শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা - ৪/৭-৮
পরমাত্মা মনুষ্যাদিরূপে জন্মগ্রহণ দ্বারা অবতার হয়ে অবতীর্ণ হন এরূপ যারা মান্য করেন তাদের নিকট অবতারবাদ সিদ্ধ করার জন্য খুবই মহত্ত্বপূর্ণ এই শ্লোক দুটি। অপরদিকে গীতাকে বেদ ও বৈদিক মান্যতা বিরোধী প্রমাণ করার জন্যও এই শ্লোক দুটি নিয়ে অনেকেই প্রশ্ন তুলেন। শ্লোক দুটি হলো-
যদা যদা হি ধর্মস্য গ্লানির্ভবতি ভারত৷
অভ্যুত্থানমধর্মস্য তদাত্মানং সৃজাম্যহম্॥৭॥
পদার্থ : হে ভারত! (যদা যদা হি) যখন, যখন'ই (ধর্মস্য) ধর্মের (গ্লানিঃ) হানি (ভবতি) হয় এবং (অধর্মস্য অভ্যুত্থানম্) অধর্মের প্রাদুর্ভাব হয় অর্থাৎ যখন অধর্ম বেড়ে যায় (তদা) তখন (অহম্) আমি (আত্মানম্) আত্মাকে (সৃজামি) রচনা অর্থাৎ শরীর ধারণ করি ॥ [কিন্তু কেন?]
সরলার্থ : হে ভারত! যখন, যখন'ই ধর্মের হানি হয় এবং অধর্মের প্রাদুর্ভাব হয় অর্থাৎ যখন অধর্ম বেড়ে যায় তখন আমি আত্মাকে রচনা অর্থাৎ শরীর ধারণ করি ॥ [কিন্তু কেন?]
পরিত্রাণায় সাধুনাং বিনাশায় চ দুষ্কৃতাম্৷
ধর্মসংস্থাপনার্থায় সম্ভাবামি যুগে যুগে॥৮॥
পদপাঠ : পরিত্রাণায় । সাধুনাম্ । বিনাশায় । চ । দুষ্কৃতাম্ । ধর্মসংস্থাপনার্থায় । সম্ভাবামি । যুগে । যুগে॥
পদার্থ : (সাধুনাং) সাধুশ্রীদের (পরিত্রাণায়) রক্ষা করার জন্য (চ) এবং (দুষ্কৃতাম) পাপিদেরকে (বিনাশায়) বিনাশ করার জন্য (ধর্মসংস্থাপনার্থায়) ধর্ম স্থাপন করার জন্য (যুগে যুগে) প্রত্যেক যুগে (সম্ভাবামি) হই অর্থাৎ শরীর ধারণ করি ॥
সরলার্থ : সাধুশ্রীদের রক্ষা করার জন্য এবং পাপিদেরকে বিনাশ করার জন্য ধর্ম স্থাপন করার জন্য প্রত্যেক যুগে হই অর্থাৎ শরীর ধারণ করি ॥
এই শ্লোকদ্বয়ে যোগীদের জন্মের হেতু ধর্মরক্ষা করা বলা হয়েছে। কিন্তু-◾ ১. যারা ঈশ্বরাবতারে বিশ্বাসী তাহারা এই শ্লোকদ্বয়ের এই অর্থ করে যে - যখন, যখনই ধর্মের গ্নানি হয় তখন তখনই পরমেশ্বর অধর্ম নাশার্থে অবতার হয়ে আসেন।
মুসলিমরা ভারতের বিভিন্ন মন্দির ভেঙ্গে মসজিদ তৈরি করেছে সেটা কি অধর্ম নয়? বাংলাদেশেও মুসলিমরা অসংখ্য মন্দির-মূর্তি ভাঙচুর করেছে, ভক্তদের নির্যাতন সহ হত্যাও করেছে সেগুলো কি অধর্ম নয়? তারপরেও ঈশ্বর অবতার হয়ে আসেননি কেন? তাছাড়াও তাদের উচিৎ এই শ্লোক দুটি দ্বারা ঈশ্বর অবতার হয় প্রমাণিত এরূপ বলার পূর্বে শ্রীকৃষ্ণ ঈশ্বর কিনা তা প্রমাণ করা। যদি শ্রীকৃষ্ণ ঈশ্বর প্রমাণিত না হয়, তাহলে এই শ্লোকদ্বয় দ্বারা ঈশ্বর অবতীর্ণ হন তা প্রমাণ করা মিথ্যা প্রলাপমাত্র। কেন না শ্লোক দুটি বলেছেন শ্রীকৃষ্ণ আর তা নিজেকে নিয়ে বলেছেন।
ক্লেশকর্মবিপাকাশয়ৈরপরামৃষ্টঃ পুরুষবিশেষ ঈশ্বরঃ।।
(যোগদর্শন, সমাধিপাদ-২৪)
সূত্রার্থঃ- অবিদ্যাদি পাঁচটি ক্লেশ, শুভাশুভ মিশ্রিত ত্রিবিধ কর্ম, সুখ-দুঃখ রূপী কর্মফল, সুখ-দুঃখ ভোগের সংস্কার, এই সকল হতে সম্বন্ধ রহিত, জীব হতে ভিন্ন স্বভাবযুক্ত চেতন বিশেষকে "ঈশ্বর" বলা হয়।
এখানে বলা হয়েছে ঈশ্বর সর্বদা ক্লেশ আদি মুক্ত। কিন্তু ঈশ্বরাবতার মান্যকারীদের অবতার ক্লেশ আদি মুক্ত ছিলেন না। বেদে আরো বলা হয়েছে-
স পর্যগাচ্ছুক্রমকায়ম ব্রণম স্নাবিরং শুদ্ধ মপাপ বিদ্ধম্ কবির্মনীষী পরিভূঃ স্বয়ম্ভূর্যাতা তথ্যতোহর্থাম্ব্যদধাচ্ছা শ্বতীভ্যঃ সমাভ্যঃ।
[যজুর্বেদ-৪০/৮. ঈশোপনিষদ-৮]
পদার্থঃ - (সঃ) পরমাত্মা (পরি) সব দিক হইতে (অগাৎ) ব্যাপ্ত আছেন (শুক্রম) সর্ব শক্তিমান (অকায়ম্) শরীর রহিত (অব্রণম্) ছিদ্র রহিত (অস্নাবিরম্) স্নায়ু আদির বন্ধন রহিত (শুদ্ধম্) দোষ রহিত (অপাপবিদ্ধম্) পাপ রহিত (কবিঃ) সর্ব্বজ্ঞ (মনীষী) অন্তর্যামী (পরিভূঃ) দুষ্টের দমন কর্ত্তা (স্বয়ম্ভুঃ) জন্মরহিত (যথাতথ্যতঃ) যথাযথভাবে (অর্থান্) সব পদার্থের (বি) বিশেষরূপে (অদধাৎ) বিধান করিয়াছেন (শাশ্বতীভ্যঃ) বিনাশ রহিত (প্রজাভ্যঃ) প্রজাদের জন্য।
বঙ্গানুবাদঃ পরমাত্মা সর্বব্যাপক, সর্বশক্তিমান, শরীররহিত, রোগরহিত, জন্মরহিত, শুদ্ধ, নিষ্পাপ, সর্বজ্ঞ, অন্তর্যামী, দুষ্টের দমন কর্তা ও অনাদি। তিনি তাঁহার শাশ্বত প্রজা জীবের জন্য যথাযথ ফলের বিধান করেন।
গ্রন্থ : বেদসার সংগ্রহস্বামী অরুণানন্দ
পরমাত্মা সর্বব্যাপক কিন্তু শ্রীকৃষ্ণ সর্বব্যাপক নয়। মহাভারতে এর অসংখ্য প্রমাণ আছে। বনপর্বে ত্রয়োদশ অধ্যায়ে দ্রৌপদীর অপমান বিষয় নিয়ে যখন কথা হচ্ছিল তখন যুধিষ্ঠির শ্রীকৃষ্ণকে জিজ্ঞেস করেছেন -
হে কৃষ্ণ! কিজন্য তুমি নিকটে ছিলে না? কোথায় ছিলে? (১)
উত্তরে শ্রীকৃষ্ণ বলেছেন -
আমি শাল্ববাজার সৌভনগর গিয়েছিলাম। (২)
এর দ্বারা প্রমাণিত শ্রীকৃষ্ণ সর্বব্যাপী নয় অর্থাৎ সর্বদা সকল স্থানে বিদ্যমান নয়। তাছাড়াও মন্ত্রে বলা হয়েছে ঈশ্বর জন্মরহিত। কিন্তু শ্রীকৃষ্ণ স্বয়ম্ গীতায় বলেছেন -
"বহুনি মে ব্যতীতানি জন্মানি তব অর্জুন" (গীতা-৪/৫)
অনুবাদ: হে অর্জুন! আমার এবং তোমার বহু জন্ম ব্যতীত হয়েছে।
এর দ্বারাও প্রমাণিত শ্রীকৃষ্ণ ঈশ্বর নয়। এখন হয়তো মনে প্রশ্ন জাগরিত হতে পারে -
গীতা-২/২০ শ্লোক সহ অনেক গ্রন্থেই তো আত্মাকেও জন্মরহিত বলা হয়েছে। যদি আত্মা জন্মরহিত হয়েও জন্মগ্রহণ করে বা করতে পারে তাহলে ঈশ্বর কেন জন্মগ্রহণ করতে পারেন না বা করবেন না?
মূলত আত্মা এবং পরমাত্মা উভয়ই জন্মরহিত। কিন্তু এখানে পরমাত্মাকে জন্মরহিত বলতে জীবাত্মার ন্যায় দেহের সহিত সম্বন্ধবিশিষ্ট হয়ে যে জন্ম হয় সেইরূপ জন্ম ঈশ্বরের হয় না তা বুঝানো হয়েছে। আর সেজন্যই শ্রীকৃষ্ণ বলেছেন -
অজেহপি সন্নব্যয়াত্মা ভূতানীমীম্বরোহপি সন্।প্রকৃতিং স্বামধিষ্ঠায় সম্ভবাম্যাত্মমায়য়া॥ (গীতা-৪/৬)
অর্থাৎ আমি জন্মরহিত ও অবিনাশী এবং ভূতসমূহের (পঞ্চভূতের) স্বামী হয়েও প্রকৃতিকে নিজ অধিন করে নিজ শক্তি দ্বারা জন্মগ্রহণ করি॥
▪️বেদান্ত দর্শনে উপরোক্ত প্রশ্নের সমাধান করা হয়েছে। বলা হয়েছে -
করণবচ্চেন্ন ভোগাদিভ্যঃ।। (বেদান্তদর্শন-২/২/৪০)
ভাষ্যঃ- জীববৎ করণকলেবরকল্পনাপি ন সম্ভবতি ভোগাদি-প্রসক্তে।
ব্যাখ্যাঃ- জীব যেমন অশরীরী হইয়াও ইন্দ্রিয়াদিকলেবর দ্বারা দেহের সহিত সম্বন্ধবিশিষ্ট হন, তদরূপ ঈশ্বরও ইন্দ্রিয়াদিকলেবর দ্বারা জগতের সহিত সম্বন্ধবিশিষ্ট হন; এইরূপ কল্পনারও সম্ভাবনা হয় না ; কারণ তাহা হইলে, জীবের ন্যায় ঈশ্বরেরও সুখদুঃখাদিভোগ প্রসঙ্গ হয়, এবং তাঁহার ঈশ্বরত্ব আর কিছু থাকে না।
---ভাষ্যানুবাদক : পণ্ডিত শ্রীনলিনীনাথ রায়◾২.যারা বলেন উক্ত শ্লোকটি বেদ ও বৈদিক মান্যতা বিরুদ্ধ, তাদের ভাবনাও শ্লোকটিতে ঈশ্বর বিভিন্নরূপে অবতার হন এরূপ বলা হয়েছে। যেহেতু শ্লোকটি শ্রীকৃষ্ণ নিজেকে নিয়ে বলেছেন, সেহেতু শ্লোক দুটির বিরুদ্ধতা করার পূর্বে তাদেরও উচিৎ শ্রীকৃষ্ণকে ঈশ্বর হিসেবে প্রমাণ করা, কিন্তু তারা তা করবে না কারন তারা শ্রীকৃষ্ণকে পরমাত্মা বলে মান্য করেন না। সুতরাং এক্ষেত্রে তাদের মূলেই ভুল। এই বিষয়টি নিয়ে সত্যার্থ প্রকাশেও ঋষি দয়ানন্দ - উদ্ধৃত করেছেন। তিনি লিখেছেন -
প্রশ্ন – ঈশ্বর অবতার হয় কিনা?উত্তর – না। কারণ, অজ একপাৎ 'সপর্যগাচ্ছুক্রমকায়ম' ইত্যাদি যজুর্বেদের বচন, এই সব বচন হইতে সিদ্ধ হয় যে, ঈশ্বর জন্মগ্রহণ করেন না।
প্রশ্ন – যদা যদা হি ধর্মস্য গ্লানির্ভবতি ভারত৷
অভ্যুত্থানমধর্মস্য তদাত্মানং সৃজাম্যহম্॥৭॥
শ্রীকৃষ্ণ বলিতেছেন, যখন যখনই ধর্মের গ্লানি উপস্থিত হয়, তখন তখনই আমি শরীর ধারণ করিয়া থাকি।
উত্তর – এই কথা বেদবিরুদ্ধ বলিয়া প্রমাণ নহে। কিন্তু এইরূপ হইতে পারে যে, শ্রীকৃষ্ণ ধর্মাত্মা ছিলেন এবং তিনি ধর্মের রক্ষা করিতে ইচ্ছা করিয়াছিলেন। "আমি যুগে যুগে জন্মগ্রহণ করিয়া শ্রেষ্ঠদিগকে রক্ষা এবং দুষ্টদিগকে বিনাশ করিয়া থাকি" এইরূপ হইলে কোন দোষ নাই। কারণ পরোপকারায় সতাং বিভূতয়ঃ', সৎপুরুষদিগের দেহ মন-ধন পরোপকারের জন্য। সুতরাং ইহা দ্বারা শ্রীকৃষ্ণ ঈশ্বর হইতে পারেন, ইহা প্রমাণিত হয় না।
----সত্যার্থ প্রকাশ - সপ্তম সমুল্লাস
ঋষি দয়ানন্দও বলেননি যে এই শ্লোকদ্বয় প্রক্ষিপ্ত বা বেদ বিরুদ্ধ বরং ঈশ্বরাবতারে বিশ্বাসীরা যে ভাব ব্যক্ত করে এই শ্লোক দ্বারা তাহা বেদ বিরুদ্ধ বলেছেন।
◾৩. এক হুজুরও এই শ্লোকদ্বয় নিয়ে বলেছেন - শ্রীমদ্ভাগবাতগীতা- অধ্যায় নাম্বার ৪ শ্লোক নাম্বার ৭ আর ৮ দুটো মন্ত্রে স্পষ্টভাবে বলছে হিন্দু ধর্মটি সারা বিশ্বের জন্য নয়। প্রমাণ মন্ত্র -
অদা অদাহি ধর্মাস্যে গ্নানাতি ভাবাতি ভারাতা অভ্যুরথানম ধর্মস্যে তদে আত্মানম স্রুজামিহম পরিত্রাণায় সাধুনং বিনাশ্বা চয় দুষ্ক্রিতম ধর্ম সংস্থাপর্থানায়ে সমভাবমি ওগে ওগে।
পাগল এবং মাতালের ন্যায় ভুল কথন করে তিনি বলেছেন এই শ্লোকে বুঝানো হয়েছে যখন ধর্মের মধ্যে অধর্ম নেমে আসে সেই সময় ঈশ্বর একজন পাঠায় অথবা নিজেই আসে ভারতে... বুঝা গেল হিন্দু ধর্ম কেবল ভারতের জন্য। ↓
হুজুরের পুরো ফোকাস শ্লোকে থাকা ভারত শব্দের উপর। বিচারহীন জ্ঞানহীন হুজুরের দ্বারা গীতা বুঝা অসম্ভব তিনি তা প্রমাণ করে দিয়েছেন। শ্লোকে ভারত শব্দ দ্বারা ভারত দেশ বুঝায়নি, ভারত নামে অর্জুনকে সম্বোধন করেছেন। কেবল গীতা-৪/৭ শ্লোকেই অর্জুনকে ভারত বলে সম্বোধন করেনি, অন্য অসংখ্য শ্লোকেই অর্জুনকে ভারত নামে সম্বোধন করা হয়েছে বা ডাকা হয়েছে। যেমন - গীতা-২/১৪, ২/১৮, ২/২৮, ২/৩০ গীতা-৩/২৫, গীতা-১৮/৬২...
✍️প্রিয়রত্ন বিদ্যার্থী
©️অমৃতস্য পুত্রাঃ