"মাতা সীতার উৎপত্তি" |
অথবা এটা হতে পারে যে- কেহ কোনো কারণ বশতঃ এই কন্যাকে ক্ষেতে ফেলে গেছেন এবং সংযোগ বশতঃ রাজা জনক তাকে খুঁজে পান অথবা কেহ ক্ষেতে দাবিদারহীন কন্যাকে পেয়েছেন বলে রাজা জনকের কাছে হস্তান্তরিত করেছেন এবং তিনি তাকে লালন পালন করেন। মহর্ষি কণ্ব এই ভাবেই শকুন্তলাকে পেয়েছিলেন। এবং প্রাপ্তির সময় পক্ষী দ্বারা সংরক্ষিত এবং পালিত (না কি প্রসুত) হওয়ায় তার নাম শকুন্তলা রাখা হয়েছিলো।
ভূমি উদ্ভেদ করে উউত্থিত হয় তাহাদিগের জন্য 'উদ্ভিজ্জ' সংজ্ঞা । তৃণ,ওষধি, তরু, লতা আদিকে উদ্ভিজ্জ বলা হয়। মনুষ্য,পশ্বাদি জরায়ুজ, অণ্ডজ এবং স্বেদন প্রাণীর অন্তর্গত। মনুষ্য বর্গ হওয়ার কারণে মাতা সীতার উৎপত্তি ভূমি হইতে হওয়া প্রকৃতি বিরুদ্ধ হওয়ায় অসম্ভব।
মাতা সীতার উৎপত্তি ভূমি হইতে কিভাবে মানা যায়, যখন বাল্মীকি রামায়ণের অনেক স্থানে তাঁকে রাজা জনকের আত্মজা ও ঔরস কন্যা তথা উর্মিলার সহোদরা বলা হয়েছে-
মহাভারতে লেখা আছে -
বিদেহরাজো জনকঃ সীতা তস্যাত্মজা বিভো (৩/২৭৪/৯)।
অমরকোশ (২/৬/২৭) এ 'আত্মজ' শব্দের অর্থ এই প্রকার লেখা হয়েছে আত্মনো দেহাজ্জাতঃ আত্মজঃ অর্থাৎ যে নিজের শরীর থেকে জন্ম নিয়েছে,তাকে আত্মজ বলা হয়। আত্মা ক্ষেত্র (স্ত্রী) পর্যায়বাচী; ক্ষেত্র এবং শরীর পর্যায়বাচী। ক্ষীয়তে অনেন ক্ষেত্রম্। স্ত্রীকে ক্ষেত্র এই জন্য বলা হয়েছে যে স্ত্রী সন্তানকে কে জনন করায় ক্ষীণ হয়ে যায়। পুরুষ বীজরূপ হওয়ার কারণে ক্ষীণ হয় না। রঘুবংশ সর্গ ৫, শ্লোক ৩৬ এ লেখা রয়েছে-
মহামনা পণ্ডিত মদনমোহন মালবীয় এর প্রেরণায় সংবত্ ২০০০ এ বিক্রমদ্বিসহস্রাব্দীর অবসরে সংস্থাপিত অখিল ভারতীয় বিক্রম পরিষদ্ দ্বারা নিয়ুক্ত কালিদাস গ্রন্থাবলীর সম্পাদক মণ্ডল এর প্রমুখ সাহিত্যাচার্য পণ্ডিত সীতারাম চতুর্বেদী উক্ত শ্লোকে আসা 'আত্মজন্মানম্' এর অর্থ রঘু এর রানীর গর্ভজাত অর্থাৎ গর্ভ হইতে উৎপন্না করেছেন। তখন জনক এর 'আত্মজা' শব্দের অর্থ ভূমি হইতে উৎপন্ন কিভাবে হতে পরে? ব্রহ্ম মুহূর্তে জন্ম নেওয়ার কারণে রঘু তাঁর পুত্রের নাম অজ (অজ ব্রহ্মের পর্যায়বাচী,কারণ ব্রহ্মারও জন্ম হয় না) রাখেন। কোনো মূর্খই বলতে পারে যে অজ এর নাম এই জন্যই রাখা হয়েছিলো,কারণ সে জন্ম গ্রহণ করে নি। আত্মজ বা আত্মজা তাকেই বলা হয় যে স্ত্রী-পুরুষের রজ-বীর্য দ্বারা স্ত্রীর গর্ভ থেকে উৎপন্ন হয়, এর মধ্যে সামবেদ ব্রাহ্মণ প্রমাণ-
হে পুত্র! তুমি অঙ্গ-অঙ্গ থেকে উৎপন্ন হয়েছো, আমার বীর্য থেকে এবং হৃদয় থেকে উৎপন্ন হয়েছো, এই জন্যই তুমি আমার আত্মা। ক্ষেত থেকে উৎপন্ন হলে তো তৃণ, ঔষধি, বনস্পতি, বৃক্ষ, লতা আদি সমস্ত আত্মজ এবং আত্মজা হয়ে যাবে এবং বাবা-দাদার সম্পত্তিতে অংশীদার হয়ে যাবে।
'জনী প্রাদুর্ভাবে' হইতে জননী শব্দ নিষ্পন্ন হয়। এতে জন্ম দানকারীকেই জননী বলা হয়। পালন-পোষণ কারী যশোদা মাতাকে 'যশোদা মাতা' বলা হতো, পরন্তু জন্ম দেওয়ার কারণে দেবকীকেই জননী বলা হতো। বনবাস কালে অত্রি মুনির আশ্রমে অনসূয়ার সাথে হওয়া কথোকথনে মাতা সীতা বলেছিলেন-
বিবাহের সময় আমার জননী অগ্নির সামনে আমাকে যে উপদেশ দিয়েছিলেন, তার মধ্যে কিঞ্চিৎ ভুলিনি। সেই উপদেশগুলোকে আমি হৃদয়ঙ্গম করেছি।
এখানে কি বিবাহের সময় উপদেশ প্রদানকারী 'জননী' ভূমি হতে পারে? আর কন্যাকে বিদায় করার সময় ভূমি কি ঘেঙ্গিয়ে-ঘেঙ্গিয়ে কান্না করতে পরে? এখানে মাতাকেই জননী বলে স্মরণ করা হয়েছে, ক্ষেতকে, ভূমিকে জননী কখনো বলা হয় নি। তুলসীদাস জী তো মাতা=জননীর নাম এই চৌপাঈতে= লিখেছেন–
হিমগিরি সঙ্গ বনী জিমি মৈনা ॥
রামচরিতমানস বালকাণ্ড ৩৫৬/২
(বিবাহ বেদীতে) সুনয়না (মহারানী) মহারাজা জনকের বাম পাশে এমনই শোভায়মান ছিল, যেনো হিমাচল এর সাথে ময়না (পার্বতীর মাতা) বিরাজমান। জলগ্রহন সংস্কারের সময় যে প্রকার রামচন্দ্র জীর পূর্বপুরুষ দের বর্ণনা করা হয়েছে সেই প্রকার মাতা সীতারও ২২ পূর্বপুরুষ এর বর্ণনা করা হয়েছে। যদি সীতার উৎপত্তি পৃথিবী থেকে হতো তাহলে পৃথিবীর আগে তার পূর্বপুরুষ কি ভাবে তৈরি হতো? একে শাখোচ্চার বলা হয়। রাজস্থানে বিবাহের সময় দুই পক্ষের পুরোহিত আজও শুধু ২২ নয়,৩০-৪০ পূর্বপুরুষের নাম পর্যন্ত উল্লেখ করে। সাধারণত ১০০ বছরে ৪ পূর্বপুরুষ পর্যন্ত বুঝতে পারেন। এই প্রকার ৪০ পূর্বপুরুষ পর্যন্ত প্রায় এক হাজার বৎসর হয়। অর্থাৎ সর্বসাধারণ মানুষও মুখে মুখে শত বৎসরের পারিবারিক জ্ঞান রাখতে পারে। যার ২২ পূর্বপুরুষের ক্রমিক ইতিহাস জ্ঞাত সে পোকা-মাকর বা গাছ-পালার মতো পৃথিবী থেকে উৎপন্ন হয়েছে এটা মানা যায় না। বস্তুত মাতা সীতার পৃথিবী/ভূমি হইতে উৎপন্ন হওয়ার গল্পের স্রোত বিষ্ণু পুরাণ, অংশ ৪,অধ্যায়৪,বাক্য ২৭-২৮ যাকে বাল্মীকি রামায়ণে প্রক্ষেপ করে দেওয়া হয়েছে। জন্ম ভূমি হইতে মেনে নিয়ে মাতা সীতার অন্তও পৃথিবীতে/ভূমিতে বিলীন হওয়ার কল্পনা করেই করা হয়েছে।
রামায়ণ অনুসারে রাজা জনক তাঁর পিতা এবং রামচরিতমানস অনুসারে সুনয়না তার মাতার নাম ছিলো। অতঃ ভূমি হইতে মাতা সীতার জন্ম কাহিনী অপ্রামাণিক ও অগ্রহণীয়।
অনুবাদক : অমৃতস্য পুত্রাঃ