বৈদিক অভিবাদন “নমস্তে”! |
দুর্ভাগ্যবশত যেখানে নিজেদের প্রাচীন গৌরবশালী “আর্য” নাম ভূলে আমরা বিভিন্ন নাম এবং সম্প্রদায়ের মায়া জালে ফেঁসে গিয়েছি সেখানে আমরা অনেক অভিবাদন সূচক শব্দ এবং বাক্য সৃষ্টি করেছি। প্রতিটি সম্প্রদায় তথা উপ-সম্প্রদায় নিজ-নিজ পৃথক অভিবাদন সূচক বাক্য তৈরি করে নিয়েছে। এগুলোর মধ্যে রাম-রাম, জয়রামজী, জয়সীতারাম, জয়শ্রীকৃষ্ণ, হরেকৃষ্ণ, জয়গুরু, রাধেরাধে, জয়গোপাল, জয়শিব, প্রণাম, দণ্ডবৎ, বন্দে, জয়হিন্দ মুখ্যতঃ অভিবাদন রূপে প্রযুক্ত (ব্যবহার) হয়। আমরা এতেও সন্তুষ্ট হতে পারিনি। বিদেশী অভিবাদনও সনাতনী তথা ভারতীয় শোভা সহর্ষে নিজের করে নিয়েছে।
আসুন জেনে নেওয়া যাক সনাতন শাস্ত্রে অভিবাদন বিষয়ে কি উল্লেখ আছে -
শিষ্ট পুরুষ উঠতে-বসতে, বলতে-চলতে যেসকল নিয়ম পালন করে থাকেন, সেটিকে লৌকিক ভাষায় “শিষ্টাচার ” বলা হয়। “অভিবাদন” এই শিষ্টাচারের এক মূখ্য ভাগ। ভগবান মনু প্রণীত ধর্মশাস্ত্র মনুস্মৃতিতে শিষ্টাচারের নিয়মের উপর অধিকতর গুরুত্ব দিয়েছেন। এর অন্তর্গত অভিবাদন এর মাহাত্ম্য এবং প্রকার নিম্ন শব্দে বর্ণন করা হয়েছে -
চত্বারি তস্য বর্ধন্তে আয়ুর্বিদ্যায়শোবলম্।। ২ /১২১
যাঁর নমন করা স্বভাব এবং যিনি নিত্য বড়দের সৎকার করেন, তাঁর আয়ু, বিদ্যা, যশ এবং বল এই চার বস্তু বৃদ্ধি হয়।
মহর্ষি দয়ানন্দ সরস্বতী জী সত্যার্থ প্রকাশ, ৩য় সমুল্লাসে এর অর্থ নিম্ন প্রকারে করেছেন- যে সর্বদা নম্র, সুশীল, এবং বৃদ্ধসেবী, তাহার আয়ু, বিদ্যা, কীর্তি এবং বল এই চারটি সর্বদা বৃদ্ধিপ্রাপ্ত হয়। আর যে ব্যক্তি এইরূপ করেনা তাহার আয়ু প্রভৃতি চারিটি বৃদ্ধি প্রাপ্ত হয় না।
এটিকে আমরা অতিরঞ্জন মনে করতে পারি, কিন্তু বিচারপূর্বক দেখা যায় তো অভিবাদন অন্যের প্রতি আদর-সৎকার এবং বিনম্রতা প্রকাশ করার এক আবশ্যক প্রকার বা উপায়। এর দ্বারা অন্যের আয়ু, বিদ্যা, যশ তথা বলদ্বারা প্রাপ্ত করা অনুভবের প্রতি আমরা আমাদের শ্রদ্ধাঞ্জলি অর্পণ করে থাকি। তাঁর আশীর্বাদ এবং সৎভাবনা দ্বারাই আমরা তাঁর এই অনুভব হতে লাভ গ্রহণ করতে পারি। তাঁর এই চিরসঞ্চিত অনুভব আমাদের ভবিষ্য জীবনে পথ প্রদর্শন করতে জ্যোতি স্তম্ভের ন্যায় কার্যকরী হয়। আমাদের পূর্বজদের অনুপম সৃষ্টি তাঁর অনুভবের সঞ্চয়ই তো। কিন্তু যিনি অবাধ্য (উশৃংখল) এবং অভিমানী, তিনি এর থেকে বঞ্চিত থাকেন। অতঃপর বিনয়পূর্বক অভিবাদনের উপর্যুক্ত উপদেশ নিরর্থক নয়। অহংকারী এবং অবাধ্য (উশৃংখল) ব্যক্তি কখনো অন্যের কৃপা-ভাজন হতে পারেন না। এমন ব্যক্তি অন্যের অনুভব এবং উপদেশ হতে বঞ্চিত থেকে জীবনে অনেক আপত্তি স্বয়ং আহবান করেন।
অভিবাদনের প্রকার বলতে গিয়ে মনু মহারাজ দ্বিতীয় অধ্যায়ের পরবর্তী শ্লোকে লিখেছেন -
২।১২২
দ্বিজ নিজের চেয়ে বড়কে নমন (অভিবাদন) করার সময় অভিবাদন সূচক শব্দের পরে “ আমি অমুক (আমার নাম অমুক)” আপনাকে নমন করি।
কিছু লোক মনে করেন যে রাম-রাম, জয়গুরু, হরেকৃষ্ণ, জয়শ্রীকৃষ্ণ আদির অর্থ সঠিক সৎকার সূচক না হোক কিন্তু এর দ্বারা অনায়াসেই অনেকবার ঈশ্বর নাম স্মরণ হয়ে যায়। যদিও এগুলোর শব্দার্থ দুটির মধ্যে একটিরও প্রয়োজন সিদ্ধি করে না - যেমন রাম, কৃষ্ণ ঈশ্বর বাচক নয় তা (মহর্ষি দয়ানন্দ সরস্বতী জী প্রণীত "সত্যার্থ প্রকাশ" এর প্রথম সমুল্লাস অধ্যায়ন করুন) অন্যত্র সিদ্ধ করা হয়েছে, তথাপি যদি এটা মেনেও নেওয়া হয় তো অভিবাদনের সময় ঈশ্বর নাম স্মরণ করার প্রয়োজনীয়তা কি? যা অপ্রাসঙ্গিক।
এইসকল অভিবাদনের , যে পর্যন্ত আমরা বুঝতে পারি, পুরাণাদি গ্রন্থে কোথাও উল্লেখ নেই। এমন প্রতীয়মান হয় যে, সম্প্রদায় ভুক্ত অশিক্ষিত সাধু-বৈরাগী দ্বারাই এগুলোর প্রচার হয়েছে। অন্যথা শিক্ষিত ব্রাহ্মণ সমাজে পরস্পরে সাক্ষাতের সময় আজও “নমষ্কার” শব্দের প্রয়োগ হয়,যা “নমস্তে” এর সমীপস্থ।
‘ও৩ম্’ এবং ‘'আর্য’ শব্দের শোভা আমাদের সমস্ত বেদ শাস্ত্র, ইতিহাস-পুরাণ ‘নমঃ’ এবং ‘নমস্তে’ শব্দ দ্বারা পরিপূর্ণ। আমরা এর প্রমাণ এবং উদাহরণ দেওয়ার পূর্বে ‘'নমস্তে’ এর সুন্দর এবং ভাবপূর্ণ শব্দার্থের উপর বিচার করি। প্রতীয়মান হয় যে আমাদের ঋষিগণ একটি শব্দেই অভিবাদনের সমস্ত গুণ কেন্দ্রীভূত করে দিয়েছেন।
“নমস্তে” শব্দ দুই ভাগে বিভক্ত করা যায় - “নমঃ + তে”। “নমঃ” পদটি অনেকার্থবাচী। কিন্তু সাধারণত এর প্রসিদ্ধ অর্থ সৎকার, শ্রদ্ধা এবং নমন অর্থাৎ নত হওয়া। “তে” শব্দের অর্থ “ তোমার জন্য / আপনার জন্য। অতঃ “নমস্তে” শব্দের অর্থ হয় “ আপনার/ তোমার জন্য নমঃ”। আসুন, এখন আমরা “নমঃ” শব্দের বিস্তৃত অর্থসমূহের উপরও বিচার এবং বিবেচন করি।
১. অমর কোষে “ নমৌ নতৌ”। ‘'নমস্” অব্যয় “নতি” অর্থাৎ কারো সামনে নত হওয়া অর্থে আসে।
২. যাস্কনিঘণ্টু ৩/৫ এ “নমস্যতি” এর অর্থ “পরিচরতি” অর্থাৎ সেবা করা, সৎকার করা অর্থে করেছেন।
৩. সিদ্ধান্ত কৌমুদীতে “ণম্” ধাতুস্তুতৌ অর্থাৎ সৎকার অর্থ করেছেন।
৪. “তত্ববোধিনী” এর টিপ্পনীতে পণ্ডিত শিবদত্ত জী লিখেছেন - “অপেকৃষ্টত্ব জ্ঞান বোধনানুকূলো ব্যপারী নমঃ পদার্থঃ” অর্থাৎ যখন মনুষ্য অন্যের সম্মুখে এমন ক্রিয়া (কার্য) করেন যার দ্বারা তিনি অন্যের চেয়ে ছোট প্রতীয়মান হন, সেই ক্রিয়া নমঃ শব্দের অর্থ। অভিব্যক্তি এই যে যখন অভিবাদনের সময় কেউ অন্যের সম্মুখে নত হয় তো তাঁর চেয়ে ছোট প্রতীয়মান হন। এই সৎকার সূচক ক্রিয়ার অর্থ “নমঃ”।
“নমঃ” এর অন্য অর্থ সাক্ষাৎকার এবং ত্যাগ। আপ্টে, সংস্কৃত কোষে “নমঃ” এর অর্থ ‘’ A Gift Present-অর্থাৎ উপহার করেছেন। এই কোষেই নমঃ এর অর্থ Sacrifice- ত্যাগও করা হয়েছে। “নমঃ” এর এই প্রকার
সৎকার, পূজা, সাক্ষাৎকার,ত্যাগ, অন্ন, বজ্র, যজ্ঞা আদি অনেক আছে। অভিবাদনের সময় এর অর্থ পূজা, সৎকার এবং আশীর্বাদই বুঝা উচিৎ। অনেকে সংশয়ে থাকেন যে বড়জনের ছোটদেরকে “নমস্তে” করা অসংগত এবং অনুচিত, উত্তর এটাই যে বড়দের দ্বারা ছোটদের প্রতি আশীর্বাদই পূজা তথা সৎকারের অভিব্যক্তি। আমরা এই সম্বন্ধে বিবাদে না পড়ে বহু প্রাচীন গ্রন্থ হতে এমন প্রমাণ প্রস্তুত করে এই শঙ্কার সমাধান করবো যেখানে ছোট-বড়, উঁচু-নিচু এবং সমমর্যাদা সম্পন্ন মনুষ্যে পরস্পরের প্রতি অভিবাদনে “নমঃ” এবং “নমস্তে” শব্দের প্রয়োগ করেছেন।
“নমঃ” এর শোভা “তে” শব্দের উপরেও এক বিবাদ আছে। কিন্তু এই বিবাদ সেই ব্যক্তিদের প্রতি ওঠানো যায়, যাদের সংস্কৃত তথা ব্যাকরণ বিষয়ে অল্পজ্ঞান আছে। তাঁরা বলেন যে “তে” পদের স্থানে “তুভ্যম্” হওয়া উচিৎ এবং যদি এখানে “তে” আদেশ হয়ে যায় তো তা কেবল পদ্যেই হয়, গদ্যে নয়। এই শঙ্কা নিরাধার এবং ব্যাকরণ বিষয়ে অল্পজ্ঞানের নির্দেশক। সিদ্ধান্ত কৌমুদীতে ভট্টো জী দীক্ষিত গদ্য এবং পদ্য, উভয়ের দৃষ্টান্ত দিয়ে এটিকে ঔচিত্য (ন্যায়সংসগত) সিদ্ধ করেছেন। সংস্কৃতের কোন বিদ্বান এই প্রকারে শঙ্কা প্রকাশ করেন না, কেবল অশিক্ষিত, অর্ধশিক্ষিত, পরম্পরাবাদী এবং গুরুবাদীদেরই এমন মত হতে পারে।
এখন “নমঃ এবং নমস্তে” এর প্রমাণ বেদাদি শাস্ত্র হতে তুলে ধরছি-
বেদ হতেঃ-
যজুর্বেদের পুরো ১৬ তম অধ্যায় “নমস্তে” “নমঃ” এবং “নমো” এর প্রয়োগ দ্বারা ভরপুর।
বাহুভ্যামুত তে নমঃ।। ১৬/১
এই মন্ত্রে রুদ্র পরমাত্মা অথবা প্রতাপী রাজার জন্য “নমস্তে” পদের প্রয়োগ হয়েছে।
এই অধ্যায়ের নিম্ন মন্ত্রে ছোট, বড়, পূর্বজ, নীচ তথা মধ্যম আদি সবার জন্য “নমঃ” পদের প্রয়োগ পাওয়া যায় -
নমো জ্যেষ্ঠায় চ কনিষ্ঠায় চ নমঃ পূর্বজায় চাপরজায় চ নমো মধ্যমায় চাপগল্ভায় চ নমো জঘন্যায় চ বধ্নায় চ।। ১৬ /৩২
যজুর্বেদের আরো কিছু মন্ত্রে “নমঃ, নমো, নমস্তে” পদের প্রয়োগ তুলে ধরা হলো-
নমস্তক্ষভ্যো রথকারেভ্যশ্চ বো নমো নমঃ কুলালেভ্যঃ কর্মরিভ্যশ্চ বো নমো নমো নিষাদেভ্যঃ কুঞ্জিষ্ঠেভ্যশ্চ। বো নমো নমঃ শ্বনিভ্যো মৃগয়ুভ্যশ্চ বো নমঃ।। ১৬/২৭
নমো বংচতে পরিবংচতে রতায়ূনাং পতয়ে নমো নমো নিষগিংণ ইষুগিংণ ইষুধিমতে তস্কারাণাং পতয়ে নমো নমঃ সৃকায়িভ্যো জিঘাং সদ্ভ্যো মুষ্ণাতাং পতয়ে নমোঽসিমদ্ভ্যো বিকৃন্তানাং পতয়ে নমঃ।। ১৩/২১
নমস্তে হরষে শোচিষে নমস্তে অস্ত্বর্চিষে।।১৭/১২
অথর্ববেদের নিম্ন মধ্যে মন্ত্রসমূহে “নমস্তে” এর প্রয়োগ আছে-
নমস্তে জায়মানায়ৈ, জাতায়া উততে নমঃ। অথর্ব ১০/১০/১
নমস্তে রুদ্র কৃণ্মঃ সহস্রক্ষায়ামর্ত্য। অথর্ব ১১/২/৩
নমস্তে প্রাণ বিদ্যুতে নমস্তে প্রাণ বর্ষতে। অথর্ব ১১/৪/২
ঋগ্বেদের নিম্ন মন্ত্র দেখুন-
নমো মহদ্ভ্যো নমো অর্ভকেভ্যঃ নমো য়ুবাভ্যো নমো। আসিনেভ্যঃ।। ঋগ্ ১/২৭/১৩
অর্থ- বড়দের জন্য, ছোটদের জন্য, যুবা এবং বৃদ্ধদের জন্য নমঃ হোক। এই মন্ত্রেও বড়,ছোট, যুবা, বৃদ্ধ সবার জন্যে “নমঃ” এর প্রয়োগ আছে।
সামবেদেরও অনেক স্থানে “নমস্তে” এর প্রয়োগ পাওয়া যায়।
নমস্তে অগ্ন ওজসে।………..ইত্যাদি।
শতপথ ব্রাহ্মণে গার্গী নিজ পতি যাজ্ঞবল্ক্যকে নমস্তে করেছেন -
সা হো বাচ-নমস্তে যাজ্ঞবল্ক্যায়।। শতপথ ১৪/৬/৫
যাজ্ঞবল্ক্য ঋষি হয়েও রাজা জনককে নমস্তে দ্বারা অভিবাদন করেন-
সহোবাচ- জনকো বৈদেহায় নমস্তে। শতপথ০
কঠোপনিষদে যমাচার্য নিজ শিষ্য নচিকেতাকে নমস্তে দ্বারা অভিবাদন করেন-
নমস্তেঽস্তু ব্রহ্মন্ স্বস্তি তেঽস্তু। কঠ ব ১ ক ০৯
রাজা জনক নিজ আসন হতে ওঠে ঋষি যাজ্ঞবল্ক্যকে নমস্তে দ্বারা অভিবাদন করেন-
জনকো হ বৈদেহঃ কুর্যাদুপাপসর্পন্নুবাচ নমস্তেঽস্তু।।
বৃ০ উপনিষদ অ০ ৪/২/১
বাল্মিকী রামায়ণেও “নমস্তে” পদ অভিবাদনে প্রয়োগ পাওয়া যায়, উদাহরণার্থ-
বিশ্বামিত্র বশিষ্ঠকে-
নমস্তেঽস্তু গমিষ্যামি মৈত্রেণেক্ষস্ব চক্ষুষা।।
বাল০ সর্গ ৫২
মাতাসীতা বৃক্ষকে-
নমস্তেঽস্তু মহাবৃক্ষ পারয়েন্মে পতিব্রতম্।।
অযো০ সর্গ ৫৫
মাতাসীতা রাক্ষসকে-
য়াঁ হরোৎসৃজ কাকুৎস্থৌ নমস্তে রাক্ষসোত্তম।।
অরণ্য০ সর্গ ০৪
বাল্মিকী রামায়ণের পরে ইতিহাসে দ্বিতীয় স্থানে আছে মহাভারত। মহাভারতেও “নমস্তে” শব্দের প্রয়োগ পর্যাপ্ত হয়েছে। সেখান থেকে কিছু তুলে ধরা হলো-
দেবযানী শুক্রাচার্যকে-
নমস্তে দেহিমামস্মৈ লোকে নান্যু পতিং বৃণে।।
আদি পর্ব অ ৮১
বিদুর দুর্যোধনকে-
য়থা তথা তেঽস্তু নমশ্চস্তু। সভাপর্ব অ ৬৩
শকুনি যুধিষ্ঠিরকে-
জ্যেষ্ঠো রাজন্ বসিষ্ঠোঽসি নমস্তে। ভরতর্ষভ।।
সভা০ অ ৬৪
দময়ন্তী পর্বতকে-
শরণ্য বহুকল্যাণ নমস্তেঽস্তু মহীধর।। বন০ অ ৬৪
নল দাসীকে-
বয় চ দেশাতিথয়ো গচ্ছ ভদ্রে নমোঽস্তু তে।
বন০ অ ৭৫
ব্যাস দেবদূতকে-
নমস্তেঽস্তু গচ্ছ তাত য়থা সুখম্।। বন০ অ ২৬
দূতগণ দুর্যোধনকে-
সর্বথা বিপ্রণষ্টাস্তে নমস্তে ভরতর্ষভ।। বিরাট০ অ ২৫
দ্বারপাল ধৃতরাষ্ট্রকে-
সংজয়োঽয়ং ভূমিপতে নমস্তে।। উদ্যোগ০ অ ৩১
সঞ্জয় ধৃতরাষ্ট্রকে-
সংজয়োঽয়ং ভূমিপতে নমস্তে প্রাপ্তোঽস্মি তত্বা
নরদেব পাণ্ডবান্।। উদ্যোগ০ অ ৩১
অর্জুন কৃষ্ণকে-
নমো নমস্তেঽস্তুসহস্র কৃত্বঃ, পুনশ্চভূয়োঽপি
নমো নমস্তে।। ভীষ্মপর্ব অ ৩৫
যুধিষ্ঠির দ্রোণাচার্যকে-
আচার্য় প্রাণিপত্যংশভ পৃচ্ছামি ত্বাং নমোঽস্তুতে।।
ভীষ্ম০ অ ৪৩
ভীম কৃষ্ণকে-
নমোঽস্তুতে শাংগর্গদাসিপাণে।। ভীষ্ম০ অ ৫৯
কৃষ্ণ ধৃতরাষ্ট্রকে-
শবেন পাণ্ডবান্ ধ্যাহি নমস্তে ভরতর্ষভ।। শল্য০ অ ৬৩
কীট ব্যাসকে-
নমস্তেঽস্তু মহাপ্রাজ্ঞ কিং করোমি প্রশাধি মাম্।।
অনু গীতাপর্ব অ ১১৮
যুধিষ্ঠির ভীষ্মকে-
য়ুধিষ্ঠিরোঽহং নৃপতে নমস্তে জাহ্ণবী সুত।।
অনুগীতা০ অ ১৬৭
ব্রাহ্মণ যুধিষ্ঠিরকে-
কুরুকার্য়াণি নমস্তে ভরতর্ষভ।। আশ্রম০ অ ১০
অর্জুন কৃষ্ণকে-
নমঃ পুরস্তাদয়ং পৃষ্ঠতস্তে নমোস্তুতে
সর্বত এব সর্ব।। গীতা - ১১/৪০
অর্থ- হে সম্পূর্ণ সংসারের স্বামী মহাদেব। কৃপা পূর্বক তুমি জীবিত শ্রদ্ধার নির্মাণ করেছো। একারণে তোমাকে নমস্তে।
পৃথিবী বরাহ ভগবান্ এর স্তুতি করার সময় বলেন-
অর্থ- শেষ নাগ রুপী শয্যার উপর, বক্ষে লক্ষ্মীকে ধারণকারী ভগবান্ কে নমস্তে, মোক্ষদায়ক ভগবান্ কে নমস্তে।
কেতকী এর ফুল, মহাদেবকে নমস্তে করেন-
শিব পু০ বিদ্দ্যেশ্বর সং০ আ ১০
অর্থ- হে নাথ! আমার জন্ম আপনার আজ্ঞায় নিষ্ফল হয়ে গিয়েছে। আপনাকে নমস্তে করছি।
ব্রহ্মা তথা বিষ্ণু, মহাদেবকে নমস্তে করেন-
নমঃ সকলনাথায়, নমস্তে সকলাত্মনে।।
শিব পু০ বিদ্দ্যেশ্বর সং০ আ ১০
অর্থ- সকলের নাথ তথা সবার আত্মা শিবের জন্য নমস্তে।
ব্রহ্মা নিজ পত্নী সাবিত্রীর চরণে পড়ে নমস্তে করেছেন-
পাদয়োঃ পতিস্তেঽহং, ক্ষম দেবি নমোঽস্তুতে।।
পদ্ম পু০ সৃ০ খ০ অ ১৭
ব্রহ্মা বললেন- হে সুব্রতে দেবি! আমি তোমার চরণে পতিত হচ্ছি, ক্ষমা করো আমি আর দ্বিতীয়বার অপরাধ করবো না, তোমাকে নমস্তে।
দেবী ভাগবতেও নমস্তে শব্দের প্রয়োগ পাওয়া যায়-
জগত্তারিণী ত্রাহি দূর্গে নমস্তে।।
দূর্গা সপ্তশতী পাঠের পঞ্চম অধ্যায়, শ্লোক ৭ হতে ৩৪ পর্যন্ত "নমঃ" এবং "নমস্তে" শব্দ দ্বারা পরিপূর্ণ।
তথাকথিত বৈষ্ণব সম্প্রদায়ের অত্যন্ত আদরণীয় গ্রন্থ এবং মান্য পুরাণ শ্রীমদ্ভাগবতেও ( যদিও অষ্টাদশ পুরাণ গণনায় এটির প্রামাণ্যতা নিয়ে যথেষ্ট সংশয় রয়েছে, অধিক তথ্যের জন্য আমাদের পর্বানুসারে প্রকাশিত "পুরাণ বিমর্শ" পড়তে পারেন) শ্রীকৃষ্ণ ব্রাহ্মণদের নমস্তে দ্বারা অভিবাদন করেছেন-
নিরহংকারিণঃ শান্তান্ নমস্তে শিরসাঽকৃদ্।।
অর্থ- এমন বিদ্বানদের বারংবার নমস্তে, যাঁরা সকলের মিত্র, নিরংকারী, শান্ত তথা লাভ না হওয়া সত্ত্বেও সন্তোষকারী।
গরুড় পুরাণেও "নমস্তে" এর পর্যাপ্ত প্রয়োগ পাওয়া যায় -
নমস্তে বিশ্বকৃদ্দেব নমস্তে বিশ্বভাবন।।
আ০ কা০ অ ২৩৪
নারায়ণ নমস্তেঽস্তু শৃণু বিজ্ঞাপনং মম।। ব্র.কা.অ ১১
স্কন্দপুরাণেও "নমস্তে" এর পর্যাপ্ত রূপে প্রয়োগ পাওয়া যায়-
শ্মশানবাসিন নমস্তে কৃত্তিবাসসে।।
বিশ্ববন্ধো নমস্তেঽস্তু নমস্তে বিশ্বভাবন।।
নমস্তে বিশ্বমিত্রায়ৈ নন্দিন্যৈ তে নমো নমঃ।।
নমস্তে এবং নমষ্কার, উভয়ের মধ্যে কোনটি প্রয়োগ করা উচিৎ তা জেনে নেওয়া যাক-
নমস্তে এবং নমষ্কার উভয়ই একটি অব্যয় “নমস্” পদ হতে গঠিত। যেমন পূর্বেই উল্লেখ করা হয়েছে যে “নমস্তে -নমঃ+তে” এর অর্থ তোমাকে, আপনাকে নমন, আদর। কিছু অল্প সংস্কৃতজ্ঞ “তে” পদের প্রয়োগ নিজের চেয়ে (বয়সে) ছোটদের জন্য বলে থাকেন, বড়দের জন্য নয়। কিন্তু সংস্কৃত সাহিত্যে "ত্বম্" এর অর্থ তুমি এবং "তে" শব্দের অর্থ তোমার জন্য বা আপনার জন্য হয় এবং এই "তে" পদ ছোট-বড় সবার জন্যে প্রয়োগ করা হয়ে থাকে। সংস্কৃতে ছোট-বড় উভয়ের জন্য একটি বচনেই প্রয়োগ হয়, যার অনেকানেক উদাহরণ পূর্বে দিয়েছি।
"নমষ্কার" এবং "নমঃ" উভয়েই সংজ্ঞা, যার অর্থ আদর, সৎকার। নমঃ এবং নমষ্কার উভয়ের একই অর্থ হয়। নমষ্কার = নমঃ + কার, এর অর্থ "নমন করেছে" হয়। কিন্তু নমঃ বা নমষ্কারে বিধেয় এবং উদ্দেশ্য এর পরিপূর্ণতা হয় না, অর্থাৎ এই নমন, আদর-সৎকার যাঁকে করা হচ্ছে, এতে তাঁর অভাব আছে, কিন্তু "নমস্তে" তে এটির পূর্ণতা প্রাপ্ত হয়। অতএব অভিবাদন হিসেবে "নমষ্কার" এর প্রয়োগ অধূরা এবং অশুদ্ধ।
সমস্ত সংস্কৃত সাহিত্য নম, নমো,নমামি, নমস্তে, নমস্তুভ্য, নমস্তেঽস্তুতে, নমস্তেঽস্তু এর প্রয়োগ দ্বারা পরিপূর্ণ। এসব "নমস্তে" এরই বিভিন্ন রূপ। কবিদের দ্বারা বৃত্ত রক্ষার দৃষ্টিতে এর প্রয়োগ করা হয়েছে। ঠিক এই কথাই আজকাল প্রচলিত নমষ্কার সম্বন্ধে, প্রাচীন বৈদিক সাহিত্যে যেটির প্রয়োগের অভাব পরিলক্ষিত হয়। আধুনিক সংস্কৃতে যদি এটির যত্রতত্র প্রয়োগ আছে তো তা কেবল নমঃ এর স্থানে ছন্দ পূর্ণ করার জন্য করা হয়েছে। কিন্তু সেইসাথে যাঁকে অভিবাদন করা হয়েছে তারও উল্লেখ করা হয়েছে। নমস্তে যেথায় আমাদের সম্পূর্ণ ভাবকে ব্যক্ত করে, সেখানে নমষ্কার দ্বারা উচ্চারণে সংক্ষিপ্ত এবং সরলও, তখন এটা হঠ এবং দুরাগ্রহ নয়তো কি? নমস্তে যেমন সর্ব সম্মত,সার্থক, সংক্ষিপ্ত, ভাবপূর্ণ প্রাচীন অভিবাদন কে নিজের না করা সনাতনীদের জন্য দূর্ভাগ্যপূর্ণ।
অতএব সকল সনাতনীদের নিকট বিনম্র নিবেদন, অনেকানেক নিরর্থক অভিবাদন পরিত্যাগ করে, সর্বশ্রেষ্ঠ, ভাবপূর্ণ, বেদাদি শাস্ত্রসম্মত "নমস্তে" পদকে একমাত্র অভিবাদন হিসেবে প্রতিষ্ঠা করি।
ও৩ম্ নমস্তে।
তথ্যসূত্রঃ-
১/ ও৩ম্ আর্য নমস্তে -
২/ সত্যার্থ প্রকাশ - মহর্ষি দয়ানন্দ সরস্বতী
✍️ অনুবাদ এবং বাক্য সংযোজন-
ডা. সমর আর্য
© অমৃতস্য পুত্রাঃ