অথর্ববেদ-৪/৫/১ মন্ত্র নিয়ে মিথ্যাচারের জবাব |
নমস্কার সকলকে আজ আমরা বিধর্মী ভ্রাতাদের নতুন একটি মিথ্যাচারের খণ্ডনমূলক জবাব দিব। এবার তারা দাবি করেছে অথর্ববেদের ৪র্থ কাণ্ডের ৫ম সূক্তের ১ম মন্ত্রে নাকি বলা হয়েছে "গরুর হাজার শিং গজায় এবং তা সমুদ্র থেকে উদিত হয়"।। এ দাবির সপক্ষে তারা প্রমাণ দিয়েছেন গ্রীফিতের অথর্ববেদ ভাষ্য হতে। তাদের উদ্ধৃত মন্ত্রটি নিম্নরূপঃ-
The Bull who hath a thousand horns, who rises up from out of the sea. By him the strong and mighty one we lull the folk to rest and sleep.
প্রশ্নঃ মন্ত্রে থাকা ১.." বৃষভ" শব্দ দ্বারা কি Bull বা ষাড়কে বোঝানো হয়েছে?
২.."সমুদ্র" শব্দ দিয়ে কি Sea বা পৃথিবীস্থিত নোনাজলের সমুদ্রকে বোঝানো হয় কি না?
জবাবঃ পবিত্র বেদের বৈদিক ভাষা সম্পর্কে যারা অনভিজ্ঞ তারাই এরূপ দাবি করে থাকে। বেদের বৈদিক ভাষা লৌকিক সংস্কৃত থেকে ভিন্ন। বেদ মন্ত্রার্থ করার ক্ষেত্রে নিরুক্ত ও নিঘন্টু আদি আভিধানিক গ্রন্থ ব্যবহার করা হয়।
২. বৃষভ শব্দের অর্থ শুধুই ষাড় নয় বরং বৈদিক সংস্কৃতে বৃষভ শব্দের অর্থ বর্ষণকারীও হয়।
নিরুক্ত (৪/৮)- এ বলা হয়েছে " বৃষভ বর্ষিতাপাম"।।
এবারে দেখতে হবে অথর্বেদের ৪র্থ কাণ্ডের ৫ম সূক্তটি কি বিষয়ে আলোচনা করতেছে - মন্ত্র ৪ - এ "রাত্রীণামতিশর্বরে" দ্বারা শয়ন-সম্বন্ধী রাত্রিকালের কথন হয়েছে, অতএব এই সূক্তে রাত্রিকালের বর্ণন করা হয়েছে। এই সূক্তে রাত্রিকালে গৃহজনদের, স্ত্রীলোকের ও পশুপাখিদের নিদ্রাতে যাবার কথা বর্ণনা করা হয়েছে। আমরা জানি সূর্য যখন অস্তমিত হয় তখন রাত হয়। সূর্য যখন উদিত হয় তখন রাত্রিকালের শেষ হয়। সূর্যের অবস্থান অন্তরিক্ষে এবং সূর্য যখন উদয় হয় তখন তার সহস্র কিরণ ভূপৃষ্ঠের সর্বত্র ছড়িয়ে দেয়। এখন অথর্বেদের (৪/৫/১) মন্ত্রটির অনান্য ভাষ্যকার কি অর্থ করেছেন তা দেখব--
১.অথর্ববেদ (৪/৫/১)
তেনা সহস্যেনা বয়ং জনান্তস্বাপয়ামসি।।১।।
অনুবাদঃ (সহস্রশৃঙ্গঃ) সহস্র রশ্মিযুক্ত (বৃষভঃ) বর্ষণকারী (যঃ) যে সূর্য (সমুদ্রাৎ) অন্তরিক্ষ হতে (উদাচরৎ) উদিত হয়, (তেন) সেই (সহস্যেন) সূর্যের দ্বারা (বয়ম) আমরা (জনান) গৃহজনদেরকে (নিস্বাপয়ামসি) গৃহ মধ্যে সর্বত্র শুইয়ে দেই।।১।।
ভাষ্যকারঃ পন্ডিত বিশ্বনাথ বিদ্যালংকার
২.অথর্ববেদ (৪/৫/১) --
(সহস্রশংগঃ) সহস্র রশ্মিযুক্ত (বৃষভঃ) বৃষ্টিজলের বর্ষাকারী (যঃ) যে সূর্য (সমুদ্রাৎ) উদয়াচলের সমীপস্থ অন্তরিক্ষ প্রদেশ হতে (উদাচরৎ) উদিত হয় (তেন) সেই (সহস্যেন) শত্রুদের অভিভূতকারক শক্তিকে প্রাপ্ত করতে উত্তম সূর্যের সাথে (বয়ম) আমরা (জনান্) লোকজনদেরকে (নিস্বাপয়ামসি) শুইয়ে দেই।।১।।
ভাষ্যকারঃ পন্ডিত হরিশরণ সিদ্ধান্তালংকার
এখানে আমরা দেখতে পেলাম আর্য ভাষ্যকারগণ "সমুদ্র" শব্দের অর্থ অন্তরিক্ষ করেছে এবং "সহস্রশৃঙ্গঃ বৃষভঃ" শব্দের অর্থ করেছেন সহস্র কিরণযুক্ত বর্ষণকারী সূর্য।। এবার পৌরাণিক ভাষ্যকার সায়ণাচার্যের অথর্ববেদ ভাষ্যের অনুবাদ থেকে দেখব তারা এই মন্ত্রের কি অর্থ করেছেন।
অনুবাদঃ সহস্ররশ্মি কামবর্ষী যে আদিত্য অন্তরিক্ষ প্রদেশ থেকে উদয় লাভ করে, সে আদিত্যের শত্রুপরাভবকারী শক্তির দ্বারা আমরা জনদের নিদ্রাভিভূত করব।।১।।
(হরফ প্রকাশনী) |
অনুবাদঃ কামনাসমূহকে জলের ন্যায় বর্ষণশালী, সহস্ররশ্মিসম্পন্ন সূর্য আকাশে উদয় হয়ে থাকে৷ শত্রুকে বশ-করণশালী সেই সূর্যের দ্বারাই আমরা উপস্থিত ব্যক্তিবর্গকে নিদ্রাযুক্ত করে দিচ্ছি।।
(অক্ষয়পত্র প্রকাশনী) |
এখানেও আমরা দেখলাম পৌরাণিক ভাষ্যকারগণ সমুদ্র শব্দের অর্থ করেছেন অন্তরিক্ষ বা আকাশ এবং "সহস্রশৃঙ্গঃ বৃষভঃ" - অর্থ করেছেন সহস্রকিরণযুক্ত কামবর্ষী সূর্য।
সূর্যকে যে "বৃষভ" বলা হয় তার প্রমাণ -
১.জৈমিনীয় উপনিষদ ব্রাহ্মণ. ১।২৯।৮ ; ১।২৮।২ - "এষ (আদিত্যঃ ) হ্যেবাঽঽসাম্প্রজ্ঞানামৃষভঃ।। এবং ঋগ্বেদ (২/১২/১২)
"স এষ (আদিত্য) সপ্তরশ্মির্বৃষভস্তুবিষ্মান্"-
মন্ত্রে মহর্ষি দয়ানন্দ ভাষ্য ;ড. তুলশীরাম শর্মার ঋগ্বেদ অনুবাদ।।
যো রৌহিণমস্ফুরদ্বজ্রবাহুর্দ্যামারোহন্তং স জনাস ইন্দ্রঃ॥ (ঋগ্বেদ-২/১২/১২)
পদার্থ : হে (জনাসঃ) মনুষ্য! তোমাদেরকে (যঃ) যে (সপ্তরশ্মিঃ) সাত প্রকার কিরণযুক্ত (বৃষভঃ) মেঘের শক্তি প্রতিরুদ্ধকারী (তুবিষ্মান্) অত্যন্ত আকর্ষণশক্তিযুক্ত সূর্যলোক (সপ্ত, সিন্ধুন্) সপ্ত সিন্ধুকে (সর্ত্তবে) চলার জন্য অর্থাৎ বহমান হওয়ার জন্য (অবাসৃজৎ) উৎপন্ন করে অর্থাৎ জল আদি পদার্থ দ্বারা পরিপূর্ণ করে (যঃ) যে (বজ্রবাহুঃ) বজ্রবাহু তুল্য কিরণযুক্ত (দ্যাম্) প্রকাশকে (আরোহন্তম্) আরোহণ করার সময় (রোহিণম্) আরোহণকারী মেঘকে (অস্ফুরৎ) ফুরতী প্রদান করে অর্থাৎ সঞ্চালন করে (সঃ) সেই (ইন্দ্রঃ) সূর্যলোক সকলকে বলার যোগ্য।
ভাবার্থ : যার মধ্যে রক্তাদি বর্ণযুক্ত সাত প্রকার কিরণ বিদ্যমান, সেই সূর্যলোকই বর্ষা দ্বারা নদ-নদীকে উত্তমপ্রকারে পরিপূর্ণ করে এবং পুনঃ উপরের জল আকর্ষণ দ্বারা ধারণ করে পুনঃ বর্ষণ করে, এরূপই ঈশ্বরের আজ্ঞারূপ নিয়মে এই সংসার চক্র বর্ত্তমান রয়েছে।
তাহলে কি গ্রীফিত ভুল ভাষ্য করেছে অথর্বেদের এই মন্ত্রের অর্থে। আসলে আমরা যখন কোনো ভাষ্যকার বা অনুবাদকের মন্ত্রার্থ পড়ি তখন মন্ত্রের নিচে সে কি টিকা,টিপ্পনী করেছে, মন্ত্রের কি ভাবার্থ করেছে তা দেখা আবশ্যক। গ্রীফিত অথর্ববেদের ৪র্থ কাণ্ডের ৫ম সূক্তটির ভাষ্য করে তার ব্যাখাতে লিখেছেন -
অর্থাৎ গ্রীফিত সহস্রশৃঙ্গঃ যুক্ত বৃষ বলতে সহস্ররশ্মিযুক্ত সূর্যকেই বুঝিয়েছেন।। তাই অপপ্রচারকারীদের অন্তত অপপ্রচার, মিথ্যাচার করার পূর্বে ভাষ্যকার কি বলেছেন তা ভালোভাবে দেখে নেওয়া উচিত। কিন্তু কি আর করার দুর্জনের তো ছলের অভাব হয় না।।