|
হনুমানজীর পাহাড় উঠিয়ে নিয়ে আসার সত্যতা! |
রণভূমিতে রাবণ দ্বারা নিক্ষেপ করা শক্তিতে আহত হয়ে লক্ষ্মণের মরণাসন্ন হয়ে যাওয়া এবং হনুমান দ্বারা নিয়ে আসা সঞ্জীবনী নামক ওষধি দ্বারা সুস্থ হয়ে যাওয়া সর্ববিদিত।পরন্তু এর পূর্বে হওয়া এই প্রকারের দুর্ঘটনার জ্ঞান প্রায়ঃ লোকের নেই। এক দিন ইন্দ্রজিৎ (মেঘনাদ) ব্রহ্মাস্ত্র এর আশ্রয় নিয়ে সম্পূর্ণ বানর সেনা কে অজ্ঞান করে দেয়। অজ্ঞান হওয়া ব্যক্তিদের মধ্যে রাম এবং লক্ষণও ছিলেন। জাম্ববান্ কিছুটা চেতন অবস্থায় ছিলো। বিভীষণ এবং হনুমান তার কাছে পৌঁছায় এবং তাকে এই স্থিতি অবগত করায়। তখন জাম্ববান্ হনুমান্ কে বলেন যে তুমি বানোর সেনাকে বাঁচাতে পারো,কারণ তুমি সমুদ্রের ঊপর সুদীর্ঘ মার্গ পার করে হিমালয় পর্যন্ত পৌঁছতে পারো। সেখানে তুমি ঋষভ নামক উত্তম পর্বত এবং কৈলাশ শিখর দেখবে-
তয়োঃ শিখরয়োর্মধ্যে প্রদীপ্তমতুলপ্রভম্ ।
সর্বৌষধিয়ুতং বীর দ্রক্ষ্যস্যৌষধিপর্বতম্ ॥৩১॥
তস্য বানরশার্দূল চতস্রো মূর্ধ্নি সম্ভবাঃ ।
দ্রক্ষ্যস্যোষধয়ো দীপ্তা দীপয়ন্ত্যো দিশো দশ॥৩২।।
মৃতসঞ্জীবনীঞ্চৈব বিশল্যকরণীমপি ।
সাবর্ণ্যকরণীঞ্চৈব সন্ধানকরণী তথা ।।৩৩।।
তাঃ সর্বা হনুমন্ গৃহ্য ক্ষিপ্রমাগন্তুমর্হসি ।
আশ্বাসয় হরীন্ প্রাণৈর্যোজ্য গন্ধবহাত্মজ ।।৩৪।।
হে বীর! সেই দুই শেখরের মধ্য দেদীপ্যমান, অনুপম, সর্বোপধিয় যুক্ত ওষধি শিলাখণ্ড দেখবে। সেই ওষধি শিলাখন্ডের চূড়ায় উৎপন্ন হইয়া চার জাজ্বল্যমান ওষধি দেখবে। মৃতসঞ্জীবনী, বিশল্যকরণী, সাবর্ণ্যকরণী এবং সন্ধানকরণী এই চার ওষধিকে তুমি দেখবে। হে হনুমান,এই ওষধিগুলো শীঘ্রই নিয়ে আসতে তুমি সক্ষম। সেই ওষধি দিয়ে তুমি সকলকে প্রাণের সাথে যুক্ত করে দাও। জাম্ববানের বচনে প্রোৎসাহিত হয়ে হনুমান হিমালয় গিয়ে পৌছায়–
স তং সমীক্ষ্যানল রশ্মিদীপ্তং বিসিষ্মিয়ে বাসবদূতসূনুঃ ।
আবৃত্য তং চোষধিপর্বতেন্দ্রং তত্রোষধীনাং বিচয়ং চকার ॥৬২।।
ততো মহাত্মা নিপপাত তস্মিন্ শৈলোত্তমে বানরসৈন্যমধ্যে । হর্যুতমেভ্যঃ শিরসাভিবাদ্য বিভীষণং তত্র চ সস্বজে চ ॥৭২।।
তাবপ্যুভৌ মানুষরাজপুত্রৌ তং গন্ধমাঘ্রায় মহৌষধীনাম্ ।
বভূবতুস্তত্র তদা বিশল্যাবুত্তস্থুরন্যে চ হরিপ্রবীরাঃ ॥৭৩॥
যুদ্ধ০ সর্গ-৭৪
হনুমান সেই পর্বত কে দেখে বিস্মিত হয়ে যায় এবং শীঘ্রই ওষধি নির্বাচন করতে শুরু করেন। এর পশ্চাৎ সে ওই উত্তম পর্বতে বানরদে মধ্যে প্রবেশ করে এবং বরিষ্ঠ বানরদের অভিবাদন করে বিভীষণ এর সাথে সাক্ষাৎ করে। মহৌষধির গন্ধ দ্বারা রাম-লক্ষ্মণ এবং অন্যান্য সকলে পীড়ামুক্ত হয়।
কিছু সময় পর একবার আবার একই ঘটনা ঘটে। এইবার রাবণ লক্ষণকে লক্ষ্য করে শক্তি প্রয়োগ করে। এই শক্তি এতটা ভয়নক ছিলো যে লক্ষ্মণের শরীর ভেদ করে ভূতলে প্রবেশ করে। লক্ষণকে সাপের মতো ছটপটাতে দেখে শ্রী রাম ধৈর্য হারিয়ে বললেন- " যখন আমি আমার ভাই লক্ষ্মণকে মৃত অবস্থায় দেখছি, তো এখন না আমার যুদ্ধের প্রয়োজন, না রাজ্যের, না সীতার প্রতি এবং না নিজের জীবন প্রতি। তখন রামকে ধৈর্য দান করে সুষেণ বললেন–
ন মৃতোঽয়ং মহাবাহো লক্ষ্মণো লক্ষ্মিবর্ধনঃ ।
ন চাস্য বিকৃতং বক্ত্রং নাপি শ্যামং ন নিষ্প্রভম্ ॥১৫॥
এবং ন বিদ্যতে রূপং গতাসূনাং বিশাং পতে ।
দীর্ঘায়ুষস্তু যে মর্ত্যাস্তেষাং তু মুখমীদৃশম্ ॥১৭॥
সর্গ-১০২
হে মহাবাহো! লক্ষণ মারা যায় নি। তার মুখ না বিকৃত হয়েছে,না কালো হয়েছে আর না প্রভাহীন হয়েছে। প্রাণরহিত মনুষ্যের রূপ এমন হয় না। যে মনুষ্য দীর্ঘজীবী হয় তার রূপ এমন হয়। তখন সুষেণ পাশে দাড়িয়ে থাকা হনুমান কে বলেন–
সৌম্য শীঘ্রমিতো গত্বা শৈলমোষধিপর্বতম্ ।
পূর্বং তে কথিতো যোঽসৌ বীর জাম্ববতা শুভঃ ॥২১॥
দক্ষিণে শিখরে তস্য জাতমোষধিমানয় ।
বিশল্যকরণীং নাম্না সাবর্ণ্যকরণীং তথা ॥২২॥
সঞ্জীবনীমপি বীর সন্ধানীং চ মহৌষধম্ ।
সঞ্জীবনার্থং বীরস্য লক্ষ্মণস্য ত্বমানয় ॥২৩॥
ইত্যেবমুক্তো হনুমান্ গত্বা চোষধিপর্বতম্ ।
চিন্তামভ্যগমচ্ছ্রীমানজানংস্তাং মহৌষধীম্ ॥২৪॥
তস্য বুদ্ধিঃ সমুৎপন্না মারুতেরমিতৌজসঃ ।
ইদমেব গমিষ্যামি গৃহীত্বা শিখরং গিরেঃ ॥ ২৫॥
সর্গ-১০২
হে সোম্য বীর ! এখান থেকে শীঘ্রই ওষধিপর্বতে যাও যার বিষয়ে তোমাকে প্রথমে জাম্ববান্ বলেছিলো। তার দক্ষিণ শিখরে উৎপন্ন ওষধি নিয়ে আসো। সেখানে উৎপন্ন বিশল্যকরণী, সাবর্ণ্যকরণী, সঞ্জীবনী তথা সন্ধানী নামক প্রসিদ্ধ মহৌষধিয় কে এখানে নিয়ে আসো। তা দ্বারাই লক্ষ্মণের জীবন রক্ষা পাবে।
[বিশল্যকরণী= শরীরে প্রবেশ করা বাণ আদি কে বের করে ক্ষতস্থান কে ভরন এবং পীড়া দূর কারী, সাবর্ণ্যকরণী= শরীরের ত্বকের পূর্বের মতো রঙ ফিরিয়ে নিয়ে আসে, সঞ্জীবনী = মূর্চ্ছা দূর করে চেতনা প্রদান কারী এবং সন্ধানী= ভাঙা হাড় জোড়া লাগাতে কার্য্যকারী। ]
তাঁর এমন কথা শুনে হনুমান জী ঔষধি পর্বতে গিয়ে পৌঁছায়। কিন্তু সেই ঔষধি কে চিনতে না পারার কারণে চিন্তায় পড়ে যায়। তখন চিন্তা করেন যে এই পর্বত শিখর কে নিয়েই চলে যাই। এবং তখন তিনি সেই পর্বত শিখর কে তুলে নিয়ে আসে।
»পর্বতকে উঠিয়ে নিয়ে আসা সম্ভব নয়। কাব্যশাস্ত্রের সিদ্ধান্ত- 'মুখ্যার্থবাধে লক্ষণ'- যেখানে মুখ্য অর্থাৎ প্রসিদ্ধ অর্থ সম্ভব হয় না সেখানে লক্ষণা ব্যবহৃত হয়। স্বামী এক সাথে অনেক গুলো সবজি নিয়ে আসায় স্ত্রীর এমন কথন যে আজকে আপনি সমস্ত সবজি মণ্ডী ইত্যাদি উঠিয়ে নিয়ে এসেছেন, অক্ষরশঃ কে বিশ্বাস করতে পারে? যখন প্রথম বার হনুমান ঔষধিপর্বতে একই ঔষধি কে নিতে যায় তো সেখানে লেখা- 'তত্রোষধীনাং নিচয়ং চকার' সেখানে হনুমান ঔষধি নির্বাচন করেন। এমনটা প্রতিত হয় যে হনুমানের যখন সন্তোষ না হয় তখন তিনি আসে-পাশের একই অনুরূপ ঔষধির সংরক্ষণ করে বড় আকারের গাঁট বেধে নিয়েছেন হয়তো। সেখানে এটাও লেখা আছে যে লঙ্কা থেকে হিমালয় এর দূরত্ব এক হজার যোজন অর্থাৎ প্রায় পাঁচ হজার মাইল ছিলো। আপাতকাল ( Emergency) তে দশ হাজার মাইল এর দূরত্ব এবং তারপর ত্রিশ হাজার ফিট চওড়া বিমান দ্বারা সম্ভব ছিল। এবং আমি প্রথমে লিখেছি যেমন বর্তমানে শত শত যাত্রীকে বহন করার বড়-বড় বিমানের অতিরিক্ত হেলিকপ্টার এর মতো ছোট-ছোট বিমান রয়েছে, তেমন সেই সময়েও পুষ্পক বিমানের মতো বড় বিমানের অতিরিক্ত বড় বড় ব্যক্তিদের কাছে ছোট-ছোট বিমান ছিলো। এমনি ছোট বিমান দ্বারা হনুমান এই যাত্রা করেছে হয়তো এবং তার দ্বারা অনেক পরিমাণ ঔষধি গাছ নিয়ে এসেছে হয়তো। একেই প্রৌঢোক্তি অথবা অর্থবাদ এর রূপে পর্বত উঠিয়ে নিয়ে আসা বলেছে হয়তো। আরো একটি কথা- যখন এক বার হিমালয় থেকে ঔষধি পর্বত নিয়ে এসেছিলো তো যুদ্ধ চলাকালীন সময়ে হনুমান সেই পর্বতকে হিমালয়ে কেনো ফেরত রেখে আসলো?
লেখক : স্বামী বিদ্যানন্দ সরস্বতী
অনুবাদক : অমৃতস্য পুত্রাঃ