আমরা সনাতনীরা নিজেদের সনাতন ধর্মের সিদ্ধান্ত নিয়ে বিভিন্ন সমস্যায় জর্জরিত। বিভিন্ন মত,পথ সনাতন ধর্মে তৈরী হওয়ার ফলে সিদ্ধান্তেও ভিন্নতা দৃষ্টিগোচর হয়। বিভিন্ন সিদ্ধান্তের মধ্যে একটি গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্তে আমরা ভিন্ন ভিন্ন মত পোষণ করে থাকি। যে পরমাত্মা আমাদের কর্মের যথাযথ ফল প্রদান করেন, সেই পরমাত্মাকে নিয়ে সনাতনীদের মধ্যে বহুল আলোচনা হয়ে থাকে। কেউ মেনে থাকেন পরমাত্মা সাকার, কেউ মানেন নিরাকার আর কেউ কেউ পরমাত্মাকে উভয়রুপেই মেনে থাকেন। এই লেখায় পরমাত্মাকে সাকার এবং নিরাকার উভয় মান্যতার একজন পৌরাণিক ভ্রাতার প্রচারিত কিছু প্রমাণ নিয়ে আলোচনা করবো।
চলুন শুরু করা যাক...........
উল্লেখিত প্রমাণ (১)—
যজুর্বেদ(১৬/২)—ঈশ্বরের তনু বা শরীর আছে।
খণ্ডনঃ
প্রথমে মন্ত্রটা দেখা যাক—
যা তে রুদ্র শিবা তনুরঘোরাহপাপকাশিনী।
তয়া নস্ত শন্তময়া গিরিশন্তাভি চাকশীহি৷৷
অনুবাদঃ হে রুদ্র! তোমার যে শরীর মঙ্গলকারী, অভয়ঙ্কর এবং কখনও পাপফল নয়, সেই আপন অত্যন্ত শান্ত শরীরের দ্বারাই, হে গিরিবাসী রুদ্র! তুমি আমাদের দেখ।
দ্রষ্টব্যঃ শুক্লযজুর্বেদ (১৬/২), অনুবাদকঃ দূর্গাদাস লাহিড়ী।
মন্ত্রের বিষয় দূর্গাদাস লাহিড়ী লিখেছেন—
এই অধ্যায়ে শতরুদ্রিয় হোমের মন্ত্রসমূহের বিধান অর্থাৎ শতরুদ্রিয় হোম কিভাবে করবে তার বিধান।
★এই ষোড়শ অধ্যায়ের (২৮-৩৬) পর্যন্ত মন্ত্রসমূহে আলোকপাত করা খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
মন্ত্র-২৮: কুকুররূপী রুদ্রদের নমস্কার; কুকুরগণের পালক কিরাত ইত্যাদি রূপী রুদ্রগণকে নমস্কার। ভবরূপী রুদ্রগণকে নমস্কার; রুদ্ররূপী রুদ্রগণকে নমস্কার; শর্বরূপী রুদ্রগণকে নমস্কার; পশুপতি রুদ্রকে নমস্কার; নীলগ্রীবা (বা কৃষ্ণগ্রীবা) ও শিতিকণ্ঠ (বা শ্বেতকণ্ঠ) রুদ্রকে নমস্কার।
মন্ত্র-২৯: কপর্দ (জটাজুট)-ধারী শিবরূপী রুদ্রকে নমস্কার; মুণ্ডিতকেশ রুদ্রকে নমস্কার; সহস্রাক্ষ রুদ্রকে নমস্কার। বহু ধনুর্ধারী শিবকে নমস্কার; গিরি বা পর্বতে শয়নকারী শিবকে নমস্কার। শিপিবিষ্ট (অর্থাৎ বিষ্ণু বা আদিত্যরূপী) রুদ্রকে নমস্কার। অত্যন্ত সেক্তা (মেঘরূপে নিষেককারী) এবং বাণযুক্ত রুদ্রকে নমস্কার।
মন্ত্র-৩০: হ্রস্ব (ক্ষুদ্র) রুদ্রকে নমস্কার। বামনকে নমস্কার। মহান্ রুদ্রকে নমস্কার। সকলের অধিক বর্ষশালী রুদ্রকে নমস্কার। বৃদ্ধকে নমস্কার। অনুভব প্রাপ্তকে নমস্কার। শ্রেষ্ঠ এবং ধনাভূত রুদ্রকে নমস্কার।
মন্ত্র-৩১: জগতে ব্যাপ্তিশীল রুদ্রকে নমস্কার, গতিশীল রুদ্রকে নমস্কার। ক্ষিপ্রকারী রুদ্রকে নমস্কার জলপ্রবাহী রুদ্রকে নমস্কার। লহরযুক্ত (তরঙ্গায়িত) রুদ্রকে নমস্কার। স্থির জলসম্পন্ন রুদ্রকে নমস্কার।
মন্ত্র-৩২: জ্যেষ্ঠ রুদ্রকে নমস্কার এবং কনিষ্ঠরূপী রুদ্রকে নমস্কার। পূর্বজরূপী রুদ্রকে নমস্কার এবং উত্তরজ (পরে উৎপন্ন) রুদ্রগণকে নমস্কার। মধ্যম (অর্থাৎ তির্যক যোনিজাত) রুদ্রকে নমস্কার এবং অপ্রগলভ (অনিয়মজাত) রুদ্রকে নমস্কার। জঘন্য (অর্থাৎ গো-ইত্যাদির পশ্চাতে) এবং নিম্নস্থ (অর্থাৎ বৃক্ষ ইত্যাদি মূলে জাত) রুদ্রকে নমস্কার।
মন্ত্র-৩৩: গন্ধর্বনগরে উৎপন্ন বা পাপপুণ্যজ মনুষ্য লোকে উৎপন্ন রুদ্রকে নমস্কার। বিবাহোচিত হস্তসূত্রধারী অথবা অভিচারে উৎপন্ন রুদ্রকে নমস্কার। পাপীগণকে নরকে আর্তি (পীড়া) প্রদানশীল রুদ্রকে নমস্কার তথা কুশলে উৎপন্ন রুদ্রকে নমস্কার। শ্লোকের যোগ্য রুদ্রকে নমস্কার। সমাপ্তি বা বেদান্তের সাথে সম্বন্ধিত রুদ্রকে নমস্কার। উর্বর ভূমিতে ধান্য ইত্যাদি উৎপন্ন রুদ্রকে নমস্কার। প্রাঙ্গনে বা ফসল মাড়াইয়ের স্থানে (বা খামারে) উৎপন্ন (বা প্রাপ্ত) রুদ্রকে নমস্কার।
মন্ত্র-৩৪: বনে উৎপন্ন (বৃক্ষ ইত্যাদিরূপী) রুদ্রকে নমস্কার। কক্ষ অর্থাৎ তৃণ ও গুল্ম ইত্যাদিতে উৎপন্ন রুদ্রকে নমস্কার। শব্দ-প্রতিশব্দরূপ রুদ্রকে নমস্কার। শীঘ্রগতি সেনাশালী রুদ্রকে নমস্কার। শীঘ্ররথী রুদ্রকে নমস্কার। যুদ্ধে শূর রুদ্রকে নমস্কার এবং শত্রুগণকে বিভেদিত করণশীল রুদ্রকে নমস্কার ৷
মন্ত্র-৩৫: শিরস্ত্রাণযুক্ত রুদ্রকে নমস্কার, তথা কবচধারী রুদ্রকে নমস্কার। শরীররক্ষক বর্মধারী রুদ্রকে নমস্কার; হস্তীর উপরে ধারণীয় শিবিকাধারীরুদ্রকে নমস্কার। প্রসিদ্ধ বীরকে নমস্কার, তথা প্রসিদ্ধ সেনাসম্পন্ন সেনাপতি রুদ্রকে নমস্কার। দুন্দভী শব্দরূপী এবং বাদনদণ্ডকেও, নমস্কার ৷৷
মন্ত্র-৩৬: ধর্ষকরূপী রুদ্রকে নমস্কার এবং বিমর্শকারী (তর্ককারী বা বিচারক) পণ্ডিতরূপী রুদ্রকে নমস্কার। খঙ্গধারী রুদ্রকে নমস্কার, তথা বাণধারী (তূণীরধারী) রুদ্রকেও নমস্কার। তীক্ষ্ণ বাণশালী রুদ্রকে নমস্কার এবং আয়ুধবান্ বীর রুদ্রকে নমস্কার। শোভন আয়ুধশালী (ত্রিশূলধারী) রুদ্রকে নমস্কার এবং শুভ ধনুষশালী (সুধন্থা বা পিনাকধারী) রুদ্রকে নমস্কার।
লক্ষ্যণীয় বিষয়ঃ
👉মন্ত্রে "রুদ্র" পদ যদি ঈশ্বর পক্ষে নেওয়া হয় তাহলে শুক্লযজুর্বেদ (১৬/৩১) এর দূর্গাদাস লাহিড়ীর অনুবাদ অনুসারে পরমাত্মা অর্থাৎ রুদ্র ব্যাপ্তিশীল হবেন।তাই এখানে স্বাভাবিকরুপে প্রশ্ন আসে শরীরধারী কোন সত্ত্বা কি সর্বব্যাপী হতে পারেন?
👉শুক্লযজুর্বেদ (১৬/৩৬) মন্ত্রে ধর্ষকরুপী রুদ্রকে নমস্কারের কথা বলা হয়েছে। পরমাত্মাও কি ধর্ষক হন? যদি হয়েও থাকেন তাহলে ধর্ষণের মত অপরাধের জন্য পরমাত্মার কি ফল ভোগ করা উচিত?
👉 শুক্লযজুর্বেদ (১৬/৫৪), দূর্গাদাস লাহিড়ীর অনুবাদে পাওয়া যায়—
"ভূমির উপর যে অসংখ্য রুদ্র আছে, তাদের সকল ধনুষকে আমরা মন্ত্রবলে সহস্র যোজন দূরে নিক্ষেপ করছি"।
উক্ত মন্ত্রের অনুবাদে পাওয়া " ভূমির উপর যে অসংখ্য রুদ্র আছে" এর মানে কি ভূমির উপর অসংখ্য ঈশ্বর বা পরমাত্মা আছেন? তাহলে পরমাত্মা অসংখ্য হয়ে যায়।
👉"বিবাহোচিত হস্তসূত্রধারী অথবা অভিচারে উৎপন্ন রুদ্রকে নমস্কার" এই কথাটি যদি সত্যই হয় তবে শুক্লযজুর্বেদ(৩১/১৯) মন্ত্রের সাথে বিরোধ হয়ে যায়। কারণ (ক)যজুর্বেদ(৩১/১৯) মন্ত্রে পরমাত্মাকে "অজায়মানঃ" অর্থাৎ স্বয়ং উৎপন্ন হয় না বলা হয়েছে।(খ)মহিধর তার শুক্লযজুর্বেদ(৩১/১৯) মন্ত্রের ভাষ্যে "অজায়মানঃ" এর অর্থ করেছেন "অনুত্পদ্যমানো" অর্থাৎ অনুৎপন্ন। ১৬তম অধ্যায়ে উৎপন্ন হয় বলে আবার ৩১ তম অধ্যায়ে অনুৎপন্ন বলায় মন্ত্রগুলো পরস্পর বিরোধী হয়।
(ক)–
(খ)–
👉করপাত্রী মহারাজতো শুক্লযজুর্বেদ (১৬/২) এ কৈলাসপতি শিবকে নিয়ে এসেছেন।
দ্রষ্টব্যঃ শুক্লযজুর্বেদ (১৬/২),ভাষ্যঃ করপাত্রী মহারাজ
কিন্তু মহাভারতে উমাপতি শিবকে আবার ব্রহ্মার পুত্র বলা হয়েছে।
দ্রষ্টব্যঃ মহাভারত, শান্তিপর্ব (৩৩৭/৬২), ক্রিটিক্যাল ইডিশন (BORI)
👉 (ক)শুক্লযজুর্বেদ (১৬/২) এ ঈশ্বরের শরীর আছে এমন মেনে থাকলে তা আবার শুক্লযজুর্বেদ (৪০/৮) এর বিরোধী হয়ে যায়। কারণ,করপাত্রী মহারাজ শুক্লযজুর্বেদ (৪০/৮) মন্ত্রের ভাষ্যে পরমাত্মাকে শরীররহিত বলেছেন।
(খ) একই মন্ত্রের দূর্গাদাস লাহিড়ীর অনুবাদেও "শরীরহীন বা নিরাকার" ই পাওয়া যায়।
(গ) উব্বটাচার্য্য শুক্লযজুর্বেদ (৪০/৮) মন্ত্রের ভাষ্যে "অকায়ম্" এর অর্থ করেছেন "ন বিদ্যতে শরীরং যস্য স তথোক্তঃ"!
(ঘ) মহিধর শুক্লযজুর্বেদ(৪০/৮) মন্ত্রের ভাষ্যে "অকায়ম্" এর অর্থ করেছেন "ন শরীরং যস্য তত্"!
পৌরাণিকদের ঈশ্বর এমনই হয়! যিনি যে কাজ আগে থেকে পারতেন না,সে কাজ করার জন্য নিরাকার থেকে সাকার হন।অথচ গীতা (২/২৪) এ বলা হয়েছে—
অচ্ছেদ্যোহয়মদাহ্যোহয়মক্লেদ্যোশোষ্য এব চ৷
নিত্যঃ সর্বগতঃ স্থাণুরচলোহয়ং সনাতনঃ৷৷
অনুবাদঃ এই আত্মা অচ্ছেদ্য, অদাহ্য, অক্লেদ্য। তিনি চিরস্থায়ী, সর্বব্যাপ্ত, অপরিবর্তনীয়, অচল এবং সনাতন।
অপরিবর্তনীয় ঈশ্বর নিরাকার থেকে সাকার হয়ে যান জাদু দেখিয়ে আবার প্রয়োজন হলে জন্মগ্রহণও করেন। মজার বিষয় হলো আদি শঙ্করাচার্য্য তার ব্রহ্মসূত্র(৩/২/১১) এর ভাষ্যে বলেছেন," পরমাত্মার মধ্যে নির্বিশেষ এবং সবিশেষ দুই স্বভাব হওয়া সম্ভব নয়, কেননা যাহা সত্য বস্তু তাতে দুই বিরুদ্ধ ধর্ম হওয়া সম্ভব নয়"!
দ্রষ্টব্যঃ ব্রহ্মসূত্র (৩/২/১১), ভাষ্যঃ আদি শঙ্করাচার্য্য।
★পৌরাণিকরা নাতো তাদের আচার্য্যদের মান্যতা দেয়,নাতো গীতাকে মান্যতা দেয়।
পৌরাণিকদের বর্তমান অবস্থাঃ
"বিচার মানি কিন্তু তালগাছ আমার"!
✍️ অরুপ আর্য
🙏অমৃতস্য পুত্রাঃ🙏
ও৩ম্ কৃণ্বন্তো বিশ্বমার্যম্