বেদ-মন্ত্র ঋষিগণ রচনা করেছেন?

 বেদ-মন্ত্র ঋষিগণ রচনা করেছেন?

বেদমন্ত্রের সহিত যে মন্ত্রদ্রষ্টা ঋষিগণের নাম লিখা হয়ে আসছে, তাঁদেরকে কিছু বিদ্বান্ মন্ত্রদ্রষ্টা নয় অপিতু মন্ত্রকর্ত্তা মানেন। মুর তার নিজ গ্রন্থ (Original Sanskrit text, vo1. iii) তৃতীয় প্রকরণে প্রায় ৮০টি রেফারেন্স দিয়েছে যাতে 'কৃ' এবং 'তক্ষ্' ধাতুর প্রয়োগ হয়েছে।

'পঞ্চবিংশ' ব্রাহ্মণ (১৩/৩/১৪) এবং ঐতরেয় ব্রাহ্মণেও (৬/১/১) মন্ত্রকৃৎ শব্দের প্রয়োগ হয়েছে।

তৈত্তিরিয়ারণ্যক চতুর্থ প্রপাঠকের প্রথম অনুবাকেও মন্ত্রকৃৎ শব্দের উল্লেখ রয়েছে। উপর্যুক্ত বিদ্বান্ নিজ পক্ষ সিদ্ধ করতে এগুলি এবং অনুরূপ রেফারেন্স দিয়ে থাকেন। পরন্তু সায়ণাদি পৌরাণিক বিদ্বানরা পর্যন্ত এই বিদ্বানদের পক্ষ সমর্থন করেন না।  এখানে দুটি উদাহরণ দেওয়া হল।

(১) উপরে উল্লিখিত তৈত্তিরীয়ারণ্যকে (৪/১৭) প্রযুক্ত বাক্য নিম্নরূপ-

নমো ঋষিভ্যো মন্ত্রকৃদ্ভ্যো মন্ত্রপতিভ্যঃ॥

এর ভাষ্য করতে গিয়ে সায়ণাচার্য এইপ্রকার লিখেছেন–
'মন্ত্রকৃদ্ভ্যঃ মন্ত্রং কুর্বন্তীতি মন্ত্রকৃতঃ । যদ্যপ্যপৌরুষেয়ে বেদে কর্তারো ন সন্তি তথাপি কল্পাদাবীশ্বরানুগ্রহেণ মন্ত্রাণাং লব্ধারো মন্ত্রকৃত উচ্যন্তে ॥'

এটা স্পষ্ট যে সায়ণাচার্য- মন্ত্রকর্ত্তা শব্দের অর্থ মন্ত্রগ্রহণকর্ত্তা (অগ্নি ,বায়ু,আদি) ঋষিগণ গ্রহণ করেন। উপর্যুক্ত সিদ্ধান্তের সমর্থনে তিনি কোন স্মৃতি থেকে নিম্নোক্ত বাক্যও দিয়েছেন।

যুগান্তেঽন্তর্হিতান্ বেদান্ সেতিহাসান্ মহর্ষয়ঃ।
লেভিরে তপসা পূর্বমনুজ্ঞাতাঃ স্বয়ম্ভুবা ॥

অর্থাৎ যুগান্তে লুপ্ত হওয়া বেদসমূকে, ঋষিগণ নিজ পূর্ব সঞ্চিত তপ দ্বারা প্রাপ্ত করে। এই বাক্য উদ্ধৃত করে সায়ণাচার্য লিখেন–
ত এব মহর্ষয়ঃ (অগ্নি, বায়ু আদি)
সম্প্রদায়প্রবৃত্ত্যা মন্ত্রাণাং পালনাৎ মন্ত্রপতয় ইত্যুচ্যন্তে ॥
অর্থাৎ সেই বেদ প্রাপ্তকারী ঋষিদের 'মন্ত্রপতি'ও বলা হয়।

(২)সর্পঋষির্মন্ত্রকৃৎ॥–(ঐত০ ব্রাহ্মণ-৬/১/১)।

এর টীকা করতে গিয়ে সায়ণাচার্য লিখেছেন–
'ঋষিঃ অতীন্দ্রিয়ার্থমন্ত্রকৃৎ' ('কৃ'–ধাতুস্ত্বত্র দর্শনার্থঃ)
মন্ত্রস্য দ্রষ্টা। অর্থাৎ এই বাক্যে 'কৃ' ধাতু দর্শনার্থে প্রযুক্ত হয়েছে এবং সর্পঋষি হলো মন্ত্রকৃৎ=মন্ত্রদ্রষ্টা।

(৩)মহর্ষি যাস্কাচার্যও সায়ণাচার্যের উপর্যুক্ত ভাব বহুকাল পূর্বেই সমর্থন করেছিলেন–
ঋষির্দর্শনাৎস্তোমান্ দদর্শেত্যৌপমন্যবস্তদ্ যদেনাংস্তপস্যমানান্ ব্রহ্ম স্বয়ম্ভ্বভ্যানর্ষত্তদ্ ঋষয়োঽভবংস্তদৃষীণামৃষিত্বমিতি বিজ্ঞায়তে ।

অর্থাৎ (পশ্যতি হ্যসৌ সূক্ষ্মান্ অর্থান্) ঋষি মন্ত্রের সূক্ষ্ম অর্থ দর্শন করেন। এজন্য তাঁকে ঋষি বলা হয়। ঔপমন্যব এর মত এই যে, যে স্তোম=বেদ মন্ত্রসমূহকে তপশ্চর্যা দ্বারা উৎপন্ন জ্ঞান দ্বারা দর্শন করেন তাঁকে ঋষি বলা হয়।

(৪) তৈ০ আরণ্যকেও (২/৯/১) ঔপমন্যব এর বাক্য এইরূপ প্রাপ্ত হয়।
অজানা হ বৈ পৃশ্নীস্তপস্যমানা ব্রহ্ম স্বয়ম্ভ্বাভ্যানর্ষত্তদ্ ঋষয়োঽভবন্ তদৃষীণামৃষিত্বম্ ॥

অর্থাৎ বেদ (ব্রহ্ম) কে (স্বয়ম্ভূ) যা বিনা কারোর সৃষ্টিতে, স্বয়ং (ঈশ্বর দ্বারা) প্রকট হওয়া, (আভ‍্যানর্ষৎ) না পড়েই, নিজ তপবলে ঋষিগণ দর্শন করেন। ইহাই ঋষিগণের ঋষিত্ব।

(৫) ঋষ্ গতৌ ধাতু থেকে ঋষি শব্দ নিষ্পন্ন হয়– ঋষি দয়ানন্দজী উণাদিকোষে এর অর্থ এইপ্রকার করেছেন–

ঋষতি গচ্ছতি, প্রাপ্নোতি জানাতি বা স ঋষিঃ ॥ (উণাদিকোষ ৪/১২)

(৬) নিরুক্তের এক স্থানে লিখা হয়েছে–
সাক্ষাৎকৃতধর্মাণো ঋষয়ো বভূবুঃ তেঽবরেভ্যোঽসাক্ষাৎকৃত- ধর্মভ্যঃ উপদেশেন মন্ত্রান্সম্প্রাদুঃ ॥  (নিরুক্ত ১/২০)

অর্থাৎ ধর্মের সাক্ষাৎকারী ঋষি হয় এবং যারা ধর্মের সাক্ষাৎ করেননি, তাদের জন্য মন্ত্রের উপদেশ করেন।

উপর্যুক্ত উদ্ধরণ স্পষ্ট করে যে, ঋষি মন্ত্রকর্ত্তা ছিলোনা অপিতু মন্ত্রসমূকে সাক্ষাৎ করে উহার উপদেশ এবং প্রচারকারী ছিলো এবং 'মন্ত্রকৃৎ' শব্দে 'কৃ' ধাতু দর্শন অর্থে প্রযুক্ত হয়েছে, এজন্য মন্ত্রকৃৎ শব্দের অর্থ মন্ত্রদ্রষ্টা ই হবে ।

ম্লেচ্ছরা আবার ঋগ্বেদের নিম্নোক্ত মন্ত্র উদ্ধৃত করে বলে যে বেদ দ্বারাই প্রমাণিত যে বেদ ঋষিদের রচনা–

"ঋষে মন্ত্রকৃতাং স্তোমৈঃ কশ্যপোদ্বর্ধয়ন্গিরঃ" ঋ০ ৯/১১৪/২

এরা নিজেরাই এর অনর্থ করে কিংবা কোন ভাষ্যকারের ভাষ্য উপস্থিত করে এটাই বুঝায় যে এই মন্ত্রে ঋষিদের মন্ত্র রচনাকারী বলা হয়েছে। আমরা জানি যে, বেদার্থ করার ক্ষেত্রে কিছু সিদ্ধান্ত অবশ্যই মান্য করতে হয়। যার মধ্যে একটি হলো -

অয়ং মন্ত্রার্থচিন্তাভ্যূহোঽভ্যূঢঃ
অপি শ্রুতিতোঽপি তর্কতঃ ।
ন তু পুথক্ত্বেন মন্ত্রা নির্বক্তব্যাঃ ।
প্রকরণশ এব তু নির্বক্তব্যাঃ ॥  (যাস্ক০ ১৩/১২)

অর্থাৎ– মন্ত্রার্থ চিন্তন করার বিষয়। উহাপোহ (যুক্তি প্রতি-যুক্তি) দ্বারা প্রাপ্তি হয়। ইহা শ্রুতির বিপরীত যেন না হয়।

শ্রুতির বিপরীত এর অভিপ্রায় - কোন মন্ত্রের অর্থ অথবা অভিপ্রায় এমন যেন না হয় যে, বেদেরই অন্য কোন মন্ত্রের ভাবের বিপরীত হয়, অথবা উহার খণ্ডন করে। [বৈদ্য গুরুদত্ত] বেদের বিবিধ মন্ত্রেই বেদ ঈশ্বর হইতে প্রকাশিত বলা হয়েছে যেমন-

তস্মাদ্যজ্ঞাৎসর্বহুত ঋচঃ সামানি জজ্ঞিরে।
ছান্দংসি জজ্ঞিরে তস্মাদ্যজুস্তস্মাদজায়ত।।(যজুর্বেদ-৩১/৭)

পদার্থঃ- (তস্মাৎ) সেই (যজ্ঞাৎ) সর্বদাতা (সর্বহুতঃ) পূজনীয় সর্বোপাস্য পরমেশ্বর হইতে (ঋচঃ) ঋগ্বেদ (সামানি) সামবেদ (জজ্ঞিরে) উৎপ্নন হয়েছে (তস্মাৎ) সেই পরমাত্মা থেকেই (ছান্দংসি) অর্থববেদ (জজ্ঞিরে) উৎপন্ন হয়েছে (তস্মাৎ) সেই জগদীশ্বর থেকে (য়জুঃ) যজুর্বেদ (অজায়ত) প্রকট হয়েছে।

ভাবার্থঃ- এই মন্ত্রটি পুরুষ অধ্যায়ের। এই অধ্যায়ে যজ্ঞ শব্দ পুরুষের পর্যায়বাচী। পুরুষের অর্থ পূর্ণ পরমেশ্বর। যজ্ঞের অর্থ হয়েছে পূজনীয় পরমেশ্বর।

যখন সৃষ্টি-রূপী যজ্ঞ প্রারম্ভ হয়েছে তখন পরমেশ্বর, মনুষ্য মাত্রের জন্য চার বেদের জ্ঞান প্রদান করেছেন। সেই যজ্ঞপুরুষ হইতে - ঋগ্বেদ, যজুর্বেদ, সামবেদ, অথর্ববেদ এই চার বেদ প্রকট হয়েছে। একইভাবে (ঋগ্বেদ - ১০/৯০/৯) এবং (অথর্ববেদ-১৯/৬/১৩) মন্ত্রেও বলা হয়েছে তথা অন্যান্য মন্ত্রেও।

আলাদা করে আর কি বলতে হবে যে "ঋষে মন্ত্রকৃতাং স্তোমৈঃ কশ্যপোদ্বর্ধয়ন্গিরঃ" ঋ০ ৯/১১৪/২॥ এর অর্থ ঋষিগণ মন্ত্রের রচনাকারী করলে সিদ্ধান্তবিরুদ্ধ এবং অগ্রহণীয় হবে?

সায়ণাচার্য তাঁর ঋগ্বেদাদিভাষ্য ভূমিকায়- দর্শন শাস্ত্রের 'অত এব চ নিত্যত্বম্" (ব্র০ সূ০ ১/৩/২৯), বেদে "বাচা বিরূপ নিত্যয়া" (ঋ০ ৮/৭৫/৬), স্মৃতি শাস্ত্রের "অনাদিনিধনা নিত্যা বাগুতসৃষ্টা স্বয়ম্ভুবা" প্রমাণ উদ্ধৃতি দিয়ে বেদ কে অপৌরুষেয় মেনেছেন, আর এও পূর্বপক্ষীর খণ্ডন করে। তারপরেও যদি সায়ণাচার্যের ভাষ্যে কিংবা ভাষ্যানুবাদে এর বিপরীত পাওয়া যায় তো সেই অর্থ ভুল তা উপর্যুক্ত প্রমাণে প্রমাণিত।

এখানে বেদাদি শাস্ত্রের উদ্ধৃতি দিয়ে বেদকে নিত্য ও অপৌরুষেয় বলেছেন সায়ণাচার্য, আর এখানে উদ্ধৃত ঋ০ ৮/৭৫/৬ নং মন্ত্রেরও বিরোধ হয়ে যাবে, যদি ঋষিগণ মন্ত্র রচনাকারী এরূপ কোন অর্থ করা হয়, যা বেদার্থের সিদ্ধান্ত বিরুদ্ধ এবং অগ্রহণীয় ।

©️অমৃতস্য পুত্রাঃ

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Please Select Embedded Mode To Show The Comment System.*

নবীনতর পূর্বতন