(গীতা ও পুনর্জন্ম বিষয়ে) জাকির নায়েকের মিথ্যাচারের জবাব

0

 

 (গীতা ও পুনর্জন্ম বিষয়ে) জাকির নায়েকের মিথ্যাচারের জবাব

জাকির নায়েকের মিথ্যাচারের জবাব (গীতা ও পুনর্জন্ম বিষয়ে)

◾এক ব্যক্তি ডা. জাকির নায়েকের নিকট পুনর্জন্ম বিষয়ে প্রশ্ন করেছিলেন। গীতা-৪/১-৩,৫ শ্লোকের অনুবাদ অস্পষ্ট এবং বিকৃতভাবে উদ্ধৃত করে জিজ্ঞেস করেছেন পুনর্জন্ম হয় কিনা।


উত্তরে জাকির নায়েক বলেছেন -

বেদ এবং কুরআন বলছে পুনর্জন্ম মানে পরবর্তী জীবন। পূর্ণ মানে পরবর্তী জনম মানে জীবন। কোথাও বলা হয়নি জীবন-মৃত্যু -জীবন-মৃত্যু...। ভগবত্ গীতাও এই ব্যাপারে কিছু বলেনি। আপনি যে উদ্ধৃতিটা দিয়েছেন তার রেফারেন্স আমি দিচ্ছি- ভগবত্ গীতা- অধ্যায় -৪/অনুচ্ছেদ-২২। সেখানে বলা হয়েছে, যেহেতু মানুষ কাপড় পরিবর্তন করে, পুরাতন কাপড় ফেলে দেয়, নতুন কাপড় পরিধান করে, একইভাবে আত্তা নতুন দেহে যায়, পুরাতন দেহ ফেলে দিয়ে নতুন দেহে যায়। আরো কিছু হাস্যকর উদ্ভট কথন করে বলেছে পুনর্জন্মের থিওরি বেদের নয় পণ্ডিতদের বানানো ইত্যাদি ইত্যাদি। 

                   


জাকির নায়েকের কথনে অসংখ্য ভুল রয়েছে। যেমন -

১. প্রশ্নকর্তা রেফারেন্স বিহীন গীতার যে শ্লোকানুবাদ বলার চেষ্টা করেছে তা গীতা-৪/২২ শ্লোকানুবাদ নয়। ইহার রেফারেন্স-৪/১-৩।

২. জাকির নায়েক গীতা-৪/২২ রেফারেন্স দিয়ে যে শ্লোকানুবাদের বিকৃতিরূপ উপস্থাপন করেছে তার রেফারেন্স ৪/২২ নয়। ইহার সঠিক রেফারেন্স গীতা-২/২২

৩.গীতা পুনর্জন্ম নিয়ে কিছু বলেনি, গীতায় অনুচ্ছেদ, কোথাও এই বিষয়ে বলেনি, পুনর্জন্ম বেদে নেই, পূর্ণ মানে পরবর্তী, আত্তা...........। 

➤সে বুঝিয়েছে গীতায় জীবন-মৃত্যু জীবন-মৃত্যু এরূপ বারংবার জন্ম-মৃত্যু চক্র বুঝানো হয়নি, বুঝানো হয়েছে - জন্ম নিয়েছেন, মৃত্যু হবে - কেয়ামতের পরে আবার পুনর্জীবিত হবেন, এতটুকুই। প্রথমত দেখে নিই কি বলা হয়েছে শ্লোকটিতে -                            

বাসাংসি জীর্ণানি যথা বিহায় নবানি গৃহ্নাতি নরোऽপরাণি ।
 তথা শরীরাণি বিহায় জীর্ণান্যন্যানি সংযাতি নবানি দেহী ॥

পদপাঠ : বায়াংসি । জীর্ণানি । যথা । বিহায় । নবানি । গৃহ্নানি । নরঃ । অপরাণি । তথা । শরীরাণি । বিহায় । জীর্ণানি । অন্যানি । সংযাতি । নবানি । দেহী ॥

পদার্থ : (নরঃ) মনুষ্য (যথা) যেরূপ (বাসাংসি জীর্ণানি) পুরাণো বস্ত্র (বিহায়) পরিত্যাগ করে (নবানি) নতুন বস্ত্র (গৃহ্নাতি) গ্রহণ করে (তথা) সেরূপ (দেহী) জীবাত্মা (জীর্ণানি শরীরাণি বিহায়) জীর্ণ শরীর ত্যাগ করে (অন্যানি নবানি সংযাতি) অন্য নতুন শরীর প্রাপ্ত হয়। 

সরলার্থ : মনুষ্য যেরূপ - পুরাণো বস্ত্র পরিত্যাগ করে নতুন বস্ত্র গ্রহণ করে, সেরূপ জীবাত্মা জীর্ণ শরীর ত্যাগ করে অন্য নতুন শরীর প্রাপ্ত হয়।

 মনুষ্য কি কেবল একবারই পুরনো বস্ত্র পরিবর্তন করে? আমরা তো প্রত্যক্ষ দেখছি - যতকাল মনুষ্য জীবিত থাকে ততকাল পর্যন্ত যতবার বস্ত্র জীর্ণ হয় ততবারই পরিবর্তন করে নতুন বস্ত্র পরিধান করে। এক্ষেত্রে তো মৃত্যুপর্যন্ত সময়সীমা রয়েছে । আর আত্মার তো জন্ম-মৃত্যুই হয়না, আত্মা তো অনাদি-   

  "প্রকৃতিং পুরুঞ্চৈব বিদ্ধ্যনাদী উভাবপি" (গীতা-১৩/১৯)

অনুবাদ : প্রকৃতি ও পুরুষ, উভয়কেই অনাদি বলিয়া জানিও।

 আর সেজন্যই চরক সংহিতা, শরীরস্থান, প্রথম অধ্যায়ের ৮১ নং শ্লোকে বলা হয়েছে - "ক্ষেত্রপারম্পর্যমনাদিকম্" অর্থাৎ ক্ষেত্রের পরম্পরা [শরীর ধারণ ও ত্যাগ বা জন্ম-মৃত্যুর পরম্পরা] অনাদি। পূর্বেও অনন্তবার জন্ম-মৃত্যু হয়েছে, ভবিষ্যৎকালেও অনন্তবার জন্ম-মৃত্যু [শরীর ধারণ ও ত্যাগ] হবে। ক্ষেত্র বলতে শরীর বুঝায় তা স্বয়ম্ শ্রীকৃষ্ণ গীতায় বলেছেন -

      " ইদং শরীরং কৌন্তেয় ক্ষেত্রমিত্যভিধীয়তে" গীতা-১৩/১

অনুবাদ : হে অর্জুন! এই শরীরকেই ক্ষেত্র বলে মানা হয়।

বারংবার জন্ম-মৃত্যুর চক্র বেদ বিরুদ্ধ নয় এবং পণ্ডিতদের মনগড়া বানানোও নয়। বেদে অসংখ্য মন্ত্রেই বারংবার জন্ম-মৃত্যুর উল্লেখ রয়েছে। যেমন যজুর্বেদে -

পুনর্মনঃ পুনরায়ুর্মআগন্ পুনঃ প্রাণঃ পুনরাত্মা ম আগন্ পুনশ্চক্ষুঃ পুনঃ শ্রোত্রং ম আগন্। বৈশ্বানরোদব্ধস্তনুপাঅগ্নিৰ্নঃ পাতু দুরিতাদবদ্যাৎ॥ 
(যজুর্বেদ-৪/১৫)

পদার্থ : যাঁহার সম্বন্ধ বা কৃপা দ্বারা (মে) আমাকে যে (মনঃ) বিজ্ঞানসাধক মন (আয়ুঃ) আয়ু (পুনঃ) বারংবার [বার বার] (আগন্) প্রাপ্ত হয় (মে) আমাকে (প্রাণঃ) শরীরের আধার প্রাণ (পুনঃ) পুনরায় (আগন্) প্রাপ্ত হয়। (আত্মা) সর্বত্র ব্যাপক সর্বান্তর্যামী পরমাত্মার বিজ্ঞান (আগন্) প্রাপ্ত হয়, (মে) আমাকে (চক্ষুঃ) দেখিবার জন্য চক্ষু (পুনঃ) পুনরায় (আগন) প্রাপ্ত হয় এবং (শ্রোত্রম্) শব্দকে গ্রহণকারী কর্ণ (আগন্) প্রাপ্ত হয়, সেই (অদব্ধঃ) হিংসা করিবার অযোগ্য (তনৃপাঃ) শরীর বা আত্মার রক্ষাকারী এবং (বৈশ্বানরঃ) শরীর প্রাপ্তকারী (অগ্নিঃ) অগ্নি বা বিশ্বকে প্রাপ্তকারী ঈশ্বর (নঃ) আমাদিগকে (অবদ্যাৎ) নিন্দিত (দুরিতাৎ) পাপ হইতে উৎপন্ন দুঃখ বা দুষ্ট কর্ম হইতে (পাতু) পালন করিয়া থাকেন ॥

ভাবার্থ : এই মন্ত্রে শ্লেষালঙ্কার আছে। যখন জীব শয়ন করিবার বা মরণাদি ব্যবহার প্রাপ্ত হয় তখন যে যে মনাদি ইন্দ্রিয় নাশ হইবার সমান হইয়া পুনরায় জাগিবার বা জন্মান্তরে যে সব কার্য্য করিবার সাধন প্রাপ্ত হয় সেই সব ইন্দ্রিয় যে বিদ্যুৎ অগ্নি ইত্যাদির সম্পর্ক, পরমেশ্বরের অস্তিত্ব বা ব্যবস্থা দ্বারা শরীর যুক্ত হইয়া কাৰ্য্য করিতে সক্ষম হয়। সেই সম্যক্ প্রকার সেবন কৃত জঠরাগ্নি সকলের রক্ষা করে এবং যাহা উপাসনা কৃত জগদীশ্বর পাপরূপ কর্ম হইতে পৃথক করিয়া ধর্মে প্রবৃত্ত করিয়া বারংবার মনুষ্য জন্ম প্রাপ্ত করাইয়া দুষ্টাচার বা দুঃখ হইতে পৃথক করিয়া ইহলোক বা পরলোকের সুখ প্রাপ্ত করান ॥

তাছাড়াও ঋগ্বেদে- 

পুনর্নো অসুং পৃথিবী দদাতু পুনর্দ্যৌর্দেবী পুনরন্তরিক্ষম্ । 
পুনর্ন: সোমস্তন্বং দদাতু পুন: পূষা পথ্যাং৩ যা স্বস্তিঃ ॥ (ঋগ্বেদ-১০/৫৯/৭)

ভাষার্থ :- (পুনর্নো অসুং পৃথিবী দদাতু পু০) হে সৰ্ব্বশক্তিমান্ পরমেশ্বর! আপনার অনুগ্রহে আমরা বারংবার পৃথিবী, প্রাণ, চক্ষু ও অন্তরিক্ষ স্থানাদি রূপ অবকাশকে যেন প্রাপ্ত হই। আপনি তাহার বিধান করুন, অর্থাৎ পুনঃ পৃথিব্যাদি স্থানে জন্মগ্রহণ করিয়া প্রাণাদি প্রাপ্ত হই এবং (পুনর্নঃ সোমস্তন্বং দদাতু) পুনর্জন্ম কালিন আমাদিগের জন্যে যেন সোম অর্থাৎ ঔষদি আদির রস উত্তম শরীর প্রদানে অনুকূল থাকে। (পুনঃ পূষা০) হে পুষ্টিকারী পরমেশ্বর! আপনি কৃপা করিয়া পুনর্জন্ম কালিন আমাকে ধৰ্ম্মমার্গী করুন, এবং যাহাতে সর্বপ্রকার দুঃখ নিবারিত হয়, এরূপে পথ্যরূপ স্বস্তি প্রদান করুন।

অথর্ববেদে


পুনর্মৈত্বিন্দ্রিয়ং পুনরাত্মা দ্রবিণং ব্রাহ্মণং চ। 
পুনরগ্নয়ো ধিষ্ণ্যা যথাস্থাম কল্পয়ন্তামিহৈব ॥ (অথর্ববেদ-৭/৬৭/১)

ভাষার্থ:- (পুনর্মনঃ পুনরাত্মা০) হে সৰ্ব্বজ্ঞ ঈশ্বর ! আমার যখন যখন জন্ম হইবে, তখন যেন (অর্থাৎ আমি যেন জন্ম জন্ম) শুদ্ধ মন, পূর্ণায়ু, আরোগ্য, প্রাণ কুশলতা যুক্ত জীবাত্মা, উত্তমচক্ষু ও শোত্র প্রাপ্ত হই। (বৈশ্বানরোদব্ধঃ) যে পরমেশ্বর বিশ্বে বিরাজমান হইয়া রহিযাছেন, তিনি যেন আমার শরীরকে জন্ম জন্ম পালন করেন। (অগ্নির্নঃ) সকল প্রকার পাপনাশক ভগবান, আপনি (পাতুদুরিতাদ অবদ্যাৎ) আমাকে জন্ম জন্মান্তরে মন্দ কর্ম ও সর্বপ্রকার দুঃখ হইতে পৃথক রাখিবেন।

এছাড়াও পুনর্জন্ম বিষয়ক এরূপ অনেক মন্ত্র রয়েছে বেদে।

পুনর্জন্ম বিষয়ে কুরানেও বলা হয়েছে-


তুমি কি তাদের প্রতি লক্ষ্য করনি, মৃত্যু বিভীষিকাকে এড়াবার জন্য যারা নিজেদের গৃহ হতে বহির্গত হয়েছিল? অথচ তারা ছিল বহু সহস্র; তখন আল্লাহ তাদেরকে বললেনঃ তোমরা মর; পুনরায় তিনি তাদেরকে জীবন দান করলেন; ---(কুরআন-২/২৪৩

আল্লাহ সৃষ্টির সূচনা করেন, অতঃপর তিনি এর পুনরাবৃত্তি করবেন, তখন তোমরা তাঁরই নিকট প্রত্যাবর্তিত হবে। ---(কুরআন-৩০/১১)  

তিনিই মৃত হতে জীবন্তের আবির্ভাব ঘটান এবং তিনিই জীবন্ত হতে মৃতের ও আবির্ভাব ঘটান এবং ভূমির মৃত্যুর পর ওকে পুনর্জীবিত করেন। এভাবেই তোমরা উত্থিত হবে।--- (কুরআন-৩০/১৯)

এটি থেকে কিঞ্চিৎ জাকির নায়েকও উদ্ধৃত করেছেন কিন্তু সে বলেছে কেবল দুইবার জন্ম আর একবার মৃত্যুর কথা রয়েছে। সে বলেছে- আপনি পৃথিবীতে আসবেন, মারা যাবেন আবার পুনরুত্থিত হবেন। কিন্তু সূরা বাকারায় দেখা যায় যে বলা হয়েছে - 

কিরূপে তোমরা আল্লাহকে অবিশ্বাস করছো? অথচ তোমরা নির্জীব ছিলে, পরে তিনিই তোমারকে সঞ্জীবিত করেছেন, পুনরায় তিনি তোমাদের নির্জীব করবেন, পরে আবার জীবন্ত করবেন... । ---(কুরআন-২/২৮)

এখানেই দুইবার মৃত্যু এবং দুইবার জন্মের কথন করা হয়েছে। আরেকটি আয়াতে বলা হয়েছে-

তৎপর আমি বলেছিলামঃ ওর (গাভীর) কিছু অংশ দ্বারা তাকে (মৃতকে) আঘাত কর; এই রূপে আল্লাহ মৃতকে জীবিত করেন এবং স্বীয় নিদর্শনসমূহ প্রদর্শন করেন যাতে তোমরা হৃদয়ঙ্গম কর। ---(কুরআন-২/৭৩)

এতে দেখা যায় আরও একবার জন্ম একবার মৃত্যু যুক্ত হয়েছে- নিদর্শন প্রদর্শন করতে গিয়ে। তাহলে মোট তিনবার জন্ম এবং তিনবার মৃত্যুর উল্লেখ পাওয়া গেল।

জন্ম-মৃত্যু জন্ম-মৃত্যু চক্র হয়েছে কি হয়নি, বিচার করুন। তবে আমাদের শাস্ত্রে কেবল তিনবার জন্ম-মৃত্যু হয় এরূপ বলা হয়নি, আর কুরানের ন্যায় এইপ্রকার কথনো নেই। অনন্তবার জন্ম-মৃত্যু হয়েছে এবং হবে, ইহার রেফারেন্স উপরেই দিয়েছি। শ্রীকৃষ্ণও স্বয়ম্ গীতায় অর্জুনকে বলেছেন- 

"বহুনি মে ব্যতীতানি জন্মানি তব চার্জুন " (৪/৫)। 

অর্থাৎ শ্রীকৃষ্ণ অর্জুনকে বলছেন- হে অর্জুন আমার এবং তোমার বহু জন্ম ব্যতীত হইয়াছে।....

🖋️ অমৃতস্য পুত্রাঃ

©️ আর্য প্রতিনিধি সভা বাংলাদেশ





Post a Comment

0Comments

Please Select Embedded Mode To show the Comment System.*