রামায়ণ ও মহাভারতের আলোকে বিভিন্ন বৈদিক নারীর ইতিহাস |
নমস্কার সকলকে। আজ আমরা রামায়ণ ও মহাভারত হতে বিভিন্ন বৈদিক নারীর ইতিহাস জেনে নিব সংক্ষেপে। যারা বেদের জ্ঞাতা ছিলেন, বেদ অধ্যয়ন করতেন, বেদমন্ত্রের উপদেশ করতেন এমনকি রাজনৈতিক উপদেশ পর্যন্ত করতেন তৎকালীন রাজপরিষদে। এসমস্ত বৈদিক নারীরা প্রতিদিন নিয়মপূর্বক বেদপাঠ, সন্ধ্যোপাসনা এবং অগ্নিহোত্র আদি করতেন স্থির চিত্তে। সুতরাং যারা বলেন সনাতন ধর্ম নারীদের বেদপাঠ করার অধিকার দেয় না, যজ্ঞের অধিকার দেয়না তাদের প্রতি এসকল দৃষ্টান্ত রইল বিচারপূর্বক দেখবেন।। শুরু করছি যজুর্বেদের একটি মন্ত্র দিয়ে যেখানে ঈশ্বর বলছেন আমার এই কল্যাণময়ী বেদবাণী ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য,শূদ্র এবং সেবকাদি সকল মনুষ্যমাত্রের জন্য -
অনুবাদ: হে মনুষ্যগণ! আমি যেরূপে ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য, শূদ্রস্ত্রীলোক এবং অন্যান্য সমস্ত জনগনকে এইকল্যানদায়িনী পবিত্র বেদবানী বলিতেছি, তোমরাও সেই রূপ কর। যেমন বেদবানীর উপদেশ করিয়া আমি বিদ্বানদের প্রিয় হয়েছি, তোমরাও সেরুপ হও। আমার ইচ্ছা বেদ বিদ্যা প্রচার হোক। এর দ্বারা সকলে মোক্ষ এবং সুখ লাভ করুক।।
রামায়ণ কালে নারীদের বেদাধ্যয়ন, সন্ধ্যা, হবনাদি
বাল্মিকী রামায়ণের অধ্যয়ন হতে জ্ঞাত হয় যে সেসময় আর্য নারীগণ বেদের অধ্যয়ন তথা বৈদিক কর্মকান্ড, সন্ধ্যা হবন (অগ্নিহোত্র), যজ্ঞাদির অনুষ্ঠান করতেন।।
🔰 উদাহরণস্বরূপ মর্যাদা পুরুষোত্তম শ্রীরামচন্দ্রজীর মাতা কৌশল্যা দেবীর বিষয়ে বর্ণণা পাওয়া যায় যে যখন রামচন্দ্র তার কাছ থেকে বনে যাওয়ার জন্য অনুমতি নিতে গিয়েছিল তো মাতা কৌশল্যা প্রতিদিনের মতোই হবন(অগ্নিহোত্র) করতেছিল। সেখানে তার জন্য 'মন্ত্রবিৎ' অর্থাৎ বেদমন্ত্রের জ্ঞাতা এই বিশেষণেরও প্রয়োগ পরিলক্ষিত হয় নিম্নলিখিত শ্লোকে -
অগ্নিং জুহোতি স্ম তদা মন্ত্রবিৎকৃতমঙ্গলা।।
বাল্মিকী রামায়ণ (২/২০/১৫)
অনুবাদঃ বেদ মন্ত্রের জ্ঞাতা, ব্রত পরায়ণা, প্রসন্নচিত্তা, রেশমী বস্ত্র পরিধায়ী কৌশল্যা দেবী শুভকার্য মেনে অগ্নিহোত্র (হবন) করছিল।।১৫।।
🔰 বালির পত্নী তারা দেবী
তখন বেদমন্ত্রের জ্ঞাতা তারা দেবী পতির বিজয়ের অভিলাষ করে স্বস্তিবাচনের মন্ত্র পাঠ করে অন্তঃপুরে প্রবেশ করলেন।। ১২।। এখানেও তারা দেবীর ক্ষেত্রে "মন্ত্রবিৎ" অর্থাৎ বেদ মন্ত্রের জ্ঞাতা " এই বিশেষণ প্রযুক্ত হয়েছে।
🔰 সীতা দেবীর সন্ধ্যোপাসনা এবং হবন (অগ্নিহোত্র) করা-
শ্রীরামচন্দ্রের আদর্শ পতিব্রতা ধর্মপত্নী সীতা দেবী প্রতিদিন নিয়মপূর্বক সন্ধ্যোপাসনা ও হবন করতেন। যার বর্ণন রামায়ণের কয়েক স্থানে পাওয়া যায়। উদাহরণস্বরূপ--
লক্ষ্মণ যখন শুদ্ধ জল আনিল তখন প্রথমে শ্রীরামচন্দ্র তারপর সীতা দেবী এবং তৎপশ্চাৎ লক্ষ্মণ আচমনাদি করল তদন্তর তারা তিনজন শান্তচিত্তে সন্ধ্যোপাসনা করিল। (এখানে আমরা সীতা দেবীর প্রতিদিন নিয়মপূর্বক সন্ধ্যোপাসনার উল্লেখ পাই)
নদীং চেমাং শুভজলাং সন্ধ্যার্থে বরবর্ণিনী।।
রামায়ণ ৫/১৫/৪৮
সন্ধ্যাকালীন সময় সন্ধ্যা করার জন্য মাতা সীতা এই উত্তম জলবিশিষ্ট নদীর তটে অবশ্যই আসবে।।৪৮।।
সীতা দেবীর অশোক বটিকায় হবন করার কথাও রামায়ণে পাওয়া যায় - বৈদেহী শোকসন্তপ্তা হুতাশনমুপাগমৎ।।(সুন্দরকান্ড স্বর্গ ৫৩/২৫) - শোকে সন্তপ্ত সীতা তখন হবন(অগ্নিহোত্র) করিল।।
পুরোহিত চলে যাবার পর স্নানের পশ্চাৎ রামচন্দ্রজী চিত্তকে একাগ্র করে বিশাল বিশাল নেত্রধারী তার স্ত্রী সীতা দেবীর সাথে ঈশ্বরের ধ্যান করলেন তারপর বিধিপূর্বক হবন করলেন।
🔰 কৈকেয়ীর জন্য "মন্ত্রজ্ঞা" এই বিশেষণের প্রয়োগ হয়েছে।।
অর্থাৎ বেদ মন্ত্রের জ্ঞাতা কৈকেয়ী সুমন্ত্রকে নিম্ন উত্তর দিলেন।।
এভাবে রামায়ণ কালে নারীদের বেদাধ্যয়ন তথা সন্ধ্যোপাসনা, হবনাদি বৈদিক কর্মকান্ডের অনুষ্ঠানের অনেক স্পষ্ট প্রমাণ পরিলক্ষিত হয়।
মহাভারত কালে তথা তার থেকেও প্রাচীনকালে নারীদের বেদাধ্যয়ন এবং বৈদিক কর্মকান্ডে অংশগ্রহণ করার অনেক উদাহরণ পাওয়া যায়।
🕉️ সর্ববেদবিশারদা শিবা -
মহাভারত উদ্যোগ পর্ব অ০ ১০৯/১৮ - তে শিবা নামক এক ব্রাহ্মণীর বর্ণনা নিম্নোক্ত শব্দে উপলব্ধ হয় -
শিবা ব্রাহ্মণী বেদে পারঙ্গতা ছিলেন। সে সকল বেদ অধ্যয়ন করে সন্দেহ রহিত হয়ে মোক্ষ-পদ প্রাপ্ত করিল।
🕉️ সিদ্ধা ব্রহ্মচারিণী -
মহাভারত শল্য পর্ব ৫৪/৬ - শ্লোকে সিদ্ধা নামক ব্রাহ্মণীর বর্ণন নিম্ন শব্দে রয়েছে -
যোগসিদ্ধি প্রাপ্ত, কুমারীবস্থা থেকেই বেদাধ্যয়নকারীণি, তপস্বিনী সিদ্ধা নামের ব্রাহ্মণী ( বেদ বিদুষী ) তপের পূর্ণ অনুষ্ঠান করে মোক্ষ প্রাপ্ত হয়েছিল।
এখানে ব্রহ্মচারিণী এবং ব্রাহ্মণী উভয় শব্দ দ্বারা সিদ্ধার বেদজ্ঞান সূচিত হয়। 'তপ' -এর অর্থ "স্বাধ্যায়প্রবচনে এব তপঃ" এরূপ তৈত্তিরীয় উপনিষদে দেওয়া হয়েছে।
🕉️ শ্রীমতি ব্রহ্মচারিণী -
অনুবাদঃ মহাত্মা শান্ডিল্যের সুপুত্রী শ্রীমতি ছিল যিনি সত্য, অহিংসা ব্রহ্মচর্যাদি ব্রতসমূহকে পূর্ণত ধারণ করেছিল এবং যিনি বেদাধ্যয়নে দিন-রাত তৎপর ছিল। অত্যন্ত কঠিন তপস্যা করে এবং অতি উচ্চকোটির সত্যনিষ্ঠ ব্রাহ্মণদের দ্বারা পূজিত হয়ে তিনি মোক্ষধাম লাভ করেন।।
🕉️ শ্রুতাবতী ব্রহ্মচারিণী -
শল্যপর্ব অ০ ৪৮ এ ভরদ্বাজের বিদুষী পুত্রী শ্রুতাবতীর বর্ণন নিম্ন শব্দে উপলব্ধ হয় -
অর্থাৎ ভরদ্বাজের শ্রুতাবতী নামে কুমারী ছিল যে ব্রহ্মচারিণী অর্থাৎ ব্রহ্ম-বেদের উত্তমভাবে অধ্যয়নকারী ছিল।
🕉️ ব্রহ্মবাদিনী সুলভা
মহাভারতের শান্তিপর্ব অ০ ৩২০ - এ সুলভা নামের ব্রহ্মবাদিনী সন্ন্যাসীনীর বর্ণনা এবং তার সাথে মহারাজ জনকের শাস্ত্রার্থের বৃত্তান্ত পাওয়া যায় যিনি নিজের পরিচয় জনক মহারাজকে নিম্নোক্ত শব্দে দিয়েছেন -
আমি সুপ্রসিদ্ধা রাজর্ষি কুলোৎপন্না সুলভা। নিজের যোগ্য পতি না পাওয়ার ফলে আমি গুরুদের নিকট হতে বেদাদি শাস্ত্রের শিক্ষা প্রাপ্ত করে সন্ন্যাস আশ্রম গ্রহণ করেছি।
🕉️ পন্ডিতা দ্রৌপদী দেবী
দ্রৌপদী দেবী তার সময়ে অতি প্রসিদ্ধ পন্ডিতা ছিলেন। তার জন্য পন্ডিতা শব্দের প্রয়োগ মহাভারতের অনেক স্থানে এসেছে।
পন্ডিতের যে লক্ষণ বিদুরনীতি আদিতে বলা হয়েছে তার মধ্যে সর্বপ্রথম "আত্মজ্ঞান"। আত্মা ও ব্রহ্মবিষয়ক জ্ঞান " নাবেদবিন্মনুতে তং বৃহন্তম" ( তৈত্তিরীয় ব্রাহ্মণ )- অনুসারে বা স্বয়ং ঋগ্বেদের "য়স্তিত্যাজ সচিবিদং সখায়ং ন তস্য বাচ্যপি ভাগো অস্তি৷ যদীং শৃণোত্যলকং শৃণোতি নহি প্রবেদ সুকৃতস্য পন্থাম।।" (ঋ০ ১০/৭২/৮) এই শ্রুতি অনুসারে বেদ অধ্যয়ন ব্যতীত সুকৃত অথবা ধর্ম মার্গের জ্ঞান অসম্ভব এর জন্য ইহা স্পষ্ট যে দ্রৌপদী দেবী বেদাদি শাস্ত্রের অধ্যয়ন করেছিলেন।
🕉️ কুন্তী তার পুত্রবধূ দ্রৌপদী দেবীর জন্য
শ্রীকৃষ্ণের সামনে "সর্বধর্মবিশেষজ্ঞা" এই বিশেষণের প্রয়োগ করেছেন যা বেদ শাস্ত্রাধ্যয়ন করা ব্যতীত সর্বথা অসম্ভব।।
একারণে শ্রী আচার্য আনন্দ তীর্থজী (শ্রী মধ্বাচার্য) " মহাভারত তাৎপর্য নির্ণয়"- তে স্পষ্ট লিখেছেন যে - "বেদাশ্চাপ্যুত্তমস্ত্রীভিঃ কৃষ্ণাদ্যাভিরিহাখিলাঃ।।
অর্থাৎ উত্তম স্ত্রীদের কৃষ্ণ (দ্রৌপদী দেবী) প্রভৃতির মতো সকল বেদ পড়া উচিত।
🕉️ রাজপরিষদ মধ্যে প্রসিদ্ধা বিদুলা -
মহাভারত উদ্যোগপর্ব অ০ ১৩৩ থেকে ১৩৬ অধ্যায় পর্যন্ত বিদুলা নামের এক অতি বীরত্ব সম্পন্ন বিদুষী দেবীর সঞ্জয় নামক পুত্রের প্রতি ওজস্বী উপদেশ রয়েছে। সেই বিদুলার বিষয়ে লিখা রয়েছে -
এখানে "বিশ্রুতা রাজসন্সৎসু" এই বিশেষণটি বিশেষ মহত্বপূর্ণ যার অর্থ হলো যে - শুধুমাত্র বিদুষী ছিল না (যেরকম তার মৃতদের মধ্যেও নবজীবনের সংসারকারী উপদেশ থেকে স্পষ্ট প্রতীত হয়) বরং রাজসভাতেও তিনি প্রসিদ্ধা ছিলেন এবং সেখানে তার কথা মনোযোগের সহিত শ্রবণ করা হতো।
সেই বিদুষী দেবী বিদুলা নিজের বিষয়ে বলেছেন -
অর্থাৎ আমি অতি উচ্চবংশে উৎপন্ন হয়েছি এবং খুবই যোগ্য বরের সাথে আমার বিবাহ হয়েছে। আমার পতিদেব আমার পূজা করত।।
আর্যবীর দল বাংলাদেশ।