীকা নাস্তিক্যভাবের দ্বারা প্রভাবিত। 

জবাব:  বেদান্তদর্শন বা ব্রহ্মসূত্র বেদের সার  নয়, সারহিসেবে লিখেছেন এরূপ বেদব্যাসজী কোথাও বলেননি আর ভাগবত ব্রহ্মসূত্রের ব্যাখ্যানও নয়। দুটো আলাদা আলাদা।এই হাস্যকর কথন নিয়ে কিছু লিখার প্রয়োজনবোধ হচ্ছেন কেননা আপনারা স্বয়ম্ বুঝতে পারবেন সামান্য এই বিষয়টি। ন্যায় আদি পাঁচটি দর্শনও বেদান্তদর্শনের টীকা নয় প্রত্যেকটির নিজস্বতা আছে। ছয়টি দর্শন, সৃষ্টির ছয়টি কারণের ব্যাখ্যান করে, আর তা হলো - কর্ম, কাল, উপাদান, পুরুষার্থ, তত্ত্বসমূহের পরস্পর সংযোগ এবং ব্রহ্ম অর্থাৎ নিমিত্তকারণভূত কর্ত্তা।  তারপর তিনি সাংখ্যদর্শন প্রণেতাকে কপিল মুনিকে সরাসরি নাস্তিক এবং বাকি চার দর্শণ প্রণেতাকে পরোক্ষভাবে নাস্তিক বলেছেন যা সম্পূর্ণ মিথ্যা। 

সাংখ্যদর্শন 
সাংখ্য দর্শনে কপিল মুনি বলেছেন—


“শ্রুতি বিরোধাত্র কুতর্কাপসদস্যাত্মলাভঃ।”(৬/৩৪)

অর্থঃ-  যে ব্যক্তি, শ্রুতি [বেদ] বিরোধী হয়ে আত্মা সম্পর্কে কুতর্কে জরিত হয়, তাহার কোনপ্রকার আত্মজ্ঞান হয় না। 

মহাভারত, শান্তিপর্ব-১২/৫ শ্লোকে বেদবিরোধীকে নাস্তিক বলা হয়েছে। এখানে কপিল মুনিও তাহাই বলে বুঝাচ্ছেন বেদের বিরোধ না করতে, তারপরেও তিনি কিভাবে নাস্তিক? কপিল মুনি আরোও বলেন -

“ন পৌরুষেয়ত্বং তত্কর্তুঃ পুরুষস্যাভাবাত্।”(৫/৪৬) সাংখ্যদর্শনের এই সূত্রেও বলা হয়েছে বেদের কর্ত্তা কোন পুরুষ নয় অর্থাৎ বেদ অপৌরুষেয়। আরও ভিবিন্ন সূত্রে বেদের মহত্ত্ব সম্পর্কে তিনি বলেছেন। যেমন -

নিজশক্ত্যভিব্যক্তেঃ স্বতঃ প্রামাণ্যম্।। (সাংখ্যদর্শন - ৫/৫১) 

অনুবাদঃ- নিজ শক্তিদ্বারা অভিব্যক্ত হওয়ার কারণে বেদ স্বতঃ প্রামাণ্য। আরো বলেন - 


"স হি সর্ববিৎ সর্বকর্ত্তা" (৩/৫৬)

সরলার্থ-ঈশ্বর সর্বজ্ঞ, সর্বব্যাপক, সর্বশক্তিমান, এক রস ও অমূর্ত্ত বলিয়া সমস্তই তাঁহার অধীনে রাখিতে পারেন। তিনিই সৃষ্টির একমাত্র কর্তা। জ্ঞানই কর্তৃত্বের মূল। তিনি সর্বজ্ঞ বলিয়া সমগ্র সৃষ্টির একমাত্র নিরপেক্ষ কর্তা।

সং-ঈশ্বরের সর্ব কর্তৃত্ব সিদ্ধির আরও প্রমাণ দিতেছেন।- "ইদৃশেশ্বরসিদ্ধিঃ সিদ্ধা" (৩/৫৭) 

সরলার্থ-যিনি সর্বব্যাপক অমূর্ত্ত, সর্বজ্ঞ, সর্বশক্তিমান, একরস, নিত্যমুক্ত ও আনন্দস্বরূপ তিনিই সৃষ্টিকর্তা হইতে পারেন। সৃষ্টির রচনাকৌশল ও পরিচালন ব্যবস্থা দেখিয়া বিচারের দ্বারা এইরূপ ঈশ্বরই সিদ্ধ হইয়া থাকে এবং বেদাদি শাস্ত্রেও সর্বত্র এইরূপ ঈশ্বরেরই সিদ্ধি পাওয়া যায়।
সাংখ্যদর্শন সম্পূর্ণই আস্তিকদর্শন, তাই এক্ষেত্রে সম্পূর্ণই পড়ে দেখতে পারেন। 

বৈশেষিক তথা ঈশ্বর

"তদ্ বচনাদাম্নায়স্য প্রামাণ্যম্" (১/১/৩)
এই সূত্র দ্বারা- পরমেশ্বরের বচন হওয়াতে আম্নায় অর্থাৎ বেদ কে প্রামাণিকতার প্রতিপাদন বলেছেন।

"আর্ষং সিদ্ধদর্শনং চ ধর্মেভ্যঃ" (৯/২/১৩)
আর্ষজ্ঞান তথা পরমাত্মার দর্শন ধর্ম দ্বারা হয়। 

আর একটি সূত্রে বলা হয়েছে-
“বুদ্ধিপূর্বা বাক্যকৃতির্বেদে”(৬/১/১)
অর্থাৎ বেদ বাক্য রচনা বুদ্ধিপূর্বক। এখানে সৃষ্টিক্রম বিরুদ্ধ কোনো কথা নেই।অতএব ইহা ঈশ্বরীয় জ্ঞান।

যোগদর্শন 


"ঈশ্বরপ্রণিধানাদ্ধা" (১/২৩)

শব্দার্থ- (ঈশ্বর-প্রণিধানাহ্) ঈশ্বরপ্রণিধান দ্বারা (বা) আরও শীঘ্র সমাধি এবং সমাধি ফলের প্রাপ্তি হয়।

"ক্লেশকর্মবিপাকাশয়ৈরপরামৃষ্টঃ পুরুষবিশেষ ঈশ্বরঃ" (১/২৪)

শব্দার্থ (ক্লেশ-কর্ম-বিপাক-আশয়েঃ) অবিদ্যা ইত্যাদি পাঁচটি ক্লেশ, শুভ- অশুভ এবং মিশ্রিত কর্ম, সুখ-দুঃখ রূপী ফল, সুখ-দুঃখ ভোগের সংস্কার; এই সকল হতে (অপরামৃষ্টঃ) সম্বন্ধ রহিত (পুরুষবিশেষঃ) জীব হতে ভিন্ন স্বভাব যুক্ত চেতন বিশেষ (ঈশ্বরঃ) ঈশ্বর।

ন্যায়দর্শন 

"তৎ কারিতত্বাদহেতুঃ" (৪/১/২১)

এটা ঠিক যে কর্ম ব্যতিরেক পরমাত্মা ফল দেন না, কিন্তু কর্মকারী জীবের উপর ঈশ্বর অনুগ্রহ করেন। এখানে অনুগ্রহ বা দয়ার অর্থ - "যদ্যথা ভূতং যস্য চ যদা বিপাককালস্তত্তথা তদা বিনিয়ুক্তম"
অর্থাৎ যে কর্ম যেমন এবং যার যখন বিপাক কাল হয়, তাহার ফল কর্মানুসারে সেই সময়ই দেওয়া, ইহাই ঈশ্বরের অনুগ্রহ বা দয়া।

মীমাংসা দর্শন

"চোদনালক্ষণোহর্থো ধর্মঃ" (১/১/২)
অর্থাৎ যে কর্ম বেদ বিহিত তাহাই ধর্ম আর যা বেদ বিরোধী তাকে অধর্ম বলা হয়।   যিনি বেদকে পরম প্রমাণ মানেন এবং বিবিধ সূত্রে ঈশ্বরের উল্লেখ করেছেন এবং ব্যাসদেবের শিষ্য তিনাকে নাস্তিক বলা কতটা ঠিক স্বয়ম্ বিচার করুন। 

তারপর তিনি একেক দর্শনে একেক বিষয়কে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে, ঈশ্বরকে দেওয়া হয়নি বলে আক্ষেপ করেছেন। এই বিষয়ে সত্যার্থ প্রকাশ থেকে সৃষ্টি ও দর্শন বিষয়ক লিখনীর পেইজ উল্লেখ করে দিচ্ছি আশা করি তাতেই বুঝে যাবেন – 

এখানে আমি বলতে চাই যে-  আমাদের বাংলাদেশের বিদ্যালয়ে বিভিন্ন বিষয়ে বিভিন্ন শিক্ষক পারদর্শী এবং এক এক বিষয়ের দায়িত্বে থাকেন। এমতাবস্থায় উপরের ক্লাসে দেখা যায় ইংরেজী বিষয়ের শিক্ষক ইংরেজী বেশি বলে, বাংলা খুবই কম।  এর মানে কি ঐ শিক্ষক বাংলা ভাষার বিরোধী বা বিরোধ করার ভাব আছে? কখনোই না, তাইতো।  কারণ ক্লাসে তিনার বিষয়ই হলো ইংরেজী।  অনুরূপ ষড় দর্শন তো তাহাই। যে দর্শনকার যে বিষয় নিয়ে লিখেছেন সেই বিষয়কেই বেশি উল্লেখ করেছেন চর্চা করেছেন। 

4.গীতার "শ্রুতিবিপ্রতিপন্না" শব্দের উদ্ধৃতি দিয়ে বলেন যে- বেদ পড়লে নাস্তিক হয়ে যেতে পারেন , সকাম কর্মে আবদ্ধ হয়ে যেতে পারেন, যার জন্য মুক্তিলাভ হবেনা বা হয়না। 

জবাব : গীতা-২/৫৩ শ্লোকে উল্লেখিত "শ্রতিবিপ্রতিপন্না" বলতে বুঝানো হয়েছে –  শ্রবণের দ্বারা বিক্ষিপ্ত ভাব। সাধক সঞ্জীবনী ভাষ্য থেকে এর ব্যাখ্যান দেখে নিতে পারেন -


শ্রুত্বা ধর্মং বিজানাতি।। (চাণক্যনীতি-৬/১) 
অর্থাৎ মনুষ্য বেদাদি শাস্ত্রকে শ্রবণ করে ধর্মের রহস্য সম্পর্কে জ্ঞাত হয়। বেদ পড়ে সকাম কর্মে আবদ্ধ হয়না বরং বেদ না পড়ে কুসংস্কারে আবদ্ধ হয়। বেদ হলো জ্ঞান বিজ্ঞানের সাগর, আর মহাভারতে বলা হয়েছে– ন বিনা জ্ঞান-বিজ্ঞানে মোক্ষস্যাধিগমো ভবেত্।। (মহা০, শান্তি০-৩২৬/২২) অর্থাৎ জ্ঞান-বিজ্ঞান ছাড়া মোক্ষ প্রাপ্তি হয় না।।  

বেদ ছাড়া মুক্তিলাভ অসম্ভব, এর বিস্তারিত জবাব গীতা-২/৪২-৪৫ শ্লোক নিয়ে উপরে যে লিংক দেওয়া হয়েছে সেই লিখনী পড়লেও পাবেন। আর তিনি ভিডিওতে আরো অনেক অশাস্ত্রীয় কথন করেছে স্বয়ম্ দেখে নিবেন। এইবার অন্য আরেকজনের ভিডিও দেখা যাক – 

এই ইসকন প্রভু তো বলছেন তিনি বেদ মানেনই না অথচ নিজেকে বৈষ্ণব বলে পরিচয় দেয়। যে পুরাণের অনুগামী বলে বেদ অমান্যতা করছেন সেই পুরাণে বলা হয়েছে– 


স্কন্দ পুরাণ বিষ্ণুখণ্ডে বেঙ্কটাচলযাহাত্ম্য-৬/৫৫-৫৭

যাঁহারা বেদপাঠনিরত হইয়া বৈদিক কর্ম্মের আচরণ করেন, যাঁহারা সত্য কথা কহেন, কদাচ অপরের অসূয়া করেন না, পরনিন্দা বা পরধন হরণ করেন না, পরনারী সুরূপা হইলেও কদাচ স্মরণ, দর্শন বা স্পর্শ করে না, তাহাদিগকেই বৈঞ্চব বলিয়া জানিবেন।  

পুরাণের এই শ্লোকদ্বয় অনুযায়ী তারা তো বৈষ্ণবই নয়। এ নিয়ে আরো প্রমাণ দেওয়া যাবে। আজ এই পর্যন্তই, পরবর্তী পর্বে ইসকনের অশাস্ত্রীয়তার আরো তথ্য উপস্থাপন করার চেষ্টা করবো।

ইতি 


Post a Comment

0Comments

Please Select Embedded Mode To show the Comment System.*