যেমন
কোনো ব্যক্তির নাম হল রাম। সেই ব্যক্তি যদি দোকানে কিছু কিনতে যায় তবে
তাকে ক্রেতা বলা হয় । সেই ব্যক্তি যদি স্কুলে পড়ায় তবে তাকে অধ্যাপক বলা হয়
। সেই একই ব্যক্তি যদি জমিতে লাঙল করে তবে তাকে কৃষাণ বলা হয় । চিকিৎসা
করলে তাকেই আবার চিকিত্সক বলা হয় । ব্যক্তি একজনই যার আসল নাম রাম । কিন্তু
কর্ম অনেক হওয়ায় নাম অনেক হয়ে গেল । তেমনি ঐ ব্যক্তি যদি
কারও প্রতি দয়া করে তবে তাকে দয়ালু বলা হবে , দান করলে দাতা বলা হবে ,
উপকার করলে উপকারী বলা হবে । অনেক গুণ হওয়ায় অনেক নাম হয়ে গেল । ব্যক্তি
কিন্তু সেই একজন যার নাম রাম । ঐ একই ব্যক্তি যে পরিবারে থাকে সেখানে কারও
পুত্র হয় , কারও সম্পর্কে ভাই হয় , কারও বা বাবা হয় ইত্যাদি । তেমনি
ঈশ্বরের মুখ্য নাম হল ওম্ ।
"
ওমিতীদং সর্বমুদ্গীথমুপাসীতং " --- ওম্ এই শব্দটি উদ্গীত করে উচ্চারণ করতে
হয় । আবার যজুর্বেদের ৪০ অধ্যায়ে বলা আছে ---" ওম্ ক্রতো স্মর ক্লীবে স্মর
"--- হে কর্মশীল মনুষ্য় ! তোমরা সামর্থ্যের জন্য ওমকে স্মরণ করো। আবার
তৈতিরিয় উপনিষদে বলা হয়েছে ---" ওমিতি ব্রহ্ম । ওমিতীদং সর্বং ।
ওমিত্য়েতদনুকৃত্য় হ স্ম শ্রাবয়েত্য় শ্রবয়ন্তি । ওমিতি সামানি গায়ন্তি । ওম্
শমিতি শাস্ত্রাণি শংসন্তি । ওমিত্য়ধ্বর্য়ু প্রতিগরং গৃণাতি । ওমিতি
ব্রহ্মা প্রস্তৌতি । ওয়মিত্য়গ্নিহোত্রং অনুজানাতি । ওমিতি ব্রাহ্মণঃ
প্রবক্ষ্য়ন্নাহ ব্রহ্মোপাপ্নুবানিতি । "---- বলা হয়েছে যে , ওম্ ই হল
ব্রহ্মা । এসব যা কিছু দেখা যাচ্ছে এদের দ্বারা সেই ওমেরই আভাস পাওয়া যায় সকল
সৃষ্ট জীব এবং পর্দাথ স্রষ্টার সৃষ্টি । ব্রহ্ম
বা ঈশ্বর
সকল পর্দাথের মধ্যে শ্রেষ্ঠ।তাই
তিনি ঈশ + বর = ঈশ্বর । ঈশ্বরকে
বিভিন্ন
নামে ডাকলেও আসলে তিনি এক এবং অদ্বিতীয় । তাঁর মুখ্য
নাম প্রনব
ওম্ । ওঁ এর পরিচয় কম বেশি আমরা সবাই জানি। ওঁ কে বলা হয়ে থাকে অক্ষরব্রহ্ম। শুধু সনাতন ধর্মেই নয়, সকল ধর্মে, সকল ঐশ্বরিক কিছুর
মাঝেই
রয়েছে
এর অবস্থান। হিন্দুরা তাদের সকল
মন্ত্র এবং শ্লোক উচ্চারণ করতে এর ব্যবহার করেন। উপনিষদেও বর্ণিত আছে। মান্ডুক্য উপনিষদ
কেবল ওঁ এর মাহাত্ম্য বর্ণনাতে উৎসর্গ। বৈদিক
সfহিত্যে
ওঁ কে ঈশ্বরের সর্বশ্রেষ্ঠ নাম এর স্বীকৃতি দেয়া হয়েছে।
ওম্ হল ঈশ্বরের মুখ্য নাম। অন্য সব নাম ঈশ্বরের গুণ , কর্ম , স্বভাব অনুসার রাখা হয়েছে , তাই সেগুলি সব ঈশ্বরের গৌণিক নাম ।
প্রাচীন কালে কেউ যদি কিছু জিজ্ঞেস করে তা ওম্ বলে প্রশ্ন শুরু করতো।
উত্তর দেওয়ার আগে ওম্ বলেই উত্তর দিতো । ওম্ উচ্চারণ করে সাম বেদের গান করা
হয় । ওম্ শং -- বলে শাস্ত্র পড়া শেষ করা হয় । ওম্ বলে বেদপাঠীরা বেদের
মন্ত্র উচ্চারণ করে । যজ্ঞের যিনি ব্রহ্মা হন তিনি ওম্ বলে ঈশ্বরের স্তুতি
করেন । ওম্ বলেই যজ্ঞ শুরু করতে হয় । ওম্ বলেই ব্রাহ্মণগণ উপদেশ করেন যে
ওমকে লাভ করতে হয় । তাহলে বোঝাই যাচ্ছে যে ওম্ হল ঈশ্বরের মুখ্যনাম ।
যোগদর্শনে মহর্ষি পতঞ্জলি ওম্ কে প্রণব নামে উল্লেখ করেছেন ---" তস্য় বাচকঃ
প্রণবঃ " । আমাদের বেদ তথা বেদানুকুল গ্রন্থগুলিতে অনেক জায়গায় ঈশ্বরের
মুখ্য নাম ওম্ বলা হয়েছে । এখানে তো কেবল কিছু উদাহরণ দিলাম । বেদের
পঠন-পাঠন যখন থেকে লুপ্ত হয়েছে , যখন থেকে বেদের কদার্থ করা হয়েছে তখন
থেকেই মানুষ বেদ থেকে দুরে চলে গেছে। তাই বিশ্বের প্রতিটি কোনে আলাদা আলাদা
মনগড়ন্ত , কাল্পনিক মত চলে এসেছে । আর প্রতিটি মতে উপাস্য় ঈশ্বরের নাম
আলাদা আলাদা । কেউ god বলে , কেউ হরি -নাম করে, কেউবা রাধে-
শ্য়াম করে , কেউ বা বলে ওম্ নমঃ শিবায় , কেউ বলে হর হর মহাদেব । যেখানে
এতগুলি মত থাকবে সেখানে একতা হওয়া সম্ভব নয়। সেখানে মারামারি হয় । সবাই
বলবে আমারটা সত্য । কিন্তু যুক্তি তর্কের দ্বারা বিচার করলে ঈশ্বরের মুখ্য
নাম ওম্ ই প্রমাণিত হয় । বাকি সকল নাম হল ঈশ্বরের গৌণিক নাম । সবার থেকে বড়
বলে তাকে ব্রহ্মা বলা হয় , সর্বত্র ব্যাপক বলে বিষ্ণু বলাহ হয় ,
কল্যাণকারী বলে তাকে শিব বলা হয় । এইসব নাম অনুসারে বর্তমান লোকেদের নাম
রাখা হয় । কারণ বেদ সৃষ্টির আদি গ্রন্থ। তাই বেদে কোনো ইতিহাস নেই । যে
সমস্ত ঋষিদের নাম বেদে পাওয়া যায় সেগুলি আসলে ঈশ্বরের নাম । বেদ থেকে নিয়ে
কালক্রমে ঋষিদের নাম রাখা হয়েছে । বেদে বায়ু , অগ্নি , আদিত্য় , আকাশ
ইত্যাদি যে সমস্ত জড় দেবতার নাম আছে সেগুলি ও প্রকরণ অনুসারে ঈশ্বরের নাম ।
অত্যন্ত বলবান হওয়ায় বায়ু , অখন্ডিত হওয়ায় আদিত্য় , ঈশ্বরের মধ্যে সমস্ত
বস্তু প্রবিষ্ট আছে আর ঈশ্বর সকল বস্তুর মধ্যে প্রবিষ্ট তাই তাকে আকাশ বলে।
বিশ্ববাসী যার মিত্র তাই সেই ঈশ্বরের নাম বিশ্বামিত্র ।
সাকারবাদীরা বলিয়া থাকেন: –
“নিরাকার ধ্যান যোগ্য নহে।” কিন্তু তাহাদের এই আপত্তি সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন, কারণ জীব ইন্দ্রিয় সমূহের দ্বারা কেবল পদার্থের গুণই গ্রহণ করিয়া থাকে।
কিন্তু গুণ মাত্রই সমস্ত নিরাকার। চক্ষু রূপ গ্রহণ করে, সেই রূপটিও কিন্তু নিরাকার। কর্ণ শব্দ গ্রহণ করে, কিন্তু সেই শব্দ ও নিরাকার। নাসিকা দ্বারা যে গন্ধ গ্রহণ করা হয়, সেই গন্ধেরও কোন আকার নাই। জিহ্বা স্বাদ গ্রহণ করে, সেই স্বাদ ও আকার বিহীন। সুখ দুঃখ স্পর্শ, অবকাশ, কানও দ্রব্যের পরিমাণ সমস্ত নিরাকার হইলেও, ইহাদের প্রত্যেকটির ধারণা করিতে আমরা সমর্থ।
সুতরাং নিরাকারের ধ্যান করা অসম্ভব, এই কথা বলিবার কোন যুক্তি নাই।
জীবাত্মা ও পরমাত্মা উভয়েই প্রায় সমগোত্রীয় হওয়ায়, নিরাকার চিৎ স্বরূপ জীবাত্মা দ্বারা নিরাকার চিৎস্বরূপ পরমাত্মার ধ্যান করিলে তবেই ওই মোক্ষস্বরূপ ব্রহ্মপদ প্রাপ্ত করা সম্ভব। ইহা ছাড়া দ্বিতীয় অন্য কোন পথ নাই। ইহাই নির্বিবাদ সত্য। এখানে না বুঝিবার কোন জায়গা নাই। যদি কেহ না বোঝে, তাহা হইলে বুঝিতে হইবে তিনি অতিশয় মূঢ় বা অজ্ঞ, অথবা বুঝিয়াও ইচ্ছাকৃত নিজের ব্যক্তিগত স্বার্থে না বুঝিবার ভান করা বা বোঝার চেষ্টা না করা, যাহাই হউক না কেন, সেটা তাহার ব্যক্তিগত বিষয় এবং সিদ্ধান্তও তাহার নিজস্ব।
ওম উচ্চারণের সময় এর তিনটি অংশ পাওয়া
যায়। অ, উ, ম। এই তিন বর্ণ দ্বারা কী বোঝানো হয় তা নিয়ে অনেক ভূল ধারণাও
আছে
। আসুন আমরা জেনে নেই প্রকৃতপক্ষে
এই তিন বর্ণ দারা কি বোঝানো হয়:
অ-
বিরাট, অগ্নি
এবং বিশ্ব।
উ-
হিরণ্যগর্ভ, বায়ূ
এবং তৈজস।
ম-
ঈশ্বর, আদিত্য
এবং প্রাজ্ঞ।
ঈশ্বরের তিনগুণের নাম ব্রহ্মা,
বিষ্ণূ,
শিব
(মহেশ্বর)। ঈশ্বর সৃষ্টিকর্তা তাই ঈশ্বরের এক গুণের
নাম ব্রহ্মা, ঈশ্বর পালন কর্তা তাই
ঈশ্বরের আর এক গুণের নাম বিষ্ণু, ঈশ্বর সংহারকর্তা তাই ঈশ্বরের অপর আর এক
গুণের নাম শিব বা মহেশ্বর
প্রকৃত অর্থে ব্রহ্মা,
বিষ্ণু,
শিব নামে পৃথক পৃথক কোন দেবতা নাই। সমাজের সুবিধাবাদী পরসম্পদ লোভী ধর্মধ্বজী কিছু মানুষ
সহজ বিশ্বাস প্রবণ মানুষদের ঠকানোর জন্য ঈশ্বরের এই সকল গুণের কল্পনা করে
দেহধারী ব্রহ্মা, বিষ্ণু ও শিব তৈরী করে প্রতারণা করছেন।
‘ব্রহ্মা’-(বৃত
বৃতি বৃদ্ধৌ) এই সকল ধাতু হইতে ‘ব্রহ্মা’ শব্দ সিদ্ধ হয়। ‘য়োৎ খিলং জগন্নির্মাণেন বহতি (বৃংহতি) বর্দ্দযতি স ব্রহ্মা।’ যিনি সম্পূর্ণ জগৎ রচনা করিয়া বিস্তৃত করেন, সেই জন্যে সেই
পরমেশ্বরের নাম
‘ব্রহ্মা’।
বিষ্ণু-বিম্ লৃ ব্যাপ্তৌ এই
ধাতুর সহিত নু প্রত্যয়
যোগে বিষ্ণ শব্দ সিদ্ধ
হয় বেবেষ্টি ব্যাপ্লোতি চরা চরং জগৎ
স বিষ্ণু পরমাত্মা চর
এবং অচর রূপ জগতে
ব্যাপক বলিয়া পরমাত্মার নাম
বিষ্ণু।
শিব-শিবু কল্যাণে এই ধাতু হইতে শিবু শব্দ সিদ্ধ হয়
বহুলমেতণ্ণীদর্শনম ইহা দারা শিবু ধাতু
গ্রহণ করা হয়। যিনি কল্যাণস্বরূপ ও কল্যাণকারী এই জন্য পরমেশ্বরের নাম শিব।