শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা - ১৭/৪
শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা- ১৭/৪ শ্লোকটি নিয়ে ভ্রান্তিকর ধারনা অনেক যুক্তিবাদীর মনেই জাগে, আর সেই জন্য শ্লোকটির বিরোধীতাও করে। শ্লোকটিতে কি বলা হয়েছে যার জন্য এমন বিরোধীতা!!! শ্লোকটিতে বলা হয়েছে -
যজন্তে সাত্ত্বিকা দেবান্যক্ষরক্ষাংসি রাজসাঃ৷ প্রেতান্ভূতগণাংশ্চান্যে যজন্তে তামসা জনাঃ৷৷
অনুবাদ : সাত্ত্বিক ব্যক্তিরা দেবতাদের পূজা করে, রাজসিক ব্যক্তিরা যক্ষ ও রাক্ষসদের পূজা করে এবং তামসিক ব্যক্তিরা প্রেতাত্মাদের পূজা করে। ---(শ্রীল প্রভুপাদ ভাষ্যম্)
অনুবাদের শেষে শ্রীল প্রভুপাদ, জয়দয়াল গোয়েন্দকা, সত্যানন্দ সরস্বতী সহ বিভিন্ন ভাষ্য ও ব্যাখাকারগণ ব্যাখাদিতে যক্ষ-রাক্ষস দ্বারা ভয়ঙ্কর কোন সত্ত্বাকে এবং ভূত-প্রেত বলতে অলৌকিক, দুষ্ট বায়ুপ্রধান দেহী - তথাকথিত ভূত-প্রেত-পিশাচ আদিকে বুঝিয়েছে। এরূপ অলৌকিক ভয়ঙ্কর অদৃশ্য সত্ত্বার মান্যতা বর্তমানে অনেক বেশি। আর সেই জন্য সেই অর্থানুকূল ভেবে অনেকেই শ্লোকটি নিয়ে শঙ্কা প্রকাশ করেন, বিরুদ্ধ আচরণ করেন । যেমন -
১. নাস্তিক: বিজ্ঞান অনুযায়ী অলৌকিক, অদৃশ্য অসীম শক্তিধারী ভয়ঙ্কর কোন সত্ত্বা অর্থাদি ভূত-প্রেত-পিশাচের অস্তিত্ব নেই। তাই এই শ্লোকটি বিজ্ঞান বিরুদ্ধ এবং হাস্যকর।
২. নিজেকে বৈদিক দাবী করা কোন কোন ব্যক্তি: ভূত-প্রেত বলতে অলৌকিক কিছুই নেই, ইহা বিজ্ঞান এবং বেদবিরুদ্ধ কথন তাই এটি প্রক্ষিপ্ত।
যদি আমরা বিচারপূর্বক জানার চেষ্টা করি যে, বৈদিক মান্যতায় যক্ষ-রাক্ষস, ভূত-প্রেত বলতে আসলে কি এবং শ্লোকটি নিয়ে বিচার করি, তাহলে দেখি যে, শ্লোকটিতে বেদ (বিজ্ঞান) বিরুদ্ধ কিছুই নেই।
যক্ষ, রাক্ষস, ভূত-প্রেতাদি এমনকি উক্ত ভাষ্যকারদের মান্য অলৌকিক তথাকথিত দেব-দেবীও বৈদিক মান্যতায় বা শাস্ত্রাদিতে নেই। বৈদিক মান্যতায় যা রয়েছে-
◾দেবতা: পৌরাণিক বিভিন্ন ভাষ্যকার দেবতা বলতে মনুষ্য হইতে ভিন্ন অলৌকিক ব্যক্তিদের বুঝিয়েছেন, যেমন ৪ মস্তকযুক্ত ব্রহ্মা, ৪ হস্তযুক্ত বিষ্ণু ইত্যাদি। কিন্তু স্বয়ম্ শ্রীকৃষ্ণ গীতা-১৬/৬ শ্লোকে মনুষ্যকেই দেব এবং অসুর দুই প্রকার বলেছেন।
মুণ্ডকোপনিষদ- ২/১/৭ শ্লোকেও দেব বলতে বিদ্বান্ ঋষিদের বুঝিয়েছেন।
ব্রহ্মা বিষয়েও বেদে বলা হয়েছে- "ব্রহ্মা দেবানাম্ পদবী" ---(ঋগ্বেদ-৯/৯৬/৬) অর্থাৎ ব্রহ্মা (চার বেদের জ্ঞাতা এমন) 'দেবানাম্'=বিদ্বাগণের পদবী।
◾যক্ষ: প্রসঙ্গ অনুযায়ী যক্ষ বলতে কোন ক্ষেত্রে ঈশ্বর, কোন ক্ষেত্রে দেব অথবা বল দ্বারা প্রতিষ্ঠিত শারীরিক বলধারী বুঝায়। যেমন কেনোপনিষদ-৩/২ শ্লোকে ঈশ্বর বুঝিয়েছে, গীতা-১০/২৩ শ্লোকে দেব বুঝিয়েছে, গীতা-১৭/৪ শ্লোকে বল দ্বারা প্রতিষ্ঠিত শারীরিক বলধারীকে বুঝানো হয়েছে।
◾রাক্ষস= সৎকর্মের বিঘ্নকারী এবং আক্রমণকারী পাপিষ্ঠকে রাক্ষস বলা হয়। ---(মনুস্মৃতি-১২/৪৪, ঋগ্বেদ-৭/১০৪/২১)
◾পিশাচ = রক্ত, মাংস ভক্ষণকারী হিংসককে পিশাচ বলা হয়। ---(মনুস্মৃতি-১২/৪৪, অথর্ববেদ-৮/২/১২)
◾ভূত-প্রেত: আত্মা যখন দেহ থেকে বিয়োগ হয় অর্থাৎ দেহ ছেড়ে দেয় তখন সেই দেহকে মৃত বলা হয়ে থাকে। সেই মৃত শবের (লাশের) নামই "প্রেত", যতক্ষণ পর্যত সেই শবকে ভস্ম না করা হয় ততক্ষণ পর্যন্ত ইহার নাম "প্রেত" ই থাকে। শব (লাশ) ভস্ম হওয়ার পর "প্রেত-সংজ্ঞা" সমাপ্ত হয়ে যায়, আর তখন সেই মৃতকে বলা হয় "ভূত"।
▪️মনুস্মৃতিতে বলা হয়েছে - গুরোঃ প্রেতস্য---(মনুস্মৃতি-৫/৬৫)
অর্থাৎ যখন গুরুর মৃত্যু হয়, তখন মৃতদেহের নাম হয় "প্রেত"......
বৃহদারণ্যক উপনিষদ্-৫/১১/১ শ্লোকেও মৃতদেহকে 'প্রেত' বলা হয়েছে।
▪️সত্যার্থ প্রকাশে বলা হয়েছে -
দাহান্তে সেই মৃতদেহের নাম হয় 'ভূত' অর্থাৎ তিনি অমুক ব্যক্তি ছিলেন, এইরূপ বলা হয়। যাহা কিছু উৎপন্ন হইয়া বর্তমান কালে থাকে না তাহা ভূতস্থ হয় বলিয়া তাহার নাম 'ভূত'। ব্রহ্মা হইতে আজ পর্যন্ত বিদ্বান্ ব্যক্তিদের এইরূপ সিদ্ধান্ত।
ভূত শব্দ দ্বারা আরও অনেক অর্থ হয়। যেমন গীতা- ১০/২২, ১৪/৩, ১৬/৬ শ্লোকে প্রাণী বুঝিয়েছে, গীতা-১৩/৩৪ শ্লোকে পঞ্চভূত বুঝিয়েছে।
উপরোক্ত সকল অর্থ এবং গীতার সপ্তদশ অধ্যায়ে চলায়মান বিষয়বস্তুর পরিপ্রেক্ষিতে গীতা-১৭/৪ শ্লোকের মহামহোপাধ্যায় আর্যমুনিকৃত বৈদিক ভাষ্য-
যজন্তে সাত্ত্বিকা দেবান্যক্ষরক্ষাংসি রাজসাঃ৷ প্রেতান্ভূতগণাংশ্চান্যে যজন্তে তামসা জনাঃ৷৷
পদপাঠ : যজন্তে । সাত্ত্বিকাঃ । দেবান্ । যক্ষরক্ষাংসি । রাজসাঃ । প্রেতান্ । ভূতগণান্ । চ । অন্যে । যজন্তে । তামসাঃ । জনাঃ ।।
পদার্থঃ- (সাত্ত্বিকাঃ, দেবান্, যজন্তে) সাত্ত্বিক ব্যক্তি দেব = বিদ্বানদের সৎকার করে, [বিদ্বাংসো হি দেবা (শ.ব্রা. ৩/৭/৩/১০)] (রাজসাঃ) রাজস ব্যক্তি (যক্ষরক্ষাংসি) যক্ষ = বল দ্বারা প্রতিষ্ঠিত রক্ষাংসি = পাপী ব্যক্তিদের সৎকার করে (অন্যে, তামসাঃ, জনাঃ) এবং অন্য তামস ব্যক্তি (ভূতগণান্) অগ্নাদি ভূত পদার্থ (চ) এবং (প্রেতান্) মৃত ব্যক্তিদের (যজন্তে) পূজা করে।
অনুবাদঃ- সাত্ত্বিক ব্যক্তি দেব = বিদ্বানদের সৎকার করে, রাজস ব্যক্তি যক্ষ = বল দ্বারা প্রতিষ্ঠিত রক্ষাংসি = পাপী ব্যক্তিদের সৎকার করে এবং অন্য তামস ব্যক্তি অগ্নাদি ভূত পদার্থ এবং মৃত ব্যক্তিদের পূজা করে।
অথ গীতার এই শ্লোকটি বেদ কিংবা ভৌতিক বিজ্ঞান এর কোনটিরই বিরোধ নয়। তাৎপর্যে বা ব্যাখ্যায় কে কি লিখেছেন তা দ্বারা গীতার শ্লোককে প্রক্ষিপ্ত বলা উচিৎ নয়।
🖋️প্রিয়রত্ন বিদ্যার্থী
অমৃতস্য পুত্রাঃ
