নিজ কুল (বংশ) ব্যতীত অন্য কুলে বিবাহ করলে কি কুলক্ষয় হয়?
শাশুড়ি ও পুত্রবধূর কথোপকথন
উভয়ে মা-মেয়ের ন্যায় তাই কন্যা ও মাতা শব্দ ব্যবহার করছি
মাতা : আয়ুষ্মান ভব।
কন্যা : মা আজ কি রান্না করবো রাতের জন্য যদি বলে দিতেন।
মাতা : আচ্ছা আজ দুজনে মিলেই ... রান্না করবো। এখন একটা বিষয়ে তোমায় কিছু জিজ্ঞাসা করতে চাই।
কন্যা : আচ্ছা ঠিকাছে মা। আর কি জিজ্ঞাসা করতে চাইছেন!
মাতা : তুমিতো ধর্মীয় গ্রন্থাদি অধ্যয়ন করো, সেই সুবাদে নিশ্চয় জানো বৈষ্ণব কুলের হয়ে ব্রাহ্মণ কুলে বিয়ে করলে বা হলে কুলক্ষয় হয়, (প্রমাণঃগীতা-১/৩৭-৩৯)
কন্যা : কুল বলতে কি বুঝায় মা, যদি বলতেন!
মাতা : কুল বলতে বংশ বুঝায়।
কন্যা : মা যদি অনুমতি দেন তো ঘর থেকে আমি কিছু গ্রন্থ নিয়ে আসি।
মাতা : ঠিকাছে নিয়ে আসো।
কন্যা : (পুস্তক আনার পর) এই যে দেখুন মা গীতার প্রথম অধ্যায়ের ৩৭-৩৯ শ্লোকে কি বলা হয়েছে -
যদ্যপ্যেতে ন পশ্যন্তি লোভোপহতচেতসঃ।
কুলক্ষয়কৃতং দোষং মিত্রদ্রোহে চ পাতকম্।।৩৭।।
কথং ন জ্ঞেয়মস্মাভিঃ পাপাদস্মান্নিবর্তিতুম্।
কুলক্ষয়কৃতং দোষং প্রপশ্যদ্ভির্জনার্দন।।৩৮।।
কুলক্ষয়ে প্রণশ্যন্তি কুলধর্মাঃ সনাতনাঃ।
ধর্মে নষ্টে কুলং কৃৎস্নমধর্মোহভিভবত্যুত।।৩৯।।
(গীতা- ৩৭-৩৯)
অনুবাদ: যদিও ইহারা লোভে হতজ্ঞান হইয়া কুলক্ষয়জনিত দোষ এবং মিত্রদ্রোহ-জনিত পাতক দেখিতেছেন না, কিন্তু হে জনার্দন, আমরা কুলক্ষয়-জনিত দোষ দেখিয়াও সে পাপ হইতে নিবৃত্ত হইব না কেন? (৩৭-৩৮)
কুলক্ষয় হইলে সনাতন কুলধর্ম নষ্ট হয়। এবং ধর্ম নষ্ট হইলে সমগ্র কুল অধর্মে অভিভূত হয়। ৩৯।
মা এখানে কিন্তু কোথাও এক বংশের সাথে অন্য বংশের বিবাহ হলে কুলক্ষয় হয় এরূপ বলা হয়নি। পাণ্ডব এবং কৌরব উভয়ে একই কুলের, যেহেতু একই কুলের সেহেতু যুদ্ধে তাদের মধ্যে যে যাকেই মারুক না কেন নিজ কুলই অর্থাৎ বংশ হ্রাস/ক্ষয়ই হবে তাহাই বলেছেন অর্জুন। কিন্তু আমি তো আমার কিংবা আমার পতির বংশের কাউকেই হত্যা করিনি বা করবোনা তাহলে আমার কিংবা আমার পতির কুলক্ষয় হবে কিভাবে! তাছাড়া দেখুন মা, এই গ্রন্থে ভগবান্ মনু বলেছেন -
অসপিণ্ডা চ য়া মাতুরসগোত্রা চ য়া পিতুঃ।
সা প্রশস্তা দ্বিজাতীনাং দারকর্মণি মৈথুনে ।। (মনু০৩/৫)
যে কন্যা মাতৃকূলের ছয় পুরুষের মধ্যে নহে এবং পিতৃ গোত্রীয় নহে সেইরূপ কন্যাকে বিবাহ করা উচিত।
বিপরীতে যে ছেলে মাতৃকূলের ছয় পুরুষের মধ্যে নহে এবং পিতৃ গোত্রীয় নহে সেইরূপ ছেলেকেই বরণ করা উচিত। শাস্ত্রে তো নিজ কুলে বিবাহ করতে নিষেধ করা হয়েছে বরং অন্য কুলে বিবাহ সম্বন্ধ করতে বলা হয়েছে। তাছাড়াও দেখুন এই গ্রন্থটিতে বলা হয়েছে -
চত্বারো বর্ণা ব্রাহ্মণক্ষত্রিয়বৈশ্যসশূদ্রাঃ।। (বসিষ্ঠ স্মৃতি - ২/১)
অর্থাৎ ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য ও শূদ্র এই চারটি বর্ণ।
আর এখানে দেখুন -
"বৈষ্ণবমসি"(যজুর্বেদ-৫/২১)।
অর্থাৎ- তুমি বিষ্ণুভক্ত (বৈষ্ণব) হও।
(বিষ্-লৃ ব্যাপ্তৌ) এই ধাতুর সহিত নু' প্রত্যয় যোগে 'বিষ্ণু' শব্দ সিদ্ধ হয়, বেবেষ্টি ব্যাপ্নোতি চরা চরং জগৎ স বিষ্ণুঃ পরমাত্মা' চর এবং অচর রূপ জগতে ব্যাপক বলিয়া পরমাত্মার নাম 'বিষ্ণু'।
অর্থাৎ ব্রাহ্মণ কোন কুল নয় আর বৈষ্ণবও কোন কুল নয়। সকল ঈশ্বর ভক্তই বৈষ্ণব। আপনিও তো ঈশ্বরভক্ত তাইনা মা! সেই অনুযায়ী আপনিও বৈষ্ণব। আর ব্রাহ্মণ কিংবা ক্ষত্রিয়, বৈশ্য, শূদ্র নিয়ে আরেকটি গ্রন্থে বলা হয়েছে যে, বের করে নিই,
এই যে দেখুন -
তজাত্যাব্রাহ্মণশ্রাত্রক্ষত্রিয়োবৈশ্যএবন।
নশূদ্রোনর্চবম্লেচ্ছোভেদিতাগুণকর্মভিঃ।। (শুক্রনীতি-১/৪/৩৮)
অনুবাদঃ- এই জগতে জন্মদ্বারা ব্রাহ্মণ-ক্ষত্রিয়-বৈশ্য -শূদ্র-ম্লেচ্ছ হয় না,
কিন্তু গুণ এবং কর্মভেদে হয়।
আপনার ছেলে যদি শাস্ত্রানুযায়ী ব্রাহ্মণের গুণ ধারণ করে এবং ব্রাহ্মণের কর্ম করে তাহলে তিনাকে যথার্থ ব্রাহ্মণ বলা যাবে আর আমিও যদি আপনার সেই ব্রাহ্মণ ছেলে তথা আমার পতির ন্যায় ব্রাহ্মণত্ব ধারণ করি তাহলে আমিও ব্রাহ্মণী হবো। দেখুন এখানে বলা হয়েছে-
ত্রৈবিদ্যো ব্রাহ্মণো বিদ্বান্ ন চাধ্যয়নজীবকঃ।
ত্রিকর্মা ত্রিপরিক্রান্তোমৈত্র এষ স্মৃতো দ্বিজঃ।
(ম০ অনুশাসনপর্ব- ১৪১/৬৬)
অনুবাদঃ- যে ত্রয়ীবিদ্যা তথা বেদের জ্ঞাতা এবং বিদ্বান্; অধ্যয়ন অধ্যাপনার কাজ করে জীবীকা নির্বাহ করে না; দান, ধর্ম এবং যজ্ঞ সদা এই তিন কর্মের অনুষ্ঠান করে; কাম, ক্রোধ এবং লোভ এই তিন দোষরহিত হয়েছে এবং সর্বপ্রাণীর প্রতি মৈত্রিভাব রাখে - এমন ব্যক্তিকেই বাস্তবে ব্রাহ্মণ মানা হয়েছে।
আর এখানে দেখুন আরেকটি গ্রন্থে -
ধর্মচর্যয়া জঘন্যো বর্ণঃ পূর্বং পূর্বং
বর্ণমাপদ্যতে জাতিপরিবৃত্তৌ ॥১॥
অধর্মচর্য্যয়া পূর্বোবর্ণো জঘন্যং জঘন্যং
বর্ণমাপদ্যতে জাতিপরিবৃত্তৌ ॥২॥
ইহা আপস্তম্ব
[ধর্মসূত্রের] সূত্র [প্রশ্ন ২/প০ ৫/কং০ ১১/সূত্র ১০-১১]
অর্থ – ধর্মাচরণ দ্বারা নিকৃষ্ট বর্ণ স্ববর্ণ অপেক্ষা উচ্চ বর্ণ প্রাপ্ত হয় এবং যে যে বর্ণের উপযুক্ত সে, সেই বর্ণে গণ্য হইবে ॥১॥ সেইরূপ অধর্মাচরণ দ্বারা পূর্ব পূর্ব অর্থাৎ উচ্চবর্ণের মনুষ্য নিজ বর্ণ অপেক্ষা নিম্ন বর্ণ প্রাপ্ত হয় এবং সে সেই বর্ণে গণ্য হইবে।
আসলে মা, আমরা শাস্ত্র বাদ দিয়ে বিভিন্ন ব্যক্তিদের কথন এবং বিভিন্ন গুরুর বই পড়ে ধর্ম পালন করে চলেছি যার জন্য এত বিশৃঙ্খলা আমাদের সমাজে। গীতায় বলা হয়েছে-
তস্মাচ্ছাস্ত্রং প্রমাণং তে কার্যাকার্যব্যবস্থিতৌ৷
জ্ঞাত্বা শাস্ত্রবিধানোক্তং কর্ম কর্তুমিহার্হসি৷৷ ১৬/২৪॥
অর্থাৎ কর্তব্য, অকর্তব্য নির্ণয়ের জন্য শাস্ত্রই একমাত্র প্রমাণ, এইজন্য শাস্ত্রের বিধানকে জেনে সেই অনুসারে কার্য করা উচিত।
মাতা : তোমার জ্ঞানের বিশালতা দেখিয়ে আমায় তো তুমি মুদ্ধ করে দিলে।
কন্যা : আসলে মা আমি জ্ঞান দেখাতে চাইনি সত্যটা প্রকাশ করেছি মাত্র, কেননা - "সত্যেন রক্ষ্যতে ধর্মো" সত্য দ্বারাই ধর্ম রক্ষা হয়। আশীর্বাদ করবেন মা, যেন সদা সত্য ও ধর্মের পথে থাকতে পারি, আরেকটি কথা বলা হয়নি সেটি হলো বিবাহের পর এখন স্বামীর কুলই আমার কুল, আমি যেন সেই কুলের মান বৃদ্ধি করতে পারি, 'সীতা' হতে পারি সেই আশীর্বাদও করবেন।
মাতা : তথাস্তু! আজ অনেক কিছু জানলাম পরে আরও জানবো। চলো এখন রান্না ঘরে যাওয়া যাক......।
অস্তু .....
কলমে- প্রিয়রত্ন বিদ্যার্থী
Tags:
শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা
