মৃত্যুর কতদিন পর জীবাত্মা নতুন দেহ ধারণ করে তা নির্ধারণ করে জীবের কর্মফলের উপর।
বেদানুকুল জন্ম-মৃত্যু-পুনর্জন্ম রহস্য। আর্য প্রতিনিধি সভা বাংলাদেশ ™
নমস্কার সনাতনী মিত্রগণ। আজকে আলোচনা করবো:
বেদানুকুল জন্ম-মৃত্যু-পুনর্জন্ম রহস্য
ওম্ সবিতা প্রথমে হন্নগ্নির্দ্বিতীয়ে বায়ুস্তৃতীয়ে আদিত্যশ্চতুর্থে চন্দ্ৰমা পঞ্চম
ঋতুঃ ষষ্ঠে মরুতঃ সপ্তমে বৃহস্পতিরষ্টমে মিত্রো নবমে বরুণো দশমে ইন্দ্র একাদশে বিশ্বে দেবা দ্বাদশে।।
যজুর্বেদ ৩৯।৬
এই মন্ত্রে বলা হইয়াছে - হে মনুষ্য গণ এই জীব স্থূল শরীর ত্যাগ করিয়া প্রথম দিন সূর্য্য প্রকাশে, দ্বিতীয় দিন অগ্নিতে, তৃতীয় দিন বায়ুতে, চতুর্থ দিন আদিত্যে অর্থাৎ মাসের মধ্যে, পঞ্চম দিন চন্দ্রমাতে, ষষ্ঠদিন বসন্তাদি ঋতুতে,সপ্তম দিন মনুষ্যাদি প্রাণিতে অষ্টম দিন সূত্রাত্মা বায়ুতে, নবম দিন প্রাণ বায়ুতে, দশম দিন উদান বায়ুতে, একাদশ দিনে বিদ্যুতে গমন পূর্বক ঐসমস্ত সমুদায় পদার্থের মধ্য হইতে নূতন স্থুল শরীরের উপযোগী দিব্য গুণ আহরণ করিয়া দ্বাদশ দিনে সমগ্র উত্তম গুণে বিভূষিত হইয়া শরীর ধারণের উপযুক্ত হইয়া থাকে।
অথর্ব বেদে বলা হইয়াছে -
আ য়ো ধৰ্ম্মানি প্রথমঃ সসাদ ততো বাপুংষি কৃণুষে পুরুণি।
ধাস্যুর্যোনিং প্রথম আবিবেশা য়ো বাচমনু দিতাং চিকেতা।।
(অথর্ব বেদ ৫।১।১(২)
অর্থাৎ পূর্বজন্মকৃত পাপ পুণ্যের ফল ভোগ করিবার স্বভাব যুক্ত জীবাত্মা পূর্ব শরীর পরিত্যাগ করিয়া সময় অন্তে প্রথমে বায়ু জল ও ঔষধি পদার্থে প্রবেশ করিয়া স্বকৃত পাপ পুণ্যানুসারে উত্তমাধ্যম যোনিতে প্রবেশ করেন, অর্থাৎ শরীর ত্যাগের পর প্রথমে বায়ুতে প্রবেশ করিয়া তাহাতে অবস্থিতি করেন,সময় অন্তে বায়ু হইতে নিষ্ক্রান্ত হইয়া জল, ঔষধি ও প্রাণাদিতে প্রবেশ করিয়া পুংশরীরে বীর্য্য মধ্যে প্রবিষ্ট হইয়া তৎপরে মিলনের মাধ্যমে স্ত্রী গর্ভাশয়ে স্থিত হইয়া সময় অন্তে জীবাত্মা পুনর্জন্ম গ্রহণ করিয়া থাকেন
মহাভারতে ব্যাসদেব বলিয়াছেন যথা –
ধেনু সহশ্রেষু বৎসো বিন্ধতি মাতরম্। এবং
পূর্বকৃতংকর্ম্ম কর্তারগনুপচ্ছতি।।
মহাভারত অনুশাসনপর্ব ৮ ।২২
অর্থাৎ গোবৎস যেমন সহস্র গরুর মধ্যে নিজের মাতাকে খুঁজিয়া লয়,সেইরূপ পূর্ব জন্মের অর্জিত কর্মফলও কর্ম কর্তার অনুসরণ করিয়া থাকে। অনেকে বলিয়া থাকেন ইহলোক কর্মভূমি ও পরলোক ভোগ ভূমি, এ কথা সত্য নয়। জীবকে ইহলোকে অবশ্যই সুখ দুঃখ উভয়ই ভোগ করিতে হইবে কারণ শরীর না থাকিলে সুখ দুঃখের অনুভূতি ভোগ প্রাপ্ত হয় না।
পরলোকে জীব স্বকাম কর্মানুযায়ী স্বর্গ প্রাপ্ত হইয়া কেবলই সুখ ভোগ করিয়া সময় অন্তে পরমাত্মার ন্যায় ব্যবস্থানুসারে পুনরায় ইহলোকে আবাগমন করত উত্তম মনুষ্য যোনি প্রাপ্ত হইয়া থাকে। কেবল মাত্র বিদেহী মুক্তপুরুষ ব্যতীত সমস্ত জীবকেই পুনরায় জন্ম গ্রহণ করিয়া শরীর ধারণ করিতে হয়। তবে কেবল মাত্র মুক্ত পুরুষই এক পরান্তকাল পর্যন্ত মুক্তানন্দ ভোগ করিয়া থাকেন। যাহার পরিমান ছত্রিশ হাজার সৃষ্টি ও প্রলয় হইতে যে পরিমাণ কালের প্রয়োজন হয়, ততকাল পর্যন্ত মুক্তাত্মা মুক্তির আনন্দ ভোগ করিয়া থাকেন।
যজুর্বেদে বলা হইয়াছে –
ওম্ দ্বে সৃতীঅশ্নবং পিতৃণামহং দেবানামুত মৰ্ত্তানাম্ ।
তাভ্যামিদং বিশ্বমেজৎসমেতি যদন্তরা পিতরং মাতরং চ।।
যজুর্বেদ০১৯।৪৭
-
অর্থাৎ এই সংসারে জীবের পাপ পুণ্যের ফল ভোগার্থে দুই প্রকার জন্ম বা পথ আছে। প্রথম পিতৃ অর্থাৎ জ্ঞানী, দ্বিতীয় দেব অর্থাৎ বিদ্বান্। পরমাত্মার ন্যায় ব্যবস্থায় জীব মাতা পিতার দ্বারা শরীর ধারণ পূর্বক পাপ পুণ্যের ফল স্বরূপ যে সুখ দুঃখ ভোগ করে তাহার নাম পিতৃযান এবং যাহাতে জীব মোক্ষপদ লাভ করিয়া জন্ম মৃত্যু রহিত হইয়া সংসার হইতে মুক্ত হইয়া যায় তাহার নাম দেবযান।
প্রথমতঃ পিতৃযানে মনুষ্য সঞ্চিত পুণ্য কর্মের ফল স্বরূপ স্বর্গ সুখ ভোগ অন্তে পুনরায় জন্ম গ্রহণ করিয়া সময় অন্তে পুনঃ মৃত্যু প্রাপ্ত হয় অর্থাৎ জীবকে বারংবার সংসারে আবাগমন করিতে হয়।
দ্বিতীয়তঃ দেবযানে পুনরায় জন্ম না হইয়া অর্থাৎ আবাগমন রহিত হইয়া জীবাত্মা বিদেহ মুক্তি লাভ করিয়া থাকে। জীবের কর্মফল ভোগাথে বেদে এই দুই প্রকার। জন্ম বা গতির কথা বলা হইয়াছে। এই দুই প্রকার মার্গেই জগতের সমস্ত জীব গমনাগমন করিয়া থাকে।
ইহাই বৈদিক সিদ্ধান্ত। পিতৃমান ও দেবযান। সম্পর্কে বেদে কোন দশা বা ক্রম প্রকাশের কথা নাই। যাহা আছে তার। গীতার বর্ণনানুযায়ী অষ্টম অধ্যায়ের ২৫, ২৬ শ্লোকে।
বেদ স্বতঃ প্রমাণ এবংঅন্য সমস্ত পুস্তক পরতঃ প্রমাণ, বেদের উপর নির্ভরশীল এবং বেদই প্রামাণ্য তবে শ্রদ্ধেয় দীনবন্ধু শাস্ত্রী মহাশয় ও শ্রীমৎ নারায়ণ স্বামীজী মহাশয় এখানে পিতৃযান প্রাপ্ত গতির ক্ষেত্রে গীতোক্ত সপ্ত প্রকার দশা বা ক্রম এবং দেবযান প্রাপ্ত গতি বা মার্গের ক্ষেত্রে নয় প্রকার দশা বা ক্রমকে রূপক বর্ণনা বলিয়াছেন, যাহাতে মানুষ বিভ্রান্ত না হন। যে সমস্ত মনুষ্য কেবলমাত্র পুণ্য কর্মই করেন, পাপের লেশমাত্র তাহাদের কার্য্যে স্থান পায় না, তাহাদের সেই কর্ম সকাম ও নিষ্কাম ভেদে দ্বিবিধ। যাহারা সকাম পুণ্য কর্ম করেন তাহারাই কেবল পিতৃযান গতি প্রাপ্ত হন এবং যাহারা নিষ্কাম পূণ্য কর্ম করেন তাহারা দেবযান গতি প্রাপ্ত হন। ফলের ইচ্ছা করিয়া কোন কর্ম করিলে, তাহাকে সকাম কর্ম বলা হয় এবং কোন ফলের ইচ্ছা না করিয়া শুধু ধর্ম বা কর্তক বোধে যে কর্ম করা যায়, তাহাকে নিষ্কাম কর্ম বলা হয়। এই নিষ্কাম কমই গীতার কর্মযোগ।
গীতার দ্বিতীয় অধ্যায়ে সাতচল্লিশ শ্লোকে বলা হইয়াছে-
কর্ম্মণ্যেবাধিকারন্তে মা ফলেষু কদাচন।
মা কৰ্ম্মফল হেতুর্ভূমা তে সঙ্গো:স্তুকৰ্ম্মণি।।
(গীতা ২।৪৭)
অর্থাৎ কর্ম করিতেই তোমার অধিকার আছে, ফলে কোনও অধিকার নাই, তুমি কর্ম ফলের হেতু হইও না, অকর্মেও আবদ্ধ হইওনা, কর্মাকর্ম ধর্মাধর্মের বিষয় বা বিচার ত্যাগের নাম নিষ্কাম কর্ম নহে। যে কর্মে বাসনা। উৎপন্ন করে না, তাহাই নিষ্কাম কর্ম এবং যে কর্মে বাসনা উৎপন্ন করে তাহা। সকাম কর্ম। বাসনা সংস্কার মাত্র। ইহা স্মৃতিরূপে চিত্তে জমা হইয়া থাকে। ভাল বা মন্দ কোন কর্ম করিলে পুনরায় যদি তাহা করিতে ইচ্ছা করে তাহাকে। বাসনা বলা হয়। হৃদয় গ্রন্থি যত সময় থাকিবে, জন্ম মৃত্যুর বন্ধন হইতে তত সময় মুক্তি নাই।
মুন্ডকোপনিষদে বলা হইয়াছে :
ভিদ্যতে হৃদয় গ্রন্থি ছিদ্যন্তে সর্ব সংশয়াঃ ।
ক্ষীয়ন্তে চাস্য কৰ্ম্মাণি তস্মিন্ দৃষ্টে পরাবরে।।
(গীতা ২।২৮)
অর্থাৎ হৃদয় গ্রন্থি ছিন্ন হইলেই জীবের সকাম বাসনা দূর হইয়া মানুষ মোক্ষের অধিকারী হইয়া থাকেন, যাহারা সদা পুণ্য কর্ম করেন এবং সর্বক্ষণের অভ্যাস বশতঃ মৃত্যুকালে তাহাদের মন যেখানে যে কামনায় আসক্ত হয় এবং সেই কামনার উপযুক্ত পূর্তি যে লোক বা যে স্থান হইতে পারে জীবাত্মা, পরমাত্মার ন্যায় ব্যবস্থায় সেই স্থানেই গমন করেন। বাসনা পূরণের জন্য জীবাত্মা লোক Rs লোকান্তরের যে কোন স্থানেই অর্থাৎ যে স্থান তাহাদের উপযুক্ত তথায় অবস্থান করিয়া তাহারা কেবল সুখ ভোগ করিয়া থাকেন, দুঃখের লেশমাত্র তাহাদের ভোগ করিতে হয় না। ইহার নাম চান্দ্রমসী বা স্বর্গ, ইহা স্বকাম কর্মের ফল।
সাংখ্যদর্শনে বলা হইয়াছে -
চন্দ্রাদি লোকে অপ্যাবৃত্তিনিমিত্ত সম্ভাবাৎ ।।
এখানে বলা হইয়াছে জীবের কর্মানুযায়ী চন্দ্রাদি লোকও প্রাপ্ত হইতে পারে। সৃষ্টিকর্তা ও কর্ম ফলদাতা এক বলিয়া যে লোক জীবের উপযুক্ত হইবে, সেই লোকই জীব প্রাপ্ত করিয়া থাকেন। দেহের নাশ হইলে জীবকে সূক্ষ্মদেহে ধূম্র, রাত্রি, কৃষ্ণপক্ষ, ষান্মাসিকী, অর্থাৎ (কৃষ্ণপক্ষের দক্ষিণায়ন- ছয়মাস) বায়বীয় ও আকাশীয় এই ছয়টি অবস্থা পার করিয়া সপ্তম অবস্থা চান্দ্রমসী বা স্বর্গ প্রাপ্ত হয়। জ্যোতি বা ক্রম প্রকাশকে ব্যক্ত করিবার জন্য এই সমস্ত রূপক নাম রাখা হইয়াছে। সকাম পুণ্য কর্মের ফল ভোগ সমাপ্তে জীবকে পুনরায় ক্রমান্বয়ে চান্দ্রমসী দশা হইতে আকাশীয় বায়বীয় সব কয়টি অবস্থা অতি স্বল্পকালে অতিক্রম করিয়া পুনরায় জন্মগ্রহণ করিতে হয়। এই অবস্থা গুলির নামও রূপক। শরীরের আদি উপাদান “কাললরস” (Proto- plasm) ইহা মনুষ্য শরীরে নাই। ইহা বৃক্ষাদিতে জন্মে, এই কারণে মনুষ্য যোনিতে জন্ম লইবার জন্য জীবকে প্রথমেই বনস্পতি বা অন্নাদির সাহায্য লইতে হয়। অন্নাদির আশ্রয়ের জন্য তাহাকে বৃক্ষ যোনিতে জন্ম লইতে হয়না, কেবল মাত্র সংযোগেই হইয়া থাকে। জীব ঔষধি বা ছিদ্র পথে শরীরে বীর্য্য মধ্যে প্রবিষ্ট হইয়া মিলনের মাধ্যমে স্ত্রী শরীরে প্রবেশ করিয়া পুরুষ গর্ভাশয়ে স্থিত হইয়া সময় অন্তে জন্ম গ্রহণ করিয়া থাকে। জগতে শুক্ল অথছি (প্রকাশময়) ও কৃষ্ণ (অন্ধকারময়) শাস্ত্রে এই দুইটি পথ অনাদি বলিয়া প্রসিদ্ধ। একটি দ্বারা মোক্ষ লাভ হয় এবং দ্বিতীয়টি দ্বারা পুনর্জন্ম লাভ করিতে হয় যিনি নিষ্কাম পুণ্য কর্ম করেন এবং তপস্বী জীবন যাপন করেন। তাহাদেরকে জীবন্মুক্ত পুরুষ বলা হইয়া থাকে।
কঠোপনিষদে বলা হইয়াছে-
শতঞ্চৈকা চ হৃদয়স্য নাডস্তাসাং মূর্ধনমভিনিঃসৃতৈকা।
তয়োৰ্ধ মায়ন্ন মৃতত্বমেতি বিম্বন্যা উৎক্রমণে ভবন্তি।।
(কঠোপনিষদ ২।৩।১৬)
দেবযান গতি প্রাপ্ত জীবাত্মারা মৃত্যুর সময় হৃদয় হইতে একশত একটি নাড়ীর মধ্যে একটি নাড়ী সুষুম্মাখ্যা হইয়া ব্রহ্মরন্ধ্র ভেদ করিয়া যাহা নির্গত হইয়াছে, সাধক ঐ নাড়ী অবলম্বনে উৎক্রমণ করিয়া সত্য লোক বা ব্রহ্মলোক প্রাপ্ত করেন। অন্যান্য নাড়ীমাণে উৎক্রমণ জীবের সংসার গতির কারণ হইয়া থাকে। ঐ একশত এখটি মূল নাড়ী হইতে শাখা প্রশাখায় বিভক্ত হইয় মোট বাহাত্তর কোটি বাহাত্তর লক্ষ দশ হাজার দুইশত একটি, জীব শরীরের সর্বত্র প্রবাহিত হইয়াছে।
প্রশ্নো ৩।৬।৭। দেবযান মার্গ প্রাপ্ত জীবাত্মা অতি অল্প সময়ের মধ্যেই আচিকী, আহ্নিকী, পাক্ষিকী, উত্তরায়নী (ছয়মাস ইহাকে শুক্ল বা প্রকাশময় মার্গ বলা হয়) সংবৎসরী, সৌরী, চান্দ্রমসী ও বৈদ্যুতি এই অষ্টম অবস্থা অতিক্রম করিয়া ব্রহ্মলোক প্রাপ্ত করেন।
মহামতি ভীষ্মদেব শরশয্যায় শায়িত অবস্থায় মৃত্যুর জন্য অপেক্ষা করিয়া উত্তরায়নেই আকাঙ্খিত দিনে প্রাণ ত্যাগ করিয়াছিলেন- মহাভারত ভীষ্ম পর্ব-১২০ অনুচ্ছেদ-১৬৭।
উক্ত নামগুলিও রূপক। ব্ৰহ্মলোক কোনও স্থান বিশেষ নয়, অবস্থা বিশেষ মাত্র। মুক্তজীব ব্রহ্মান্ডের যত্র তত্র দৃশ্য, অদৃশ্য, লোকে স্বাধীন ভাবে স্বচ্ছন্দে সহিত কোনরূপ শরীর থাকে না, থাকে কেবল মাত্র অভৌতিক স্বাভাবিক। পরিভ্রমণ করিয়া থাকেন। ব্রহ্মলোক প্রাপ্তির অর্থ আনন্দ প্রাপ্তি। মুক্ত জীবের নিয়মের জীবের দুই প্রকার গতিকে তিন প্রকার গতি বলিয়া ব্যাখ্যা করিয়াছেন। শরীর। ইহা জীবের স্বভাবিক গুণ স্বরূপ। মহাত্মা নারায়ণ স্বামিজী বেদোক্ত। কীটপতঙ্গ ও বৃক্ষাদি স্থাবর জন্মকে প্রথমাণতি বলিয়া বর্ণনা করিয়াছেন। - সাধারণ মনুষ্য জন্ম ও মনুষ্যেতর বা ইতর জন্ম অর্থাৎ পক্ষী, কিট পতঙ্গ ও বৃক্ষাদি স্থাবর জন্ম কে প্রথমাগ গতি বলিয়া বর্ণনা করিয়াছেন।এবং উচ্চতর মনুষ্য জন্ম অর্থাৎ পিতৃ শরীরকে দ্বিতীয়া গতি এবং উচ্চতম মনুষ্য জন্ম অর্থাৎ দেব শরীরকে তৃতীয়া গতি বলিয়া বর্ণনা করিয়াছেন। কিন্তু যজুর্বেদের ১৯ অধ্যায়ের ৪৭ মন্ত্রের ব্যাখ্যানুযায়ী দেখিতে পাওয়া যায় যে, ব্রহ্মান্ডের সমগ্র জীবের কর্মফল ভোগার্থে দুইটি মার্গ বা গতি রহিয়াছে এক পিতৃযান, দুই দেবযান। যাহার আবাগমন প্রাপ্ত অর্থাৎ জন্ম মৃত্যুর অধীন এবং উচ্চতম মনুষ্য জন্ম হইতে আরম্ভ করিয়া সাধারণ মনুষ্য জন্ম এবং মনুষ্যেতর অর্থাৎ ইতর নিম্নযোনি প্রাপ্ত পশু পক্ষী কীট পতঙ্গ বৃক্ষ লতা-গুল্ম প্রভৃতি স্থাবর অনুশয়ী জন্মগুলিকে এক প্রকার গতি অর্থাৎ পিতৃযান এবং আবাগমন রহিত অবস্থায় জীবনমুক্ত হইয়া বিদেহ মুক্তি প্রাপ্তির নাম দ্বিতীয়া গতি দেবযান বলা হইয়াছে।
উক্ত বেদ মন্ত্রে পিতৃযান ও দেবযান সম্বন্ধে কোন দশা বা ক্রম প্রাপ্তির উল্লেখ নাই, যদিও ইহা সাধারণ মানুষের বোঝার জন্য রূপক বর্ণনা বলা হইয়াছে। পূর্বেই বলিয়াছি বেদ স্বতঃ প্ৰমাণ অন্য সকল গ্রন্থ পরতঃ প্রমাণ, এবং বেদের উপর নির্ভরশীল, এখানে বেদই একমাত্র প্রামাণ্য। প্রথমা গতি প্রাপ্ত জীবের মৃত্যুর সাথে সাথেই জন্ম হইয়া থাকে, তাহাতে এক মুহূর্ত্তও সময় লাগে না ইহার পুষ্টি সিদ্ধির জন্য শ্রীমৎনারায়ণ স্বামিজী বৃহদারণ্যক উপনিষদের ৪র্থ অধ্যায়ের ৪ ব্রাহ্মণ ও তৃতীয় বচনের প্রমাণের উদ্ধৃতি দিয়াছেন—অর্থাৎ জলৌকা মানে জোঁক যেমন নূতন তৃণকে আশ্রয় করিয়া পূর্ব ধৃত তৃণকে ত্যাগ করে, সেইরূপ জীবাত্মা নূতন স্থূল শরীরকে আশ্রয় করিয়া পুরাতন স্থূল শরীরকে ত্যাগ করে। এখানে লক্ষ্য করিবার বিষয় এই যে, এই উদাহরণ প্রত্যক্ষ যুক্তি ও বিচার বিরুদ্ধ। জলৌকা বা জোঁক যেমন নূতন তৃণকে আশ্রয় করিয়া পুরাতন তৃণকে ত্যাগ করে, জীবাত্মা কিন্তু নূতন স্থূল শরীরকে ধারণ করিয়া পুরাতন স্থূল শরীরকে ত্যাগ করেনা। পক্ষান্তরে জীব পুরাতন শরীরকে ত্যাগ করিয়া নূতন স্থুল শরীর ধারণ করে।
সুতরাং উক্ত শ্লোকের দ্বারা মৃত্যুর সাথে সাথেই জীবাত্মা জন্ম গ্রহণ করে ইহা প্রমাণিত হয় না।
তবে মহর্ষি যাজ্ঞবল্ক্য রচিত উক্ত শ্লোকের যথার্থ তাৎপর্য শ্রদ্ধেয় আর্য্য্যমুনি মহাশয় তদীয় ভাষ্যে বিশদে আলোচনা করিয়াছেন।
জলৌকা একপ্রকার কীট বিশেষ জীব, এক তৃণকে ধরিয়া তবে মৃত্যুর পর জীবের সাথে সাথেই জন্ম হয়, ইহা মহর্ষি দয়ানন্দ বিশ্বাস করিতেন না, ইহা তাঁহার ঋষীন্দ্র জীবনেও পাওয়া যায় মহাত্মা শঙ্কর নাথ প্রণীত ঋষীন্দ্র জীবনে দেখাইয়াছেন যে, একদিন স্বামীজী (মহর্ষি দয়ানন্দ) যখন ডুমুরাওতে ভাষণ দিতেছিলেন তখন ছোটেলাল নামক একজন জিজ্ঞাসু স্বামীজীকে জিজ্ঞাসা করিয়াছিলেন যে, জীবের মৃত্যুর পর কিরূপ দশা হয় এবং বেদে কি লিখিত আছে। তাহাতে স্বামীজী তাহাকে বলিলেন যে, জীবের কর্মানুসারে গতি হয়, তাহা সাধারণতঃ যেরূপ গতি হয় তাহা যজুর্বেদে লিখিত আছে। তাহা এইরূপ যে, জীব মৃত্যুর পর দেহ পরিত্যাগ করিয়া বায়ুসহ কিছুকাল আকাশে অবস্থান করিয়া, পরে জলে, তৎপশ্চাৎ ক্রমশঃ ঔষধিতে,অন্নে ও তৎপরে পুরুষে গমন করিয়া স্থিত হয় এবং পরে যথা সময়ে উপযুক্ত পদ্ধতি অনুসারে গর্ভে গমন করে। এখানে স্বামীজী মহারাজ জীবের মৃত্যুর পর কিছুকাল বায়ুসহ আকাশে অবস্থানের কথা বলিয়াছেন। এখানে পুনর্জন্মের নির্দিষ্ট সময়ের কোন কথা বলেন নি।
তাছাড়া জীব সমূহের কর্ম ও ফল, সকলের এক হইতে পারে না, সুতরাং দ্বাদশ দিনেই সকল জীব গর্ভাশয়ে গমন করিবে ইহা অযৌক্তিক। একমাত্র বিদেহ মুক্ত আত্মা ব্যতীত সকল জীবের ক্ষেত্রে জন্ম নেওয়ার ঈশ্বরীয় পূর্বাপর পদ্ধতি যুক্তিপূর্ণ এবং সঠিক। জীব কর্মে স্বাধীন, ফলে পরাধীন সুতরাং কর্মফল অনুসারে আবাগমন প্রাপ্তসকল জীবের জন্ম একই সময়ে হইতে পারেনা। কর্মফলানুয়ায়ী ঈশ্বরীয় ব্যবস্থায় লোকান্তরের যে কোন জায়গায় অবস্থান করত ফল ভোগ অন্তে জীব নির্দিষ্ট সময়ে ঈশ্বরীয় ঐ একই নিয়মে জন্ম গ্রহণ করিতে হইবে। কারণ ফলদাতা ঈশ্বর, জীব ফলে পরাধীন এই ক্ষেত্রে স্বামীজী ঠিকই বলিয়াছেন যে, কিছুকাল বায়ু সহ জীব আকাশে অবস্থান করেন। ঐ মন্ত্রের অর্থানুযায়ী দ্বাদশ দিনে গর্ভাশয়ে গমনের কথা বলা হয়নি, বলা হইয়াছে গর্ভাশয়ে গমনের পূর্বে দ্বাদশ দিনে সর্বগুণে বিভূষিত হওয়ার কথা। ইহাই ঐ মন্ত্রের সার্থকতা ঐ এবং এই মন্ত্রে অনেকে “অহন্” শব্দে ক্রম, বা দশা প্রতিপন্ন করিতে চাইয়াছেন, কিন্তু মহর্ষি দয়ানন্দ অহন্ শব্দে অহোরাত্র বা ২৪ ঘন্টা অর্থাৎ দিন অর্থ করিয়াছেন, ইহাই সঠিক।
মহাত্মা অরবিন্দ বলিয়াছেন – “অন্তে যে ভাষাই প্রামাণিক বলিয়া স্বীকৃত হউক না কেন, মহর্ষি দয়ানন্দ সর্বাগ্রে পূজিত হইবেন, কারণ তিনিই বেদ ভাষ্যের প্রকৃত রহস্য আবিষ্কার করিয়াছেন। বিশৃঙ্খলা, অবিদ্যা অন্ধকার ও বহু শতাব্দীর ভ্রমজালে জনতা এতদিন আবদ্ধ ছিল। তাঁহার দূরদৃষ্টি ইহা ভেদ করিয়া সত্যকেই গ্রহণ করিয়াছিলেন। সহস্র বর্ষের বন্ধ দুয়ারের চাবিকাটি তিনিই পাইয়াছিলেন এবং বন্ধ বেষ্টণী ভাঙিয়া স্রোতের প্রবাহ তিনিই খুলিয়া দিয়াছিলেন।”
চলবে......
কলমে: facebook.com/aryapsbd ™