যজুর্বেদ(৩২/৪) মন্ত্র অনুসারে কি ঈশ্বরের মুখ আছে?

ရိုရို
0



আমাদের একজন পৌরাণিক ভ্রাতা ঈশ্বর সাকার এমন দাবী করে কিছু প্রমাণ তুলে ধরেছেন।তার উল্লেখিত (১) নং প্রমাণটি ইতিমধ্যে আমরা প্রমাণ সহকারে খণ্ডন করেছি।
সেটির লিঙ্কঃ

আজকের লেখায় তার উল্লেখিত(২) নং প্রমাণটির সত্যতা তুলে ধরা হল।

উল্লেখিত প্রমাণ(২)—

শুক্লযজুর্বেদ(৩২/৪)—ঈশ্বরের মুখ আছে।


খণ্ডনঃ

প্রথমে মন্ত্রটি দেখে নেওয়া যাক—
এষো হ দেবঃ প্রদিশোহনু সর্বাঃ পূর্বো হ জাতঃ স উ গর্ভে অন্ত। 
স এব জাতঃ স জনিষ্যমাণঃ প্ৰত্য জনাস্তিষ্ঠতি সর্বতো মুখঃ।। 
অনুবাদঃএই পরমাত্মাদেব সম্পূর্ণ দিসমূহকে ব্যাপ্ত করে স্থিত আছেন। তিনিই সর্বপ্রথম উৎপন্ন হয়েছিলেন, এবং তিনিই উৎপন্নশীল সর্ব-প্রপঞ্চ। হে মনুষ্যগণ! এই পরমাত্মা সকলের মধ্যে ব্যাপ্ত হয়ে স্থিত হয়ে থাকেন। ইনি সর্বত্রই মুখ ইত্যাদি অবয়বশালী।
দ্রষ্টব্যঃশুক্লযজুর্বেদ(৩২/৪),অনুবাদকঃদূর্গাদাস লাহিড়ী।


এর পরের মন্ত্রঃ
যম্মাজ্জাতংন পুরা কিং চনৈব য আবভূব ভুবনানি বিশ্বা। প্রজাপতিঃ প্রজয়া সংররাণস্ত্রীণি জ্যোতীংষি সচতে স ষোড়শী৷৷

অনুবাদঃতার পূর্বে কিছুই উৎপন্ন হয়নি-তিনি স্বয়ং সর্বভূতময় হয়ে আছেন। সেই প্রজাপতি পরমাত্মা আপন জীবপ্রজার সাথে সম্যক রমমাণ হয়ে অগ্নি, বায়ু ও আদিত্য এই তিন জ্যোতিকে নির্মাণ করে থাকেন এবং তাদের মধ্যে ব্যাপ্ত হয়ে থাকেন। সেই পরমাত্মাই ষোড়শ অবয়বশালী ষোড়শী।

দ্রষ্টব্যঃশুক্লযজুর্বেদ(৩২/৫),অনুবাদঃদূর্গাদাস লাহিড়ী।



এই লেখায় দুইটি বিষয় তুলে ধরা হলঃ
(১)যজুর্বেদ(৩২/৪) এর মূল বিষয়।
(২)উপমা নিয়ে পৌরাণিক বিদ্বানদের মতামত।

বিষয় (১)—

যজুর্বেদ(৩২/৪) মন্ত্রে মূলত উপমা বোঝানো হয়েছে।উক্ত মন্ত্রে "সর্বতো মুখ" এটি দ্বারা পরমাত্মার সর্বব্যাপকত্বকেই বোঝায়। জানতে হলে অন্যান্য শাস্ত্র থেকে কিছু গুরুত্বপূর্ণ প্রমাণ দেখা উচিত।
(ক)
শরীরাদিব্যতিরিক্তঃপুমান্।।
পদঃ- শরীরাদিব্যাতিবিক্রঃ। পুমান্।।
সরলার্থ-পুরুষ শরীরাদি হইতে ভিন্ন অর্থাৎ জড় প্রকৃতি হইতে উৎপন্ন স্থূল ও সূক্ষ্ম শরীর এবং যাবতীয় প্রাকৃতিক পদার্থ আছে তাহাদের হইতে পুরুষ পৃথক্।
দ্রষ্টব্যঃসাংখ্যদর্শন(১/১৩৯)

(খ)
সর্বেন্দ্রিয়গুণাভাসং সর্বেন্দ্রিয়বিবর্জিতম্।
 অসক্তং সর্বভূচ্চৈব নির্গুণং গুণভোেত্ত্ব চ৷৷
অর্থ: সেই পরম আত্মা সমস্ত ইন্দ্রিয়ের প্রকাশক তথাপি তিনি সমস্ত ইন্দ্রিয় বিবর্জিত। যদিও তিনি সকলের পালক তথাপি তিনি সম্পূর্ণ অনাসক্ত। তিনি জড়া প্রকৃতির গুণের অতীত তথাপি তিনি সমস্ত গুণের ঈশ্বর।
দ্রষ্টব্যঃশ্রীমদ্ভগবদ্গীতা(১৩/১৫)



(গ)
বৃহচ্চ তদ্‌ দিব্যমচিন্ত্যরূপং সূক্ষ্মাচ্চ তৎ সূক্ষ্মতরং বিভাতি। 
দূরাৎ সুদুরে তদিহান্তিকে চ পশ্যৎস্বিহৈব নিহিতং গুহায়াম্।।

অন্বয়: তৎ (তিনি অর্থাৎ সেই ব্রহ্ম); বৃহৎ (সর্বব্যাপী); চ (এবং); দিব্যম্ (জ্যোতিস্বরূপ); অচিন্ত্যরূপম্ (চিন্তার অতীত); তৎ সূক্ষ্মাৎ চ সূক্ষ্মতরম্ (তিনি সূক্ষ্ম থেকেও সুক্ষ্মতর); [রূপে] বিভাতি (বিবিধ রূপে প্রকাশ পান); তৎ (তিনি); দূরাৎ (দূর থেকে); সুদূরে (আরও দূরে); অন্তিকে চ ইহ (এই দেহে; অতি কাছে); পশ্যৎসু (দ্রষ্টাদের কাছে); ইহ এব গুহায়াম্ (এই গুহাতে অর্থাৎ হৃদয়ে); নিহিতম্ (নিহিত আছেন)।

সরলার্থ: ব্রহ্ম অনন্ত, ইন্দ্রিয়াতীত এবং কল্পনার অতীত। ইনি সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম (সূক্ষ্মতমের চেয়েও সূক্ষ্মতর), তিনি দূরতমের চেয়েও দূরে রয়েছেন আবার একই সাথে খুব কাছেও রয়েছেন। মানুষের হৃদয়-পদ্মেই তিনি বিরাজ করেন।
দ্রষ্টব্যঃমুণ্ডকোপনিষদ(৩/১/৭),অনুবাদঃস্বামী লোকেশ্বরানন্দ

(ঘ)
মচক্ষুঃশ্রোত্রং তদপাণিপাদম্। 
নিত্যং বিভুং সর্বগতং সুসূক্ষ্মং তদব্যয়ং যদ্ভূতযোনিং পরিপশ্যন্তি ধীরাঃ।।

অন্বয়: তৎ যৎ (সেই অক্ষর ব্রহ্ম); অদ্রেশ্যম্ (অদৃশ্য অর্থাৎ ইন্দ্রিয়ের দ্বারা ধরা যায় না); অগ্রাহ্যম্ (যাঁকে গ্রহণ করা যায় না); অগোত্রম্ (মূল বা উৎস নেই); অবর্ণম্ (রূপহীন); অচক্ষুঃশ্রোত্রম্ (চক্ষুকর্ণহীন); তৎ (সেই); অপাণিপাদম্ (হাত পা বর্জিত); নিত্যম্ (অবিনাশী); বিভুম্ (ব্যাপক); সর্বগতম্ (সর্বব্যাপী); সুসূক্ষ্মম্ (অতি সূক্ষ্ম); তৎ (সেই); অব্যয়ম্ (ক্ষয়হীন); যৎ (যিনি); ভূতযোনিম্ (সৃষ্টির উৎস); [সেই ব্রহ্মকে] ধীরাঃ (জ্ঞানী ব্যক্তিরা); পরিপশ্যন্তি (সর্বত্র দেখেন)।

সরলার্থ: যিনি অদৃশ্য (জ্ঞানেন্দ্রিয়ের অতীত), অগ্রাহ্য (কর্মেন্দ্রিয়ের অতীত), স্বয়ম্ভু, অরূপ, সকল ইন্দ্রিয়ের ঊর্ধ্বে (জ্ঞানেন্দ্রিয় ও কর্মেন্দ্রিয়) অবিনাশী এবং সর্বব্যাপী (আকাশের মতো) এবং যিনি সুক্ষ্মতম ও সকল সৃষ্টির উৎস-সেই ব্রহ্মকে জ্ঞানী ব্যক্তিরা সর্ববস্তুতে এবং সর্বত্র দেখেন।
দ্রষ্টব্যঃমুণ্ডকোপনিষদ(১/১/৬),স্বামী লোকেশ্বরানন্দ

উপরোক্ত প্রমাণগুলো হতে প্রাপ্ত বিষয়ঃ
(১)ঈশ্বর যাবতীয় প্রাকৃতিক পদার্থ হতে ভিন্ন বা পৃথক।
(২)ঈশ্বর সমস্ত ইন্দ্রিয়বর্জিত।
(৩) ব্রহ্ম অনন্ত, ইন্দ্রিয়াতীত এবং কল্পনার অতীত।
(৪)জ্ঞানেন্দ্রিয় এবং কর্মেন্দ্রিয়ের অতীত।

বিচারঃ
আমরা জানি "মুখ" হল একটি কর্মেন্দ্রিয়!অন্যান্য শাস্ত্রে পরমাত্মাকে ইন্দ্রিয়বর্জিত বলা হয়েছে।তাহলে যজুর্বেদ(৩২/৪) নং মন্ত্রে পরমাত্মার "মুখ" তথা ইন্দ্রিয় আছে এমন বলা হবে কেন?দূর্গাদাস লাহিড়ীর অনুবাদে এই মন্ত্রের শেষ অংশে বলা হয়েছে," ইনি সর্বত্রই মুখ ইত্যাদি অবয়বশালী"।সর্বত্রই মুখ বিশিষ্ট কোন প্রাণী কি পৃথিবীতে আছে?এর দ্বারা বরং পরমাত্মার অস্তিত্বই প্রশ্নবিদ্ধ হয়।
আবার শ্বেতাশ্বতর উপনিষদে বলা হয়েছে—
[সেই পরমাত্মা] হস্তূপাদশূন্য [হইয়াও] বেগবান্ ও গ্রহীতা। তিনি অচক্ষু হইয়াও দর্শন করেন, অকর্ণ [হইয়াও] শ্রবণ করেন। তিনি জ্ঞেয় বিষয় জানেন, কিন্তু তাঁহার জ্ঞাতা নাই। (যেহেতু তিনিই সর্ব্বঘটে অদ্বিতীয় জ্ঞাতা)। [ব্রহ্মবিদ্‌দ্গণ] তাঁহাকে প্রথম ও মহান্ পুরুষ বলিয়া কীর্তন করেন ।।
দ্রষ্টব্যঃশ্বেতাশ্বতর উপনিষদ(৩/১৯)


রামানুচার্য্য বলেছেন—
যে সকল বস্তুর শব্দাদিগুণ আছে তাহারা অনিত্য এবং স্থূল,ব্রহ্মের শব্দাদিগুণ নেই,তিনি নিত্য এবং শুদ্ধ।
দ্রষ্টব্যঃকঠোপনিষদ(১/৩/১৫),ভাষ্যঃরামানুচার্য্য


জিজ্ঞাসাঃ
👉সর্বত্র অর্থাৎ সবস্থানে বিরাজিত কোন সত্ত্বার মুখ হওয়া সম্ভব?যদি হয়ে থাকে তাহলে সেটি কেমন?
👉যার শব্দাদিগুণই নাই তিনি মুখ দিয়ে কি করবেন?
👉যজুর্বেদ(৩২/৫) এ বলা হয়েছে,"তার পূর্বে কিছুই উৎপন্ন হয়নি"!তাহলে ঈশ্বরের মুখ কোন পদার্থ দ্বারা তৈরী ছিল?
👉প্রশ্ন উপনিষদ(৬/৫) এ পাওয়া যায়—
তিনি প্রাণকে' সৃষ্টি করিলেন এবং প্রাণ হইতে শ্রদ্ধাকে সৃষ্টি করিলেন। অতঃপর আকাশ, বায়ু, তেজ, জল, পৃথিবী, ইন্দ্রিয়, মন, অন্ন, অন্নসম্ভূত বীর্য, তপস্যা, মন্ত্রসমূহ, অগ্নিহোত্রাদি কর্ম, লোকসমূহ এবং লোকসমূহে অবস্থিত নামও সৃজন' করিলেন।
উক্ত শ্লোক অনুসারে ষোল কলা পরমাত্মা সৃষ্টি করেছেন এবং "ইন্দ্রিয়" সেই ষোল কলার একটি।তাহলে সৃষ্টির পূর্বে পরমাত্মার "মুখ" বা ইন্দ্রিয় হওয়া কি সম্ভব?
দ্রষ্টব্যঃপ্রশ্ন উপনিষদ(৬/৫)
👉আদি শঙ্করাচার্য্য বলেছেন—
অদৃষ্ট ঈশ্বরকে কল্পনা করতে ইচ্ছুক ব্যক্তিদের ঈশ্বরের কোন শরীর অথবা ইন্দ্রিয় এর বর্ণনা দেখাতে হবে কিন্তু ইহা বর্ণনা করা সম্ভব নয়,কেননা শরীর সৃষ্টির উত্তরকালে হওয়ায় সৃষ্টির পূর্বে উহা অনুৎপন্ন হয়।
দ্রষ্টব্যঃব্রহ্মসূত্র(২/২/৪০),ভাষ্যঃআদি শঙ্করাচার্য্য


তিনি আরও বলেন—
"যিনি ইন্দ্রিয়ের বিষয়ই নয় তার মূর্তি হওয়া সম্ভব নয়"
দ্রষ্টব্যঃপরপূজা,পৃষ্ঠাঃ৪(আদি শঙ্করাচার্য্য)




আরও বলেছেন—
পরমাত্মা অজ্ঞানতাসম্পন্ন কার্যদেহ,ইন্দ্রিয়,নাম,রুপ ইত্যাদি আদিরুপী মল হতে রহিত।
দ্রষ্টব্যঃআত্মবোধ,শ্লোকঃ২০,পৃষ্ঠাঃ২৬


🤔আদি শঙ্করাচার্য্যের সিদ্ধান্তকে পৌরাণিক ভ্রাতা মান্যতা না দেওয়ার কারণ কি?
বিষয়(২)
আর্য সমাজের বেদভাষ্যে উপমা বিষয়কে নিয়ে অনেক পৌরাণিকগণ বিদ্রুপ মন্তব্য করে থাকেন,তারা এটা বলার চেষ্টা করেন যে আর্য সমাজ নিজেদের সিদ্ধান্তের সাথে সাংঘর্ষিক কোন কিছুই মানে না।এই ধারণাটি সম্পূর্ণ ভ্রান্ত,কারণ মহর্ষি দয়ানন্দ সরস্বতী স্বামী বিরজানন্দ মহারাজজীর শিষ্যত্ব প্রাপ্ত হওয়ার পূর্বে শৈব,বৈষ্ণব ইত্যাদি মতের সিদ্ধান্তগুলোকে পর্যালোচনা করেছিলেন অর্থাৎ তিনি পূর্বে সরাসরি কোন সিদ্ধান্তকে শতভাগ প্রাধান্য দেননি।যখন তিনি বেদ,বেদাঙ্গ উত্তমরুপে অধ্যয়ন করেন তখনই নিজেকে পরিবর্তিত করেন এবং বৈদিক সিদ্ধান্তকে সত্য মেনে গ্রহণ করেন।তাই উনার তৈরী আর্য সমাজও সেই অনুসারে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করবে। আর্য সমাজের বেদভাষ্যে   যে উপমা দেখানো হয়েছে তা নিয়ে পৌরাণিক বিদ্বানরা অনেক প্রকার সমালোচনা করে থাকে।বিষয়টি এমন হয়ে যায় যে,"যত দোষ নন্দ ঘোষ"!কিন্তু মজার বিষয় হলো পৌরাণিক বিদ্বানদের অধিকাংশই বেদে উপমার বিষয়টি মেনেছেন।
প্রথমে একটি মন্ত্র নিয়ে বলা যাক!
📖যজুর্বেদ(৩২/৩) নং মন্ত্রটির অনুবাদ দূর্গাদাস লাহিড়ী করেছেন—
সেই পরমাত্মার সূর্য ইত্যাদি অন্য কোনই উপমানও নেই (অর্থাৎ তার সাথে তুলনা করার মতো কিছুই নেই- যে পরমাত্মার নাম মহাযশ। সেই হিরণ্যগর্ভইত্যাদি, এই চারি মন্ত্র। তিনি যেন আমাদের না হনন করেন-ইত্যাদি অপর একটি মন্ত্র। যাঁর অপেক্ষা বৃহৎ কেউ উৎপন্ন হয়নি-ইত্যাদি এবং তিনি সম্রাট-ইত্যাদি এই দুটি মন্ত্রও এই ব্রহ্মেরই প্রতিপাদক। এগুলির পাঠ জপ ব্রহ্মযজ্ঞে করা উচিত)।
👉দূর্গাদাস লাহিড়ীর যজুর্বেদ(৩২/৩) মন্ত্রের অনুবাদে পাওয়া যায়,"সেই পরমাত্মার সূর্য ইত্যাদি অন্য কোনই উপমানও নেই (অর্থাৎ তার সাথে তুলনা করার মতো কিছুই নেই- যে পরমাত্মার নাম মহাযশ। " অর্থাৎ পরমাত্মার কোন উপমা নেই।


🤔কিন্তু সেই দূর্গাদাস লাহিড়ীরই শুক্লযজুর্বেদ(৫/২০) মন্ত্রের অনুবাদে ব্যাখ্যায় বলা হয়েছে—
[এই মন্ত্রের অন্তর্গত মৃগো ন ভীমঃ কুচরো গিরিষ্ঠাঃ মন্ত্রাংশটি সম্বন্ধে নানা বিতর্ক উপস্থিতি হয়। যাস্ক, উবট, মহীধর, সায়ন-ঐ অংশের নানারকম অর্থ-নিষ্কাশনে প্রয়াস পেয়েছেন; কিন্তু তার প্রকৃত তাৎপর্য যে কি, সেই বিষয়ে কেউই স্থির-সিদ্ধান্তে উপস্থিত হতে পারেন নি। তাদের ব্যাখ্যায় মৃগো ন ভীমা অংশ কখনও উপমার মধ্যে ৬ পরিগণিত হয়েছে, কখনও বা তাঁরা ঐ অংশকে উপমারূপে গ্রহণ করেন নি। এইরকম ভাষ্য ব্যাখ্যাগুলিতে। দুটি পক্ষ পরিগৃহীত হয়েছে। একটি লৌকিক পক্ষ, অপরটি দেবপক্ষ। লৌকিক পক্ষে মৃগোন ভীমঃ অংশটি উপমা বলে ধরা হয়েছে, আর দেবতাভিধানে নপদ পাদপূরণে ব্যবহৃত বলে উপমা পরিত্যক্ত হয়েছে। মৃগো ন ভীমঃ অংশকে উপমা বলে স্বীকার করে লৌকিক প্রয়োগ-অনুসারে মন্ত্রের যে অর্থ, প্রচলিত আছে, তা এই-যেহেতু বিষ্ণুর তিন পদক্ষেপে সমস্ত ভূবন অবস্থিতি করে, অতএব ভয়ঙ্কর হিংস্র, গিরিশায়ী আরণ্য-জন্তুর মতো বিষ্ণুর বিক্রম লোকে প্রশংসা করে।-এ রকম অর্থে মন্ত্রের যে কি ভাব প্রকাশ পায়, সুধীগণেরই তা বিচার্য।



➡️এখানে দূর্গাদাস লাহিড়ী বলছেন কেউ কেউ উপমা মেনেছেন আবার কেউ কেউ মানেন নি।
👉ঋগ্বেদ(১/৩২/১৫) মন্ত্রের অনুবাদে রমেশ চন্দ্র দত্ত (৪) নং পয়েন্টে লিখেছেন—

(৪) ইন্দ্র পণিকে জয় করিয়া দেবগণের গাভী উদ্ধার করেন এসম্বন্ধে যে বেদে গল্প আছে তাহা প্রাতঃকালে অন্ধকার বিনাশ ও আলোক প্রকাশ সম্বন্ধে উপমা ঘটিত গল্প মাত্র।


➡️সায়ণাচার্য্যও বেদে উপমা মেনেছেন।
👉রমেশ চন্দ্র দত্তের ঋগ্বেদ(১০/১১৪/৫) মন্ত্র অনুবাদে পাওয়া যায়—
 পক্ষী একই আছেন, বুদ্ধিমান পণ্ডিতগণ তাঁকে কল্পনাপূর্বক অনেক প্রকার বর্ণনা করেন। তাঁরা যজ্ঞের সময় নানা ছন্দ উচ্চারণ করেন এবং দ্বাদশসংখ্যক সোমপাত্র সংস্থাপন করেন।
অর্থাৎ পরমাত্মা এক,বুদ্ধিমানরা পরমাত্মাকে অনেক প্রকার কল্পনা করেন মাত্র!


👉রমেশ চন্দ্র দত্তের ঋগ্বেদ(১/২৩)  সূক্তের অনুবাদে (১) নং পয়েন্টে আমরা পাই—
যদিও উত্তয় বিশেষণই উভয় দেব সম্বন্ধে প্রয়োগ হইয়াছে, তথাপি "মনের ন্যায় বেগসম্পন্ন' সায়ুব সম্বন্ধেও "সহস্রাক্ষ” ইন্দ্রের সম্বন্ধে খাটে। ইন্দ্রকে সহস্রাক্ষ বলে কেন? আকাশ বিস্তীর্ণ, অথবা বহুনক্ষত্র বিভূষিত, এই জন্য তাঁহাকে সহস্রাক্ষ বলা হইয়াছে।এই উপমা হইতে ইন্দ্রের সহস্রাক্ষ সম্বন্ধীয় পৌরাণিক আখ্যান সৃষ্ট হয়।


➡️উল্লেখিত মন্ত্রেও উপমা বোঝানো হয়েছে।
👉অমরেশ্বর ঠাকুরের নিরুক্ত(১/৩/৯/১৪) তেও উপমার উল্লেখ পাওয়া যায়।দেখুন—
'মুগো ন ভীমঃ কুচরো গিরিষ্ঠাঃ' ইহা ঋগ্বেদের (১০/১৮০/২) মন্ত্রের অংশ। এই মন্ত্রে ইন্দ্র প্রধান দেবতা, ইন্দ্রকে মৃগের সহিত তুলনা করা হইয়াছে, মৃগ উপমান মাত্র, প্রধান নহে, নৈঘণ্টক।


➡️ঋগ্বেদ (১০/১৮০/২) মন্ত্রেও অমরেশ্বর ঠাকুর উপমা মেনেছেন।
👉দূর্গাদাস লাহিড়ীর শুক্লযজুর্বেদ(৫/১৫) এর অনুবাদে পাওয়া যায়—
বিষ্ণুঃ বিশ্বব্যাপী পরমেশ্বরঃ; ত্রেধা অতীতানাগতবর্তমানত্রিকালমেব; পাংসুরে-রশ্মিকণাযুক্ত প্রভুত্বে, জ্ঞানস্বরূপে পদে; ইত্যাদি। ত্রেধা অগ্নিবায়ুসূর্যরূপেণ ভূম্যন্তরিক্ষদুলোকেষু ত্রিধা; পাংসুরে- পাংসুল ইব প্রদেশে অতিনিগূঢ়প্রদেশে ইতি ভাবঃ; ইত্যাদি]। [ভাষ্যে ত্রেধা পদে তিনবার এবং বিচক্রমে পদে ভ্রমণ করেছিলেন-এইরকম অর্থ পরিগ্রহ করা হয়। পদং পদে পা এবং নিদধে পদে ধারণ বা রক্ষা করেছিলেন- এইরকম অর্থ পরিগ্রহ করা হয়। তারপর পাংসুলে পদে ধূলিকণায় এবং সমূঢ়ং পদে সমাবৃত হয়েছিল, এইরকম অর্থ স্থির হয়ে যায়। তাতে এক শ্রেণীর ব্যাখ্যাকারের ব্যাখ্যায় মন্ত্রের ভাব দাঁড়িয়ে গেছে,-বিষ্ণু যখন মধ্য এশিয়া থেকে দলবল সহ এ দেশে আসছিলেন, তখন পথে তিনি তিন স্থানে বিশ্রাম করেছিলেন এবং তার চরণধূলিতে জগৎ পরিব্যাপ্ত হয়েছিল। কেউ বা, বিষ্ণুর পদধূলিতে জগৎ আচ্ছন্ন-এমন উক্তি থেকে জগতে বিষ্ণুর অধিপত্য বিস্তৃত হয়েছিল বলে মনে করেন। কেউ বা বিষ্ণুকে সূর্য জ্ঞান করে সূর্যরশ্মির বিষয় ধূলি-বিস্তৃতির উপমায় ব্যক্ত হয়েছে সিদ্ধান্ত করে নেন]


➡️বিষ্ণুর মধ্য এশিয়া থেকে দলবল নিয়ে ভারতবর্ষে আসার বিষয়টিও কি উপমা ছাড়া গৃহীত হবে?
পৌরাণিক বেদভাষ্য এবং অনুবাদে এত উপমা থাকা সত্ত্বেও বারবার সেগুলোকে এড়িয়ে গিয়ে সব দোষ আর্য সমাজের উপর চাপিয়ে দেয়।এর কারণ হল,"বিভ্রম"!
👉দূর্গাদাস লাহিড়ীর ঋগ্বেদ(১/২২/১০) মন্ত্রের অনুবাদে পাওয়া যায়—
রূপ-গুণের অংশভূত নরদেহধারী জীব আমরা, রূপগুণের অভীষ্ঠ বিষয়কে আমাদের ধ্যান ধারণায় ধারণা করিতে পারি না; তাই আমরা আমাদের দেবতাকে মনোমত ধারণাযোগ্য রূপে গুণে বিভূষিত করিয়া লই; তাই আমরা অরূপে রূপের আরোপ করি, অগুণে গুণের প্রকাশ দেখি; তাই আমাদের দেবদেবী, অদৃশ্য অব্যক্ত অবাত্মনসগোচর হইয়াও, দৃশ্য-রূপে, ব্যক্ত ভাষায়, বাত্মনের গোচরীভূত অবস্থায়, প্রকাশনাম্ হন। 'মর্মানুসারিণী-ব্যাখ্যায়' বা 'বঙ্গানুবাদে' দুই দিক্ দিয়া ঋকের যে দুইরূপ অর্থ দুইরূপ ভাব প্রকাশ করিলাম; তাহাতে, এক-অদৃশ্যকে দৃশ্যভাবে, অন্যে-অব্যক্তকে ব্যক্তভাবে প্রকাশের চেষ্টা হইয়াছে মাত্র। ফলতঃ, যই যাহা-কিছু বিপদ-ব্যাখ্যার স্পর্দ্ধা করি না কেন, সকলই আমাদের বিভ্রম মাত্র; কেন-না, স্বরূপ-ব্যক্তি-চিত্রপটেও হয় না, ভাষায়ও হয় না; সে কেবল অনুভাবনার সামগ্রী মাত্র-সে কেবল জ্ঞানযোগের বিষয়ীভূত।
দ্রষ্টব্যঃঋগ্বেদ(১/২২/১০)মন্ত্রের ব্যাখ্যা,অনুবাদঃদূর্গাদাস লাহিড়ী




সিদ্ধান্তঃ
উপরোক্ত প্রমাণাদি হতে এটিই সিদ্ধ হয় যে যজুর্বেদ(৩২/৪) মন্ত্রে কখনই ঈশ্বরের মুখের কথা বলা হয় নি।এটি পরমাত্মার সর্বব্যাপকতাকে বোঝানোর জন্য উপমা ব্যবহার করা হয়েছে।

ও৩ম্ কৃণ্বন্তো বিশ্বমার্যম্
✍️অরুপ আর্য
🙏অমৃতস্য পুত্রাঃ🙏

Post a Comment

0Comments

Please Select Embedded Mode To show the Comment System.*