পুরাণের মান্যতা হলো ঈশ্বর বিভিন্নরূপে অবতীর্ণ হন। সেই অবতীর্ণ হওয়া ঈশ্বরকেই ঈশ্বরের অবতার বলা হয়। ঈশ্বর কেন অবতীর্ণ হন? পুরাণের অনেকত্রই এর উত্তর পাওয়া যায়, যেমন চতুর্থ পর্বেই বলা হয়েছে - ভগবান্ বিষ্ণু প্রত্যেক দ্বাপরযুগে অবতীর্ণ হন পুরাণ রচনা করার জন্য এবং বেদের অনেক ভেদোপভেদ করার জন্য। মৎস্যপুরাণে বলা হয়েছে- যখন লোকজন ধর্ম বিমুখ হয়ে যায় তথা শুভ কর্মে বিশেষরূপে শিথিলতা আসে তখন ভগবান বিষ্ণু নিজ দিব্য শরীর ত্যাগ করে ভূতলে মানব-যোনিতে প্রকট হয়।
কিন্তু দেবীভাবতে বলা হয়েছে-
মন্দবুদ্ধি পণ্ডিতেরাও মায়ার বিমোহিত হইয়া বলিয়া থাকেন যে, বিষ্ণু স্বীয় ইচ্ছায় নানা অবতার রূপে জন্মিয়া থাকেন, কিন্তু যখন মূর্খেরাও বহু ক্লেশকর অনতিপ্রশস্ত অতিশয় সঙ্কট গর্ভবাসে অভিলাষী হয়েন না, তখন চক্রধারী বিষ্ণু কেন গর্ভবাসে অভিলাষ করিবেন?। মধুসুদন কৌশল্যা ও দেবকীর বিষ্ঠা প্রভৃতি মলদুষিত গর্ভে নিজ ইচ্ছায় সহসা আগমন করিয়াছিলেন, বৈষ্ণবেরা এই কথা বলিয়া থাকে। কিন্তু, ক্লেশকর বিষসম সেই গর্ভে শত শত চিন্তার উদয় হইয়া থাকে অতএব হরি বৈকুণ্ঠবাস ত্যাগ করিয়া গর্ভে বাস করিবেন, তাহাতে সুখ কি?
অর্থাৎ ভগবান্ বিষ্ণু নিজ ইচ্ছায় ধর্মরক্ষার জন্য অবতীর্ণ হন না, তাহলে কেন হন? পুরাণে দেখা যায়–
ভৃগু ঋষি ভগবান্ বিষ্ণুকে বলছেন :- পাপিষ্ঠ! তুমি ইন্দ্রের নিমিত্ত আমাকে অতিশয় দুঃখান্বিত ও কাতর করিয়াছ? আমি ইন্দ্রকে অভিশাপ প্রদান করিব না, তুমি নিয়তই কপটভাব অবলম্বন এবং কৃষ্ণসর্পের ন্যায় ব্যবহার করিয়া থাক; তুমি অত্যন্ত দৃষ্টাশয়, আমি তোমাকেই অভিশাপ প্রদান করিব জনার্দ্দন! যে সকল মুনিগণ, তোমাকে সত্ত্বগুণ সম্পন্ন বলে তাহারা অতিশয় মূর্খ; তুমি যে অতিশয় দুরাচার অদ্য আমি তাহা প্রত্যক্ষ করিলাম॥ বিষ্ণু! তুমি আমার অভিশাপে মর্তালোকে বহুবার অবতীর্ণ হইয়া পাপ- কর্ম্মের ফলস্বরূপ প্রায়ই গর্ভযন্ত্রণা ভোগ করিবে সন্দেহ নাই॥
ব্যাসদেব বলেন : ভগবান্ বিষ্ণু সেই শাপবশেই ধৰ্ম্মনষ্ট হইলে লোকের হিতের নিমিত্ত এই মনুষ্যলোকে পুনঃ পুনঃ অবতীর্ণ হইয়া থাকেন ।
মৎসপুরাণেও বলা হয়েছে যে ভগবান্ বিষ্ণু ভৃগু ঋষির অভিশাপেই পুনঃ পুনঃ মানব যোনিতে অবতীর্ণ হন, তবে মৎসপুরাণে দেখা যায় ভৃগু ঋষি ভগবান্ বিষ্ণুকে সাতবার মানব যোনিতে জন্ম ধারণের অভিশাপ দিয়েছেন। অন্যদিকে ভবিষ্যপুরাণে শ্রীকৃষ্ণ নিজে বলেছেন যে - ১০বার জন্ম গ্রহণের অভিশাপ দিয়েছেন।
অর্থাৎ অবতীর্ণ হওয়ার মূল কারণ হলো অভিশাপ, এই অভিশাপের কারণে তিনি বাধ্য হয়ে অবতার হন। শ্রীকৃষ্ণ নিজেও বলেছেন-
"শাপান্নারায়ণাংশোঽহং জাতোঽস্মি ক্ষিতিমণ্ডলে॥
ভোক্তুং বহুতরং দুঃখং মায়াপাশেন যন্ত্রিতঃ।"
আমি শাপবশে মায়াপাশে নিয়ন্ত্রিত হইয়া বহুতর দুঃখ ভোগ করিবার নিমিত্ত অবনীতলে জন্মগ্রহণ করিয়াছি।
অন্যদিকে ঈশ্বরাবতার ব্যাসদেবজী নিজ ব্রহ্মসূত্রে বলেছেন-
করণবচ্চেন্ন ভোগাদিভ্যঃ॥ (বেদান্তদর্শন-২/২/৪০)
ভাষ্যঃ- জীববৎ করণকলেবরকল্পনাপি ন সম্ভবতি ভোগাদি-প্রসক্তে।
ব্যাখ্যাঃ- জীব যেমন অশরীরী হইয়াও ইন্দ্রিয়াদিকলেবর দ্বারা দেহের সহিত সম্বন্ধবিশিষ্ট হয়েন, তদরূপ ঈশ্বরও ইন্দ্রিয়াদিকলেবর দ্বারা জগতের সহিত সম্বন্ধবিশিষ্ট হয়েন; এইরূপ কল্পনারও সম্ভাবনা হয় না ; কারণ তাহা হইলে, জীবের ন্যায় ঈশ্বরেরও সুখদুঃখাদিভোগ প্রসঙ্গ হয়, এবং তাঁহার ঈশ্বরত্ব আর কিছু থাকে না।
অন্তবত্ত্বমসর্ব্বজ্ঞতা বা।। (বেদান্তদর্শন- ২/২/৪১)
ভাষ্যঃ- তস্য পুণ্যাদিরূপাদৃষ্টযোগেহন্তবত্ত্বমজ্ঞত্বং চ স্যাৎ।
ব্যাখ্যাঃ- (ঈশ্বরের ভোগাদি স্বীকার করিলেও কোন দোষ হয় না; অতিসামান্য হিমকণিকা যেমন বৃহৎ অগ্নিকুণ্ডের উত্তাপ খর্ব্ব করিতে পারে না, তদ্রূপ উক্ত ভোগও ঈশ্বরকে খর্ব্ব করিতে পারে না। যদি এইরূপ আপত্তি হয়, তদুত্তরে বলা হইতেছে, যে এইরূপ বলিলে) পুণ্যপুণ্যাদি অদৃষ্টযোগে ঈশ্বরও জীবের ন্যায় অন্তবিশিষ্ট ও অসর্ব্বজ্ঞ হইয়া পড়েন; কারণ ইন্দ্রিয়াদিবিশিষ্ট সুখদুঃখাদিভোগ সম্পন্ন কেহই জন্মমরণাদিবিহীন এবং পূর্ণজ্ঞ বলিয়া দৃষ্ট হয় না ; লৌকিক দৃষ্টান্তে ঈশ্বরও যুগবৎ অন্তবিশিষ্ট ও অজ্ঞ হইয়া পড়েন। পরন্তু এইরূপ ঈশ্বর পাশুপতদিগেরও সম্মত নহে।
[ভাষ্যানুবাদক – পণ্ডিত শ্রীনলিনীনাথ রায়।]
[গীতা-৪/৭-৮ শ্লোক নিয়ে পূর্বেই অমৃতস্য পুত্রাঃ ব্লগে লিখা হয়েছে]
অর্থাৎ ঈশ্বর জন্মগ্রহণ করেন না, দেহধারণ করেন না। এটা দেখার পর অনেকেই বলতে আসেন যে - শ্রীকৃষ্ণ মাতা দেবকীর গর্ভের মাধ্যমে জন্মগ্রহণ করেনি, বসুদেব ও দেবকী মায়ের সামনে প্রকট হয়েছে মাত্র। কিন্তু শ্রীকৃষ্ণ নিজেই বলেছেন- "গর্ভবাসে মহদ্দুঃখং প্রাপ্তং" আমি গর্ভাশয়ে থেকে অনেক কষ্ট প্রাপ্ত হয়েছি। তাছাড়া পূর্বেও বলা হয়েছে - তিঁনি অভিশাপের কারণে দেবকী ও কৌশল্যার গর্ভের মাধ্যমেই জন্মগ্রহণ করেছেন। তাছাড়াও অন্যান্য অনেক অবতারের জন্মগ্রহণের তথ্য পাওয়া যায় পুরাণেই। এখন আমরা কোনটা মানবো?
ভগবান্ বিষ্ণুর অংশ শ্রীকৃষ্ণকে ঈশ্বর মানলেও ঈশ্বরের বিরোধ হয়ে যাবে, ঈশ্বর না মানলেও ঈশ্বর ও পুরাণের বিরোধীতা হয়ে যাবে। যদি ঈশ্বর মানা হয় তাহলে মানতে হবে যে-
১.ঈশ্বর অভিশপ্ত। ২. দুষ্ট। ৩.দুরাচারী। ৪.পাপিষ্ঠ। ৫.দুঃখী ৬.ঈশ্বরত্বহীন।...... এবং ঈশ্বর দুষ্ট ব্যক্তিদের ভয় পান, কেননা পুরাণে বলা হয়েছে যে, শ্রীকৃষ্ণ নিজেই বলেছেন-
◑আমি কংসভয়ে নন্দ গোকুলে যাইয়া নিরন্তর দুঃখভোগ করিয়াছি।
◑ম্লেচ্ছরাজ কালযবনের ভয়ে অত্যন্ত সন্ত্রস্ত হইয়া সুদুর্লভ পিতৃস্থান মথুরাপুরী পরিহারপূর্বক দ্বারবতী নগরে গমন করিয়াছি।
শুধু তাহাই নয় তিনি আরো বলেছেন যে, তিনি সদা উগ্রসেনের দাসত্ব করেছেন। অর্থাৎ 'ঈশ্বর' মানুষের দাস ইহাও স্বীকার করতে হবে। পুরাণ না মানার এই কারণগুলোও হতে পারে।
যদি অবতারের তালিকা দেখি তাহলে ........... (পরবর্তী পর্বে)
📚প্রমাণ সংগ্রহ–
১.মন্বন্তরেষু সর্বেষু দ্বাপরে দ্বাপরে যুগে।
প্রাদুঃকরোতি ধর্মার্থী পুরাণানি যথাবিধি ॥
দ্বাপরে দ্বাপরে বিষ্ণু্যাসরূপেণ সর্ব্বদা।
বেদমেকং স ৰহুধা কুরুতে হিতকাম্যয়া ॥
দেবীভাগবত-১/৩/১৮-১৯
২.ত্যক্ত্বা দিব্যাং তনুং বিষ্ণুর্মানুষেষ্বিহ জায়তে।
যুগে ত্বথ পরাবৃত্তে কালে প্রশিথিলে প্রভুঃ ॥
মৎসপুরাণ-৪৭/৩৪
৩.মায়া বিমোহিতা মন্দাঃ প্রবদন্তি মনীষিণঃ।
করোতি স্বেচ্ছয়া বিষ্ণুরবতারাননেকশঃ॥৪৭
মন্দোহপি দুঃখগহনে গর্ভবাসেহতিসঙ্কটে।
ন করোতি মতিং বিদ্বান্ কথনং কুর্য্যাৎ স চক্রভৃৎ॥৪৮
কৌশল্যাদেবকীগর্ভে বিষ্ঠামল সমাকুলে।
স্বেচ্ছায়া প্রবদন্ত্যদ্ধাগতো হি মধুসূদনঃ॥৪৯
বৈকুন্ঠসদনং ত্যক্ত্বা গর্ভবাসে সুখং ন কিম্।
চিন্তাকোটিসম্মুত্থানে দুঃখদে বিষসম্মিতে॥৫০
দেবীভাগবতম্- ৫/১/৪৭-৫০
৪.শপামি ত্বাং দুরাচারং কিমন্যৎ প্রকরোমি তে।
বিধুরোঽহং কৃতঃ পাপ! ত্বয়াহং শত্রুকারণাৎ ॥৫
ন শপেঽহং তথা শত্রুং শপে ত্বাং মধুসূদন!।
সদা ছলপরোঽসি ত্বং কীটযোনির্দুরাশয়ঃ ॥ ৬
যে চ ত্বাং সাত্ত্বিকং প্রাহুস্তে মূর্খা মুনয়ঃ কিল।
তামসত্ত্বং দুরাচারঃ প্রত্যক্ষং মে জনাৰ্দ্দন! ॥৭
অবতারা মৃত্যুলোকে সন্তু মচ্ছাপসম্ভবাঃ।
প্রায়ো গর্ভভবং দুঃখং ভুঙ্ক্ষ্ব পাপাজ্জনাৰ্দ্দন ! ॥৮
ততস্তেনাথ শাপেন নষ্টে ধর্ম্মে পুনঃপুনঃ।
লোকস্য চ হিতার্থায় জায়তে মানুষেষিহ ॥ ৯
দেবীভাগবত-৪/১২/৫-৯
ভৃগুশাপান্মহারাজ বিষ্ণুর্দেববরঃ প্রভুঃ।
দেবীভাগবত-৪/১০/২৯
৫.যস্মাৎ তে জানতো ধর্মমবধ্যা স্ত্রী নিষূদিতা ।
তস্মাৎ ত্বং সপ্তকৃত্বেহ মানুষেষূপপৎস্যসি ॥
ততস্তেনাভিশাপেন নষ্টে ধর্মে পুনঃ পুনঃ ।
লোকস্য চ হিতার্থায় জায়তে মানুষেষ্বিহ ॥
৬.ভবিষ্যপুরাণ, উত্তরপর্ব-৬৩/১-১৩
৭.শাপান্নারায়ণাংশোঽহং জাতোঽস্মি ক্ষিতিমণ্ডলে।
ভোক্তুং বহুতরং দুঃখং মায়াপাশেন যন্ত্রিতঃ॥
দেবীভাগবত-৪/২৫/৫৫
৮..গীতা-৪/৭-৮ https://aryapsbd.blogspot.com/2024/05/blog-post_80.html
৯.গর্ভবাসে মহদ্দুঃখং প্রাপ্তং মদনদাহক।
দেবীভাগবত-৪/২৫/৪৪
১০.জন্মতঃ কংসভয়জমনুভূতং চ গোকুলে।
ম্লেচ্ছরাজভয়ত্রস্তো গতো দ্বারবতীং পুনঃ।
উগ্রসেনস্য দাসত্বং কৃতং বৈ সর্বদা ময়া।
দেবীভাগবত-৪/২৫/৪৫,৪৬,৪৮
🖋️প্রিয়রত্ন বিদ্যার্থী
©️অমৃতস্য পুত্রাঃ