আমাদের
পুরাতন
অভিবাদনের নিয়ম
হল
নমস্তে।
হাতদুটো পরস্পর সংলগ্ন করে মিষ্টি হাসির সাথে নমস্কার অভিবাদন ― ভারতের একটি জনপ্রিয় রীতি ।
সৃষ্টিতত্ত্ব থেকে জানা যায় প্রাচীন সনাতনী সম্ভাষণ এই অঞ্জলি মুদ্রাকে তবে কালের ও মতবাদের ডামাঢোলে কিছুটা কমলেও সনাতনী সমাজ থেকে হারিয়ে যায়নি এবং অদূর ভবিষ্যতে হারিয়ে যাবেও না । যতই মতবাদী
সম্ভাষন ব্যাঙের ছাতার মত গড়ে উঠুক সত্য সনাতন কখনো কালের গর্ভে হারিয়ে যাবে না । এই রীতিটি ভারত, নেপাল, বাংলাদেশ, এশিয়ার অন্য কিছু অঞ্চল এবং যেখানে দক্ষিণ ও
দক্ষিন-পূর্ব এশিয়ার আদি মানুষ বসবাস করে, সেখানে ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হয় । নমস্কার বা নমস্তে সম্ভাষণ, অভিবাদন এবং আত্মীয়, অতিথি কিংবা আগন্তুককে স্বাগত জানবার একটি সম্মানজনক রীতি
একজন
বৈদিক
তথা
সনাতন ধর্মালম্বী ব্যক্তির অন্যতম
একটি
বৈশিষ্ঠ্য হল
কারো
সাথে
দেখা
হলে
কড়জোড়ে
তাকে
নমস্কার প্রদান
করে
অভিবাদন বা
সম্মান
জানানো।
রাম
জন্ম
নেওয়ার
আগে
নিশ্চয়ই রামরাম
বলা
হতো
না
তখনও
নমস্তে
বলতে
হত."নমস্তে" দুটো শব্দ নিয়ে
তৈরি
'নম:'
আর
'তে'
এর
মানে
হলো
আপনাকে
আমি
মান্য
করি
বা
আপনি
যেরূপে
হোন
আপনাকে
সম্মান
জানাই.
সংস্কৃতে নমো
শব্দটির সাথে
চতুর্থী বিভক্তি হয়.
"যুস্মত্" প্রাতিপদিকের চতুর্থী একবচনের রূপ
'তে'
হয়.
"তে"
মানে
আপনাকে। "জয় শ্রীরাম" বা "রামরাম" বা "রাধে রাধে"
বা
"জয়
গুরু" " জয় নিতাই" "জয় গুরু" বা "জয় হরিবোল" এই
অভিবাদনের মধ্যে
যাঁর
উদ্দেশ্যে বা
যাঁকে
অভিবাদন করা
হল
তার
কোনও
উল্লেখ
নেই। কিন্তু
"নমস্তে"
এই
সংস্কৃত শব্দটির মধ্যে
উল্লেখ
রয়েছে।
"নমস্তে" আপনার আমার
তৈরি
নয়
"নমস্তে"
শব্দটি
বেদ
থেকে
এসেছে। শ্রীরাম বলুন
শ্রীকৃষ্ণ বলুন
প্রত্যেকেই তাঁদের
সম্বোধনে "নমস্তে" শব্দটি বলতেন। আমরা
রামায়ণ
ও
মহাভারতের অনেক
জায়গায়
দেখতে
পাই। তাই
কোনও
সন্দেহ
নয়
আজ
থেকে
আপনারা
একে
অপরকে
নমস্তে
বলা
শুরু
করুন।
নমস্কার/ নমস্তে
শব্দটির ঋষিকৃত
ব্যাখ্যা দিলাম------
বৈদিক
অভিবাদন--- "নমস্তে"
"নমস্তে" = নমঃ+তে
। ব্যাকরণ অনুসারে "তে" শব্দটির অর্থ
হয়---
আপনার
উদ্দেশ্যে। আর
"নমঃ"
শব্দটির অর্থ
হল
--- সত্কার,
শ্রদ্ধা, কারো
কাছে
নত
হওয়া।
(ক) অমরকোষে বলা
আছে
"নমস্
নতৌ"---
কারো
কাছে
নত
হওয়া।
(খ) য়াস্কাচার্য তার
নিঘণ্টুতে ৩\৫-এ "নমস্যতি"-র অর্থ
"পরিচরতি" লিখেছেন ।
অর্থাত্ সেবা,
সত্কার
করা
অর্থে
"নমঃ"
পদটি
ব্যবহার হয়
।
(গ) সিদ্ধান্ত কৌমুদিতে "নম্" ধাতু প্রহত্ব অর্থাত্ সত্কার
অর্থে
ব্যবহার হয়
।
নমস্তে
শব্দটির শাস্ত্রীয় প্রয়োগঃ-----
রামায়ণে নমস্কার। সৰ্ব্বাথা চ মহাপ্রাজ্ঞ পূজার্হেণ সুপূজিতঃ |
নমস্তেঽস্তু গমিষ্যামি মৈত্ৰেণেক্ষস্ব চক্ষুসা ||
(বাল্মীকি রামায়ণ বালকাণ্ড ৫২/১৭)
###বিশ্বামিত্র
বশিষ্ঠকে বললেন, "হে মহাপ্রাজ্ঞ, আশ্রমের অন্যান্য বস্তু দ্বারা
সর্বপ্রকারে আপনি আমার পূজা করেছেন। এক্ষণ আমি যাই, আপনাকে নমস্কার। আপনি
আমার সকরুণ নয়নে আমাকে অবলোকন করুন।
##বাল্মীকি রামায়ণের অরণ্য
কান্ডে
(৫৫\২৮) মাতা সীতা
জঙ্গলের বিরাধ
নামক
রাক্ষসকে নমস্তে
করেছেন
।-----
মহাভারতে নমস্কার।
মহাভারতের শকুনি
বড়
হওয়া
সত্বেও
রাজা
যুধিষ্ঠিরকে নমস্তে
করেছেন----
# জ্যেষ্ঠো রাজন
বরিষ্ঠোসি নমস্তে
ভরতর্ষভ।যুদ্ধের পরে
মহর্ষি
শাকল্য
ধৃতরাষ্ট্রকে নমস্তে
বলেছেন
। যদিও মহর্ষির স্থান
রাজার
চেয়ে
অনেক
উঁচু
হয়
। ধৃতরাষ্ট্র একজন
ক্ষত্রিয় ছিলেন
। মহর্ষি তাঁকেও
নমস্তে
করেছিলেন ।
আদিপর্ব, ৮১ অধ্যায়ের ৩০ তম শ্লোকে দেবযানী শুক্রাচার্যকে নমস্কার করছেন।
"নমস্তে দেহি মানস্মৈ লোকে নানাং পতিং বৃণে।"
সভাপর্ব, ৬৫ অধ্যায়ের ১৯তম শ্লোকে শকুনি যুধিষ্ঠিরকে নমস্কার জানাচ্ছেন।
"জোষ্ঠো রাজন্ বরিষ্ঠো অসি নমস্তে ভরতর্ষভ।"
বনপর্ব, ৭৩ অধ্যায়ের ২৮ শ্লোকে [BORI সংস্করণ] নল তাঁর দাসীকে নমস্কার জানাচ্ছেন।
"বয়ং চ দেশাতিথয়ো গচ্ছ ভদ্রে নমোহস্তু তে।।"
বিরাট পর্ব, ২৫ অধ্যায়ের ১৭ শ্লোকে দূত দুর্যোধনকে নমস্কার করছে।
"সর্বথা বিপ্ৰনষ্টাস্তে নমস্তে ভারতর্ষভ।।"
উদ্যোগ পর্ব, ৩২ অধ্যায়ের ৫ম শ্লোকে দ্বারপাল মহারাজ ধৃতরাষ্ট্রকে নমস্কার করছে।
"সঞ্জয়ো অয়ং ভূমিপতে নমস্তে।"
ভীষ্মপর্ব, ৪র্থ অধ্যায়ে ১ম শ্লোকে সঞ্জয় ধৃতরাষ্ট্রকে নমস্কারের মাধ্যমে সম্ভাষণ জানাচ্ছেন।
"শাস্ত্রচক্ষুরবেক্ষস্ব নমস্তে ভারতর্ষভ।।"
ভীষ্মপর্ব, ৪৩ অধ্যায়ের ৪৭ শ্লোকে যুধিষ্ঠির পিতামহ ভীষ্মকে নমস্কার করে প্রশ্ন করছেন।
"হন্ত পৃচ্ছামি তস্মাৎ ত্বাং পিতামহ নমোঽস্তু তে।।"
ভীষ্মপর্ব, ৪৩ অধ্যায়ের ৬৩ শ্লোকে যুধিষ্ঠির দ্রোণাচার্যকে প্রথমে নমস্কার বলে তারপর চরণস্পর্শ করে প্রণাম করছেন।
"আচার্য প্ৰণিপত্যৈষ পৃচ্ছামি ত্বাং নমোঽস্তু তে।।"
শল্যপর্ব, ৬৩ অধ্যায়ের ৫৪ শ্লোকে স্বয়ং শ্রীকৃষ্ণও ধৃতরাষ্ট্রকে নমস্কার জানাতে দেখা যায়।
"শিবেন পাগুবান্ পাহি নমস্তে ভারতর্ষভ।।"
আশ্রমবাসিক পর্ব, ১০ম অধ্যায়ের ৫০তম শ্লোকে একজন ব্রাহ্মণ যুধিষ্ঠিরকে নমস্কার করেছেন।
"কুরু কার্যাণি ধর্ম্যাণি নমস্তে পুরুষষর্ভ।।"
গীতায় নমস্তে/নমস্কার
গীতায়, ১১|৩১ শ্লোকে অর্জুনও শ্রীকৃষ্ণকে বার বার নমস্কার করে বলছেন-"নমো নমস্তেঽস্তু সহস্রকৃত্বঃ পুনশ্চ ভূয়োহপি নমো নমস্তে।।"
উপনিষদে নমস্তে বা নমস্কারের প্রমাণ।
সনাতন ধর্মে আদিকাল হতেই নমস্কার করার প্রমাণ আছে। তিস্রো রাত্রীর্যদবাৎসী গৃর্হে মেঽনশ্নন্ ব্ৰহ্মন্নতিথির্নমস্যঃ |
নমস্তেঽস্তু ব্ৰহ্মন্ স্বস্তি মেঽস্তু তস্মাৎ প্রতি ত্ৰীন্ বরান্ বৃণীত্ব ||
(কঠোপনিষদ- ১|১|৯)
যম
নচিকেতাকে বললেন, "হে ব্রাহ্মণ, নমস্কারযোগ্য অভিথি, তোমাকে নমস্কার করি।
হে ব্রাহ্মণ, আমার কল্যাণ হোক। যেহেতু তুমি আমার গৃহে তিন রাত্রি অনাহারে
যাপন করেছ, তাই প্রতি রাত্রির জন্য একটি করে মোট তিনটি বর প্রার্থনা করো।"
সা
হোবাচ ব্রাহ্মণ্য ভগবস্তুস্তদের বহু মন্যে ধ্বং যদস্মান্নমস্কারেণ
মুচ্যেধ্বং ন বৈ জাতু যুষ্মকমিমং কশ্চিদ্ ব্রহ্মোদ্যং জেতেতি ততো হ
বাচক্মব্যুপররাম।।
(বৃহদারণ্যক উপনিষদ ৩/৮/১২)
গার্গী
বললেন, "শ্রদ্ধেয় ব্রাহ্মণগণ, যদি যাজ্ঞবল্ক্যকে নমস্কার করে এনার কাছ
থেকে নিষ্কৃতি পান তবে যথেষ্ট মনে করবেন। ব্রহ্মবিচারে আপনারা কেউই এনাকে
পরাস্ত করতে পারবেন না।" তারপর বাচক্মবী গার্গী বিরত হলেন।
জনকস্য বৈদেহস্য হোতাশ্বলো বভূব স হৈনং পপ্ৰচ্ছদ ত্বং নু খলু নো যাজ্ঞবল্ক্য ব্রহ্মিষ্ঠোসী৩ ইতি।
স হোবাচ নমো বয়ং ব্রহ্মিষ্ঠায় কুর্মো গোকামা এব বয়ং স্ম ইতি।
(বৃহদারণ্যক উপনিষদ ৩/১/২)
বৈদেহ
জনকের অশ্বল নামক একজন হোতা ছিলেন। তিনি বললেন, "যাজ্ঞবল্ক্য, তুমিই কি
আমাদের মধ্যে ব্রহ্মিষ্ঠ ?" যাজ্ঞবল্ক্য বললেন, "ব্রহ্মিষ্ঠকে নমস্কার।
আমরা গো লাভ করতে ইচ্ছা করি।"
জনকো হ বৈদেহঃ কূাদপাবসপর্ন্নুবাচ নমস্তেঽস্তু যাজ্ঞবল্ক্যানু মা শাখীতি.....
(বৃহদারণ্যক উপনিষদ ৪/২/১)
বৈদেহ জনক সিংহাসন থেকে উঠে বললেন, "যাজ্ঞবল্ক্য, আপনাকে নমস্কার। আপনি আমাকে উপদেশ দিন।"
সনাতন ধর্মে অন্যের সাথে সাক্ষাৎ হলে নমস্কার [নমস্তে] করার কথা বলা হয়েছে। হরে কৃষ্ণ, রাঁধে রাঁধে, জয় নিতাই ও জয় গুরু ইত্যাদি অযোগ্য।
বেদে বর্ণিত নমস্তে/নমস্কার
# দিব্য দেব
নমস্তে
অস্তু
।। --- (অথর্ব বেদ
২\২\১)
# বিশ্বকর্মনঃ নমস্তে
পাহ্যস্মান্ ।।
---( অথর্ব
২\৩৫\৪)
# তস্মৈ জ্যেষ্ঠায় ব্রহ্মনে নমঃ।।
---(অথর্ব
১০\৭\৩২)
# নমস্তে ভগবন্নস্তু।। --- ( য়জুর্বেদ ৩৬\২১)
স্ত্রীর উদ্দেশ্যে-----
# নমস্তে জায়মানায়ৈ জাতায়া
উত
তে
নমঃ।
---( অথর্ব
১০\১০\১)
# নমস্তেক্ষভ্যো রথকারেভ্যশ্চ বা
নমো
নমো
কুলালেভ্য কুমরিভ্যশ্চ বো
নমো
নমো
নিষাদেভ্যঃ পুঞ্জি
জ্যেষ্ঠভ্যশ্চ বা
নমো
নমঃ
শ্বনিভ্যো মৃগয়ুভ্যশ্চ বো
নমঃ।।
--- (যজুর্বেদ ১৬\২৭)
এখানে
তক্ষক,
রাজমিস্ত্রি, রথকার,
কুলাল,
কুমোর,
নিষাদ
অর্থাত্ চাণ্ডাল, কুকুরের শিক্ষক
আদি
সবার
উদ্দেশ্যে "নমস্তে" অর্থাত্ অন্নাদি ভোগ্য
বস্তুর
বিধান
করা
উচিত।
#নমস্তে হরসে
শোচিষে
নমস্তেস্ত্বর্চিষে। -- (যজুর্বেদ ১৭\১১)
নমস্তে
য়াতুধানেভ্যো নমস্তে
ভেষজেভ্যঃ মৃত্যো
মূলেভ্যো ব্রাহ্মণেভ্য ইদ
নমঃ।
---- (অথর্ব
৬\১৪\৩)
নমো জ্যেষ্ঠায় চ কনিষ্ঠায় চ নমঃ পূর্বজায় চাপরজায় চ
নমো মধ্যমায় চাপগভ্লয় চ নমো জঘন্যায় চ বুধ্ন্যায় চ ||
(যজুর্বেদ- ১৬|৩২)
অর্থাৎ নমস্কার জ্যেষ্ঠদেরকে, নমস্কার কনিষ্ঠদেরকে, নমস্কার পূর্বজ ও অনুজদের। নমস্কার উচ্চবিত্ত, মধ্যবিত্ত, ধনী-গরীব, জ্ঞানী, স্বল্পজ্ঞানী সকলকে। সকলকে নমস্কারের কথা বলা হয়েছে।
নমো মহাদে্ভ্যো নমো অর্থকে্ভ্যো নমো যুবভ্যো নম আশিনেভ্যঃ |
যজাম দেবান্যদি শক্নবাম মা জ্যাযসঃ শংসমা বৃষ্টি দেবাঃ ||
(ঋগ্বেদ- ১|২৭|১৩)
জ্ঞানীগণ, সাধকগণ ও ঋষিগণ আমরা সকল পণ্ডিতদের নমস্কার জানাই ও শ্রদ্ধা প্রদর্শন করি, নতুন যুবকদের স্নেহ ও সাহায্য প্রদান করি, যুবক বিদ্যার্থীদের স্তুতিমূলক বাক্য ও সাহায্য প্রদান করি, জ্ঞান ও পাণ্ডিত্যে প্রবীণদের শ্রদ্ধা করি। আমরা সকল প্রকার মানবকে ও স্বর্গীয় সত্তাকে শ্রদ্ধা জানাই ও নমস্কার করি, যতটা জানানো আমাদের দ্বারা সর্বোচ্চ সম্ভব। কখনোই কারও এই সম্মান ও শ্রদ্ধাবোধ নষ্ট করা উচিত নয়৷
# নমো নমস্তেস্তু সহস্রকৃত্বঃ; পুনশ্চ
ভূয়োপি
নমো
নমস্তে
। নমঃ পুরস্তাদথ পৃষ্ঠতস্তে নমোস্তু তে
সর্বত
এব
সর্ব।।
এইভাবে
নমস্তে
শব্দটির ব্যবহার বেদ,
ব্রাহ্মণ গ্রন্থ,
উপনিষদ,
রামায়ণ-মহাভারতের অনেক
জায়গায় রয়েছে। এ
থেকে
আমাদের
বোঝা
উচিৎ
যে
আমাদের
অভিবাদনের পরম্পরা নমস্তে
দিয়ে
হতো।
আমাদের
পূর্বপুরুষ নমস্তে
শব্দটির প্রয়োগ অনেক
আগে
থেকেই
করে
এসেছেন। সুতরাং
আমাদের
উচিত
হায়
হ্যালো
না
করে
তার
জায়গায় নমস্তে
শব্দটির প্রয়োগ করা।
||নমস্তে||
||ও৩ম্ শান্তিঃ শান্তিঃশান্তিঃ||