যেমন শ্রীকৃষ্ণ ও রাধার সম্পর্ক নিয়ে বিবিধ বিপরীত তথ্য
উপলব্ধ হয়, তেমনই রাধার উৎপত্তি বা আবির্ভাব বিষয়েও
পাওয়া যায়। শ্রী মনোরঞ্জন দে 'শ্রী শ্রী রাধাতত্ত্ব' নামে পুস্তকে এরূপ কিছু তথ্য একত্রিত করেছেন। যা যা আছে তা এরূপ–
১.গোবিন্দ বিজয় কাব্যগ্রন্থ
২.পদ্মপুরাণ অনুযায়ী
৩.ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণ অনুযায়ী
৪.ললিতমাধব-নাটক অনুযায়ী
৫.শ্রীকৃষ্ণ কীর্ত্তন গ্রন্থানুযায়ী
৬.তন্ত্রশাস্ত্রানুযায়ী
মতভেদ–
শ্রী শ্রী রাধা তত্ত্ব
গ্রন্থ থেকে ৬টি তথ্য এখানে যথাবৎ দেওয়া
হয়েছে। এখানে যদি আপনাদের মতভেদ দৃষ্ট হয় তো ভালো,
না হলে আমি এখানে রাধার উৎপত্তি বা আবির্ভাব নিয়ে যে মতভেদ আছে তা
স্পষ্ট করছি।
১.
গোবিন্দ বিজয় কাব্যগ্রন্থে বুঝানো হয়েছে যে,
রাধার উৎপত্তি গোবিন্দ অর্থাৎ শ্রীকৃষ্ণের শরীর থেকে হয়েছে।
ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণের বিবিধ স্থলে এবং দেবীভাগবতেও বলা হয়েছে যে শ্রীকৃষ্ণের
বামাংশ হইতে রাধার উৎপত্তি হয়েছে। (রাধার পরিচয়-৯নং দেখুন)।
২.
মহাভাগবতের ৪৯নং অধ্যায়ের
১৬-২৯ শ্লোকে বুঝানো হয়েছে যে- রাধা শিবের অবতার। শিব নিজেই বলেন "বৃষভানোঃ
সুতা রাধাস্বরূপাহং স্বয়ং শিবে" অর্থাৎ আমি বৃষাভানুপুত্রী রাধা হয়ে বিহার
করবো। (পুরাণ বিমর্শের 'পুরাণে শ্রীকৃষ্ণ' অংশ
দেখুন)
অপরদিকে গর্গ সংহিতা, শ্রীবৃন্দাবনখণ্ডের ২৫নং অধ্যায়ে বলা হয়েছে যে- শিবজী শ্রীকৃষ্ণের দর্শনের
জন্য রাসমণ্ডলে প্রবেশ করতে চাইলে, দ্বারপালিকা
বলেন–
আমরা কোটি-কোটি গোপী, বৃন্দাবনকে চারদিক থেকে ঘিরে রাসমণ্ডলকে সর্বদা রক্ষা করছি।
শ্যামাসুন্দর শ্রীকৃষ্ণই আমাদের এই কাজে নিযুক্ত করেছেন। এই নির্জন রাসমণ্ডলে,
একমাত্র কৃষ্ণই পুরুষ। গোপীযুত ছাড়া আর কেউ সেই পুরুষহীন নির্জন
স্থানে যেতে পারবে না। যদি আপনারা দুজনেই
তাঁকে দেখতে চান, তাহলে এই মানস সরোবরে স্নান করুন। সেখানে
আপনারা শীঘ্রই গোপী রূপ লাভ করবেন, এবং তারপর রাসমণ্ডলে
প্রবেশ করতে পারবেন।
এসব শুনে শিবজী এবং মুনি উভয়ে সেই সরোবরে স্নান করে তারপরেই রাসমণ্ডলে প্রবেশ
করেন।
একস্থানে বুঝালো রাধা
শিবের অবতার, অন্যত্র বুঝালো রাধা শিবের অবতার নয় বলেই
রাসমণ্ডলে নারী হয়ে তারপর প্রবেশ করতে হয়েছে।
৩.
পদ্মপুরাণ,পাতালখণ্ড-৪০নং অধ্যায়ের ১৫নং শ্লোকের পর থেকে বলা হয়েছে যে-
নারদ মুনি চিন্তা করলেন
যে, ভগবতী লক্ষ্মী ভগবানের সহিত ক্রীড়ার
নিমিত্তে গোপিকারূপ ধারণ করিয়া অবশ্য ভূমণ্ডলে অবতীর্ণ হইয়াছেন, সংশয় নাই, অতএব তাঁহাকে অদ্য প্রত্যেক ব্রজবাসীর
গৃহে অন্বেষণ করিয়া দেখি।
এবং খোঁজেও পেলেন
বৃষভানুর গৃহে। মূলভাব এই যে রাধা লক্ষ্মী দেবীর অবতার। কিন্তু ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণ,প্রকৃতিখণ্ড-৪৮/৪৪ নং শ্লোকে বলা হয়েছে–
রাধাবামাংশভাগেন
মহালক্ষ্মীবভূব সা।
চতুর্ভূজস্য সা
পত্নী দেবী বৈকুণ্ঠবাসিনী ॥৪৪
অর্থাৎ রাধার বাম অংশ
হইতে মহালক্ষ্মী উৎপন্ন হন এবং তিনি চতুর্ভুজ নারায়ণের প্রিয়তমা ; বৈকুণ্ঠে তাঁহার বাস।
৪.
রাধাতন্ত্রম্ এর ৭ম পটলে
বুঝানো হয়েছে যে- মহাত্মা বৃকভানু যমুনাতীরে মহাকালীর আরাধনা করিতে লাগিলে সেখানে
মহামায়া কাত্যায়নী উপস্থিত হন। তিঁনি বৃকভানুকে বর প্রার্থনা করতে বলেন, বৃকভানু বলেন - প্রার্থনা এই যে তোমার সদৃশরূপা একটা কন্যা
আমাকে প্রদান কর। কাত্যায়নী দেবী তার প্রার্থনায়- অতি মনোহর একটা ডিম্ব প্রদান
করি-লেন। সেই ডিম্ব নিয়ে তিঁনি নিজ স্ত্রী কীর্ত্তিদাকে দিলেন। তিনি সেই ডিম্ব
পর্যবেক্ষণ করছিলেন, তখনই সেই ডিম্ব দ্বিখণ্ডিত হইয়া এক কন্যার
আবির্ভাব হইলো, আর বৃকভানু এবং কীর্ত্তিদা দেবী উভয়ে মিলে
সেই কন্যার নামই 'রাধা' রাখেন।
(সংক্ষেপে)
৫.
পদ্মপুরাণ, ব্রহ্মখন্ড ৭/৩৪-৪২ নং শ্লোক অনুযায়ী, ব্রহ্মা
নারদ মুনিকে শ্রীমতি রাধারাণীর কিভাবে এই পৃথিবীতে আবির্ভূত হন তা বর্ণনা করতে
গিয়ে বলেন–
একদা পৃথিবী বৎস
দুষ্টসঙ্গশ্চ তাড়িতা।
গৌভূর্ত্বা চ ভূশং
দীনা চ যত্রৌ সা মমান্তিকম।।৩৪।।
নিবেদয়ামাস দুঃখং
রুদন্তী চ পুনঃপুনঃ।
তদ্বাক্যঞ্চ
সমাকণ্য গতোহহং বিষ্ণুসন্নিধিম।।৩৫।।
কৃষ্ণে
নিবেদিতশ্চাশু পৃথিব্যা দুঃখসঞ্চয়ঃ।
তেনোক্তং গচ্ছ ভো
ব্রহ্মণ দেবৈ সার্দ্ধঞ্চ ভূতলে।।৩৬।।
অহং তত্রাপি
গচ্ছামি পশ্চাত্মম গণৈ সহ।।৩৭।।
তচ্ছ্রত্বা সহিতো
দেবৈরাগতঃ পৃথিবীতলম।
ততঃ কৃষ্ণ সমাহূয়
রাধাং প্রাণগরীয়সীম।।৩৮।।
উবাচ বচনং দেবি
গচ্ছেহহং পৃথিবীতলম।
পৃথিবীভারনাশায়
গচ্ছ ত্বং মর্ত্ত্যমন্ডলম।।৩৯।।
ইতি শ্রুত্বাপি সা
রাধাপ্যাগতা পৃথিবীং ততঃ।
ভাদ্রে মাসি
সিতেপক্ষে অষ্টমীসংজ্ঞিকে তিথৌ।।৪০।।
বৃষভানোযজ্ঞভূমৌ
জাতা সা রাধিকা দিবা।
যজ্ঞাথং
শোধিতায়াঞ্চ দৃষ্টা সা দিব্যরুপিনী।।৪১।।
রাজানন্দমনা ভূত্বা
তাং প্রাপ্য নিজমন্দিরম।
দত্তবান মহিষীং
বীত্বা সা চ ত্বাং পয্যপালয়ৎ।।৪২।।
(পদ্মপুরাণ,
ব্রহ্মখণ্ড ৭/৩৪-৪২)
অনুবাদ: বৎস একদা পৃথিবী
দুঃজনসমূহে দ্বারা পীড়িত হওয়ায় গোরূপ ধারণপূর্বক অত্যন্ত দীন হইয়া পুনঃপুনঃ
কাঁদিতে কাঁদিতে আমার নিকট আসিয়া স্বীয় দুঃখ নিবেদন করিল। পৃথিবীর বাক্য শ্রবণ
করিয়া আমি বিষ্ণুর সন্নিকটে গমন পূর্বক তার নিকট পৃথিবীর দুঃখরাশি নিবেদন করিলাম। তিনি
বললেন– হে ব্রহ্মণ,তুমি
দেবগণসহ ভূতলে গমন কর। আমি পরে আমার লোকজন সহ সেখানে গমন করব। আমি সেই কথা শ্রবণ
করে দেবগণসহ ভূতলে আসিলাম। অনন্তর শ্রীকৃষ্ণ প্রাণপ্রিয়া শ্রীরাধিকাকে আহবান করে
বললেন– দেবী, আমি পৃথিবীতে গমন করব।
পৃথিবীর ভার নাশের নিমিত্তে তুমিও মর্ত্ত্যমন্ডলে
গমন কর। শ্রীরাধিকা এই কথা শ্রবণ করে পৃথিবীতলে আগমন করেন। ভাদ্রমাসের শুক্লপক্ষের
অষ্টমী তিথিতে শ্রীরাধিকা দেবী বৃষভানুর যজ্ঞস্থলে আবির্ভূত হন। যজ্ঞার্থ শোধিত
ভূতলে সেই দিব্যরুপিনী শ্রীরাধা পরিদৃষ্ট হলেন। রাজা তাঁকে পেয়ে আনন্দিত মনে নিজ
নিকেতনে লইয়া গেলেন এবং মহিষীর নিকট অর্পন করিলেন। রাজমহিষী তাঁকে পালন করতে
লাগলেন।
রাধাতন্ত্রে বুঝালো কি আর
পদ্মপুরাণে বুঝালো কি! দুটোই ভিন্ন এবং বিপরীত। তন্ত্রে বুঝালো
ডিম্ব থেকে রাধার উৎপত্তি, পদ্মপুরাণে বুঝালো যজ্ঞস্থলে আবির্ভূত
হয়েছে, অপরদিকে ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণে বলছে -
কলাবতীর গর্ভে জন্মগ্রহণ করেন।
©️অমৃতস্য পুত্রাঃ