ক্রমবিকাশবাদ নিয়ে আলোচনা- পর্ব - ১ আর্য প্রতিনিধি সভা বাংলাদেশ ™

সাত রং
0

 

 ক্রমবিকাশবাদ নিয়ে আলোচনা- আর্য প্রতিনিধি সভা বাংলাদেশ ™


 
ডারুইন এবং ডারুইন পন্থীদের বিশ্বাস অনুযায়ী ক্রমবিকাশবাদের নিয়মানুসারে মানুষই হল প্রাণীর সৃষ্টির অন্তিম উন্নত বিকাশ অর্থাৎ বানরের অন্তিম বিকাশই হইল মানুষ। কিন্তু এ ধারণা সম্পূর্ণ ভ্রান্ত, শুধু তাই নয়, ডারুইনের দেশ U.S.A তে প্রায় সমস্ত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে তাঁহার লেখা বিকাশবাদ পুস্তক পড়ান নিষিদ্ধ হইয়া গিয়াছে। এই বিষয়ে আচার্য প্রিয়ব্রত বেদবাচস্পতির (ভূত পূর্ব আচার্য এবং কুলপতি গুরুকূল কাঁগড়ী বিশ্ববিদ্যালয় হরিদ্বার) বিকাশবাদের (Theory of Evolution) উপরে বিশদে বিস্তারিত লেখা পুস্তকের নাম “বেদ এবং তার বৈজ্ঞানিকতা” (হিন্দীতে)। বাংলা রূপান্তর পন্ডিত বাসুদেব শাস্ত্রী হইতে প্রাপ্ত অনুবাদের কিছু অংশ (যাহা জয়ন্ত শাস্ত্রী দ্বারা পরিবর্তিত ও পরিবর্ধিত) পাঠকদের উপলব্ধির জন্য তুলিয়া দিতেছি, যাহাতে তাহারা ঈশ্বরের সৃষ্টিক্রম সম্পর্কে সত্য জ্ঞান প্রাপ্ত করিতে পারে।যদি বিকাশবাদের সিদ্ধান্ত সত্য হয় তাহলে ঈশ্বরীয় জ্ঞানের সিদ্ধান্ত এবং বেদ হল ঈশ্বরীয় জ্ঞান এই কথার মান্যতা কোথাও স্থান পাবেনা। বেদ অপৌরুষেয় অর্থাৎ ঈশ্বরীয় জ্ঞান - এই সিদ্ধান্তে বিকাশবাদের সিদ্ধান্ত হল। অনেক বড় প্রতিপক্ষ এই জন্য বিকাশবাদের যুক্তি-যুক্ততা এবং তর্কসঙ্গততার সম্বন্ধে এখানে কিছুটা বিস্তারপূর্বক বিচার করে নেওয়ার প্রয়োজন রয়েছে।
 
বিকাশবাদের মুখ্য চারটি সিদ্ধান্ত –
১. জীবনের অস্তিত্ব রক্ষার জন্য সংগ্রাম (Struggle for existence).
২. পরিবেশ অনুযায়ী নিজেকে তৈরী করে নেওয়া (Adaptation to environments).
৩. উপযুক্ত শরীরের অঙ্গগুলির পরিবর্তন (Transmission of acquired properties).
৪. যোগ্যতমের বেঁচে থাকা (Survival of the fittest).

বিকাশের প্রক্রিয়া উপরি লিখিত সিদ্ধান্ত অনুসারে চলে। সমুদ্রে উৎপন্ন হওয়া প্রথম জীবাণু এমিবা (Amoeba) থেকে আরম্ভ করে বিকাশের প্রক্রিয়াতে অনেক পরে আসা মনুষ্য পর্যন্ত, মাঝে কীট-পতঙ্গ, পশু-পক্ষী এবং অন্যান্য বিভিন্ন প্রাণীদের যত সব প্রজাতি রয়েছে তারা সব বিকাশের উক্ত চার প্রক্রিয়ার দ্বারা সৃষ্ট হয়েছে। প্রাণী বেঁচে থাকতে চায়, পরিবেশের পরিস্থিতি তার প্রতিকূল হওয়ায় সে তার সাথে লড়াই করে এবং এই লড়াইয়ে প্রাণী তার শরীরের প্রতেকটি অবয়বকে ব্যবহার করে এবং শক্তি লাগায়। জীবন রক্ষার জন্য এই সংঘর্ষে টিকে থাকার এবং শক্তি লাগানোর পরিণামস্বরূপ প্রাণীর অনেক অঙ্গের কিছু পরিবর্তন এসে যায়। তখন সেই পরিস্থিতির অনুকূল হয়ে যায়। তার মানসিক শক্তিতেও কিছু পরিবর্তন এসে যায়, কিছু পরিবর্তন হয়ে প্রথমের অবয়ব থেকে ভিন্ন প্রকারের হয়ে যায়।এই পরিবর্তনের কারণে প্রাণী নিজেকে পরিস্থিতির অনুকূল করে এবং নিজেকে রক্ষা করে নেয়। যে প্রাণী এইভাবে নিজের শরীর এবং মনকে পরিস্থিতির অনুকূল করে নিয়ে পরিস্থিতির সম্মুখীন হওয়ার যোগ্য করে নেয়, সে জীবিত থেকে যায় এবং যে প্রাণী এইরকম করতে না পারে, সে বিনষ্ট হয়ে যায়। যে প্রাণী এইভাবে নিজের পরিস্থিতির সম্মুখীন হয়ে, ক্ষমতা প্রাপ্ত করে বেঁচে থাকে, তাদের শরীর এবং মনে যে নূতন বিশেষতা উৎপন্ন হয়ে ছিল, সেই সব বিশেষতা তাদের সন্তানদের মধ্যে প্রবাহিত হয়ে যায়। এই নূতন জাতি নিজের সেই পরিস্থিতির সাথে পুনঃ সংগ্রাম করে। ফলে তার শরীর এবং মনে নূতন পরিবর্তন এবং শারীরিক সামর্থ্য বা ক্ষমতা উৎপন্ন হয়ে যায়। এই নূতন পরিবর্তন এবং ক্ষমতা তার সন্তানদের মধ্যে আবার প্রবাহিত হয়ে যায়। এইভাবে প্রাণীদের একটি অন্য নূতন জাতি তৈরি হয়ে যায়। লক্ষ-লক্ষ এবং কোটি কোটি বছরের অতিদীর্ঘ কালক্রমে বিকাশেরউক্ত চার প্রক্রিয়ার দ্বারা এমিবা থেকে আরম্ভ হয়ে প্রাণীদের সেই সব অগণিত জাতিসমূহ এই ধরণীতে ধীরে-ধীরে সৃষ্ট হয়ে যায় যা আজ আমরা দেখতে পাচ্ছি। এমিবা থেকে সমুদ্রের অনেক প্রাণী বা জীব বিকশিত হয়েছে। সমুদ্রের মাছেরা তীরে উৎপন্ন বৃক্ষগুলির উপর চড়ার প্রযত্ন করেছে। এই প্রযত্নের ফলে ধীরে-ধীরে মাছেরা পাখী হয়ে গেল। পরবর্তী সময়ে এইভাবে অন্যান্য প্রাণী সৃষ্ট হয়ে চলল। তাদের প্রয়োজনের অনুসারে তাদের অঙ্গসমূহে পরিবর্তন হতে লাগল। গাই, মহিষ, গাধা, ঘোড়া ইত্যাদিকে হিংস্রক জন্তুদের কাছ থেকে নিজেদেরকে রক্ষা করার জন্য হিংস্র জন্তুদের আওয়াজকে দূর থেকে শুনে নেওয়ার প্রয়োজন ছিল। এইজন্য তাদের কান অনেক লম্বা তৈরি হয়ে গেল। বানরদেরকে জঙ্গলে বৃক্ষের উপর চড়ার এবং ঝুলে থাকার আবশ্যকতা ছিল, এইজন্য তাদের শরীরে লম্বা-লম্বা লেজ বেরিয়ে এল। পরবর্ত্তী সময়ে বানরদের একটি বিশেষ জাতি থেকে মনুষ্যের বিকাশ হয়। মানুষের লম্বা লেজের প্রয়োজন ছিল না, তাই শনৈঃ-শনৈঃ তার লেজ ঝরে গেল। এইভাবে বিকাশের উক্ত চারটি প্রক্রিয়ার দ্বারা এক অতিদীর্ঘ কালক্রমে সংসারের সমস্ত কীট- পতঙ্গ, পশু-পক্ষী এবং অন্যান্য প্রাণী এবং মনুষ্য তৈরি হয়ে গেল।
 
বিকাশবাদীদের মান্যতা অনুসারে প্রকৃতির জড় পরমাণু সমূহের একটি বিশেষ প্রকারের অনুপাত বা সংখ্যা প্রাণীদের মস্তিষ্কে সংযুক্ত হওয়ার কারণে বিভিন্ন প্রাণীদের মধ্যে নিজ-নিজ কম বা অধিক চেতনার গুণও উৎপন্ন হয়েছে। মানুষের মধ্যে প্রকৃতির এই জড় পরমাণুগুলি সর্বাধিক চেতনার গুণ উৎপন্ন করেছে। আবার মনুষ্য জগতে নিজের বিভিন্ন প্রকারের অনুভবের কারণে একটি লম্বা দীর্ঘ সময় ধরে অনেক প্রকারের জ্ঞান-বিজ্ঞানেরও আবিষ্কার করে নিয়েছে এবং নিজের চিন্তা ভাবনাও আবিষ্কার গুলিকে প্রকাশ করার জন্য ভাষাও আবিষ্কার করে ফেলেছে। মনুষ্যের ভাষা এবং তার সব জ্ঞান-বিজ্ঞান তার নিজস্ব অনুভব এবং চেষ্টার ফল। এ বিষয়ে কোনো দৈবী শক্তি বা ঈশ্বরের কোনো হাত নেই।
 
কোনো পদার্থের সৃষ্টির জন্য জড় উপাদানকারণ (Material Cause)এবং চেতন নিমিত্তকারণ (Efficient Cause)-র অবশ্যই প্রয়োজন হয়। নিমিত্তকারণ, উপাদানকারণকে নিয়ে তার দ্বারা বিভিন্ন-বিভিন্ন প্রকারের রচনা করে থাকে। উপাদানকারণ স্বয়ং নিজে নিজেকে কোনো বস্তু বা পদার্থের বদল করতে পারেনা। মাটি স্বয়ং পেয়ালা, বাটি, থালা বা কলসি ইত্যাদির রূপ ধারণ করতে পারে না। কেননা মাটি হল জড়। তাকে চেতন কুমোরই পেয়ালা আদি বানাতে পারে। কুম্ভকারের অভাবে জড় মাটি অনন্ত কাল পর্যন্ত এমনিই পড়ে থাকবে। কখনও পেয়ালা, থালা ইত্যাদি কিছুই তৈরি হবে না। প্রকৃতি (Matter) হল জড় পরমাণু সমূহের সমষ্টির নাম। এই জড় পরমাণু পদার্থ সমূহের উৎপাদন কোনো চেতন রচয়িতা ছাড়া স্বয়ং সংসারের কোনো পদার্থকে তৈরি করতে একেবারেই অসমর্থ। চেতন পরমাত্মাই এদের দ্বারা সংসারের বিভিন্ন পদার্থের রচনা করে। এইজন্য বিকাশবাদীদের জড় প্রকৃতি এবং তার পরমাণু কোন বৃক্ষ-বনস্পতি, বন পর্বত, পৃথিবী, চন্দ্র, সূর্য, নক্ষত্র ইত্যাদি পদার্থের রচনা করতে পারে না এবং কোন প্রাণীদের শরীরকেও রচনা করতে পারে না। সুতরাং বিকাশবাদীদের জড় প্রকৃতি এবং কারণবাদের সিদ্ধান্ত সম্পূর্ণ অযৌক্তিক ও ভ্রান্ত।
 
প্রকৃতির পরমাণু সমূহের সংযোগ বিশেষের দ্বারা প্রাণীদের মধ্যে চেতনা বা জ্ঞান উৎপন্ন হয়ে যায় এবং মনুষ্য কারও কাছে না শিখে স্বয়ংই সর্বপ্রকারের জ্ঞান প্রাপ্ত করে নেয় এবং ভাষা বলাও শিখে নেয়, এই সিদ্ধান্তও ভ্রান্ত৷ প্রাণীদের মধ্যে চেতনতা বা জ্ঞান, গুণ তার চেতন জীবাত্মার কারণে হয় এবং মানুষকে ভাষা এবং জ্ঞান শেখানোর আদি গুরু হল পরমাত্মা।
 
মনুষ্যের মানসিক বা বৌদ্ধিক বিকাশের সম্বন্ধে বিকাশবাদীদের মান্যতার বিষয়ে এখানে একটি মনোরঞ্জক কথা পাঠকগণের সম্মুখে তুলে ধরাটা উপযুক্ত মনে করি। ডারুইনের সমকালীন একজন বৈজ্ঞানিক ডঃ আলফ্রেড রসেল ওয়ালেস (Dr. Alfred Russel Wallace) ছিলেন। এনাকে ডারুইনের সাথেই প্রাকৃতিক জগতে বিকাশবাদের সিদ্ধান্তের আবিষ্কারক বলে মনে করা হয়। যদ্যপি এই আবিষ্কারের যশ মুখ্যতঃ ডারুইনকেই দেওয়া হয়। ওয়ালেসমহোদয় সামাজিক পরিবেশ এবং নৈতিক প্রগতি (Social Environment and Moral Progress) নামক একটি গ্রন্থ লেখেন। এই বিকাশবাদী বিদ্বান নিজের এই গ্রন্থে মানসিক ও নৈতিক বিকাশের সিদ্ধান্তকে স্বীকার করেননি। তিনি সেই গ্রন্থের এক স্থানে লিখেছেন –

In the earliest records which have come down to us from the past, we find ample indications that accepted standard of morality and conduct resulting from these were in no degree inferior to those which prevail today, though in some respects they differed from ours. The wonderful collection of hymns known as the Vedas is a vast system of religious teachings as pure and lofty as those of the finest portions of the Hebrew scriptures. Its authors were fully our equals in their conception of the universe and the deity - expressed in the finest poetic language - P.11

অর্থাৎ আমরা প্রাচীন কালের যে সব গ্রন্থ পাই তাতে আমরা এই কথার পর্যাপ্ত প্রমাণ পাই যে সেই সময়ের সদাচারাদি বিষয়ক ব্যবহার এবং বিচার আমাদের থেকে কোনো অংশেই নিম্নমানের ছিল না। যদিও তারা আমাদের থেকে কিছু বিষয়ে ভিন্ন ছিল। বেদ নামে প্রসিদ্ধ আশ্চর্যজনক সংহিতার ভিতরে বাইবেলের উত্তম থেকে উত্তম ভাগের তুল্য পবিত্র এবং উচ্চস্তরীয় ধার্মিক শিক্ষার একটি পদ্ধতি পাওয়া যায়। এর লেখক বিশ্ব বিষয়ক এবং সুন্দরতম কবিতাতে প্রকাশিত ঈশ্বর বিষয়ক বিচারে পূর্ণরূপে আমাদের সমান ছিল। এর মধ্যে আমরা অত্যধিক উন্নত ও প্রগতিশীল ধার্মিক বিচার সমূহের মুখ্য শিক্ষাকে পাই । আমাদেরকে একথা স্বীকার করতেই হবে যে, যে মন সেইসব উচ্চ বিচারকে গ্রহণ করেছে এবং তদনুরূপ উত্তম ভাষাতে প্রকট করেছে, যা বেদের সর্বত্র পাওয়া যায়, তা আমাদের উচ্চতম ধার্মিক শিক্ষকগণ এবং মিল্টন, শেক্সপীয়র তথা টেনিসনের মত কবিদের তুলনায় কোনো অংশেই কম ছিল না।
In it we find many of the essential teachings of the most advanced religious thinkers-P.13.
We must admit that the mind which conceived and expressed in appropriate language such ideas as are every where present in those of the best of our religious teachers and poets, were not inferior to our Milton, Shakespeare and Tennyson (Social Environment and Moral progress by Dr. Alfred Russel Wallace. P.14)

ওয়ালেস মহোদয় বেদের অনুবাদকেই দেখেছিলেন যাতে বেদের উদ্দেশ্য ও বিচারকে ঠিকরূপে প্রকাশ করা হয়েছে, একথা বলা যেতে পারে না। তাহলেও তিনি বেদের কবিতাগুলিতে বাইবেলের উচ্চ থেকে উচ্চ ধার্মিক বিচারসমূহের সমকক্ষ পবিত্র নৈতিক শিক্ষা এবং বিচার দেখেছিলেন এবং তিনি বেদের কবিতুকে মিলটন, শেক্সপীয়র তথা টেনিসনের কাব্যের সমকক্ষ পেয়েছিলেন। বেদের রচনা বাইবেল এবং মিল্টন, শেক্সপীয়র তথা টেনিসনের বহু পূর্বে হয়েছিল। কট্টর বিকাশবাদীদের অনুসারে বেদের মধ্যে এত উচ্চ বিচার পাওয়া উচিত ছিল না যতটা কি বাইবেল এবং মিল্টন ইত্যাদির মধ্যে পাওয়া যায়। ওয়ালেস মহোদয়ের উপযুক্ত বক্তব্য জ্ঞান, মন এবং বুদ্ধির উত্তরোত্তর বিকাশের সিদ্ধান্তের স্পষ্ট খন্ডন করে। 
 
এখানে বলা হয়েছে বিভিন্ন প্রাণীজাতি বিকাশবাদের উপযুক্ত চারটি প্রক্রিয়ার মধ্য থেকে পার হয়ে উৎপন্ন হয়েছে – বিকাশবাদীদের এই মান্যতার বিসঙ্গতির উপরও কিছু বিচার করে নেওয়া দরকার। প্রথম কথা হল যে মনুষ্য জাতির দীর্ঘতম ইতিহাসে কখনও পৃথিবীর কোনো দেশের, কোনো স্থানে বাস করা কোনো ব্যক্তি, প্রাণীদের কোনো জাতিতেও এই প্রকারের নাম মাত্র পরিবর্তন হতে দেখেনি যার দ্বারা সেই সব জাতিদের মধ্য থেকে কোনো নূতন জাতি সৃষ্ট হয়ে প্রাদুর্ভূত হয়েছে। বিকাশবাদীদের এই কল্পনা কেবল কল্পনা মাত্র। আবার প্রতিকূল পরিস্থিতির সাথে সংঘর্ষের ফলে নূতন অঙ্গ বা শক্তি উৎপন্ন হয়ে যায় – একথাও কেবল কথার কথা। নিজেকেরক্ষার জন্য দূর থেকে বিপদের আওয়াজ শুনতে পাওয়ার নিমিত্ত গরু, মহিষ, ঘোড়া, গাধা ইত্যাদির কান যদি লম্বা-লম্বা হয়ে যায় তো, এইজন্য মনুষ্যের কান কেন লম্বা হয়ে যায়নি ? তার জন্যও তো জীবন রক্ষার জন্য দূর থেকে বিপদের শব্দকে শুনে নেওয়া বহু উপযোগী হত, বিশেষ করে হিংস্র জন্তুতে ভরা জংগল এবং পর্বতে বসবাস করা মনুষ্যদের কান তো অবশ্যই লম্বা-লম্বা হয়ে যাওয়া উচিত ছিল। এইভাবে যদি পাখীদের জন্য ডানা লাভদায়ক, তাহলে এই ডানা সব প্রাণীদের জন্য লাভদায়ক হতে পারত। এই ডানা মনুষ্যদের শরীরে কেন উৎপন্ন হল না ? রাজস্থান ইত্যাদি মরুভূমিগুলিতে বাস করা গাই, গরু, মহিষ ইত্যাদি পশুরা জলে সাঁতার কাটেনি। এইরকম স্থিতিতে এইসব পশুদেরকে সাঁতার কাটা একেবারেই সম্ভব ছিল না। পরন্ত আমরা দেখি যে এই সমস্ত গরু, মহিষের বাছুরকে যদি ধরে নিয়ে জলে ফেলে দেওয়া হয়, তখন সে তখুনি সাঁতার কাটতে লাগে। এই বাছুরের মধ্যে সাঁতার কাটার এই গুণ কোথা থেকে এল ? এর পূর্বের বংশের পশুরাও তো কখনও সাঁতার শেখার অভ্যাস করেনি। এদিকে আমরা পূর্ব বাংলা পশ্চিম বাংলা বা সমুদ্রের কোনো দ্বীপের লোকদেরকে দেখি যে তাদের সব সময় জলের সাথে সম্বন্ধ থাকে। তাই প্রায় সবাই সাঁতার জানে এবং নিজেদের সন্তানদেরকেও সাঁতার কাটা শিখিয়ে দেয়। শত-শত, হাজার-হাজার বংশধারাতে তারা এইভাবে সাঁতার শেখে এবং শেখায়। এত কিছু হওয়া সত্ত্বেও তাদের ছেলেমেয়েরা স্বয়মেব স্বভাবতঃ সাঁতার কাটতে জানে না। তাদের সদ্যোজাত অথবা সাঁতার না জানা বাচ্চা/বড়কে যদি জলে ফেলে দেওয়া হয় তো তারাও জলে ডুবে মরে যাবে। তাদের প্রত্যেকটি ছোট-বড় ব্যক্তিকে প্রযত্নপূর্বক সাঁতার কাটা শেখাতে হয়। তাদের বাচ্চাদের মধ্যে নিজেদের পূর্বপুরুষদের সাঁতার কাটার এই গুণ পরিবাহিত হয়ে কেন আসে না ? ওদিকে কচ্ছপকে জমিতেও চলতে হয়। চলার সময় তাকে ঘাস, খড়, মাটি, কাঁকর, পাথর, টীলা ইত্যাদির উপর দিয়ে অগ্রসর হতে হয়। এইসব বস্তুগুলির সাথে সম্পর্ক এবং সংঘর্ষের কারণে তার পেট তো কঠোর এবং শক্ত হওয়া উচিত ছিল এবং পিঠ কোমলহওয়া উচিত ছিল – যার উপর ভর করে তাকে চলতে হয় না। অথচ উল্টা এরকম কেন? ছাগল প্রতিদিন জঙ্গলে হয় – পিঠ কঠোর, পেট নরম চলাকালীন নিজের সামনের দুটো পাকে উঠিয়ে তথা পা দুটিকে উঁচু ঝাড়ির উপর ঠেকিয়ে যথাশক্তি উঁচু থেকে উঁচু পাতাকে খাওয়ার জন্য গলা বাড়িয়ে খাওয়ার প্রযত্ন করে। এইরকম প্রযত্ন করতে করতে তাদের হাজার-হাজার, লক্ষ-লক্ষ বর্ষ ব্যতীত হয়ে গেছে। অথচ ছাগলের গলা জিরাফের গলার মতো লম্বা কেন হয়ে যায়নি ? বাস্তবে বিকাশবাদের বিভিন্ন জাতির জড় প্রকৃতি থেকে উৎপন্ন হওয়ার সিদ্ধান্ত হল অযৌক্তিক। তাদের শরীর সমূহের রচনা জড প্রকৃতির দ্বারা পরমাত্মা করেছেন এবং তাদের মধ্যে পাওয়া চেতনতা তাদের চেতন আত্মার কারণে।
-
বিকাশবাদীদের অনুসারে বিকাশের প্রক্রিয়ার মুখ্য চারটি সিদ্ধান্তের মধ্যে একটি সিদ্ধান্ত হল যোগ্যতম অবশিষ্ট থাকে বা বেঁচে থাকে। যদি তাদের এই সিদ্ধান্ত সত্য হয়, তাহলে সংসারে প্রাণীদের জাতিসমূহকে অল্পসংখ্যক রূপে পরিলক্ষিত হওয়া উচিত। 
কেননা যে সব জাতিসমূহ শারীরিক ও মানসিক দৃষ্টিতে যোগ্য নয়, সেই সব জাতিসমূহ তো নিজেদের তুলনায় যোগ্যতর এবং যোগ্যতম জাতিদের বিকাশের সাথে-সাথে বিনষ্ট হতে থাকবে এবং এই প্রক্রিয়াতে যোগ্যতম জাতিসমূহ সংখ্যাতে অনেক কম অবশিষ্ট থাকবে। বস্তুতঃ এই প্রক্রিয়াতে শেষকালে তো কেবল মনুষ্য জাতিরই বেঁচে থাকা উচিত, কেননা মনুষ্য অন্যান্য সব প্রাণীজাতিদের থেকে শারীরিক এবং মানসিক বিকাশের দৃষ্টিতে যোগ্যতম। পরন্তু আমরা দেখি যে ধরণীর উপর ভিন্ন-ভিন্ন প্রদেশে স্ব-স্ব একই প্রকারের ভৌগোলিক এবং জলবায়ুর পরিস্থিতিতে এক, দুই, দশ, কুড়ি বা পঞ্চাশ, একশত প্রকারেরই নয় প্রত্যুত এর থেকেও অধিক হাজার-হাজার প্রকারের বিভিন্ন ধরনের কীট-পতঙ্গ, মশা-মাছি, পোকা-মাকড়, পশু-পক্ষী এবং অন্য প্রাণীদের জাতিসমূহ দেখা যায়। এদের মধ্যে অনেক প্রাণীর জাতি বিকাশের দৃষ্টিতে যোগ্যতম (Fittest) নয়। প্রত্যুত তারা শারীরিক ও মানসিক বিকাশের দৃষ্টিতে অত্যন্ত দুর্বল এবং নিম্ন শ্রেণীর। 
এইসব জাতিরাতো কখনও বিকশিত হতে পারেনা এবং বিনষ্ট হয়ে যায়ও। যথার্থ বাস্তবস্থিতি হল এই যে পরমাত্মা এইসব প্রাণীজাতির রচনা করেছে স্ব স্ব কর্ম ফল ভোগের কারণে যাতে করে তারা সব স্বাভাবিক জীবন যাপন করতে পারে, যাতে করে তারা সব মিলেমিশে একে অন্যের সহায়তা এবং সহযোগ করতে পারে এবং সেই প্রদেশের ভৌগোলিক পরিবেশের ভারসাম্যে স্থির থাকতে পারে। বিকাশবাদী লোকেরা বিকাশবাদের সমর্থনে অন্য আর একটি যুক্তি দেয় যাকে তারা বড় প্রবল এবং মজবুত বলে ভাবে। এই সব লোকেদের উক্তি যে ভিন্ন-ভিন্ন জাতিদের ভ্রূণসমূহের অধ্যয়ন করলে জানা যায় যে কোনো জাতি বিশেষের প্রাণীর ভ্রূণ (Embryos) মায়ের গর্ভে সেই অবস্থানগুলির মধ্য থেকে ক্রমশঃ বর্দ্ধিত হয় যার মধ্য থেকে সেই জাতির পূর্বপুরুষ বিকাশ প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে চলেছিল । উদাহরণস্বরূপ এই সব লোকেদের কথা অনুসারে মানুষের ভ্রূণ মায়ের গর্ভে বানর আদির সেই সব অবস্থার মধ্য দিয়ে বাড়ে যার মধ্য দিয়ে মানুষের বর্তমান রূপে বিকাশ হয়েছে। বিকাশবাদীদের এই যুক্তিরও কোনো গুরুত্ব নাই। বিভিন্ন জাতির ভ্রূণগুলির বিভিন্ন অবস্থা বা স্থিতিতে (stages) কিছু সমানতা থেকে এটি আবশ্যকরূপে প্রমাণিত বা সিদ্ধ হয় না যে তাদের পূর্বজ একে অনের থেকে বিকশিত হয়েছিল । যদি আমরা বিদ্যুতের এক, দুই, তিন, চার, পাঁচ বা ছয় অশ্বশক্তির (Horse Power) ইঞ্জিনকে দেখি তাহলে আমরা তার রচনার মধ্যে একটির পর অন্যটিতে পর্যাপ্ত ক্ষমতা পাবো। কিন্তু তার অর্থ এই নয় যে সেই সব ইঞ্জিন এক থেকে দুই-এ, দুই থেকে তিন-এ এইভাবে বিকশিত হয়ে তৈরি হয়েছে। এই সব ইঞ্জিনগুলির স্বতন্ত্ররূপে পৃথক-পৃথক রচনা হয়েছে এবং তাদের রচয়িতা কোনো চেতন জ্ঞানবান ইঞ্জিনিয়ার। 
এইরকমই যখন কোনো কুমোর মাটির পেয়ালা, কলসি ইত্যাদি তৈরি করে তখন তারও চাকের উপর তৈরির সময় প্রারম্ভিক কিছু অবস্থা – এক সমান হয়। কিন্তু এর অর্থ এই নয় যে পেয়ালা, কলসি ইত্যাদি এক থেকে দুই, দুই থেকে তিন  এইভাবে তারা সব বিকশিত হয়ে সৃষ্ট হয়েছে। বস্তুতঃ এই সব পৃথক্‌-পৃথক্ স্বতন্ত্ররূপে তৈরি করা হয় এবং তাদের তৈরি করে কোনো চেতন জ্ঞানবান কুমোর । এই রকমই বিভিন্ন জাতিসমূহের ভ্রূণের রচয়িতাও হল সর্বজ্ঞ চেতন পরমাত্মা। এতো রচয়িতার নিজস্ব পদ্ধতি, নিজ কৌশল যে, সে কোন্ বস্তুকে কেমন ধরণের তৈরি করবে। 
 
শ্রী বি. শংকর এবং শ্রী এস. কে. সিন্‌হা তার পুস্তকে (Plant Ecology, Cyfogenetics etc.) এই বিষয়ের উপর সুন্দর বিচার করেছেন। তাদের একটি উদাহরণ আমরা এখানে দিচ্ছি। তিনি লিখেছেন যে – “বিভিন্ন জন্তুদের ভ্রূণ (Embryo)-এর সমানতাকে দেখে ভান বেয়র (Van Baer) বিকাশবাদের সিদ্ধান্তের পুষ্টি করেছেন। হেকিল (Haeckel) এ ব্যাপারে প্রভাবিত হয়ে (Recapitulation Theory) তৈরি করেন। তার কথা অনুসারে প্রত্যেকটি জন্তু নিজের বিকাশ (Development) সেই সমস্ত অবস্থা সমূহের (Stages) মধ্য থেকে অগ্রসর হয় যে সমস্ত যোনির মধ্য থেকে তাদের পূর্বপুরুষদের বিকাশ হয়েছিল। কিন্তু আমরা দেখি যে –

ক) মানবভ্রূণ (Human Embryo) কখনও মাছ (Amphibian) এবং সরীসৃপ (Reptilian) অবস্থা মধ্য দিয়ে বৰ্দ্ধিত হয়না ।
খ) ভ্রূণের বিকাশে হৃদয়ের নির্মাণ প্রথমে হয় এবং রক্তবহানালীর নির্মাণ পরে হয়। বিকাশবাদের (Evolution) অনুসারে হৃদয় পরে তৈরি হয় ।
গ) বিকাশবাদের তথ্যে (Theory of Evolution) দাঁত প্রথমে তৈরি হয় এবং জিভ পরে। কিন্তু ভ্রূণের বিকাশে এর বিপরীত হয় Van Baer, a great embryologist, noticed a close resemblance in the embryos of different animals. This resemblance of embryos could not be explained except on the basis of evolution. Impressed by the studies of Van Baer, Haeckel formulated his 'Recapitulation Theory' which states that 'every individual in the course of it's development tends to recapitulate the development of the race'. But studies in this field show that Haeckel's law has no sound base since.
 
A) Human embryo never passes through the fish, amphibian and reptilian stage as envisaged by Haeckel's law.
B) During the development of embryo the heart develops before the blood vessels. But in the process of evolution the heart in fact appeared later.
C) In the development of embryo tongue is formed first and the teeth later, but in evolution the reverse is true. From Plant Ecology, Cylogenetics etc.
by V. Shanker and S. K. Sinha - Rajeev Prakashan, Meerut,U.P. 1963

বিশুদ্ধ বিকাশের প্রক্রিয়ার দ্বারা চেতন প্রাণীদের উৎপত্তি সম্ভব নয়। প্রত্যুত তার জন্য চেতন এবং সর্বজ্ঞ রচয়িতা পরমাত্মার আবশ্যকতা রয়েছে। এই সম্বন্ধে শ্রী মনমোহন চৌধুরী তার নিজের পুস্তকে (Science and Self Knowledge)-এ বড় সুন্দর বিচার প্রস্তুত করেছেন। তিনি এই পুস্তকের এক জায়গায় লিখেছেন যে ‘জিন’ এবং ‘জেনেটিক উৎপরিবর্তনের’ জ্ঞান আমাদেরকে নেচারেল সিলেক্শানের সিদ্ধান্তকে মানার জন্য প্রেরিত করে এবং সাথে সাথে ঈশ্বর দ্বারা নির্মিত সৃষ্টির সিদ্ধান্তের খন্ডন করে। কিন্তু যখন আমরা পৃথিবীর ইতিহাসে অপূর্ণ এবং অর্দ্ধ কাঁচা-পাকা পদার্থ সমূহের আবর্ত থেকে চৈতন্যে (Consciousness) মানবের পৃথিবীতে আসার উদ্দেশ্যের বিকাশের উপর বিচার করি তখন তো আমাদেরকে ঈশ্বর দ্বারা নির্মিত উদ্দেশ্যপূর্ণ সৃষ্টির সিদ্ধান্তের আশ্রয় নিতে হয় –

"The discovery of genes and of the haphazard process of genetic mutation that provide the basis of natural selection have only strengthened the view that the process has been a hit and a miss one. But it becomes difficult to rid one self of the feeling of a grand design behind all these when one contemplates the grand drama of evolution of consciousness and human purpose out of whirlpools of indoate matter"- Manmohan Choudhari 'Science of self knowledge' Gandhi Marg, 30 Sept. 1981
 
সুপ্রসিদ্ধ বিদ্বান্ সরফ্রেড হায়ল কেম্ব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ে জ্যোতির্বিজ্ঞান এবং প্রয়োগাত্মক দর্শনশাস্ত্র-র (Astronomy and Experimental Philosophy) প্রফেসার। তিনি লন্ডনের রয়েল ইনস্টিটিউট-এ সেখানকার বৈজ্ঞানিকদের সামনে একটি ভাষণ দিয়েছিলেন। সেই ভাষণে তিনি ডারুইনের বিকাশবাদের সিদ্ধান্তকে চ্যালেঞ্জ দিয়েছিলেন । সেই ভাষণের সংক্ষিপ্ত বিপোর্ট ১৯ই জানুয়ারী, ১৯৮২-এ Hindustan Times-র পৃষ্ঠা ১২-তে প্রকাশিত হয়। তার কিছু প্রসঙ্গ এই প্রকার – “কিছু সময় পূর্বে কেম্ব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের এস্ট্রোনোমি এবং এক্সপেরিমেন্টাল ফিলোজফির প্রফেসার সরফ্রেড হায়ল ডারুইনের বিকাশবাদকে চ্যালেঞ্জ জানিয়েছেন। তার কথা অনুসারে জীবনের রাসায়নিক সংরচনা এত জটিল যে তা সংযোগবশতঃ হয়ে গেছে এ তাহার বিশ্বাস হয় না। এমন মনে হয় যে বায়োমেটিরিয়েল্স-র রচনা কোনো প্রাণীর বুদ্ধিপূর্বক প্রয়াসের পরিণাম।”

--Recently Sir Fred Hoyle, Professor of astronomy and experi- mental philosophy at Cambridge University has challenged the theory of Darvin that man was the product of evolution. According to him, the chemical structures of life were too complicated to have arisen through a series of accidents as evolutionists believed "Biomaterial" with their amaging measure of order, must be the outcome of intelli- gent design. "He said life on earth may have been spawned by intelli- gent beings millions of years ago in another part of the Universe. He attributed the existence of life on earth in it's present form to planning by intelligent beings. (Address to scientists at London's Royal Institu- tion) - Hindustan Times. Jan 19, 1982, P-12.
 
এইভাবে বিকাশবাদের সিদ্ধান্ত কেবল একটি কল্পনামাত্র ছাড়া আর কিছু নয়। এ কেবল শুনতেই রমণীয় প্রতীত হয়। এ কোনো মজবুত প্রমাণ, তর্ক এবং যুক্তির উপর আধারিত নয়। তর্ক এবং যুক্তির কাছে এই সিদ্ধান্ত দাঁড়ায় না। বস্তুতঃ সংসারের সব পদার্থ এবং সব প্রাণীদের শরীরের রচনা সর্বজ্ঞ চেতন পরমাত্মা করেছেন এবং তিনি এইসব রচনা বুদ্ধিপূর্বক করেছেন, যার মধ্যে গণিতশাস্ত্র এবং অন্যান্য বিবিধ বিজ্ঞানের সূক্ষ্ম এবং উচ্চ থেকে উচ্চ সিদ্ধান্ত এবং নিয়ম কাজ করছে, এমনটি পাওয়া যায়। সৃষ্টির এক একটি পদার্থ এবং প্রাণীদের শরীরের এক-একটি অঙ্গের রচনা এত সূক্ষ্ম এবং বৈজ্ঞানিক যে, সেই একটি অঙ্গের অধ্যয়ন করতে বৈজ্ঞানিকদের সারা জীবন ব্যতীত হয়ে যায়, তা সত্ত্বেও তারা তার সমস্ত রহস্যকে প্রকাশ করতে পারে না। সাথে সাথেই বিশ্বের সমস্ত রচনা হল উদ্দেশ্যপূর্ণ। এইরকম বৈজ্ঞানিক নিয়মসমূহের উপর আধারিত এবং উদ্দেশ্যপূর্ণ রচনা সমূহ সর্বজ্ঞ পরমাত্মাই করতে পারেন। পরমাত্মা জগতের রচয়িতাও বটে এবং সৃষ্টির আরম্ভে আদিম মনুষ্যকে জ্ঞান এবং ভাষা শেখানোর গুরুও বটে। মহর্ষি দয়ানন্দ এবং ভারতীয় ঋষি-মুনিগণ এবং আচার্যগণের পরম্পরা অনুসারে আদি গুরু পরমাত্মার দ্বারা শেখানো আদি জ্ঞান হল বেদ এবং তার দ্বারা শেখানো আদি ভাষা হল বেদের সংস্কৃত ভাষা ৷
 
স্বামী বিদ্যানন্দ সরস্বতীর দিব্যজ্ঞান (Theory of Evolution) অনুযায়ী ভারতীয় ইতিহাস, বিকৃতির একটি প্রমুখ কারণ হল বিকাশবাদ অথবা সতত প্রগতিবাদের ভ্রান্ত মত। বলা হয়েছে আধুনিককালে বিকাশবাদ হল একটি মহত্ত্বপূর্ণ শাস্ত্ৰ ৷ বৈজ্ঞানিক এবং ঐতিহাসিক বিচারধারাতেই তার প্রবেশ হয়েছে। বৈজ্ঞানিক বিচারধারাতে প্রাণীদের বিভিন্ন জাতির উৎপত্তিতে বিকাশবাদকে মান্যতা দেওয়া হয় এবং ঐতিহাসিক বিচারধারাতে মানবীয়বুদ্ধির বিকাশ অথবা জ্ঞান-বিজ্ঞানের উপলব্ধিতে বিকাশবাদকে আধাররূপে মেনে নেওয়া হয়। সাধারণ দৃষ্টিতে দেখলে পরে কথাগুলি ঠিক লাগে পরন্তু গম্ভীরতাপূর্বক বিচার করলে পর এর শূন্যতা স্পষ্ট হয়ে যায়।
 
বিকাশবাদের অনুসারে প্রাণী অথবা জীবন তত্ত্বের প্রথম আবির্ভাব জলের মধ্যে উদ্ভিজের রূপে হয়েছে। প্রথমে জল-মাটি-বায়ু ইত্যাদির সংযোগে এক প্রকারের সূক্ষ্ম শৈবাল তৈরি হয়। তার থেকে পুনঃ জল-বায়ুর বিলক্ষণ প্রভাব প্রাপ্ত করে সমস্ত জলীয় তথা পৃথিবীর তৃণ, বীরুধ, লতা, গুল্ম, ওষধি বনস্পতি তথা বিবিধ বৃক্ষ ইত্যাদির ক্রমিক বিকাশ হয়েছে। কালান্তরে এই মূল জীব-বীজ থেকে সর্বপ্রথম জলেই একটি অন্য জীবন-শাখা প্রারম্ভ হয়। আরম্ভে এমিবা (Amaeba-এককোশীয় প্রাণী)-র মতো সূক্ষ্ম জলজ প্রাণী সৃষ্ট হয়। ধীরে-ধীরে জলীয় কীট, মাছ, ব্যাঙ, কচ্ছপ, শূকর, ভালুক, বাঁদর, বনমানুষ ইত্যাদি বিভিন্ন প্রাণীস্তরগুলিকে পার করে এবং বিকশিত হয়ে হয়ে মানুষ তৈরি হয়েছে। আদিকালের এককোশী প্রাণী থেকে মনুষ্য পৰ্য্যন্ত পৌঁছানোর জন্য মাঝখানে না জানে কত স্তর পার করতে হয়েছে। তখন কোথাও লাখ-লাখ, কোটি-কোটি বছরে মনুষ্য তার বর্তমান স্বরূপে এসেছে। 

এই বিচার অনুসারে যদি আমরা মনুষ্যের উৎপত্তিকে এক কোটি বছর পূর্বে মানি এবং হৈকলের History of Creation-র পৃষ্ঠসংখ্যা ২৯৫-এ লেখা প্রাণীদের ক্রমের পরে মনুষ্যের উৎপত্তি মানি এবং প্রত্যেক স্তর বা ক্রমকে এককোটি বছর সময় দিই তাহলে প্রথম প্রাণীর উৎপত্তি থেকে মনুষ্যের উৎপত্তি পৰ্য্যন্ত প্রায় বাইশ কোটি বছর হয়। লোকমান্য তিলকের গীতারহস্য- তে ডাক্টর গেডোর (Gadaw) সাক্ষীতে লেখা আছে যে ‘মাছ থেকে মনুষ্য হতে ৫৩ লাখ ৭৫ হাজার বংশ ব্যতীত হয়েছে।' এই এতটা সময় লেগে গেছে এমিবা থেকে মাছ পর্য্যন্ত সৃষ্টি হতে অর্থাৎ এমিবা থেকে আজ পর্যন্ত এককোটি বংশ ব্যতীত হয়েছে। অনেক বংশ একদিন এবং অনেক বংশ একশত বছর পর্য্যন্ত বাঁচে। যদি সবাইয়ের গড় ২৫ বছর মেনে নেওয়া হয় তাহলে এই হিসাব থেকেও প্রাণীদের প্রাদুর্ভাবকে আজ ২৫ কোটি বছর হচ্ছে। এটাও মানা হয় যে পৃথিবীর সৃষ্টি হওয়ার পরে কোটি কোটি বছর পরে প্রাণী হয়েছে এবং প্রাণীর উৎপত্তি থেকে আজ পর্য্যন্ত ২৫ কোটি বছর ব্যতীত হয়ে গেছে। এইভাবে এই অবধি (সময়) বিকাশবাদীদের নিশ্চিত করা অবধির (দশ কোটি বছর) থেকে অনেক আগে চলে যাচ্ছে।

আদ্যকালিক প্রাণীরচনাকে ক্রমিক বিকাশের সিদ্ধান্তকে মেনে নেওয়া বিদ্বান্‌গণ এই কথার উপর বিচার করেছেন যে একমাত্র মূল থেকে অনেক শাখা-প্রশাখাতে বিভক্ত হয়ে বিভিন্ন যোনি সমূহের রূপে জীবন কিভাবে পৌঁছে যায়। ওনাদের কথা হোল যে, প্রাণীর ইচ্ছা এবং আবশ্যকতা হল এমন একটি স্থিতি যেটা তার বিকাশ এবং পরিবর্তনের কারণ হয়ে যায়। প্রাণ- রক্ষার ভাবনা হল প্রত্যেক প্রাণীর জন্য নৈসর্গিক। সেই ভাবনাতে বাধ্য হয়ে প্রাণীকে যে ক্রিয়া বারবার করতে হয়, ধীরে-ধীরে তাতে সেই শক্তির প্রাদুর্ভাব হয়ে যায় এবং ফের ধীরে-ধীরে ক্রিয়াকে করার জন্য সমর্থ অঙ্গের বিকাশ হয়ে যায়। অন্যদিকে প্রাণরক্ষার জন্য যে যে ক্রিয়ার দরকার নেই তার অভ্যাস থাকেনা। অভ্যাস না থাকার জন্য সেই অঙ্গ অসমর্থ হয়ে যায় এবং শেষকালে একদিন সেই অঙ্গের লোপ হয়ে যায়। (ভোজনের জন্য প্রযত্ন তথা প্রাকৃতিক সংঘর্ষ এবং শত্রুর থেকে রক্ষার জন্য প্রাণীকে অনেক পরিবর্তনের মাধ্যম দিয়ে অগ্রসর হতে হয়। তাঁর মধ্যে যে নিজেকে আবশ্যকতা অনুসারে পরিবর্তিত না করতে পেরেছে সে নষ্ট হয়ে গেছে। এইসব কারণেই শরীরে ধীরে ধীরে পরিবর্তন হতে শুরু করেছে এবং প্রাণী বিভিন্ন যোনিসমূহে বিভক্ত হয়ে গেছে। আধুনিক বিকাশবাদের অনুসারে প্রাণীর ক্রমিক বিকাশে তার আবশ্যকতার জন্য ইচ্ছা তথা তাকে পূর্ণ করার জন্য করা হয়েছে, চিরকালীন অভ্যাসের পরিণামস্বরূপ ভাবী আকৃতি পরিবর্তনের উদাহরণের রূপে আফ্রিকার মরুদেশে প্রাপ্ত লম্বা গলার জিরাফ নামক পশুর উল্লেখ করা হয়।

বলা হচ্ছে যে এরকম প্রথমে ছিল না যেমনটি এখন দেখা যাচ্ছে। জিরাফ যখন বৃক্ষের নিচের পাতা খেয়ে নিল তখন উপরের পাতাগুলিকে খাওয়ার ইচ্ছা হল। তার এই আবশ্যকতার পূর্তির জন্য সে গলা উঠিয়ে উঠিয়ে প্রযত্ন করতে লাগল । দীর্ঘদিন পর্য্যন্ত এই ক্রিয়া করতে করতে তার গলা লম্বা হয়ে গিয়েছে। 
 
পরন্তু পরিস্থিতির অনুরূপ আবশ্যকতাবশতঃ আকৃতি-পরিবর্তনের মান্যতা যুক্তিযুক্ত মনে হচ্ছে না। ছাগল যখন নিচের পাতা খেয়ে নেয় তখন গাছের গোড়ায় বা শাখায় পা লাগিয়ে গলা উঁচু করে উপরের পাতা খেয়ে নেয়। লক্ষ-লক্ষ বছর ধরে এইভাবে ছাগল তার পেট ভরে চলছে। পরন্তু আজ পর্যন্ত না তো ছাগলের গলা বড় হয়েছে, না তার আগের দিকের ভাগ লম্বা হয়েছে এবং না তার জন্য ঘাসের অভাব হয়েছে। এখানে এটাও বিচারণীয় যে লম্বা গলা জিরাফের মধ্যে বাঁদরের মতো গাছ চড়ার প্রবৃত্তির বিকাশ কেন হয় নাই ? না জানে কবে থেকে মনুষ্য উত্তরী ধ্রুব তথা গ্রীণল্যান্ডের মতো শীতপ্রধান দেশে বসবাস করে আসছে, কিন্তু শীত থেকে বাচার ইচ্ছা তথা আবশ্যকতা হওয়া সত্ত্বেও কেন তার শরীরে ভালুকের মতো লোম উৎপন্ন হয় নাই ? এটাই নয়, যেমন লম্বা চুল রাজস্থানের উষ্ণ মরুভূমিতে থাকা ভেড়াদের হয় তেমনিই হিমালয়ের শীতপ্রধান দেশে থাকা ভেড়াদেরও হয়। আফ্রিকার অতি উষ্ণ প্রদেশে দীর্ঘরোমা ভালুক এবং রোমরহিত গন্ডার একসাথে বসবাস করে। নিজেরই দেশে একই ধরনের পরিস্থিতিতে থাকা গাই ও মহিষের মধ্যে এর বিপরীত পার্থক্য দেখা যায়। মহিষের চামড়া পাতলা, মসৃণ এবং লঘু রোম যুক্ত। এর বিপরীত গাইয়ের চর্ম অপেক্ষাকৃত কঠোর এবং রোমবহুল হয়। বিকাশবাদের অনুসারে আত্মরক্ষার ভাবনার কারণে হরিণ, চীতল, নীলগাই ইত্যাদি অনেক প্রকারের জঙ্গলী পশুদের মধ্যে পুরুষদের শিং হয়, স্ত্রীদের হয় না। আত্মরক্ষার জন্য কি শিংয়ের দরকার নরদেরই হয়, স্ত্রীকে নয়। জঙ্গলী পশুদের অপেক্ষা মনুষ্য দ্বারা পালিত এবং সুরক্ষিত গাই - মহিষের কম বিপদ হয়, তাহলেও কি কারণ যে, তাদের পুরুষ নারী দুইজনেই শিং হয় ?

ভাই এবং বোন একই পরিস্থিতিতে জন্ম নেয় এবং শারীরিক বৃদ্ধি হয় । পরন্তু বোনের দাড়ী-মোচের নামও থাকে না। হাতী এবং হাতিনী একই পরিস্থিতিতে থাকে কিন্তু হাতিনীর মুখে বাইরে বেরিয়ে থাকা বড় দাঁত থাকেনা। হাতীর দাঁত খাওয়ার জন্য অন্যকিছু এবং দেখানোর অন্য কিছু – এই বাগ্ধারা হাতীর উপরেই প্রয়োগ হয়, হাতিনীর উপর নয়। ময়ূর এবং ময়ূরী এবং এইপ্রকার মুরগী এবং মোরগ একই পরিস্থিতিতে জন্ম নেয়, তাঁদের পালন হয় এবং বৃদ্ধি হয় পরন্তু ময়ূরী এবং মুর্গীর সেই সুন্দর পালক এবং মাথার উপরে চূড়া হয় না যা ময়ূর এবং মোরগের হয়।
 
ভারতে বাঘ্র, সিংহ এবং হাতী পাওয়া যায় পরন্ত ইংল্যাণ্ড ইত্যাদি দেশে পাওয়া যায়না। জিরাফ আফ্রিকাতে, কাঙ্গারু অস্ট্রেলিয়াতে এবং ময়ূর ভারতে পাওয়া যায়। ইউরোপবাসীদের দ্বারা পৌঁছে দেওয়ার পূর্বে অস্ট্রেলিয়াতে খরগোশ পাওয়া যেত না। এথেকে স্পষ্ট হচ্ছে যে যতক্ষণ পর্যন্ত কোনো প্রাণী কোথাও না পৌছায় এবং সন্তান-সন্ততির বিস্তার না করে, ততক্ষণ পৰ্য্যন্ত কোনো প্রাণী স্বয়ং সেখানে জন্ম নেয় না।
 
মনুষ্যকে বাদ দিয়ে যত প্রাণী আছে তাদের চুলে জন্ম থেকে মৃত্যু পর্য্যন্ত কোনো প্রকার পরিবর্তন হয়না। যে গাই যে রঙের হয়, আজীবন সে সেই রঙেরই থাকে পরন্তু না চাইলেও মনুষ্যের তথাকথিত পূর্বজ বাঁদরও জন্ম নিতেই সাঁতার কাটতে লাগে । এমনকি রাজস্থানের সেই স্ত্রী মহিষও, যে জীবনে কখনও পুকুরের দর্শনও কখনও করেনা, অবসর পেলেই সঙ্গে সঙ্গে সাঁতার কাটতে লাগে। পরন্তু সর্বদা নদী বা সমুদ্রের কিনারাতে বসবাস করা মল্লাহ বা মাঝীর ছেলে সাহায্য বিনা সাঁতার শিখে সাঁতার কাটতে পারবে না। প্রাণরক্ষার ভাবনা হওয়া সত্ত্বেও জংগলী লোকেদের শিং বেরোয়না এবং নদীর কিনারে থাকা লোকেদের মধ্যে স্বতই সাঁতার কাটার শক্তির বিকাশ হয়েছে। অনাদি কাল থেকে কচ্ছপ পৃথিবীর উপর চলে আসছে, কিন্তু তার পেটের কোমলতাতে কোনোই পরিবর্তন হয় নাই। অন্যদিকে তার পিঠ হয় পাথরের মতো কঠোরযখন কি তার পিঠ মাটিতে একদিনও ঘষা লাগেনা, বিকাশবাদের অনুসারে এর বিপরীত হওয়া উচিত ছিলো। প্রাণীমাত্রে আত্মরক্ষার প্রবৃত্তি স্বাভাবিক। এই প্রবৃত্তি কীট-পতঙ্গের মধ্যেও হওয়া উচিত। দীপশিখার সম্পর্কে আসতেই সে পুড়ে যায়। না জানে কবে থেকে সে জ্বলে আসছে, কিন্তু সে নিজে তার থেকে বাঁচার প্রয়াস করেনি, এজন্য তাকে কোনো বিশেষ চেষ্টাও করতে হত না। দীপশিখার থেকে একটুখানি দূরে থাকার অভ্যাসমাত্রই তো করতে হত। কিন্তু লাখ-লাখ, কোটি-কোটি বছরেও সে এতটুকুও করতে পারেনি কেন ? ক্রমিক বিকাশে মনুষ্যকে অন্তিম-শ্রেষ্ঠতম প্রাণী মেনে নেওয়া হয়েছে। 
যদি তাই হয়, তাহলে মানুষের তুলনায় পিঁপড়া যেমন ক্ষুদ্র হওয়া সত্ত্বেও বর্ষার এবং কুকুরের মত নিকৃষ্ট প্রাণী ভূমিকম্পের পূর্ব অনুমান কি করে পায় ? প্রশাসনিক যোগ্যতার দৃষ্টিতে মৌমাছিকে আদর্শরূপে কেন মেনে নেওয়া হয় ? প্রত্যেক প্রাণী অনেক অনেক কাল পৰ্য্যন্ত বেঁচে থাকতে চায়। বিকাশের যে কোন স্তরে সে এই ইচ্ছাকে পরিত্যাগ করে না। তাহলে মানুষের অপেক্ষা নিম্নস্তরের প্রাণী কচ্ছপ, সাপ ইত্যাদি কেন দীর্ঘজীবী হয় ? অল্প সময়ে অধিক দূর চলার জন্য মানুষ মোটরগাড়ী, উড়োজাহাজ ইত্যাদির আবিষ্কার এবং বিকাশ করছে। তখন, সে চিতার তেজ গতিকে কেন ত্যাগ করবে ? কুকুরের ঘ্রাণ শক্তি এবং শকুনের দূরদৃষ্টিকেও সে জেনেবুঝে কখনও ছাড়তে চাইবে না। অনুপযোগী জেনে সে যদি তাদের উপেক্ষা করে দিত তাহলে আজ অপরাধীদের ধরবার জন্য কুকুরের সহায়তা কেন নিত ?
 
ছোট্ট ধরনের বাবুই পাখী যেমন সুন্দর ঘর তৈরী করে, সেরকম মানুষের থেকে কেবল এক বংশ নীচে মেনে নেওয়া বাঁদর তৈরি করতে পারেনা। তাহলে এটাও সত্য যে, যেমনটি ঘর বাবুই লাখ কোটি বছরের পূর্বে তৈরি করতো, ঠিক সেইরকম আজও তৈরি করছে। মাকড়সা জাল বোনে। মৌমাছি মোচাক করে। ফুল থেকে পরাগ নিয়ে তাকে মধু তৈরি করে মৌচাকে একত্র করে। কিন্তু এরা এই কলা কারও কাছ থেকে শেখেনি, এই কলা তাদের আবিষ্কারও নয় । এর এই কলা অন্যপ্রাণীকে শেখায়ও না। যে যতটা জানে এবং যেমনটি জানে, সে তাকে সেইরূপে করে চলে আসছে। 
 
লোমার্ক নামক এক বিদ্বান্ ইঁদুরের লেজ কেটে দিয়ে লেজ বিহীন ইদুর তৈরি করতে চাইলেন। ইঁদুরদের অনেক বংশ পর্যন্ত উনি ঐরকম চেষ্টা। চালালেন কিন্তু লেজবিহীন ইঁদুর জন্মই নিলনা। হিন্দুদের ছেলেমেয়েরা লাখ- লাখ বছর ধরে কান ফুঁড়ে আসছে, হজরত ইব্রাহীমের সময় থেকে ইহুদী এবং মুসলমান খতনা করিয়ে আসছে, চীন দেশের স্ত্রীরা না জানে কবে থেকে পা-কে ছোটো করার প্রয়াস করে আসছে পরন্তু আজ পর্যন্ত হিন্দুদের ঘরে কানফোঁড়া ছেলেমেয়ে জন্ম নিচ্ছে না বা মুসলমানদের ঘরে খতনা (লিঙ্গ মুখ কাটা) হওয়া সন্তান জন্ম নিয়েছে বা চীন দেশের ঘরে ছোট-ছোট পা-যুক্ত কন্যা জন্ম নিয়েছে ।
 
মোটর ইত্যাদির বিকাশক্রমে উপলব্ধ অন্তিম রূপই (Latest Model) তো তৈরি হয়। কিন্তু যখন মানুষের মতো সর্বোৎকৃষ্ট প্রাণী তৈরি হয়ে গেল তখন নিম্নস্তরের সমস্ত পশু-পক্ষীর সর্বদা লোপ হয়ে যাওয়া উচিত ছিল। পরন্তু আমরা দেখছি যে আজও মাছ থেকে মাছ, ভেড়া থেকে ভেড়া এবং কুকুর থেকে কুকুরই জন্ম নিচ্ছে। এমনকি যে বাঁদর থেকে মানুষ হয়েছে এরকম বলা হয় সেই বাঁদর থেকে বাঁদরই জন্ম নিচ্ছে, মানুষ নয়। ফের, বিকাশ তো বিকাশই, তার কোনো অন্তিম সীমা দেখতে পাই না, তাহলে আবার বিকাশের ক্রম কিভাবে থেমে গেল ? মানুষের বিকাশের পর অন্য কোন কিছু কেন হলনা?
 
এই প্রকারের শত শত উদাহরণ দেওয়া যেতে পারে, যেটা বিকাশবাদের দ্বারা প্রতিপাদিত সিদ্ধান্তের ব্যতিক্রমকে প্রমাণিত করে। বস্তুতঃ যে যোনি যেমন ধরনের, সে সদা তেমনিই আছে এবং ভবিষ্যতে তেমনিই থাকবে। আবশ্যকতা, তন্মূলক ইচ্ছা, অভ্যাস এবং বাতাবরণ বা পরিস্থিতির কারণে তাতে শরীরের অঙ্গের কোনো প্রকারের পরিবর্তন সম্ভব নয়। এমনও হতে পারে যে অত্যন্ত প্রতিকূল প্রাকৃতিক পরিস্থিতিতে অনেক জাতি নষ্ট হয়ে যাবে, পরন্তু তাতে এমন কোনো পরিবর্তন হতে পারবে না, যা তার নৈসর্গিক জাতিকে বদলে দেবে। এই সব কথার দ্বারা প্রমাণিত হয় যে আদিম মনুষ্য হীন-মস্তিষ্ক প্রাণীদের দ্বারা বিকশিত হয়ে উন্নতি করে নি, প্রত্যুত তারা ছিলেন পরমাত্মার বিশিষ্ট রচনা এবং বর্তমানের উত্তম মস্তিষ্ক সমূহের অপেক্ষা অধিক উন্নত এবং বিকশিত ছিলেন।
 
বিজ্ঞান বলছে যে সর্বপ্রথম এককোশীয় প্রাণী হয়েছে, কিন্তু এই সমস্যার সমাধান বিজ্ঞান আজ পর্য্যন্ত করতে পারেনি যে, এক কোশের প্রাণী কি ভাবে হোল ? এমিবা নামের প্রাণী হচ্ছে একটি কোশের দেহ। ঠিক সেই দেহই অনেকানেক সংখ্যাতে মিলে অন্য অনেক কোশযুক্ত প্রাণীদেহের রচনা করে – এই রকম জিনিষ সিদ্ধ করা বিজ্ঞানের কাছে কঠিন। যদি এককোশীয় প্রাণী নিজে নিজেই উৎপন্ন হতে পারে তাহলে মানুষও স্বয়ং উৎপন্ন হয়ে। যাবে, যে অন্তর্ব্যাপ্ত শক্তির প্রভাবে এক সেল (Cell)-র এমিবা উৎপন্ন হতে পারে, সেই শক্তির দ্বারা মনুষ্য শরীরের রচনা হওয়াতে কোনো প্রকারের বাধা উপস্থিত হতে পারে না। বনস্পতি শাস্ত্রের অন্তরাষ্ট্রীয় খ্যাতিপ্রাপ্ত বিদ্বান্ ডক্টর বীরবল সাহানীকে জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল – “আপনি বলেন যে আরম্ভে (প্রথমে) এককোশীয় প্রাণী ছিল, তা থেকে উন্নতি করে বড়-বড় প্রাণী হয়ে গেছে। আপনি এও বলেন যে আরম্ভে অনেক কম জ্ঞান ছিল, ধীরে-ধীরে উন্নতি হয়ে জ্ঞান সেই অবস্থাতে পৌছে গেছে। তাহলে আপনি এইটুকু বলুন

- Where from did life come in the very begiming and wherefrom did knowledge come in the very beginning ?" অর্থাৎ প্রারম্ভে জীবন কোথা থেকে এসেছে এবং প্রারম্ভে জ্ঞান কোথা থেকে এসেছে ? ডাক্তার সাহানী উত্তরে বলেছিলেন – “এই প্রশ্নের সাথে আমাদের কোনো সম্বন্ধ নাই যে জীবন বা জ্ঞান কোথা থেকে এসেছে। আমরা এই কথাকে স্বীকার করে বলি যে, আরম্ভে কিছু জীবনও ছিল এবং কিছু জ্ঞানও ছিল – With this we are not concerned as to where from life came in the very beginning or where from knowledge came in the very beginning, we are to take it for granted that there was some life in the beginning of the world and there was knowledge also in the beginning of the world and by slow progress it increased”- এই উক্তি থেকে জানা যায় যে বিকাশবাদ যাকে নিয়ে এত চর্চা এবং যাকে অর্ধশিক্ষিত লোক বলে মেনে চলে আসছে – তা স্বয়ং সঞ্চালন (Self-direction) তথা সম্প্ৰয়োগ (Co-ordination)-র শক্তি একেবারেই নেই, তাহলে বিকাশবাদের সিদ্ধান্তানুসারে কোটি-কোটি বছরেরও বেশী সময়েও জড় পরমাণুতে এই প্রকারের সঞ্চালন যে, শেষ পর্যন্ত জীবিত প্রাণীর বিকাশ হতে পারে – তা অসম্ভব। এইভাবে যদ্যপি মানুষের জ্ঞানের বিকাশ তার চিন্তন-শক্তির সাহচর্য্যে হয় তথাপি সে কিছু জ্ঞান প্রাপ্ত করে, 

তার আদিমূল সে স্বয়ং নয়। জ্ঞানের বিকাশ মানব বুদ্ধি জড় হওয়ার জন্য কোনো অন্যের থেকে প্রেরণার অপেক্ষা রাখে। বুদ্ধি হোল এক জন্মজাত শক্তি কিন্তু জ্ঞান অর্জিত সম্পত্তি। মনুষ্যের স্বতঃ জ্ঞানের উপলব্ধি হয় না। তাকে যদি প্রারম্ভে গুরু দ্বারা জ্ঞান প্রাপ্ত হয়ে যায় তাহলে সে নিজের অনুভব, চিন্তন, সংবেদন এবং বুদ্ধির দ্বারা সেই জ্ঞানের বিকাশ করতে পারে, অর্থাৎ পশুদের মতো কেবল স্বাভাবিক জ্ঞানের আশ্রিত না থেকে সে নৈমিত্তিক জ্ঞানের আশ্রয়ে জ্ঞানের বৃদ্ধি করতে সমর্থ হয়ে যায়। মনুষ্য যোনির এইটি হোল বিশেষতা এই ব্যবস্থাতেই মনুষ্য যোনির সার্থকতা। এইটাই হল এমনই যোনি যাহা হতে জীব বিকাশ করার সুযোগ প্রাপ্ত হয়। পরন্তু এই বিকাশ স্বতঃ হয়না, সমুচিত সাধনের দ্বারা নৈমিত্তিক জ্ঞানের দ্বারাই সম্ভব হয়। 
একেই লক্ষ্য করে শাস্ত্রে বলা হয়েছে –
  “মাতৃমান্ পিতৃমান্ আচার্যবান্ পুরুষো বেদ’’- 
অর্থাৎ মাতা, পিতা, আচার্য্যের সহায়তাতেই মানুষ জ্ঞানবান হয়। 
 
আফ্রিকাতে জন্ম নেওয়া হাশীপুত্রকে ইংল্যান্ডে নিয়ে গিয়ে সেখানেই কোনো গৃহস্থের ঘরে রেখে যদি তার পালন-পোষণ করা হয় তাহলে সে ইংরেজদের মতো ব্যবহার করবে। এর বিপরীতে যদি কোন ইংরেজবালক কে আফ্রিকার কোনো হাবশীর ঘরে রেখে পালন-পোষণ করা যায় তাহলে সে হাবশীদের মতো ব্যবহার করবে। গুজরাটে উৎপন্ন বালক গুজরাটী এবং বঙ্গে জন্ম নেওয়া বালক বাংলা বলে। এই সবের কারণ এটাই যে, যেখানে যাকে যেমনটি শেখার অবসর প্রাপ্ত হয় সে তেমনই শেখে এবং ব্যবহার করতে থাকে । জংলী জাতির মধ্যেই নয়, আধুনিক সভ্য সুশিক্ষিত সমাজেও কোনো
অতিবড় বিদ্বানের ছেলেও না পড়ে বিদ্বান্ হয় না। 
 
স্বাভাবিক জ্ঞানের দৃষ্টিতে মানুষ পশুর থেকেও পেছনে রয়েছে। পশুকে সাঁতার শেখাতে হয়না কিন্তু সাঁতারের কথা মানুষকে বলে, যতক্ষণ পর্যন্ত আঙুল ধরে শেখানো না হয়, ততক্ষণ পর্যন্ত মানুষের ছেলে মেয়ে সাঁতার শিখতে পারেনা।

স্বাভাবিক জ্ঞান নৈমিত্তিক জ্ঞানের প্রাপ্তিতে সহায়ক তো হতে পারে কিন্তু স্বয়ং বিকশিত হয়ে মানুষের ব্যবহারাদির জন্য পর্যাপ্ত হতে পারে না। স্বাভাবিক জ্ঞানের দ্বারা যুক্ত বাচ্চাদেরকেও পড়াশুনার জন্য শিক্ষকের কাছে যেতে হয় । যদি কেবলমাত্র স্বাভাবিক জ্ঞানের আশ্রয়ে মানুষ নিজের অনুভবের দ্বারাই জ্ঞানপ্রাপ্ত করেত পারে তাহলে তো জঙ্গলে বসবাস করা প্রত্যেক ব্যক্তি না পড়েই কখনও না কখনও গণিত বা ব্যাকরণের আচার্য্য, ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার এবং বিজ্ঞানবেত্তা হয়ে যেতে পারত। কিন্তু আফ্রিকা, আমেরিকা এবং আস্ট্রেলিয়ার দ্বীপে যেখানে শিক্ষার কোনো ব্যবস্থা নেই, হাজার-হাজার লাখ- লাখ বছর ধরে বসবাস করা হাবশী লোকেরা আজও পশুবৎ জীবন ব্যতীত করে চলছে। ভারতেও সুদূর পর্বতীয় প্রদেশে এবং জঙ্গলে নিবাস করা ভীল, সাঁওতাল, নাগা ইত্যাদি সম্প্রদায় আজ পর্যন্ত অজ্ঞানী হয়ে রয়েছে। কে বলতে পারে যে, তাদের মধ্যে চেতনা বা সংবেদনার সর্বদা অভাব আছে ? যদি স্বভাবের দ্বারা মানুষ উন্নতি করতে পারে তাহলে তাদের দশা আজ পর্যন্ত যেমনকে তেমন কেন হয়ে রয়েছে ? অন্য পক্ষে আমরা আরও দেখি যে, যেমন যেমন শিক্ষিত এবং সভ্য দেশের লোকেরা এইসব অবিকশিত ক্ষেত্রে পৌছে স্কুল ইত্যাদির ব্যবস্থা করতে থাকে, তেমনি তেমনি সেইসব লোকেরা শিক্ষিত হতে থাকে। যে কাজ স্বতঃ লাখ-লাখ বছরেও হচ্ছিল না, চেষ্টা করার পর সেই কাজ অল্প সময়ের মধ্যে বা কিছু বছর পরেই হয়ে গেল।
 
সমাজ বিজ্ঞানীরাও এটা স্বীকার করেন যে মানুষ, যেমন ভাবেই হোক, সমাজ থেকে জ্ঞান প্রাপ্ত করে। এইজন্য যদি আজও কোনো মানবকে সমাজ থেকে পৃথক করে দেওয়া যায় তাহলে সে সর্বদা অজ্ঞ থেকে যাবে এবং তার ব্যবহার পশুবৎ হবে। বিভিন্ন সময়ে যে সব পরীক্ষা করা হয়েছে তাতে এটাই জানা গেছে যে, যদি কোনো বালককে জন্ম হতেই মাতা-পিতা এবং মানব সমাজ থেকে পৃথক করে জঙ্গল পশুদের মাঝখানে ছেড়ে দেওয়া যায় তাহলে সে পশুর মতোই ব্যবহার করবে। সেইরকমই ঘুরবে-চলবে এবং সেইরকমই শব্দ বলবে । আকৃতি ছাড়া সেই মানব শিশুর মধ্যে এবং সেই পশুদের মধ্যে কোনো পার্থক্য হবেনা। জন্মের কিছুক্ষণ পরেই নেকড়ে বাঘের গুহায় পালিত রামু এবং কমলার কাহিনী তো পুরা দেশে চর্চার বিষয় হয়ে ছিলো। উক্ত দুইজন (রামু+কমলা) নেকড়ে বাঘের মতো চার হাত পায়ে চলতো, পশুর মত কাঁচা মাংস খেত এবং কথা বলার নামে বাঘের মতো গর্জন করতো। মানব সমাজ থেকে দূরে পশুদের মাঝখানে থেকে তারা পশুই হয়ে গিয়েছিল।

আহার, নিদ্রা, ভয়, মৈথুন তথা আত্ম-সংরক্ষণ-বিষয়ক পশুজগতের কার্য্য স্বাভাবিক জ্ঞানের দ্বারা চলতে পারে, কিন্তু ধর্ম, অর্থ, কাম এবং মোক্ষ যার জীবনের লক্ষ্য সেই মানুষ নৈমিত্তিক জ্ঞান ছাড়া অগ্রসর হতে পারে না। বিকাশবাদ অনুসারে মানুষের বুদ্ধি জ্ঞান এবং অনুভবের দ্বারা ধীরে ধীরে বিকসিত হয়ে স্বতঃ জ্ঞান-প্রাপ্তিতে সমর্থ হয়ে যায়। এটা বলা হয় যে, যদ্যপি একটি মানুষ তার জীবনকালে স্বতঃ জ্ঞানপ্রাপ্ত করতে পারেনা, তথাপি বংশানুক্রমের দ্বারা ধীরে ধীরে বিকাশ করতে করতে জ্ঞানের সঞ্চয় করে নেবে। সাধারণ দৃষ্টিতে দেখলে এই কথাটিকে ঠিক বলে মনে হবে কিন্তু গম্ভীরভাবে বিচার করলে এর শূন্যতা স্পষ্ট হয়ে যায়। দীপকের উপরে পতঙ্গ আসে এবং জ্বলে যায়। যখন থেকে দীপক এবং পতঙ্গ রয়েছে তখন থেকেই এইরকম হয়ে চলে আসছে। পতঙ্গদের লাখ কোটি বছরের অনুভব তাদেরকে সেই জ্ঞান দেয় নাই যাতে করে তারা ভবিষ্যতে জ্বলন থেকে বেঁচে যায়। শেখালে তো সার্কাসে বাঁদর, হাতী, ঘোড়া ইত্যাদি পশু অনেক প্রকারের খেলা দেখায় পরন্তু স্বতন্ত্র রূপে তাদের আচরণ আজও সেইরকমই যেমনটি লাখ-লাখ বছর পূর্বে ছিল । মনুষ্যোচিত ব্যবহারের প্রদর্শন করতে দক্ষ শিম্পাঞ্জীও চিড়িয়াখানা এসে কিছু শিখতে পায় এবং তাও প্রশিক্ষকের দ্বারা। কেবলমাত্র পশুজগতেই নয়, মানব জগতেও এই নিয়ম কাজ করে চলেছে। কোনো পরিবার যতই শিক্ষিত এবং জ্ঞানী, এবং যতই বংশপরম্পরা থেকে তাদের মধ্যে শাস্ত্রের অধ্যয়ন-অধ্যাপন চলে আসুক না কেন, সেই পরিবারের সাহায্য বিনা স্বয়ং পড়াশুনা করে বিদ্বান হয়ে যাবে-তা সম্ভব নয়। জ্ঞানের যদি ক্রমিক বিকাশ হত তাহলে আগামী সন্ততিতে তা স্বতঃ সংক্রমত হয়ে থাকতো। যদি কোথাও দুই সহোদর ভাইয়ের মধ্যে একজনের শিক্ষার সমুচিৎ ব্যবস্থা করে দেওয়া যায় এবং অন্যজনকে শিক্ষার ব্যবস্থা থেকে বঞ্চিত রাখা যায় তাহলে দ্বিতীয় ভাই একই বংশ পরম্পরাতে সহোদর ভাই হওয়া সত্ত্বেও মূর্খ থেকে যাবে। জ্ঞানপ্রাপ্তির নৈমিত্তিক সাধনের উপর অবলম্বিত থাকাটাই মূল কারণ। 
 
যদি জীবাত্মা স্বভাবতঃ উন্নতি করতো তাহলে সৃষ্টি উৎপত্তির লাখ-কোটি বছর ব্যতীত হওয়ার পর আজ পর্যন্ত জ্ঞানের উচ্চতম স্থান প্রাপ্ত হয়ে যেতো। স্কুল-কলেজ সেও কবে বন্ধ হয়ে যেতো। অনেক লোক সর্বজ্ঞ হয়ে যেতো। কিন্তু বাস্তবিকতা হল এইটি যে যদি আজও বাচ্চাদেরকে স্বতন্ত্র ছেড়ে দেওয়া যায় তাহলে তারা উন্নতি করার স্থানে অবনতি করতে থাকবে। উপর ওঠার মতো উন্নতিও পরিশ্রম এবং তপস্যার দরকার এবং মনুষ্য তা থেকে বাঁচতে চায়, কেননা সে স্বভাব থেকে সরলতা এবং সুগমতা চায়। বর্তমান যুগের তথাকথিত উন্নতি মানবীয় গুণের বিকাশের ফল নয়, তার সুখ, সুগমতা এবং সরলতা অর্জনের ইতিহাস। বস্তুতঃ মানব গুণের হ্রাস হয়ে চলছে। আদিমানব আজকের মনুষ্য থেকে মানবীয় সামর্থ্যে অধিক উন্নতি ছিল - এটি নির্বিবাদ সত্য। এর সাক্ষী কোনোও এইরকম মানবীয় ব্যবহারে খোঁজা যেতে পারে যাহা আদিমানবে হওয়া প্রমাণিত এবং যা আজও বিদ্যমান। তা হল ভাষাবিজ্ঞান। 

বৈদিক ভাষা সংস্কৃত থেকে এবং সংস্কৃত ভাষা গ্রীক এবং ল্যাটিন ইত্যাদি ভাষার থেকেও অধিক সক্ষম, বিবিধ উচ্চারণকে অংকিত করতে অধিক সমর্থ এবং অধিক বিজ্ঞান সম্মত বর্তমান ভাষাগুলি উচ্চারণ করতে সুগম এবং স্মরণ করতে সুসাধ্য তো বটে কিন্তু তাতে প্রাচীন ভাষাগুলির মত না আছে লালিত্য, বা ভাষাভিব্যক্তির ক্ষমতা এবং না আছে অল্প শব্দে অনেক কিছু বলে দেওয়ার সামর্থ্য। আধিভৌতিক, আধিদৈবিক এবং আধ্যাত্মিক সমস্ত দৃষ্টিতে আজকের তুলনাতে আদিমানব অধিক উন্নত ছিলো ৷ যখন এটা নিশ্চয় হয়ে গেলো যে মানুষ কারও দ্বারা না শেখালে সে কিছুই শিখতে পারেনা তাহলে প্রশ্ন হচ্ছে যে প্রথম বংশের মানুষেরা জীবনের ব্যবহার কার থেকে শিখে থাকবে? যেভাবে বর্তমানে আমরা মাতা-পিতা ইত্যাদি থেকে জ্ঞান প্রাপ্ত করেছি, ঠিক তেমনি ভাবে আমাদের মাতা-পিতা ইত্যাদি তাঁদের মাতা-পিতা থেকে এবং তারাও তাদের মাতা-পিতা থেকে জ্ঞানপ্রাপ্ত করে আসছে। এই ক্রম চলতে চলতে যখন সৃষ্টির আদিকালে অমৈথুনী সৃষ্টি পর্যন্ত পৌঁছাবে, যেখানে পৃথিবীর উপর মানবের সর্বপ্রথম প্রাদুর্ভূত বংশ পাওয়া যাবে, তখন নিশ্চয়ই পরমেশ্বরের অতিরিক্ত অন্য কোনো শিক্ষা পাওয়া যাবেনা। 

অতএব মনুষ্যমাত্রের কল্যাণার্থ পরমেশ্বরের দ্বারা অমৈথুনী সৃষ্টিতে উৎপন্ন মানুষকে বেদজ্ঞান দ্বারা নৈমিত্তিক জ্ঞানকে প্রাপ্ত করাটা সর্বদাই যুক্তিযুক্ত। সেই মনুষ্যদের দ্বারাাা নিজের সন্ততি অথবা শিষ্যের মধ্যে জ্ঞানের প্রসার হয়েছে এই ক্রম আজ পর্যন্ত চলে আসছে। এইভাবে সংসারে আজ যতটুকুই জ্ঞান রয়েছে, তার আদিমূল পরমেশ্বরই।

এইজন্যই মহর্ষি পতঞ্জলি তার যোগদর্শনে ‘স পূর্বেষামপি গুরুঃ কালেনানবচ্ছেদাৎবলে পরমাত্মাকে গুরুদের গুরু বলে অভিহিত করেছেন। যোগদর্শনের এই সূত্রের উদ্দেশ্য হল এটাই যে, আদিকালে যখন সর্বপ্রথম মানবের আবির্ভাব হয়েছে তখন তাদের মার্গদর্শনের জন্য আবশ্যক সব বিষয়গুলি পরমগুরু পরমাত্মা তাদের আত্মাতে স্ফূর্ত করে দিয়েছেন। এই জ্ঞানরাশিকেই বেদ নামে অভিহিত করা হয়েছে। এবং ডারুইনের ক্রম বিকাশবাদ নিয়মানুসারেবানরের অন্তিম বিকাশ মানুষ এই সিদ্ধান্ত সম্পূর্ণ ভ্রান্ত, সত্য হল মনুষ্যেতর জীব হল কেবলমাত্র ভোগযোনী, থাকে বলা যায় নরকাগার ইহাই পরমপিতার সৃষ্টির অমোঘ নিয়ম।।”
 
যদি আজ মানুষে মানুষে হানা হানি, মারা মারি, উচ্চ নীচু, দ্বেষ বিদ্বেষ, বিচ্ছেদ, সাম্প্রদায়িকতা ও অশান্তি দূর করে ইহলৌকিক ও পারলৌকিক শান্তি প্রাপ্ত করিতে চাই, তাহা হইলে আসুন আমরা বিশ্ববাসী সকলে সেই
শাশ্বত সনাতন বৈদিক মন্ত্রের মিলিত সুরে বলি -

সমানো মন্ত্রঃ সমিতিঃ সমিতিঃ সমানী সমানং মনঃ সহ চিত্তমেষাম্।
সমানং মন্ত্রমভিমন্ত্রয়ে বঃ সমানেন বো হবিষা জুহোমি।।
(ঋগ্বেদ-০১০ সু ১৯ ম০ ১৩)
পরমপিতা বলিয়াছেন তোমাদের সকলের মন্ত্র এক হউক, সভা এক হউক, মন এক হউক এবং চিত্ত এক হউক। আমি একই মন্ত্রে তোমাদের সকলের জন্য একই উপদেশ দান করিয়া তোমাদের সকলের মঙ্গলের জন্য একই যজ্ঞ স্থির করিয়াছি। 
তিনি ঋগ্বেদ বলিয়াছেন-
সংগচ্ছষ্বং সং বদষ্বং সং বো মনাংসি জানতাম্।
দেবা ভাগং য়থা পূর্ব সংজানানা উপাসতে।। 
(ঋ০০-১০ সূ০-১৯১ ম০-১)
তিনি বলিয়াছেন হে মনুষ্যগণ তোমরা সকলে একসাথে চল অর্থাৎ তোমাদের যাত্রাপথ এক হউক, তোমাদের ভাষা এক হউক, তোমাদের মানসিক জ্ঞান এক হউক, যেমন পূর্বকালে বিদ্বান জ্ঞানী ব্যক্তিরা একমত হইয়া ধর্মপথে সকল ঐশ্বর্য্য ভোগ করিতেন, তোমরাও তেমনি করিতে থাকো। 
তিনি আবারও ঋগ্বেদে বলিয়াছেন-

সমানী ব আকৃতিঃ সমানা হৃদয়ানি বঃ ।
সমানমস্ত বো মনো য়থা বঃ স্ সহাসতি।। 
(ঋ০০-১০, সু০-১৯১ ম০-৪)

তিনি বলিয়াছেন তোমাদের প্রযত্ন এক হউক। তোমাদের হৃদয় এক হউক, তোমাদের মন এক হউক। তোমাদের শুভ মিলন যেন সদা বর্তমান থাকে। 
তিনি যজুর্বেদে বলিয়াছেন-
মিত্রস্যাহং চক্ষুষা সর্বাণি ভূতানি সমীক্ষে।
মিত্রস্য চক্ষুষা সমীক্ষামহে।।   
(যo অ০-৩৬, ম০-১৮)

আমরা সকলে পরস্পর সন্মেলিত হইয়া সবাই সবাইকে যেন মিত্রের দৃষ্টিতে দেখি। বিশ্বের সকল প্রাণী মাত্রই আমাদের মিত্র হউক। বিশ্বের সকল মনুষ্য ও প্রাণী মাত্রের জন্যই পরমপিতার এই মহৎ উপদেশ। 
ঋষির কথায় বলি –
শৃণ্বন্তু বশ্বে অমৃতস্য পুত্রা, কৃণ্বন্তো বিশ্বমায়ম্।।
বিশ্বের সকলেই আমরা সেই অমৃতের সন্তান, সকলেই আর্য হউক।

আমাদের সকলের প্রার্থনা হউক-
অসতো মা সদ্‌গময় তমসো মা জ্যোতির্গময় মৃত্যোমামৃতং গময়েতি।
আমরা সকলে যেন অসত্যকে ত্যাগ করিয়া সত্যকে গ্রহণ করি, অন্ধকার
হইতে আলোয় গমন করি, মৃত্যু হইতে অমৃতের পথে গমন করি। গীতায়
 
শ্রীকৃষ্ণ বলিয়াছেন –
যত্তদগ্রে বিষমিব পরিণামে মৃতোপমম্। গীতা অ০-১৮ শ্লো০-৩৭
স্বয়ং শ্রীকৃষ্ণের কথায়, তিনি বলিয়াছেন সত্য প্রথমে বিষের মত মনে হইলেও, পরিণামে তাহা অমৃতই দান করে। লেখকের এই লেখনী কাহারও বিরুদ্ধে নয়, কাহারও পক্ষেও নয়, কাহারও বিপক্ষেও নয়। কোনও ব্যক্তিগত দ্বেষ নয়, না কোনও সমষ্টিগত বিদ্বেষ। লেখকের এই লেখনীর একমাত্র উদ্দেশ্য বেদানুকূল ও বৈদিক ধর্মের ন্যায়ের মানদন্ডে পরম সত্যের উদ্ঘাটন ।
বেদ ও বেদানুকূল গ্রন্থ কেবলমাত্র আর্য তথাকথিত হিন্দুদের নয়, বিশ্বের সকল মনুষ্য, সকল সম্প্রদায়ের জন্য পরমেশ্বরীয় সংবিধান, যাহা সর্বকালের শাশ্বত সনাতন ও অপৌরুষেয়, যে কথা আজ আমরা মহর্ষি দয়ানন্দের কৃপায়
অবগত। তাঁহার অমর সৃষ্টি ও আশ্চর্য গ্রন্থ সত্যার্থ প্রকাশ বহুভাষায় সারা বিশ্বে সমাদৃত ইহা ছাড়াও ঋগ্বেদাদি ভাষ্যভূমিকা যাহা অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ে আজ পঠনরত। ইহা ছাড়াও অনেক গ্রন্থ রহিয়াছে, যাহা মানুষের নিকট অমূল্য সম্পদ বলিয়া পরিগণিত। আসুন আমরা সকলে সেই সত্যকে গ্রহণ করিয়া বলি-
সত্যমেব জয়তে নানৃতং, সত্যেন পন্থা বিততো দেবযান।।    মুন্ড০ ৩।১।৬
অর্থাৎ সর্বদা সত্যের বিজয় ও অসত্যের পরাজয় হইবেই। ইহাই বেদানুকূল শাশ্বত সনাতন বাণী। জীবনের আয়ু অনন্ত নয়, সময়ের বেলা যে বহিয়া যায়, তাই রবীন্দ্রনাথের ভাষায় বলি -
আমার বেলা যে যায় সাঁঝ বেলাতে।
তোমার সুরে সুরে সুর মেলাতে।।
সেই সাথে কবি কামিনী রাখের কথায় বলি –
পরের কারণে স্বার্থ দিয়া বলি এ জীবন ও ধন সকলি দাও। তার মত সুখ কোথাও কি আছে আপনার কথা ভুলিয়া যাও ৷
সূর্য্যের মত স্বতঃ প্রকাশিত বেদ এবং বেদানুকূল জ্ঞান দ্বারা সকলের মনের অন্ধকার দূর হইয়া, জ্ঞানের আলোকে উদ্ভাসিত হইয়া পরম সত্যকে গ্রহণ করুক, পরমাপিতার নিকট ইহা আমার একান্ত প্রার্থনা।
 

ও৩ম্ শান্তিঃ শান্তিঃ শান্তিঃ

কলমেঃ আর্য প্রতিনিধি সভা বাংলাদেশ ™

Post a Comment

0Comments

Please Select Embedded Mode To show the Comment System.*