আমাদের
জাতিগত বা সমাজগত পরিচয়ে আমরা কোনক্রমেই হিন্দু নই। অতীতকালে এই ভূ-ভাগের নাম ছিল ভারতবর্ষ বা আর্যাবর্ত। এই আর্যাবর্তে যাঁরা বাস করতেন তাঁদের
বলা হত আর্য। ‘হিন্দু’ নামটি বিদেশিদের দেওয়া নাম। ফার্সি অভিধান ‘লুগা’তে এই ‘হিন্দু’ নামটি গালি এবং কদর্থে ব্যবহার করা
হয়েছে। আরবি ভাষাতেও
‘হিন্দু’
শব্দের অর্থ ‘ঘৃণাযুক্ত’।
ইংরেজ শাসনামলে
ভারতবাসীকে তারা ঘৃণাভরে বলত ‘নেটিভ ব্লাক’। আবার কেউ কেউ বলেন ‘সিন্ধু’ নদের নাম পরিবর্তিত হয়ে ‘হিন্দু’ শব্দ হয়েছে-এটাও ঠিক নয়। ঐতিহাসিক ও ভাষাতাত্ত্বিকগণ গবেষণা করে
প্রমাণ করেছেন যে, ‘হিন্দু’
নামটি বিদেশি শাসকদের
চাপিয়ে দেওয়া নাম। কালে
কালে এই ভূ-ভাগে আর্য জনসাধারণ বিদেশি শাসকদের চাপে ‘হিন্দু’ নামটি স্বীকার করে নিতে বাধ্য হয়েছিল। ১৮৩০ সালে ভারতীয় সংবিধানে ইংরেজ সরকার ‘হিন্দু’ নামটি পাকাপাকিভাবে সংবিধানে জুড়ে দেন। সনাতন ধর্মের প্রামাণ্য ধর্মপুস্তকসমূহ প্রমাণ
দেয় যে, আমদের
ধর্ম সনাতন ধর্ম বা বৈদিক ধর্ম এবং আমাদের পরিচয় আমরা আর্যজাতি।
আর্য কারা? এর শাব্দিক অর্থ কি? ব্যকরণগত অর্থ কি? ঋষিদের দেওয়া পরিভাষা কি?
"ঋ" গতৌ -- ধাতুটি থেকে কর্তরি "ঋহলোর্ণ্যত্" সূত্রটি দিয়ে "ণ্যত্" প্রত্যয় করলে, ঋ-কে বৃদ্ধি ও 'র'পর করে "আর্য়" শব্দটি সিদ্ধ হয়। আর্য শব্দটির ব্যাকরণগত অর্থ হল, যে নিরন্তর উন্নতির দিকে গতিশীল। "আর্য" নামে কোনও জাতির উল্লেখ আমাদের কোনও গ্রন্থ নেই। যেমন- শক, হুন, পাঠান, মোগল এক একটি জাতি ছিল সেধরনের "আর্য" কোনও জাতি নয়. মহর্ষি দয়ানন্দ সরস্বতী লিখেছেন যে, "যারা শ্রেষ্ঠ স্বভাব, ধর্মাত্মা, আর্যাবর্ত দেশের আদি নিবাসী তাঁদের "আর্য" বলা হয়."
যাস্কাচার্যের মতে ‘আর্য’ শব্দের নিরুক্তগত অর্থ ‘ঈশ্বরপুত্র’। অর্থাৎ ঈশ্বরের যথার্থ পুত্রকে ‘আর্য’ নামে সম্বোধন করা হয়। পিতার অনেক পুত্র থাকা সত্ত্বেও
পিতার অনুবর্তী, আজ্ঞা
পালনকারী, সদাচারী,
আদর্শ পুত্রকেই প্রকৃতপক্ষে
পুত্র বলা হয়ে থাকে। সেইরূপ,
যদ্যপি মানবমাত্রেই
ঈশ্বরের পুত্র তথাপি সদাচারপরায়ণ পুরুষকেই ঈশ্বরপুত্র
অর্থাৎ ‘আর্য’
নামে অভিহিত করা হয়ে থাকে।
আর আর্যাবর্ত দেশ সম্বন্ধে মহর্ষি মনু বলেছেন-----
" আসমুদ্রাত্ তু বৈ পূর্বাত্ আসমুদ্রাত্তু পশ্চিমাদ্.
তয়োরেবান্তরোর্গির্য়োরার্যাবর্তম্ বিদুর্বুধা:."
পূর্বে বঙ্গোপসাগর পশ্চিমে আরব সাগর, উত্তরে হিমালয়, দক্ষিণে নীলগিরি পর্বতমালা, এগুলির বিস্তার যত দূর তার মধ্যভাগের ভূভাগকে "আর্যাবর্ত" বলা হয়. তার মানে পাকিস্তান, আফগানিস্তান, বাংলাদেশ, মায়ানমার, তিব্বত, দক্ষিণে সমুদ্র পর্যন্ত এই সম্পূর্ণ ভূভাগটি "আর্যাবর্ত" ছিল. আর্যরা যেখানে থাকে তাকে আর্যাবর্ত বলা হয়. "আর্যাবর্ত" শব্দটির ব্যুত্পত্তি করলে হয়-- "আর্যা: বর্তন্তে য়স্মিন্ স আর্যাবর্ত:" যেখানে আর্য় থাকে তাকে আর আর্য়াবর্ত বলে. মানে আর্যরা ইরান থেকে আসেনি. আর্যরা মধ্য এশিয়া থেকে আসেনি. আমাদের দুটি ঐতিহাসিক গ্রন্থ হল রামায়ণ ও মহাভারত. সেখানে কোথাও আর্যরা মধ্যে এশিয়া থেকে বা ইরান থেকে এসেছে এরকম লেখা নেই. মহাভারত ও রামায়ণের অনেক জায়গায় "হে আর্য পুত্র!" বলে সম্বোধন করা আছে.
আমরা সবাই মহাভারতের একটি উজ্জ্বল চরিত্র বিদুরকে জানি. তিনি মহারাজা ধৃতরাষ্ট্রকে "আর্য" শব্দটির ব্যাখ্যা করে শোনাচ্ছে , আর্য কারা হয়?.....
" ন বৈরীমুদ্দীপয়তি প্রশান্তম্ ন দর্পমারোহতি নাস্তমেতি.
ন দূর্গতোস্মিতি করোত্যকার্যম্ তমার্য় শীলম্ পরমাহুরার্য়:.
ন স্বে সুখে বৈ কুরুতে প্রহর্ষম্ চান্যস্য দুঃখে ভবতি বিষাদী
দত্ত্বা ন পশ্চাদ্ কুরুতেনুতাপম্ স কথ্যতে সত্ পুরুষার্য় শীল:."----
অর্থাত্ যে অন্যের সাথে ব্যর্থ বিবাদ করে না, সর্বদা শান্ত থাকে, কখনও দর্প করে না, নিজের অস্তিত্বকে মিটতে দেয় না, কঠিন পরিস্থিতিতেও অধর্ম করে না, নিজের সুখে হর্ষ করে না, অন্যের দুঃখে বিষাদী হয়, দান দিয়ে অনুতাপ করে না, তাকেই "আর্য", এবং "শীলপুরুষ" বলা হয়। তার মানে বিদুরজি কোন বিশেষ গুণ, কর্ম ও স্বভাবের অধিকারী ব্যক্তিকে আর্য পুরুষ বলে ব্যাখ্যা করেছেন। আর্য জাতি বলে কোনো কিছু নেই, আর্য প্রতিটি পরিবারে হতে পারে. একই মা বাপের দুটি সন্তান একজন আর্য ও অন্যটি অনার্য বা দস্যু বা অসুর হতে পারে। আর্যরা যথা সামর্থ্য পরিশ্রম করে ধনবান হয়, আর সেই ধনের দশম অংশ দান করে. অন্য দিকে অসুর বা অনার্যরা নিজের স্বার্থসিদ্ধির জন্য অন্যের ক্ষতি করে. ঋগ্বেদে তাই আর্যদের ধন সম্পত্তির অধিকারী হওয়ার কথা বলা হয়েছে ----
" অহম্ভূমিম্ দদাম্যার্য়ায় "
ঈশ্বর বলছেন যে,আমি এই সম্পূর্ণ ভূমি আর্যদের দান করেছি। কারণ আর্যদের হাতে ধন সম্পত্তি এলে তারা তা সর্বসাধারণের মধ্যে বিলিয়ে দেবে। কিন্তু অনার্যরা বা দস্যুরা নিজের স্বার্থে খরচ করবে।
বেদের একটি মন্ত্রে সম্পূর্ণ বিশ্বকে আর্য বানানোর আদেশ দেওয়া হয়েছে--
" কৃণ্বন্তো বিশ্বমার্য়ম্"
অর্থাত্ সম্পূর্ণ বিশ্বকে তোমরা আর্য বানাও. এই ধরনের অনেক বেদের মন্ত্রে "আর্য" শব্দটি পাওয়া যায়. আমাদের সকলেরই মান্যতা বিশ্বের প্রাচীনতম গ্রন্থটি হল ঋগ্বেদ. আর এই ঋগ্বেদ পাঁচ হাজার বছর পুরনো নয়. ম্যাক্স মুলার বেদের "হিরন্যগর্ভ" পদটি ব্যাখ্যা করতে গিয়ে বেদকে মাত্র পাঁচ হাজার বছর পুরনো বলেছিল. কিন্তু সেই "হিরণ্যগর্ভ" শব্দটি ঈশ্বরকে বলা হয়. সূর্য, চন্দ্র, নক্ষত্রগুলি ঈশ্বরের গর্ভে থাকে বলে ঈশ্বরকে "হিরণ্যগর্ভ" বলা হয়. যেহেতু বেদ বিশ্বের প্রাচীনতম গ্রন্থ সেহেতু বেদে বলা আর্যরা হলেন সৃষ্টির আদি মানব.
বন্ধুগণ! আর্যরা যদি বাইরে থেকে এসে থাকে তাহলে কোথাও না কোথাও তো লেখা থাকবে? আর্যদের দুটি ইতিহাস গ্রন্থ রামায়ণ ও মহাভারতে কোথাও লেখা নেই. রামায়ণে তো রামকেও "আর্য" বলা হয়েছে---
" আর্য়: সর্বসমতশ্চব সদৈব প্রিয়দর্শন:"
----( বালকাণ্ড সর্গ1 শ্লোক16)
মহর্ষি বাল্মীকি মুনি শ্রীরাম সম্বন্ধে বলেছেন যে, তিনি আর্য, সমদৃষ্টি সম্পন্ন ও প্রিয়দর্শন ছিলেন.
এবার ভাবুন আমরা নিজেদের পূর্বপুরুষ শ্রীরামচন্দ্রকে মানি কিন্তু নিজেদের পূর্ব পুরুষ আর্যদেরকে মানি না. নিজেদের আর্য বলতে কেন কিন্তুবোধ করেন? যখন আমাদের পূর্বপুরুষ শ্রীরামচন্দ্র আর্য ছিলেন. রামায়ণের অন্য জায়গায় অযোধ্যা কাণ্ডে বলা হয়েছে যে, শ্রীরামচন্দ্র সর্ববিদ্যাব্রত স্নাতক, তথা ছয়টি অঙ্গ( শিক্ষা, কল্প, ব্যাকরণ, ছন্দ, নিরুক্ত, জ্যোতিষ) যুক্ত সম্পূর্ণ চারটি বেদের বিদ্বান ছিলেন.....
"সর্ববিদ্যাব্রতস্নাতো যথাবত্ সাঙ্গবেদবিত্"
---(অযোধ্যাকাণ্ড1/20)
প্রাচীন গ্রন্থসমূহে ‘আর্য’ শব্দের অর্থঃ
বেদঃ
• “আর্যা
ব্রতা বিসৃজন্তো অধি ক্ষমি।” (ঋগ্বেদ ১০/৬৫/১১)
• “কৃণ্বন্তো
বিশ্বমার্যম্।’’ (ঋগ্বেদ ৯/৬৩/৫)
• “বি
জানীহ্যার্যান্যে চ দস্যবো বর্হিষ্মতে রন্ধয়া শাসদব্রতান্।” (ঋগ্বেদ ১/৫১/৮)
উক্ত মন্ত্রসমূহে
সত্য, অহিংসা,
পবিত্রতাদি উত্তম
ব্রতধারী ব্যক্তিদের ‘আর্য’
বলা হয়েছে এবং
বিশ্বের নর-নারী সকলকে এইরূপ ‘আর্য’ করার উপদেশ দেয়া হয়েছে।
• “আর্যবৃত্ত।’’ (গৌতম ধর্মসূত্র ১৯/৯৬)
এখানে সদাচারপরায়ণ
অর্থে ‘আর্য’
শব্দ প্রযুক্ত হয়েছে।
বাল্মীকি রামায়ণঃ
• “সর্বদাভিগতঃ
সদ্ভিঃ সমুদ্র ইব সিন্ধুভিঃ। আর্যসর্বসমশ্চৈব
সদৈব প্রিয়দর্শন।।” (বাল্মীকি রামায়ণ ১/১/১৬)
অর্থাৎ, রামচন্দ্র সদাসর্বদা সৎপুরুষদের
সাহচর্যে থাকতেন যেরূপ সমুদ্র সদা নদীসমূহের সাথে মিলে থাকে তথা তিনি
আর্য, সমদর্শী
ও সকলের প্রিয় ছিলেন।
বিদুর নীতিঃ
• “আর্য
কর্মাণি রজ্যন্ত ভূতি কর্মাণি কুর্বতে হিতং চ নাভ্যসূযন্তি পণ্ডিতা ভরতর্ষভ।
ন স্বে সুখে বৈ
কুরুতে প্রহর্ষ। নান্যস্য
দুঃখে ভবতি প্রহৃষ্টঃ।।
দত্ত্বা ন পশ্চাৎ
কুরুতেহনুতাপং স কথ্যতে সৎপুরুষার্য শীলঃ।।” (বিদুর নীতি ১/৩০/১/১৮)
এই বচনসমূহে অত্যন্ত
ধার্মিককে ‘আর্য’
বলা হয়েছে।
চাণক্যনীতিঃ
• “অভ্যাসাদ্
ধার্যতে বিদ্যা কুলং শীলেন ধার্যতে। গুণেন জ্ঞাযতে আর্যঃ কোপো নেত্রেণ
গম্যাতে।।” (চাণক্য নীতি ৫/৮)
এখানে গুণীজনকে ‘আর্য’ বলা হয়েছে।
মহাভারতঃ
• “স
বাল এবার্যমতির্নৃপোত্তমঃ।” (মহাভারত আদিপর্ব ৪০/৭)
এই বচনে উত্তম
রাজকুমারের সাথে ‘আর্যমতি’
বিশেষণ যুক্ত করা
হয়েছে যার অর্থ শ্রেষ্ঠ, বুদ্ধিমান।
কৌটিল্য-অর্থশাস্ত্রঃ
• “ব্যবস্থিতার্যমর্যাদাঃ
কৃতবর্ণাশ্রমস্থিতঃ।”
আর্যগণের মর্যাদাকে
যে ব্যবস্থিত করতে সমর্থ সেই রাজ্যাধিকারী, এরূপ বর্ণিত হয়েছে।
শ্রীমদ্ভগবদ্গীতাঃ
• “কুতস্ত্বা
কশ্মলমিদং বিষমে সমুপস্থিতম্। অনার্যজুষ্টমস্বর্গ্যমকীর্তিকরম
র্জুন।।” (ভগবদ্গীতা ২/২)
এখানে যুদ্ধসাজে
সজ্জিত ভীরুতাপ্রাপ্ত অর্জুনের বৃত্তিকে ‘অনার্যবৃত্তি’ বলা হয়েছে। এস্থলে আর্যকে শ্রেষ্ঠ বলা হয়েছে।ধর্ম্মপদঃ
• “অরিযপ্পবেদিতে
ধর্ম্মে সদা রমতি পণ্ডিতো।”
অর্থাৎ, পণ্ডিতগণ আর্যপ্রদর্শিত ধর্মে বিচরণ
করেন।
• “ন
তেন অরিযো হোতি যেন পাণতি হিংসতি। অহিংসা সব্ব পাণানং অরিযোতি পবচ্চতি।।” (ধর্ম্মপদ ২৭০/১৫)
অর্থাৎ, প্রাণীহিংসা করে কোনও ব্যক্তি আর্য হয়
না। যে
ব্যক্তি হিংসা করে না সে-ই আর্য।
শব্দকল্পদ্রুমঃ
• “মান্যঃ
উদারচরিতঃ শান্তচিত্তঃ ন্যায়পথাবলম্বী প্রকৃতাচারশীলঃ সততকর্তব্যকর্মানুষ্ঠাতা।
যদুক্তং
কর্তব্যমাচরন্ কার্যম্ অকর্তব্যমনাচরন্। তিষ্ঠতি প্রকৃতাচারে সতু আর্য ইতি
স্মৃতঃ।।” (শব্দকল্পদ্রুম ১০/৫৭)
অর্থাৎ, মান্য(সম্মানযোগ্য), উদারচরিত্র, শান্তচিত্ত, ন্যায়ের পথ অবলম্বনকারী, শাস্ত্রানুকুল আচরণকারী, নিরন্তর কর্তব্যকর্মের অনুষ্ঠানকারী এবং
অসৎকর্ম বর্জনকারী পুরুষকেই স্মৃতি অনুসারে ‘আর্য’ বলা হয়।
তাহলে বন্ধুগণ আর্যরা যে বাইরে থেকে এসেছে এ কথা কে রটিয়েছে? এই কথাটি ইংরেজ অফিসার ম্যাকলে আমাদের ইতিহাসে লিখে রটিয়ে দিয়েছে। আর বলেছে যে আর্যরা বাইরে থেকে এসে এখানের দ্রাবিড়দেরকে এমন মারল যে তারা দাক্ষিণাত্যে গিয়ে বসবাস করল। একটি মিথ্যা যুদ্ধের কল্পনা যা ইতিহাসে কোন দিনও হয়নি তাকে রটিয়ে দিয়েছে ইংরেজদের স্বার্থে. আর্য দ্রাবিড় নিজেদের মধ্যে একটি মিথ্যা ধারণায় প্রেরিত হয়ে যুদ্ধ করবে, সঙ্ঘবদ্ধ হবে না, আর নিজেরা দেশকে শাসন করবে। এটাই ছিল ইংরেজদের ষড়যন্ত্র।
আমাদের নিজেদেরকে আর্য বলতে গর্ব করা উচিত,কারণ আমাদের পূর্বপুরুষেরা সব আর্য ছিলেন।
ইংরেজরা ভেদ নীতির এতবিষাক্ত বিষ বুনে দিয়েছিল যে, আজ বিশ্ব হিন্দু পরিষদ "আর্য" নাম না ধরে "হিন্দু" নামের দ্বারা সমস্ত ভারতবাসীদেরকে এক ছত্রছায়ায় করার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে।
ইংরেজরা আমাদের হৃদয়ে কেবল ভেদভাবনা তৈরি করেনি তার সাথে সাথে হীন ভাবনাও তৈরি করেছে। আমরা আজও ম্যাকলে শিক্ষা ব্যবস্থার ইতিহাসে পড়ি যে---
আর্যরা পোশাক পরত না, আর্যরা বল্কল পরত, আর্যরা অসভ্য ছিল, আর্যরা আগুনে জ্বালিয়ে মাংস খেত, আর্যরা নানা দেবদেবীর পূজা করত, আর্যরা অগ্নি পূজা করত, ইত্যাদি ইত্যাদি।
বন্ধুগণ! এবার ভাবুন! যেখানে চারটি বেদ ছিল, ভূগোল বিদ্যা, খগোল বিদ্যা, রসায়ন শাস্ত্র, পদার্থবিদ্যা, ভৌত বিদ্যা, গণিত শাস্ত্র, চিকিত্সা শাস্ত্র, সবকিছু পড়ানো হত সেখানে বিজ্ঞান অনুন্নত বললে, আমরা তাকে কী করে মেনে নিতে পারি বলুন? আর্যভট্টের রচিত "সূর্য সিদ্ধান্ত","চরক ও সুশ্রুত সংহিতা", বাগভট্ট রচিত "অষ্টাঙ্গ হৃদয়ম্", পাণিনির "অষ্টাধ্যায়ী",মহর্ষি ভারদ্বাজের "বিমান শাস্ত্র"(যেখানে সূর্য কিরণ ও পারদের সাহায্যে বিমান ওড়ানোর কথা লেখা আছে) আজও আমাদেরকে আশ্চর্য করে. আমাদের মাধবাচার্য অনেক বড় গণিতজ্ঞ ছিলেন। এখানের লীলাবতী গণিত, বৈদিক গণিত, শ্রৌত সূত্র, শুল্ব সূত্র-- দুটি সূত্রের গ্রন্থ গণিত আধারিত। সম্পূর্ণ বিশ্বে যেখানে গণিত শাস্ত্র ছিল না ভারত সেখানে গণিত বিদ্যায় উন্নত ছিল। আমাদের এখানে স্টিল এত উন্নত ছিল যে, হাজার হাজার বছর পুরানো রাজস্থানের "শিশুমার চক্র" রয়েছে জং লাগে না। সম্পূর্ণ বিশ্বকে গণিত শিক্ষা, চরিত্রের শিক্ষা, পদার্থবিদ্যার শিক্ষা কে দিয়েছিল? আর্যরা দিয়েছিল। নালন্দা, তক্ষশিলা গুরুকুলে কারা পড়ত? সম্পূর্ণ বিশ্বের ছাত্ররা এসে পড়াশোনা করত। এই জন্য আর্যাবর্তকে বিশ্বগুরু বলা হত। মহর্ষি মনু মহারাজ বলেছেন যে, সম্পূর্ণ বিশ্বের লোকেরা এখানে এসে আমাদের পূর্বপুরুষদের কাছে চরিত্রের শিক্ষা নিত.....
" এতদ্দেশ্য প্রসূতস্য সকাসাদগ্রজন্মন:
স্বম্ স্বম্ চরিত্রম্ শিক্ষেরন্ পৃথিব্যাম্ সর্বমানবা:."
যেখানে বৈদিক শিক্ষা ব্যবস্থা ছিল, বিজ্ঞান এত উন্নত ছিল, শিল্প এত উন্নত ছিল সেখানের মানুষ অসভ্য থাকতে পারে? আর্যরা জড় ও পাষাণ মূর্তি পুজক ছিল না. নিজের হৃদয়ে ঈশ্বরের উপাসনা করত. কোনও প্রাণী বধ করত না, মাংসাহার করত না. মাংসাহার তো মুসলমান ও ইংরেজদের দান. গোমেধ, অশ্বমেধ,-এর নামে ব্রাহ্মণরা যে জীবন্ত গরু ও ঘোড়াকে আগুনে দাহ করত আসলে তা বেদমন্ত্রের কদর্থ ও ব্রাহ্মণদের ধূর্ততা থেকে হয়েছিল. নানা ধরনের দেবদেবীর পূজা বলতে আর্যরা অগ্নির পূজা করত আজও করে. যজ্ঞকেই অগ্নি পূজা বলা হয়। যজ্ঞের দ্বারা পরিবেশ শুদ্ধ হওয়ায় জড় ও চেতন প্রায় তেত্রিশ প্রকারের দেব সন্তুষ্ট হয়. মানে এগুলি ব্যবস্থিত, শুদ্ধ ও রোগমুক্ত থাকলে আমরাই সন্তুষ্ট হই এগুলির দ্বারা. বিজ্ঞানীরা আজও রিসার্চ করার পরে যজ্ঞকে সর্বশ্রেষ্ঠ পরিবেশ শোধনকারী উপায় মনে করে। এছাড়া রাজা হর্ষবর্ধনের সময়ের "বরফ বানানোর বিদ্যা" "ইলেকট্রনের এমিশন্ থিওরি" সমস্ত কিছুই বিশ্ববাসীকে আমাদের পূর্ব পুরুষদের দেওয়া. আমরা ভারতীয় হয়ে গর্ব করি। এখানে যে সুন্দর "বিবাহ পদ্ধতি" রয়েছে তা বিশ্বে কোথাও নেই। মা, বোন ও মেয়ের সাথে যে পবিত্র সম্পর্ক রয়েছে তা বিশ্বের কোথাও নেই. আর্যদের শিক্ষা ব্যবস্থা, বিজ্ঞান, শিল্প উন্নত যদি না হতো তাহলে দেশ বিশ্বগুরু হতো না. আজও আমরা "বিশ্ব গুরুর" দিকে এগিয়ে চলেছি। শক, হুন, পাঠান, মোগল এসে লুণ্ঠন করেছে, শাসন করেছে তবুও দেশ বিশ্ব গুরুর দিকে ক্রমশ এগোচ্ছে। কারণ এখানে যে বিদ্যা রয়েছে তা বিশ্বের কোথাও নেই।