📚 সত্যিই কি ঈশ্বর বলতে কেহ আছে🤔? না কি নেই?📚
- আর্য প্রতিনিধি সভা বাংলাদেশ ™
📚 সত্যিই কি ঈশ্বর বলতে কেহ আছে🤔? না কি নেই?📚 |
কমল : বিমলদা! তুমি প্রায়ই বলে থাকো -" নিত্য ঈশ্বরের প্রার্থনা করবে।" আমি জিজ্ঞেস করছি আচ্ছা বলেন তো, ঈশ্বর কোথায় আছেন যে, তার কাছে প্রার্থনা করবো?
বিমল : কেন? - ঈশ্বর তো সব জায়গায় আছেন। এমন কোন স্থান নেই যেখানে তিনি নেই।
বিমল : নারে ভাই, ঈশ্বর ছাড়া কোন স্থান খালি নেই একথা বলার উদ্দেশ্য হলো এই যে, সর্বত্র তাঁর অস্তিত্ব আছে। এই সাধারণ কথাটা বলতে হলে ঐভাবেই বলতে হয় - ঈশ্বর ছাড়া কোন স্থান খালি নেই বুঝলে?
শোনো ঈশ্বরের অস্তিত্ব কোন স্থানকে অধিকার করে থাকে না, প্রকৃতিই স্থান অধিকার করে থাকে। পৃথিবী, অগ্নি, জল, বায়ু তথা তাদের পরমাণু, এরাই স্থান অধিকার করে থাকে। ঈশ্বর ঐসমস্ত পদার্থে ব্যাপক, তাই বলা হয় ঈশ্বর সর্বত্র আছেন।
কমল : বেশ,ভালো কথা। কিন্তু ঈশ্বর যদি সর্বত্র বিদ্যমান, তাহলে তাকে দেখা যায় না কেন? যখন তাকে দেখা যায় না, সে অবস্থায় সব স্থানে তার থাকার প্রমাণ কি?
বিমল : তুমি কি বলতে চাও যে, যে বস্তু চোখে দেখা যায় না, সে বস্তুটা থাকে না? জগতে এমন বহু পদার্থ আছে, যার অস্তিত্ব আছে, অথচ তাকে দেখা যায় না। যেমন নাকি - শীত-গ্রীষ্ম, সুখ-দুঃখ, সময়,দিক,পিপাসা,সুরসুরি,
ব্যথা ইত্যাদি। কোন বস্তুর দৃশ্যমান হওয়ার বহু কারণ থাকতে পারে এবং থাকেও। জগতে আছে কিন্তু যদি দূরে থাকে তাহলে দেখা যায় না। যেমন ইউরোপ, আমেরিকা, (বহু দূরে উড্ডীয়মান ঘুরি বা পাখি)। আবার এমন জিনিসও আছে যা অত্যন্ত নিকটে থেকেও দেখা যায় না, যেমন - চোখ, চোখের একেবারে নিকটে থাকা চোখের পাতা। এমন বহু জিনিস আছে যা অত্যন্ত সূক্ষ্ম অথচ দৃশ্যমান নয়, যথা -- পরমাণু। ঠিক তেমনি অনেক প্রকার কীটাণু আছে যাদের অণুবীক্ষণ যন্ত্র ছাড়া দেখা যায় না, যথা শেওলা ডাকা পুকুরের জল। দর্পণে ময়লার আবরণ থাকালে প্রতিচ্ছবি দেখা যায় না। এমন অনেক জিনিস আছে যার মধ্যে কোন একটি গুনের সমানতা থাকার জন্য তাকে দেখা যায় না, যথা দুগ্ধে জল। কেনন, এরা উভয়ই তরল পদার্থ। এমন অনেক জিনিস আছে যা চোখের দোষে দৃষ্টি গোচর হয় না,যথা- পীত রোগে শ্বেত বর্ন। তাই, যারা বলে, দেখা যায় না অর্থাৎ দৃশ্যমান নয়, তার অস্তিত্ব নেই, এ কথা মহা ভুল।
কমল : দাদা! সত্যি বলতে কি, না দেখলেতো আমার বিশ্বাসই হয় না।
বিমল : এটা তোমার হঠকারিতা ছাড়া কিছুই নয়। আমি পূর্বেই বলেছি যে, এমন বহু জিনিস আছে, যা চোখে দেখা যায় না,কিন্তু তা আছে, সে কথা তোমার বিশ্বাস করতেই হবে। আচ্ছা বলতো আমি যা বলছি তুমি তা গুনছ -না শুনছ না?
কমল : হ্যাঁ শুনছি বৈকি।
বিমল : কি দিয়ে শুনছ?
কমল : কান দিয়ে শুনছি।
বিমল : যে শব্দটা উচ্চারিত হচ্ছে, তা আছে- না নেই?
কমল : কেন থাকবে না? - আছে।
বিমল : তাহলে বলতো সেই উচ্চারিত শব্দটা দেখতে পাচ্ছ না কেন? আরও বলি শোনো। আমার হাতে এই যে ফুলটা দেখছো, বলতো এটা কি ফুল?
কমল : এটা গোলাপ ফুল।
বিমল : এতে সুগন্ধ আছে না নেই?
কমল : হ্যাঁ , এতে সুগন্ধ আছে।
বিমল : কিভাবে জানলে, এতে সুগন্ধ আছে?
কমল : কেন?- নাক দিয়ে শুঁকে জানলাম।
বিমল : আচ্ছা আর এক কথা। রাতে তুমি যে দুধটুকু পান করেছিলে, তাতে চিনি ছিল -- না ছিলনা?
কমল : ছিল।
বিমল : তা তুমি জানলে কি করে?
কমল : জিভ দিয়ে।
বিমল: এবার আরেক কথা জিজ্ঞেস করি। বলতো শব্দ জ্ঞান কান দিয়ে, সুগন্ধের জ্ঞান নাক দিয়ে, চিনির জ্ঞান জিভ দিয়ে হলো কেন?
চোখ দিয়ে শব্দের, কান দিয়ে সুগন্ধের, নাক দিয়ে মিষ্টতার জ্ঞান হলো না কেন? গন্ধ এবং মিষ্টতা থাকা সত্বেও চোখ কেন তা দেখলো না?
কমল : যে ইন্দ্রিয়ের যে বিষয়, সে সেই বিষয়ের জ্ঞানই লাভ করেছে। কিন্তু ঈশ্বরকে যখন কোন ইন্দ্রিয় দ্বারা জানা যায় না, এমতাবস্থায় তাঁকে কি দিয়ে জানা যাবে যে, এ তিনি।
বিমল : তোমার প্রশ্ন ছিলো যে, যেহেতু ঈশ্বর দৃশ্যমান নহেন,অতএব তিনি নেই। দেখতে না দেখতে তুমি তোমার কথা বদলে দিচ্ছ দেখি। যাই হোক একথা তুমি স্বীকার করে নিলে যে, যে জিনিস চোখ দিয়ে দেখা যায় না, সেই জিনিসেরও অস্তিত্ব থাকে। একথা পৃথক যে, তা চক্ষু জ্ঞান ব্যতীত অন্য ইন্দ্রিয় দ্বারাও জানা সম্ভব। এবার তুমি প্রশ্ন করছ যে, ঈশ্বরকে যখন কোন ইন্দ্রিয় দ্বারা জানা যায় না এই অবস্থায় তুমি কেমন করে স্বীকার করবে - এই তিনি? এবার বলো -ইন্দ্রিয় দ্বারা জানা যায় না বলে, তুমি যখন ঈশ্বরকে স্বীকার করছ না,তখন এ অবস্থায় তুমি ইন্দ্রিয়গুলোকেই বা কেমন করে জানলে?
যদি বলো কেন ইন্দ্রিয় সমূহকে ইন্দ্রিয়ের দ্বারা জানতে পারা যায়, তাহলেতো আত্মশ্রয় দোষ হয়ে যাবে। কেননা যে কোন দ্রষ্টা সে নিজে দৃশ্যমান হতে পারে না। ইন্দ্রিয় সমূহের বিষয় যে ভিন্ন ভিন্ন। চোখের - রূপ, কানের-শব্দ,
নাসিকার-গন্ধ, জিহ্বার - রস, এবং ত্বকের- স্পর্শ এগুলো ইন্দ্রিয়ের আপন আপন বিষয়। নাক চোখকে জানতে পারে না,জিহ্বা কানকে জানতে পারে না।
কমল : বেশ তো বললে! কেন জানতে পারবে না? আমি যখন আয়না হাতে নিই,তখন তাতে চোখ,মুখ,,কান,জিভ এই সমস্ত ইন্দ্রিয়তো দেখা যায়। চোখ এমন একটি ইন্দ্রিয়,যে সমস্ত ইন্দ্রিয়ের জ্ঞান করিয়ে দেয়।
বিমল : ভাইটি! এ তোমার ভুল ধারণা। তুমি চোখ দিয়ে যা কিছু দ্যাখো সে তো রূপ। অন্য ইন্দ্রিয় বা তাদের বিষয়কে তো দেখতে পাওনা, আয়নায় ইন্দ্রিয় দেখা যায় কে বললো? যা দ্যাখো তা তো ইন্দ্রিয়ের গোলক অর্থাৎ রূপবান স্থানকে দেখতে পাও। ইন্দ্রিয় সমূহ তো সেই সব স্থানে শক্তি রূপে বিদ্যমান থাকে। চোখ সমগ্র ইন্দ্রিয়ের জ্ঞান করান তো দূরের কথা, চোখ তো নিজে নিজেকেই দেখতে পায় না। আর যদি তোমার এই ধারণা জন্মে থাকে, যে আয়নায় চোখ দেখা যায়, তাহলে আমি তোমায় একটা কথা জিজ্ঞেস করি। আচ্ছা বলতো আমার হাতে কি আছে?
কমল : আয়না।
বিমল : আয়না। ভালো কথা। একে কি দিয়ে দেখলে?
কমল : চোখ দিয়ে।
বিমল : বেশ। চোখ দিয়ে আয়না দেখছো কেমন? তাহলেতো আয়নায় চোখ দেখার পূর্বে তোমার চোখের জ্ঞান ছিল। এর অর্থ এই হলো যে, যদি চোখ না থাকতো, তাহলে আয়নাতে দেখতে পেতে না। এবার বলতো দেখি, চোখ দ্বারা আয়নার জ্ঞান হয়, -না আয়না দ্বারা চোখের জ্ঞান হয়ে থাকে? যদি বলো আয়না দ্বারা চোখের জ্ঞান হয়, তাহলে চোখ কানা হয়ে গেলে, আয়না অবশ্যই নষ্ট চক্ষুর জ্ঞান করিয়ে দিতে পারবে। কিন্তু চোখ নষ্ট হয়ে গেলে, আয়না সেই চোখের জ্ঞান করাবে কেমন করে?
সেতো নিজেই তার জ্ঞান লাভ করতে পারে না। আর যদি একটু গভীর ভাবে চিন্তা কর, তাহলে দেখবে যে,চোখ যা দেখে,তা সাধনের সহায়তায় দেখে। স্বতন্ত্র ভাবে দ্যাখে না। কিন্তু এ কথা ঠিক যে চোখ ব্যাতিত রূপের জ্ঞান হতে পারে না। কেননা রূপের জ্ঞানও চোখ নিজে নিজে করতে পারে না।
কমল : জিজ্ঞেস করছি,চক্ষুর কোন সাধনের প্রয়োজন হয়? চোখ তো স্বাধীন ভাবেই দেখে থাকে । চোখের বিষয়ই তো দর্শন করা। আচ্ছা বিমল দা -- চোখ সাধন ব্যতীত স্বতন্ত্ররূপে দেখতে পারে না কেন?
বিমল : তো শুনো। আমি এ সময় সব কিছু দেখছি কিন্তু যদি ঘন অন্ধকারে চারিদিক ছেয়ে যায়, তাহলে আমি কি এই সমস্ত বিষয় দেখতে পাবো -- না পাব না?
কমল : না। দেখতে পাবে না।
বিমল : তাহলে জানা গেল যে কোন বস্তুকে দেখতে গেলে শুধু চোখেরই প্রয়োজন হয় না, আলোরও প্রয়োজন হয়।আলো যদি না থাকে তাহলে চোখ থাকিতেও অন্ধ।শুধু তাই নয়, আলো আছে তাতেও দেখতে পাই না, কেননা দ্রব্যষ্ট বস্তুর এক নিশ্চিত স্থানে থাকা প্রয়োজন। দ্যাখো, এ একটা বই, যদি আমি এক মাইল দূর হতে বইয়ের অক্ষর দেখতে চাই, তাহলে আমি বইয়ের অক্ষর দেখতে পাবো না। আর যদি চোখের উপরেই বইয়ের পাতা লাগিয়ে রাখি তাহলেও বইয়ের অক্ষর দেখতে পাবো না। অক্ষর দেখবার জন্য, নিশ্চিত দূরত্বে বই থাকা চাই,তবে তা দেখতে বা পড়তে পারা যাবে।আবার দ্যাখো চোখ,আলো এবং নিশ্চিত দূরত্বে বই থাকা সত্বেও দেখা যায় না, চোখের সঙ্গে মনের সমন্ধ থাকা চাই । মন যদি অন্য কোনও বিষয়ে যুক্ত থাকে, সে অবস্থায় চোখের সামনে দিয়ে কোন কিছু চলে গেলেও চোখ তা দেখতে পায় না। প্রায়ই এমন দেখা যায়, যে চোখের সামনে দিয়ে কোন কিছু চলে গেল, তারপর যদি কেউ জিজ্ঞেস করে, তুমি কি এখন কিছু যেতে দেখেছো? উত্তর পাবে, কই নাতো, কিছু দেখিনি। এবার তুমি নিশ্চয় বুঝেছ যে, দেখতে হলে কতটা সাধনের প্রয়োজন হয়।
কমল : তুমি যে,এত কথা শুনালে এর অর্থ কি? কেন এত কথার অবতারণা করলেন?
বিমল : এতেও বুঝলে না? এর মানে হলো ঈশ্বরকে যেমন কোনও ইন্দ্রিয় দ্বারা জানা যায় না, তেমনি ইন্দ্রিয়কেও ইন্দ্রিয় সমূহ দ্বারা জানা যায় না। ইন্দ্রিয়কে ইন্দ্রিয় দ্বারা না জানা গেলেও, তোমায় স্বীকার করতে হবে যে ইন্দ্রিয় আছে। যদি তাই হয় তাহলে ঈশ্বরের অস্তিত্বকে স্বীকার করতে তোমার সন্দেহ কিসের বলো?
কমল : ইন্দ্রিয় সমূহকে কিভাবে জানা যেতে পারে?
বিমল : জীবাত্মার অনুভূতি দ্বারা ইন্দ্রিয় সমূহকে জানতে পারা যায়। কেননা যখন - রূপ,রস,গন্ধ,শব্দ ও স্পর্শ জ্ঞান লাভ করতে থাকে, তখন সে জানতে পারে যে, তার কাছে এর সাধান আছে। যাকে দিয়ে সে কাজ করিয়ে নিচ্ছে,সেই সমস্ত বিষয় জানার সাধনই তো ইন্দ্রিয়।
কমল : তাহলে ঈশ্বরকে কেমন করে জানা যায়?
বিমল : ঈশ্বরকে অনুভূতি দ্বারা জানা যায়।
কমল : অনুভূতি হবে কোথায়?
বিমল : ঈশ্বরের অনুভূতি হয় আত্মায়।
কমল : এ অনুভূতি হয় কখন?
বিমল : যখন মনের ত্রিদোষ ঘুচে যায় তখন ঈশ্বরের অনুভূতি হয়।
কমল : ত্রিদোষ আবার কি?
বিমল : মল, বিক্ষেপ এবং আবরণ এই তিনটি দোষকে ত্রিদোষ বলে।
কমল : মল, বিক্ষেপ এবং আবরণ কাকে বলে? এদের পরিভাষাই বা কি?
বিমল : মনের মধ্যে অপরের অনিষ্ট চিন্তা করা তথা আত্মায় পাপের সংস্কার পড়াকে মল বলে। সদাসর্বদা বিষয় চিন্তন অথবা মনকে সদা চঞ্চল রাখাকে বিক্ষেপ বলে। জগতের যাবতীয় নাশবান পদার্থের অভিমান মনের উপর পদার্থর মত পড়ে থাকাকে আবরণ বলে।
কমল : এই তিন প্রকার দোষকে কী উপায়ে নাশ করা যায়?
বিমল : ত্রিদোষ দূর করার তিনটি সাধন।
কমল : কী কী?
বিমল : জ্ঞান কর্ম ও উপাসনা।
কমল : জ্ঞান, কর্ম ও উপাসনার মানে কি?
বিমল : যে পদার্থ যে রূপ তাকে সেই রূপ মনে করা অর্থাৎ জড় বস্তুকে জড়, চেতনকে চেতন, নিত্যকে নিত্য এবং অনিত্যকে অনিত্য জানা জ্ঞান।
শরীর, সমাজ তথা আত্মার উন্নতি করা, অভিপ্রেত পদার্থ সমূহ লাভ করার জন্য পুরুষার্থ করাকে কর্ম বলে।
পদার্থের সমীপে গিয়ে, তার গুণ নিজের মধ্যে ধারণ করা এবারের আপন দোষ সংশোধন করার নাম উপাসনা।
কল্পনা করো একজন শীতে কাতর বা শীতার্ত। সে যদি শীত হতে পরিত্রাণ পাওয়ার জন্য জলের কাছে যায়, তাহলে তাকে অজ্ঞানী বলা হয় কিনা? এটা তার অজ্ঞানতা যে, সে শীত নিবারন করার জন্য জলের সমীপস্থ হচ্ছে, একে জ্ঞান বলে না। শীত তখনই দূর হতে পারে। যদি তার মধ্যে প্রথম থেকেই অগ্নির বিষয়ে জ্ঞান থাকে। তারপরে তাকে অগ্নির সমীপস্থ হয়ে শীত রূপী দোষকে অগ্নির যে গুন তা দিয়ে দূর করতে হবে। অর্থাৎ জ্ঞান দ্বারা মল, কর্ম দ্বারা বিক্ষেপ এবং উপাসনা দ্বারা আবরণ দূর হলে তার পর পরমাত্মার অনুভূতি হবে।
কমল : এ বিষয়টিকে আরও একটু পরিষ্কার করে বলনা দাদা! জ্ঞান দ্বারা মল, কর্ম দ্বারা বিক্ষেপ এবং উপাসনা দ্বারা আবরণ কেমন করে দূর হয়?
বিমল : জ্ঞানের দ্বারা জানতে হবে যে, জগতের সমস্ত প্রাণী এবং সমস্ত পদার্থ নাশবান, এই জন্য অপরের অধিকার ছিনিয়ে নেবার ভাবনা না রাখলেই 'মল' দোষ দূর হয়।
যখন মানুষ সাংসারিক পদার্থ সমূহকে জীবনের উদ্দেশ্য মনে করে উপভোগ আরম্ভ করে , তখন তার চিত্ত চাঞ্চল্য সৃষ্টি হয়, সেই চাঞ্চল্যকে বিক্ষেপ বলে। বাস্তবিক পক্ষে সাংসারিক পদার্থ সমূহ যে সাধন মাত্র, তাতে কোন সন্দেহ নেই। কিন্তু সাংসারিক পদার্থ সমূহ লাভ করা জীবনের উদ্দেশ্য নয়। এ সত্যকে জেনে যে কর্ম করা যায়, সেই কর্ম মানুষকে জলে পদ্ম পত্রের ন্যায় সাংসারিক মমতায় লিপ্ত হতে দেয় না। নিষ্কাম কর্মের অনুষ্ঠান দ্বারা বিক্ষেপ দূর হয়। মানুষের মনের উপর অহংকার বা অভিমানের আবরণ পড়লে, সে পরমেশ্বর প্রদত্ত বস্তু সমূহকে আপন মনে করতে থাকে। আর ধন,আমার স্ত্রী, আমার জন,আমার রাজ্য,আমার শাসন ইত্যাদি ইত্যাদি। অভিমানে বশিভূত হয়ে সে অপরকে পীড়ন করা আরম্ভ করে। সে মনে করতে থাকে, তার মতো বড় এ সংসারে আর কেউ নেই। কিন্তু যখন সে জ্ঞানপূর্বক কর্ম করে, মন এবং ইন্দ্রিয় সমূহকে বাহ্য বিষয় সমূহ হতে দূরে সরিয়ে শক্তিকে হৃদয়ে একাগ্র করে এবং মনে করে যে,পরমাত্মা তার সমীপে বর্তমান এবং সে পরমাত্মার সমীপে, এইরূপ উপাসনা দ্বারা অহংকার অর্থাৎ আবরণ দোষ দূর হয়ে যায়। এইভাবে ত্রিদোষ দূরীকরণ সাধন দ্বারা ত্রিদোষ নাশ করার নিরন্তর অভ্যাসই পরমাত্মার অনুভূতি করিয়ে দেয়।
কমল : বিমলদা! তোমার বিষয় বস্তুকে বিশদভাবে বুঝিয়ে বলার দক্ষতা অতি চমৎকার, তুমি তর্কে বড়ই চতুর। যাই হোক আমার জিজ্ঞাসা এই যে, ঈশ্বরকে দিয়ে জগতের কোন প্রয়োজনটা সিদ্ধ হবে?
বিমল : ঈশ্বরকে দিয়ে জগতের কোন প্রয়োজনটা সিদ্ধ হলে এই তো প্রশ্ন? দ্যাখো, যদি ঈশ্বর না থাকেন তাহলে জগৎ সৃষ্টি হবে কেমন করে? এই পৃথিবী, জল, অগ্নি, বায়ু,সূর্য, চন্দ্র, নক্ষত্র সমূহ, নদ -নদী, হ্রদ, ঝরণা, সরোবর, পাহাড়,পর্বত,বন-উপবন, লতা, পাখি,জলচর, স্থলচর , নভচর, অণ্ডজ, উদ্ভিদ, জরায়ুজ প্রভৃতি অনেক প্রকার জীব তথা অন্যান্য যাবতীয় পদার্থ, কে সৃষ্টি করবে বলো? ঈশ্বর ছাড়া কে এইসব সৃষ্টি করতে সূক্ষ?
কমল : এইসব সৃষ্টি করতে আবার ঈশ্বরের প্রয়োজন হয় নাকি? এসব সৃষ্টি তো নিজে নিজেই হয়েছে,আর চিরকাল হতেই থাকবে।
বিমল : জগতের কোন পদার্থ স্রষ্টা ব্যতীত সৃষ্টি হয় না। এ সমস্ত যদি নিজেই সৃষ্টি হতো, পাচক ব্যতীত অন্নাদী, কুম্ভকার ব্যতীত ঘট,স্বর্নকার ব্যতীত অলংকার, ময়রা ব্যতীত মিষ্টি, দর্জি ব্যতীত জামা-কাপড়, আপনি আপনিই হতো। আর এক কথা, সৃষ্ট বস্তু চিরকাল থাকে না। প্রত্যেক বস্তু উৎপন্ন হয়,বৃদ্ধি হয়, পরিবর্তন হয়,হ্রাস পায় এবং পরিশেষে তার বিনাশ হয়। প্রত্যেক সৃষ্ট বস্তুতে এই ছয় প্রকার বিকার দেখা যায়। বিশাল হতে বিশালতর পর্বত, অতিকায় হতে মহাতিকায় গাছ, বৃহৎ হতে বৃহত্তর পশু তথা জগতের মহান হতে সুমহান প্রত্যেকটি বস্তু সৃষ্ট এবং পরিশেষে বিনষ্ট হয়।
কমল : কিন্তু দাদা! পরমেশ্বর কোথাও কোন বস্তুর সৃষ্টি করেছে তা তো কোথাও দেখা যায় না। এরূপ ক্রম তো চিরকালের। পৃথিবী, জল, বায়ু আর এদের পরমাণু জগতে আছে, আর ঐ সমস্ত এক সাথে সংযুক্ত হয়ে, পদার্থ সমূহের সৃষ্টি হচ্ছে আর পরস্পর পৃথক হয়ে বিনষ্টও হচ্ছে। এতে ঈশ্বরের সৃষ্টি করার কি আছে?
বিমল : এ ধারণা তোমার ভুল। পৃথিবী প্রভৃতি তত্ব আর তাদের পরমাণু চেতন নয়,তারা তো জড়। তাদের যদি পরস্পর কেউ মিলন না ঘটায় তারা পরস্পর যুক্ত হবে কেমন করে? এই ভাবে তাদের যদি কেহ পৃথক না করে,তারা নিজেরা পৃথকও হতে পারবে না। সংযোগ এবং বিয়োগ এ দুটি বিপরীত গুন। কোন জড় অর্থাৎ প্রাণহীন পদার্থে এই বিপরীত গুন থাকা সম্ভব নয়। যদি কোন পদার্থে তাদের সম্মিলিত হওয়ার স্বাভাবিক গুন থাকে, তো তারা কদাপি বিযুক্ত হতে পারবে না।তারা কেবল যুক্ত হয়েই থাকবে। আর যদি পৃথক থাকার স্বাভাবিক গুন থাকে, সে কোন দিনও সংযুক্ত হবেই না।যদি বলো যে, প্রাকৃতিক তত্ত্বের কিছুটার মধ্যে সংযুক্ত এবং কিছুটার মধ্যে বিযুক্ত হওয়ার মত থাকবে, সে অবস্থায় তারা জগতেকে কখনো নষ্ট হতে দিবে না এবং যদি বিনষ্ট মূলক তত্ত্বের মতা থাকে, তাহলে তারা জগৎকে কখনো গঠন হতে দিবে না। আর যদি বারংবার থাকার স্বভাব থাকে,তাহলে যেখানে দুই তত্ত্ব সংযুক্ত হবে তাহারা তারা পরস্পর বিচ্ছিন্নও হবে। এরূপ অবস্থায় কোন বস্তুর নির্মাণ হবে না। কিন্তু জগতে প্রত্যেক বস্তু নির্মিত হয়,স্থির থাকে এবং ধংস হয়, এইতো আমরা দেখি। প্রকৃতি তত্ত্বে তুমি যত ইচ্ছে গুনের কল্পনা করোনা কেন, সে নিয়মানুসারে উৎপন্ন হবে,স্থির থাকবে এবং বিনষ্ট হবে। এই যে উৎপত্তি, স্থিতি এবং বিনাশ এ ক্রিয়া ঈশ্বর ছাড়া হতে পারে না। জড় এবং চেতনে পার্থ কি জানো?
প্রথমতঃ জড় বস্তু, সে স্বভাবত ক্রিয়াহীন, দ্বিতীয়তঃ সে যদি চেতনের সাহায্যে কিছু কর্ম করেও সে একই প্রকারের কর্ম করতে থাকবে। চেতন অর্থাৎ জ্ঞানবান সত্ত্বায় কর্ম করা, না করা এবং বিপরীত করার শক্তি আছে। এ গুণ চেতন সত্ত্বায় স্বাভাবিকভাবে বিদ্যমান।
কমল : কোন বস্তুর নির্মাতাকে তো প্রত্যক্ষ ভাবে দেখা যায়, যথা অলংকার নির্মাতা স্বর্নকারকে, মিষ্টি নির্মাতা ময়রাকে,ঘট নির্মাতা কুম্ভকারকে, নীড় নির্মাণকারী পাখিকে আমরাতো দেখতে পাই। ঈশ্বর যদি জগৎ নির্মাতা হন, তাকে দেখা যায় না কেন?
বিমল : বিশ্বাস করো কোন বস্তুর নির্মাতাকে দেখা যায় না,তুমি যে বলছ স্বর্নকার কুম্ভকার, ময়রা এদের দেখা যায়, একথা সত্য নয়। তুমি হয়তো বলবে কেন?
আচ্ছা কেন তাই বলছি শোনো। স্বর্নকার, কুম্ভকার, ময়রা প্রভৃতি যত প্রকারের যত কর্তা আছে, তারা দুই প্রকারের পদার্থ দ্বারা নির্মিত। প্রথমত- নাশবান পার্থিব শরীর, দ্বিতীয় - অমর জীবাত্মা। শরীর জীবাত্মার কোন কাজে লাগে সেটা শোনো। শরীর জীবাত্মার কর্ম করার এক সাধন। যখন জীবাত্মা শরীর রূপী সাধনকে কর্মে নিযুক্ত করে, তখনই সে কিছু নির্মান করতে সমর্থ হয়। আর যদি সে এই শরীর রূপী সাধনকে কর্মে নিযুক্ত না করে, তার দ্বারা তখন কোনও পদার্থ গড়া যায় না। এবার চিন্তা কর -স্বর্ণকার, কুম্ভকার, ময়রা এদের যেটি শরীর, - সেটি তাদের কর্মের যন্ত্র, তাতো দেখতে পাওয়া যায়। পৃথিবী, জল, অগ্নি, বায়ু, আকাশ প্রভৃতি পঞ্চতত্ত্ব দ্বারা শরীর নির্মিত। কিন্তু জীবাত্মা, যে শরীর সহযোগে কর্ম করে অর্থাৎ কর্তা তাকে তো দেখা যায় না।জীবাত্মা শরীর ব্যতীত কোন পদার্থ নির্মাণ করিতে পারে না। কেননা জীবের শক্তি পরিমিত। এই কারনেই পরমাত্মা তাকে যে শরীর দান করেছেন তা দৃশ্যমান। পরমাত্মা অসীম অনন্ত এবং সর্বব্যাপক। তিনি শরীর ব্যতীতই নিজের যাবতীয় কর্ম করে থাকেন। উভয় কর্তাই অর্থাৎ জীবাত্মা, পরমাত্মা কেহই দৃশ্যমান নয়। জীবাত্মারূপী অল্পজ্ঞ কর্তাও দৃশ্যমান নয়, আর পরমাত্মারূপী সর্বজ্ঞ সর্বশক্তিমান কর্তাও দৃশ্যমান নন।
কমল : যদি পরমাত্মার শরীর না থাকে তাহলে তিনি জগৎ সৃষ্টি করেন কেমন করে? শরীর ব্যতীত ক্রিয়া এবং কার্য উভয়ের কোনটাই সম্ভব নয়।
বিমল : এবার বিচার বিনিময় করার সময় পূর্ণ হয়েছে। আগামীকাল আবার এই প্রশ্নের উত্তর দেওয়া যাবে।
কমল : বেশ, তাহলে কালই হোক।।
বৈদিক ধর্মধারা
লেখকঃ পণ্ডিত সিদ্ধগোপাল কবিরত্ন
আর্য প্রতিনিধি সভা বাংলাদেশ