বেদ-প্রতিপাদিত "শরীরে‌ আত্মার নিবাস‌-স্থান"

প্রিয়রত্ন বিদ্যার্থী
26 minute read
0


বেদ-প্রতিপাদিত‌ "শরীরে‌ আত্মার নিবাস‌-স্থান"

যে‌ ব্যক্তি আত্মাকে উৎপত্তিবিনাশধর্মী মানেন, অর্থাৎ শরীর ব্যতীত অন্য কোনো নিত্য‌ পদার্থকে স্বীকার‌ করেনা, [দ্র০–পুরাতন চার্বাক মতানুযায়ী এবং আধুনিক বিকাসবাদী] তার‌ মনে এই প্রশ্ন‌ই উৎপন্ন হয় না যে‌, আত্মা শরীরের কোন স্থানে নিবাস করে ? তদ্রূপ যে‌ আত্মাকে শরীর‌ হইতে পৃথক নিত্য‌ মেনে‌ও তাকে সর্বব্যাপক বলে মান্য করে, [দ্র০–নৈয়ায়িক আদি দার্শনিক] তার মনেও এই প্রশ্ন উৎপন্ন হয় না। এই প্রশ্ন‌ তো কেবল‌ তার মনেই উৎপন্ন হয়, যে‌  আত্মাকে শরীর হইতে পৃথক নিত্য‌ পদার্থ মেনে তাকে অণু‌, পরমাণু‌ বা পরিচ্ছিন্ন পরিমাণশীল মানেন ।
                                    "তিন মত"  
আত্মার শরীরে অবস্থান বিষয়ে‌ তিনটি মত প্রচলিত রয়েছে। কেহ আত্মার নিবাস মস্তিষ্কে মানে, কেহ হৃদয়ে মানে এবং কেহ সুষুম্ণা নাড়ীতে মানেন ।
  1. অনেক প্রাচীন বিদ্বান‌্ আত্মার নিবাস‌ মস্তিষ্কে মানতেন ।  তাদের‌ মন্তব্য‌ এই যে‌, শরীরে‌ ব্যাপ্ত সমস্ত সূক্ষ্ম সংবেদনাত্মক জ্ঞান-তন্তুসমূহের কেন্দ্র মস্তিষ্ক, ইহাই বুদ্ধির নিবাসস্থান এবং সেখান থেকেই সমস্ত শারীরিক চেষ্টার নিয়মন হয়। অতঃ চেতন‌ অর্থাৎ সংবেদক আত্মার নিবাস‌ মস্তিষ্কে হ‌ওয়া উচিত ।
  1. যে‌ ব্যক্তি আত্মার‌ নিবাস হৃদয়ে মানেন, সে‌ নিজ মত সত্য সিদ্ধ করতে উপনিষদ‌ এবং আয়ুর্বেদের সেই প্রমাণ‌সমূহ উপস্থিত করে থাকে, যেখানে আত্মার নিবাস-স্থান হৃদয় বলা হয়েছে । যথা‌ – অঙ্গুষ্ঠমাত্রঃ পুরুষোऽন্তরাত্মা সদা জনানাং হৃদয়ে সন্নিবিষ্টঃ।                                                      (কঠোপনিষদ-২/৬/১৭) আত্মনঃ শ্রেষ্ঠতমমায়তন হৃদয়ম্।                        (চরকসংহিতা, নিদানস্থান-৮/৩)
  1. কতিপয়‌ ব্যক্তি, সুষুম্ণায় জীবের নিবাস‌ মানেন। তাদের কথন এই যে‌, এই উর্ধ্বমূল অধঃশাখ শরীররূপী বৃক্ষের মূল আধারভূত হলো মেরুদণ্ড এবং এর মধ্যে রয়েছে সুষুম্ণা নাড়ী, যা হইতে সহস্র তন্তু বের হয়ে এই সমস্ত শরীররূপী বৃক্ষকে কার্যক্ষম বানায় । অত‌ঃ আত্মার নিবাস‌ স্থান‌ও সুষুম্ণারূপী কেন্দ্রস্থানে‌ই হ‌ওয়া উচিত।
এই লেখনীতে এই বিষয়ে বিবেচনা করা হবে যে‌ উপরোক্ত তিন মতের মধ্যে কোন মতটি বেদ-প্রতিপাদিত‌ এবং প্রামাণিক । তথা যে‌ বচনসমূহের আধারে জীবের বিবিধ‌ নিবাস‌-স্থানে‌র কল্পনা করা হয়ে থাকে, এর মধ্যে‌ পরস্পর কোনো সামঞ্জস্য হতে পারে কিনা ? এর বিবেচনা এই লেখনীতে সংক্ষেপে করবো ।
‌ ‌ ‌ ‌ ‌ ‌ ‌ ‌ ‌ ‌ ‌ ‌ ‌  ‌ ‌ ‌"বেদ এবং আত্মার নিবাস-স্থান"
সর্বপ্রথম বেদের সেই প্রকরণকে উপস্থিত করছি, যেখানে‌ আত্মার নিবাস-স্থানের বর্ণনা মিলে।
অথর্ববেদের দশম কাণ্ডের দ্বিতীয় সূক্ত "কেনপাষ্ণী" নামে প্রসিদ্ধ । এই সূক্তের ঋষি নারায়ণ, দেবতা=প্রতিপাদ্য‌ বিষয় পুরুষ=ব্রহ্মপ্রকাশন। এর মধ্যে একত্রিংশ তথা দ্বাত্রিংশ মন্ত্রকে সাক্ষাৎ ব্রহ্ম প্রকাশক‌ বলা হয়ে থাকে।
[দ্র০– অথর্ববেদীয় বৃহৎসর্বানুক্রমণী, তথা তদনুসার মুদ্রিত অথর্ববেদীয় ঋষি নির্দেশ ] 
এই সূক্ত কেন উপনিষদের মূল আধার। কেন উপনিষদের প্রবচন‌ শৈলীতে এই সূক্তের অনুকরণ করা হয়েছে । অত‌ঃ বেদের এই কেনপাষ্ণী সূক্ত‌ এই প্রকার প্রতিপাদন শৈলীর সর্বপ্রাচীনতম উদাহরণ।
আমি এই সূক্ত হইতে কতিপয় সেই মন্ত্র উদ্ধৃত করছি, যা দ্বারা আত্মার শরীরগত বিশিষ্ট নিবাসস্থানের বিষয়ে কিছু প্রকাশ হবে–
তদ্বা অথর্বণঃ শিরো দেবকোশঃ সমুঞ্জিতঃ। 
তৎ প্রাণো অভি রক্ষতি শিরো অন্নমথোঃ মনঃ॥২৭॥
 [দ্র০–তুলনা করো - দিব্যে ব্রহ্মপুরে হ্যেষ ব্যোমন্যাত্মা প্রতিষ্ঠিতঃ। মনোময়ঃ প্রাণশরীরনেতা প্রতিষ্ঠিতোऽন্নে হৃদয়ম্ সন্নিধায়॥ মুণ্ডোপনিষদ্-২/২/৭]
অষ্টচক্রা নবদ্বারা দেবানাং পূরযোষ্যা। 
তস্যাং হিরণ্যয়ঃ কোশঃ স্বর্গো  জ্যোতিষাবৃতঃ॥৩১॥
তস্মিন্ হিরণ্যয়ে কোশে ত্র্যরে ত্রিপ্রতিষ্ঠিতে। 
তস্মিন্ যদ্ যক্ষমাত্মন্বত্ তদ্বৈ ব্রহ্মবিদো বিদুঃ॥৩২॥
[দ্র০– মন্ত্র-৩১,৩২ এর সহিত তুলনা করো - হিরণ্ময়ে পরে কোশে বিরজং ব্রহ্ম নিষ্কলম্। তচ্ছুভ্রং জ্যোতিষাং জ্যোতিস্তদ্ য়দাত্মবিদো বিদুঃ॥ মুণ্ডোপনিষদ্-২/২/৯]
প্রভ্রাজমানাং হরিণীং যশসা সংপরীবৃতাম্।  
পুরং হিরণ্যয়ী ব্রহ্মা বিবেশাপরাজিতাম্॥৩৩॥
অন্তের দ্বাত্রিংশ এবং ত্রয়োস্ত্রিংশ  মন্ত্রে প্রতিপাদিত বিষয়ের সংক্ষেপে এবং সমানরূপে প্রতিপাদনকারী এক অন্য‌ মন্ত্র এই প্রকার –
পুণ্ডরীকং নবদ্বারং ত্রিভির্নুণেভিরাবৃতম। 
তস্মিন্ যদ্ যক্ষমাত্মন্বদ্  তদ্বৈ ব্রহ্মবিদো বিদুঃ॥
                                                      (অথর্ববেদ-১০/৮/৪৩)
এই মন্ত্রসমূহের শব্দার্থ করার পূর্বে নিম্ন পদসমূহের তাৎপর্য বুঝা আবশ্যক ।
     'মন্ত্রসমূহে প্রযুক্ত বিশিষ্ট পদ এবং ইহার বিবরণ‌'
১.দেব  ২.দেবকোশ‌  ৩.প্রাণ‌  ৪.অন্ন‌  ৫.মন‌  ৬. হিরণ্ময়কোশ‌, ৭. হিরণ্যয়ী পুরী‌  ৮.স্বর্গ  ৯.জ্যোতিষাবৃত  ১০.ত্র্যর‌  ১১.ত্রিপ্রতিষ্ঠিত  ১২.যক্ষ‌  ১৩. আত্মন্বৎ  ১৪. ব্রহ্মা।
এখন আমি ক্রমশ প্রত্যেক পদের ব্যাখ্যান করছি-
১.দেব – দ্বিতীয় মন্ত্রে শরীর‌কে দেবতাদের পুরী বলা হয়েছে । এই দেব হলো পুরুষের জ্ঞানেন্দ্রিয়সমূহ । এর দ্বারাই আত্মা সাংসারিক পদার্থসমূহের জ্ঞান উপলব্ধ করে তথা এর দ্বারা সমস্ত সাংসারিক ব্যবহারসমূহকে সিদ্ধ করতে সমর্থ হয়।এই কারণে ইন্দ্রিয়কে দেব বলা হয়–
দেবো দানাদ্বা, দ্যোতনাদ্বা, দ্যুস্থানো ভবতীতি বা 
(নিরুক্ত ৭/১৫)
দিবু  ক্রীডাবিজিগীষাব্যবহারদ্যুতি----(ধাতুপাঠ)।
চক্ষুর্দেবঃ। গোপথব্রাহ্মণ,পূর্বভাগ-২/১০ (১১)।
বাগ্ দেবঃ। গোপথব্রাহ্মণ,পূর্বভাগ-২/১০ (১১)
শরীরে দেবাধিদেব‌ ইন্দ্র (ইন্দ্র=আত্মা) দ্বারা সম্বন্ধ
 [দ্র০– "ঊধ্বং প্রাণমুন্নয়ত্যপানং প্রত্যগস্যতি। মধ্যে বামনমাসীনং বিশ্বেদেবা উপাসতে" (কঠোপনিষদ ২/৫/৩)। প্রাণাপানক্রিয়া কারী বামন (বামঃ শ্রেষ্ঠঃ, বামং রূপমস্য স বামনঃ। অষ্টাধ্যায়ী ৫/২/১০০ হতে মত্বর্থীয় 'ন' প্রত্যয়) আত্মাকে বিশ্বে দেব = সমস্ত ইন্দ্রিয়সমূহ উপাসনা করে থাকে । দেবগণ‌ = ইন্দ্রিয়সমূহের মধ্যে আসীন বামন = আত্মা মস্তিষ্কেই নিবাস করে, অন্যত্র নয়।]  
ইন্দ্রিয়রূপী হ‌ওয়ায় এই শরীরকে "দেবতাদের পুরী‌" বলা হয়॥
২.দেবকোশ‌ – প্রথম মন্ত্রে মস্তককে 'দেবকোশ‌' বলা হয়েছে।  দেব অর্থ জ্ঞানেন্দ্রিয়, ইহা পূর্বেই বলা হয়েছে । সমস্ত জ্ঞানেন্দ্রিয়ের বাহ্য স্থুলরূপ শিরোভাগে বিদ্যমান রয়েছে ( ত্বক্ ইন্দ্রিয় শরীরব্যাপী বিদ্যমান)। পরন্তু এই ইন্দ্রিয়সমূহের সূক্ষ্ম সংবেদনাত্মক শক্তির কেন্দ্র মস্তিষ্কেই রয়েছে। ইন্দ্রিয়সমূহের বাস্তবিক স্বরূপ শক্ত্যাত্মক‌ই
 [দ্র০– ইন্দ্রিয়মিন্দ্রলিঙ্গমিন্দ্রদৃষ্টমিন্দ্রসৃষ্টমিন্দ্রজুষ্টমিন্দ্রদত্তমিতি বা । (অষ্টাধ্যায়ী-৫/২/৯৩) ]
কেননা বাহ্য স্বরূপসমূহের সর্বদা নীরোগ‌ হ‌ওয়ার পরও শক্তির হ্রাস অথবা উৎসন্ন‌ হ‌ওয়ার ফলে শ্রবণ‌ দর্শনাদি ক্রিয়া হয় না । অতঃ এখানে দেবকোশ‌ শব্দ দ্বারা মস্তিষ্কেরই বাচক [টিকাটিপ্পনী- অত‌এব সাংখ্য দর্শনে অহংকার হইতে ইন্দ্রিয়সমূহের উৎপত্তি বলা হয়েছে - 'অহংকারাৎ পঞ্চতন্মাত্রাণি উভয়মিন্দ্রিয়ং চ । ভৌতিক উপষ্টম্ভ ব্যতীত ইন্দ্রিয়সমূহ কার্য্যে সমর্থ হয় না, এইজন্য নৈয়ায়িক একে ভৌতিক মেনেছেন । দ্র‌.ন্যায়দর্শন-৩/১, ইন্দ্রিয় পরীক্ষা প্রকরণ‌ ] 
এই দেবকোশকে অথর্ববেদ-৬/৯৫/১ মন্ত্রে দেবসদন‌ বলা হয়েছে ‌। "দেবকোশের‌" অর্থ মস্তিষ্ক করার ফলেই তৃতীয় মন্ত্রে উল্লেখিত  "হিরণ্যকোশ‌" বিশেষণের ঠিক সামঞ্জস্য হয়। (দেখুন "হিরণ্যকোষের" ব্যাখ্যা)।এইজন্য  তদেকদেশ-ন্যায়ানুসার এই মন্ত্রে নির্দিষ্ট মস্তক শব্দ দ্বারা মাথার একটি অংশ মস্তিষ্কেরই অর্থ অভিপ্রেত॥
৩.প্রাণ – বৈদিক বাঙ্ময়ে প্রাণ শব্দ বিবিধ অর্থে ব্যবহৃত হয়। পরন্তু প্রথম মন্ত্রে প্রাণকে মস্তক, দেবকোশ‌, মস্তিষ্ক তথা‌ অন্ন এবং মনের রক্ষক‌ বলা হয়েছে। এই প্রাণ‌ ভৌতিক বায়ু নয় অপিতু জীবের বাচক‌ । "প্রাণো‌ হি প্রিয়ঃ প্রজানাম্" (তৈত্তিরীয় ব্রাহ্মণ-২/৩/৯/৫ ) এ প্রাণ‌ শব্দের অর্থ আত্মা'ই বলা হয়েছে । ইহাই এই ভৌতিক শরীরে অমৃতস্বরূপ । এইজন্য ব্রাহ্মণগ্রন্থগুলোর বিভিন্ন স্থানে প্রাণকে অমৃত বলা হয়েছে - "অমৃতং বৈ প্রাণঃ" (কৌষীতকি ব্রা‌হ্মণ-১১/৪/১৪/৪ ইত্যাদ)।
ভৌতিক প্রাণবায়ু নাশবান‌, অত‌ঃ এই বায়ুর জন্য অমৃত শব্দ ব্যবহার করা উপযুক্ত হতে পারেনা । মহাভারত শান্তিপর্ব ১৮৭/৩১ শ্লোকে এই মানস অগ্নিকেই জীব (আত্মা) বলা হয়েছে – "মানসোऽগ্নিঃ শরীরেষু জীব ইত্যভিধীয়তে"।অথর্ববেদের "প্রাণসূক্ত‌ " (১১/৪) মন্ত্রে প্রাণ শব্দ দ্বারা জীবের‌ই মহিমা বর্ণন করা হয়েছে ।
জগতে‌ জীবযুক্ত সচেতন‌ শরীরকেই "প্রাণী" বলা হয়ে থাকে । অতঃ স্পষ্ট হলো যে, প্রাণ‌ শব্দের মুখ্যতয়া জীবেরই বাচক‌ । প্রাণ‌ অপান‌ আদি ভৌতিক বায়ু সমূহের জন্য‌ প্রাণ শব্দের ব্যবহার "প্রাণ=জীব" এর সাহচর্যের কারণে লক্ষণাবৃত্তিতে হয়॥
৪-৫. অন্ন, মন – এখানে অন্ন এবং মন দ্বারা "পদেষু পদৈকদেশান্" (পদসমূহের স্থানে পদের‌ একদেশের প্রয়োগ হয়ে থাকে ) ন্যায় দ্বারা অন্নময় এবং মনোময় কোশসমূহের নির্দেশ হয়। ইহার বিশেষ ব্যাখ্যা উপনিষদে দেখা উচিৎ॥ 
৬. হিরণ্ময়কোশ – দ্বিতীয় মন্ত্রে অষ্টচক্রা নবদ্বারা দেবগণের (ইন্দ্রিয়সমূহের) পুরীতে হিরণ্ময়কোশের উল্লেখ রয়েছে। একে "স্বর্গ" এবং "জ্যোতিষাবৃত" (জ্যোতি দ্বারা আবৃত) বলা হয়েছে । পরবর্তী মন্ত্রেই এই হিরণ্ময়কোশের "ত্রিপ্রতিষ্ঠিত ত্র্যর" স্থানে "আত্মন্বৎ যক্ষ" এর স্থিতি বলা হয়েছে । এইজন্য প্রথমে বিচার করা উচিত যে‌, মন্ত্রোক্ত হিরণ্ময়কোশের স্থিতি শরীরের কোথায় ?
বৈয়াকরণগণের মতানুসারে হিরণ্ময় শব্দ হলো ময়ট্‌প্রত্যয়ান্ত। 
[দ্র০ – ঋত্ব্যবাস্ত্ব্যবাস্ত্বমাধ্বীহিরণ্যয়ানি ছন্দসি। 'অষ্টাধ্যায়ী-৬/৪/১৭৫' সূত্র দ্বারা "হিরণ্ময়" এর "ময়ট‌্" এর মকারের লোপ বেদে দর্শিত করা হয়েছে। কিছু বৈদিক গ্রন্থে "হিরণ্ময়" শব্দের‌ও প্রয়োগ‌ রয়েছে, সেখানে‌ "হিরণ্ময়" এর য়কারের লোপ জানা উচিৎ, অথবা‌ হিরণ্যার্থক " হিরণ্‌ " প্রকৃত্যন্তর রয়েছে]   
এই পদে ময়ট্ "আনন্দময়" এর সমান প্রকৃত অর্থ্যাৎ প্রাচুর্য দ্বারা প্রস্তুত  [দ্র০– তৎপ্রকৃতবচনে ময়ট্ (অষ্টাধ্যায়ী-৫/৪/২১)–প্রাচুর্যেণ প্রস্তুতং প্রকৃতম্ ( কাশিকা)]  অর্থে হয়েছে। তদনুসার "হিরণ্ময়" শব্দের অর্থ হবে - হিরণ্যের প্রাচুর্য - প্রাধান্যে নির্মিত বস্তু। এই দেবপুরী শরীরে এমন কোন অবয়ব রয়েছে, যা‌ হিরণ্যের প্রাচুর্য দ্বারা নির্মিত। এই বিষয়ে শরীর-শাস্ত্র-নিষ্ণাতসমূহের কথন‌ এই যে, মস্তিষ্কে এমন একটি অবয়ব রয়েছে, যা‌ হাল্কা হলুদ (ধুসর) বর্ণের পদার্থের বাহুল্য দ্বারা নির্মিত হয়েছে [দ্র০– আজ্ঞাকন্দৌ নাম------- ধূসরবস্তুভূয়িষ্ঠৌকন্দৌ ব্রহ্মগুহামুভয়তো বর্তেতে। (গণনাথসেন কৃত প্রত্যক্ষশারীর ভাগ-৩, অধ্যায়-৬, পৃষ্ঠা-৭৯)] যোগীজন একে "আজ্ঞাচক্র" বলে থাকে। ইহা বাম এবং দক্ষিণ‌ ভেদে দুই বিভাগে বিভক্ত। [দ্র০– প্রত্যক্ষশারীরের পূর্বোক্ত উদাহরণ]  এই দুটির‌ আকৃতি মনুষ্যের অঙ্গুষ্ঠ-পর্বে মিলে [দেখুন – প্রত্যক্ষশারীর ভাগ-৩, ৮৫নং পৃষ্ঠার ২২১এর চিত্র] । ইহাই সমস্ত জ্ঞান তথা‌ চেষ্টাতন্তুসমূহের কেন্দ্র। এই অবয়ব ব্যতীত শরীরে আর অন্য কোনো এমন অবয়ব নাই যা‌, হাল্কা হলুদ বর্ণ বহুল পদার্থ দ্বারা নির্মিত। অতঃ বেদের "হিরণ্ময়কোশ" এই আজ্ঞাচক্র‌ই হতে পারে। এই হিরণ্ময় কোশকে ঋগ্বেদ-৪/৫৮/৫ মন্ত্রে "হিরণ্ময় বেত " বলা হয়েছে।
শুধু এতটুকুই নয়, বেদে এই 'হিরণ্ময়কোশকে' স্বর্গ‌ও বলা হয়েছে । ব্রাহ্মণ গ্রন্থগুলোতে স্বর্গকে উর্ধ্বলোক বলা হয়েছে – "ঊর্ধ্বমু বৈ স্বর্গো লোকঃ, উপরীব স্বর্গো লোকঃ" (তৈত্তিরীয় ব্রাহ্মণ- ৩/২/১/১৫ )। এই ব্রহ্মাণ্ডে স্বর্গ আদিত্যলোক, পৃথিবীতে স্বর্গ ত্রিবিষ্টপ (তিব্বত) এবং এই শরীরের স্বর্গ মস্তিষ্কের অবয়বভূত হিরণ্ময়কোশ‌। তিনটিই ঊর্ধ্বভাগে নিহিত। আদিত্যে অজর‌ অমর‌ দেবতাদের= কিরণসমূহের বাস,  ত্রিবিষ্টপে মনুষ্য দেবজাতির নিবাস এবং এই হিরণ্ময়কোশে দেবতাদের = ইন্দ্রিয়সমূহের সূক্ষ্ম সংবেদনাত্মক শক্তির সংনিবাস। এইজন্য‌ বলা হয়েছে " যদ্‌ ব্রহ্মাণ্ডে তৎপিণ্ডে" অর্থাৎ ব্রহ্মাণ্ডের রচনা যেরূপ হয়েছে শরীরের রচনাও সেরূপ হয়েছে॥
৭.স্বর্গ – মন্ত্রে হিরণ্ময়কোশকে স্বর্গ বলা হয়েছে । এর ব্যাখ্যা পূর্ব লিখনীতে করা হয়েছে॥
৮. জ্যোতিষাবৃত - মন্ত্রে হিরণ্ময়কোশকে "জ্যোতি দ্বারা আবৃত" বলা হয়েছে। পূর্বোক্ত আজ্ঞাকেন্দ্রসমূহ (ধূসরবর্ণ) হ‌ওয়ায় বেদে একে জ্যোতিষাবৃত বর্ণন করা সর্বথা উপযুক্ত‌ ।  কঠোপনিষদ‌ অধ্যায়-২, বল্লী-৪, কঠ-১৩ তেও অঙ্গুষ্ঠ-পর্বমাত্র পুরুষকে ধুমরহিত জ্যোতি দ্বারা অর্থাৎ উজ্জ্বল অলঙ্কার দ্বারা উপমা দেওয়া হয়েছে। [দ্র০-অঙ্গুষ্ঠমাত্রঃ পুরুষো জ্যোতিরিবাবধুমকঃ ] উপনিষদের অঙ্গুষ্ঠমাত্র পুরুষ বেদের এই হিরণ্ময় কোশ‌ই, কেননা এই হিরণ্ময় কোশের‌ আকার‌ও অঙ্গুষ্ঠপর্ব সদৃশ। এই বিষয়ে পূর্বেই লিখা হয়েছে॥
৯. ত্র্যর‌ -  ত্র্যর‌ শব্দের অর্থ - ত্রিকোণ‌। মন্ত্রকে সামান্য দৃষ্টিতে দৃষ্টিপাত করার পর ত্র্যর‌ এবং ত্রিপ্রতিষ্ঠিত পদকে হিরণ্ময়কোশের বিশেষণ‌ প্রতীত হয়। পরন্তু এক‌ই মন্ত্রে দুইবার 'তস্মিন্' পদের নির্দেশ থাকার কারণে এই মন্ত্রের দুইটি বাক্য‌ করতে হবে। এইটুকুই নয়, হিরণ্ময়কোশের আকৃতি যে‌ অঙ্গুষ্ঠপর্ব সদৃশ তা পূর্বেই বলা হয়েছে । এজন্য ত্র্যর‌ এবং ত্রিপ্রতিষ্ঠিত পদ হিরণ্ময়কোশের বিশেষণ হতে পারে না । এই কারণে  'ত্র্যরে ত্রিপ্রতিষ্ঠিতে' পদের সম্বন্ধ উত্তর 'তস্মিন্' পদের সাথে জুড়তে হবে । তদনুসার যেই স্থানে 'আত্মন্বৎ যক্ষ' এর স্থিতি উক্ত মন্ত্রে বর্ণন করা হয়েছে, সেই স্থান হলো ত্র্যর এবং ত্রিপ্রতিষ্ঠিত এবং তা হিরণ্ময়কোশের মধ্যে রয়েছে। দুই আজ্ঞাকেন্দ্রের মধ্যে  'ব্রহ্মগুহা' নামক এক ত্রিকোণ‌ পরিখাকার‌ স্থান রয়েছে  [দ্র০-ব্রহ্মগুহা ব্রহ্মযোনির্বা নাম আজ্ঞাকন্দয়োরন্তরালে মধ্যরেখায়াং দৃশ্যা গুহা তনুত্রিকোণপরিখাকারা। তদেব ক্বচিদ্ ব্রহ্মহৃদয়মিতি হৃদয়মিতি মা ব্যবহরন্তি প্রাঞ্চ॥  প্রত্যক্ষশারীর ভাগ-৩, অধ্যায়-৬, পৃষ্ঠা-৮২ ] একেই বেদে ত্র্যর‌ পদ দ্বারা উল্লেখ করা হয়েছে॥
১০. ত্রিপ্রতিষ্ঠিত – ত্রিপ্রতিষ্ঠিত শব্দের অর্থ হলো - তিন স্থানে স্থিত, অথবা তিন আধারে আধৃত । উপযুক্ত হিরণ্ময়কোশের (আজ্ঞাকেন্দ্রের) মধ্যে বর্তমান যে‌ ত্র্যর‌ (ব্রহ্মগুহা) স্থান‌ রয়েছে, তা গুহান্তরালিকবিবরদ্ধার দ্বারা দুই দিক হইতে দুই ত্রিপথগুহা দ্বারা সম্বন্ধিত । এবং তৃতীয় দিকে ব্রহ্মদার সুরঙ্গ দ্বারা প্রাণগুহাতে সম্বন্ধিত রয়েছে। 
[দ্র০– সা‌ চ‌ গুহায়াঃ পুরস্তাদুর্ধ্ব ত্রিপথগুহাভ্যাং সম্বন্ধবতী গুহান্তরালিক বিবরদ্বারেণ‌, পশ্চিমতশ্চ প্রাণগুহয়া 'ব্রহ্মদ্বারসুরঙ্গ' মার্গেণ॥ প্রত্যক্ষশারীর ভাগ-৩, অ‌ধ্যায়-৬, পৃষ্ঠা ৮২] 
এইজন্য বেদে‌ও ত্র্যরকে  ত্রিপ্রতিষ্ঠিত বলা হয়েছে॥
১১. যক্ষ – এই শব্দ "যক্ষ পূজায়াম্" ধাতু হইতে উৎপন্ন।  আধ্যাত্মে 'যক্ষ' শব্দ জীব এবং ঈশ্বর দুইয়েরই বাচক‌ ।  অথর্ববেদের তিন আধ্যাত্ম প্রকর‌ণে বার‌ংবার যক্ষ শব্দের প্রয়োগ‌ উপলব্ধ হয়। এই প্রকরণে‌ যেখানে যেখানে‌ জ্যেষ্ঠ ব্রহ্মের (পরমাত্মার) বর্ণন রয়েছে, সেখানে সেখানে যক্ষের বিশেষণ "মহত্" উল্লেখ রয়েছে। দেখুন অথর্ববেদ-১০/৭/৩৮; ১০/৮/৮৫॥ এবং যেখানে যেখানে‌ জীবের বর্ণন রয়েছে, সেখানে সেখানে যক্ষের‌ বিশেষণ‌ "আত্মন্বত্" এর উপলব্ধ হয় । দেখুন অথর্ববেদ-১০/২/৩২; ১০/৮/৪৩॥ 
প্রকৃত মন্ত্র সমূহে যক্ষ‌কে নবদ্বারযুক্ত 
[দ্র০-কঠোপনিষদ‌্ ২/২/১ এ একাদশদ্বার যুক্ত‌ পুরের উল্লেখ রয়েছে -- "পুরমেকাদশদ্বারমজস্যাবক্রচেতসঃ"] 
দেবপুরীর অন্তর্গত ত্র্যর (ব্রহ্মগুহা) স্থানে বিদ্যমান বলা হয়েছে । অত‌ঃ এই যক্ষ‌ শব্দ নিশ্চয়‌ই জীব বাচক॥
১২. আত্মন্বৎ‌ - আত্মা শব্দ‌ জীব এবং ঈশ্বর‌ দুইয়েরই বাচক । ইহা লোকপ্রসিদ্ধ রয়েছে। পরন্তু আত্মা শরীরের বাচক‌ যা‌ কেবল বিদ্বান‌ই জানেন । "হন্ত্যাত্মা আত্মানম্ " (মহাভাষ্য‌- ১/৩/৬৭ ) ইত্যাদি বাক্যে প্রথম আত্মা শব্দ জীবের জন্য এবং দ্বিতীয়টি শরীরের বাচ‌ক । অথর্ববেদে যেখানে‌ যেখানে 'আত্মন্বৎ' বিশেষণের সাথে 'যক্ষের' বর্ণন রয়েছে, সেখানে সেখানে নবদ্বার পুরী অথবা পুণ্ডরীক (গৃহেরও) এরও উল্লেখ রয়েছে। [দ্র০- অথর্ববেদ ১০/৮/৪৩]  আত্মন্বৎ শব্দের অর্থ – আত্মাধারী (আত্মাऽস্যাস্তীতি)। এর দ্বারা স্পষ্ট যে‌ তৃতীয় মন্ত্রে প্রযুক্ত 'আত্মন্বৎ' শব্দের মধ্যে আত্মা শব্দ শরীর বাচক । এজন্য ব্রাহ্মণগ্রন্থসমূহে বলা হয়েছে – "আত্মা বৈ তনুঃ" (শতপথব্রা‌হ্মণ- ৬/৭/২/৬, ৭/৩/১/২৩, ৩/৫/২/৩২ ) ; "পাংক্ত ইতর‌ আত্মা লোমত্বঙমাংসমস্থিমজ্জা" (তাণ্ডব্য ব্রা‌হ্মণ-৫/১/৪ ); "আত্মা বৈ পুঃ‌" (শতপথ‌ ব্রা‌হ্মণ-৭/৫/১/২১) এজন্য‌ প্রকৃত মন্ত্রে প্রযুক্ত আত্মন্বৎ শব্দের অর্থ শরীরধারী=শরীর দ্বারা যুক্ত॥
১৩. ব্রহ্মা – ইহার মূল শব্দ - ব্রহ্মন্। ইহা পুংলিঙ্গ এবং নপুংশকলিঙ্গ (ব্রহ্মা-ব্রহ্ম) ভেদে‌ দুই প্রকার । দুই প্রকার ব্রহ্মন্ শব্দ‌ই আধ্যাত্মে জীব এবং ঈশ্বর এই দুইয়ের জন্য‌ই প্রযুক্ত‌ হয়। [দ্র০–বস্তুতঃ, যক্ষ, পুরুষ, ব্রহ্ম, ব্রহ্মা, আত্মা আদি যত পদ  জীব এবং ঈশ্বর বাচক, সেসব আধ্যাত্মতে শরীরের এবং আধিদৈবিকে ব্রহ্মাণ্ডেরও বাচক।] যেখানে ব্রহ্মণ শব্দের সাথে "জ্যেষ্ঠ"  [দ্র০–তস্মৈ জ্যেষ্ঠায় ব্রহ্মণে নমঃ। (অথর্ববেদ- ১০/৮/১)] অথবা‌ "মহৎ" আদি বিশেষণ‌ প্রযুক্ত হয়, সেখানে তা নিশ্চিতরূপে ঈশ্বর বোধক‌ হয়। অন্যত্র প্রকর‌ণ আদি‌ অনুসারে এর বাচ্যকে নিশ্চয় করা হয়ে থাকে। প্রকৃত চতুর্থ মন্ত্রে হিরণ্ময়ী পুরীতে ব্রহ্মের প্রবেশ‌ করার‌ উল্লেখ রয়েছে। অত‌ঃ প্রকরণ অনুসারে এই মন্ত্রে প্রযুক্ত "ব্রহ্মা" পদ নিশ্চিতরূপে জীব বাচক‌ 
[দ্র০–অথর্ববেদ-১০/২ সূক্তের অনেক মন্ত্রে এর উল্লেখ রয়েছে–"পুরং যো ব্রহ্মণো বেদ যস্যাঃ পুরুষ উচ্যতে"। (অথর্ববেদ-১০/২/৩০) ]
ঈশ্বর‌ বাচক‌ নয়॥
 ‌ ‌ ‌ ‌ ‌ ‌ ‌ ‌       ‌ "উক্ত‌ মন্ত্রসমূহের সামূহিক অর্থ"
এখন সামূহিক রূপে চারো মন্ত্রের অধ্যয়নের ফলে মন্ত্রসমূহের নিম্ন অভিপ্রায় স্পষ্ট হয় –
"আট‌ চক্র এবং নবদ্বার যুক্ত‌ দেবতাদের অযোধ্যা তথা অথর্বা নাম্নী নগরীর শিরস্থানে হিরণ্ময় দেবকোশ‌ রয়েছে । এর মধ্যে ত্রিদিক সম্বদ্ধ ত্রিকোণ‌ স্থানে আত্মন্বৎ যক্ষ ব্রহ্মা (জীব) নিবাস করে।"
এই বর্ণন‌ হইতে স্পষ্ট হয় যে‌, মস্তিষ্কান্তর্গত পীতাভ বর্ণের দুই আজ্ঞাকেন্দ্রের মধ্যে যে‌ ত্রিকোণ‌ পরিখাকার‌ স্থান রয়েছে, সেখানে জীবাত্মা নিবাস‌ করে। এইজন্য‌ যোগীগণ এই ত্রিকোণ‌ পরিখাকার‌ স্থানকে ব্রহ্মগুহা বলে থাকে। 
[দ্র০–(আজ্ঞাকন্দৌ নাম------- ধূসরবস্তুভূয়িষ্ঠৌকন্দৌ ব্রহ্মগুহামুভয়তো বর্তেতে। (গণনাথসেন কৃত প্রত্যক্ষশারীর ভাগ-৩, অধ্যায়-৬, পৃষ্ঠা-৭৯), (ব্রহ্মগুহা ব্রহ্মযোনির্বা নাম আজ্ঞাকন্দয়োরন্তরালে মধ্যরেখায়াং দৃশ্যা গুহা তনুত্রিকোণপরিখাকারা। তদেব ক্বচিদ্ ব্রহ্মহৃদয়মিতি হৃদয়মিতি মা ব্যবহরন্তি প্রাঞ্চ॥  প্রত্যক্ষশারীর ভাগ-৩, অধ্যায়-৬, পৃষ্ঠা-৮২)] 
ইহাই সপ্তম সত্যনামক সপ্তম লোক‌ স্বর্গ। 
[ দ্র০–"সপ্তমে উ লোকে ব্রহ্ম। (জৈমিনীয় ব্রাহ্মণ-১/৩৩৩)। এই সাতটি লোককেই বৈদিক গ্রন্থসমূহে, ভূঃ ভুবঃ স্বঃ মহঃ জনঃ তপঃ সত্যম্ রূপ সপ্ত ব্যাহ্যতি রূপে স্মরণ করা হয়েছে। পুরাণে যে সাত স্বর্গের কথা বলা হয়েছে, তা এই পিণ্ড=শরীরের নাভি হইতে উপর পর্যন্ত বর্তমান সাতটি স্থান। এতে দেবগণ নিবাস করেন। সত্য নামক স্বর্গে দেবরাজ ইন্দ্র=আত্মা নিবাস করে।] 
এর মধ্যে ব্রহ্ম=জীব নিবাস করে।
এই ভাবকে মাধ্যন্দিন সংহিতার‌ অন্তিম মন্ত্রে এইরূপ ব্যক্ত করেছে – "হিরণ্ময় পাত্র দ্বারা সত্যের মুখ ঢাকা‌ রয়েছে, সেই সত্যরূপী আদিত্যে বর্তমান যে‌ পুরুষ রয়েছে, তা‌ আমি।
  [দ্র০–হিরণ্ময়েন পাত্রেণ সত্যস্যাপিহিতং মুখম্ । যো‌ऽসাবাদিত্যে পুরুষঃ সোऽসাবহম্॥ যজুর্বেদ-৪০/১৭ ] 
এখানে হিরণ্ময় পাত্রের অভিপ্রায় উক্ত পীতাভ আজ্ঞাকেন্দ্রসমূহ। পাত্র‌ শব্দের প্রয়োগ‌ এর জন্য সর্বথা যুক্ত‌ ‌। কেননা যেরূপ পাত্র কোনো বস্তুর আধার‌ হয়ে থাকে, সেরূপ সমস্ত শরীরে ব্যাপ্ত জ্ঞানবাহক তথা‌ চেষ্টাবাহক তন্তুসমূহের কেন্দ্র‌ আজ্ঞাকেন্দ্রই । ব্রাহ্মণ গ্রন্থসমূহে সত্যকে আদিত্য‌ বলা হয়েছে–"তদ্‌ যৎসত্যমসৌ স আদিত্যঃ" (শতপথ ব্রা‌হ্মণ-৬/৪/১/১২ ) ; "অসৌ বা আদিত্যঃ সত্যম‌্"  (তৈত্তিরীয়  ব্রা‌হ্মণ-২/১/১১/১ )। ব্রহ্মাণ্ডে যে‌ আদিত্য‌ রয়েছে, তা মস্তকস্বরূপে। এইজন্য‌ মন্ত্রের অর্থ স্পষ্ট যে, সেই সত্যরূপী আদিত্যলোকে যা‌ বর্তমান, তা আমি অর্থাদি জীবাত্মা॥
‌ ‌ ‌ ‌ ‌ ‌ ‌ ‌ ‌ ‌ ‌ ‌ ‌ ‌ ‌ ‌ ‌ ‌ ‌ ‌ ‌ ‌ ‌ ‌ ‌   ‌ ‌ ‌ ‌"খং ব্রহ্ম"
ও৩ম্ ক্রতো‌ স্মর ( যজুর্বেদ-৪০/১৫) এই মন্ত্রে মৃত্যুর সময় জীবাত্মার জন্য যে ও৩ম্ স্মরণ‌ করার বিধান দেওয়া হয়েছে, সেই ও৩ম্ এর লক্ষণ‌ পরে বর্ণন করা হয়েছে –"ও৩ম্ খং‌ ব্রহ্ম"  অর্থাৎ ও৩ম্ নাম "খ‌" ব্রহ্মের।
পূর্বে‌ই বর্ণন করা হয়েছে যে‌, বৈদিক গ্রন্থসমূহে 'ব্রহ্ম' পদ‌ জীবাত্মা এবং পরমাত্মা দুইয়ের জন্য‌ই প্রযুক্ত‌ হয়। 
[দ্র০– ব্রহ্ম পদ শরীরেরও বাচক, ইহা পূর্বেই লিখা হয়েছে। ব্রহ্মাণ্ড শব্দের মধ্যে ব্রহ্ম শব্দ জগৎ বাচক। তা অণ্ড অর্থাৎ অণ্ডাকার গোল। এই ব্রহ্মান্ড ব্রহ্মের শরীর। অতঃ আত্মার ন্যায় ব্রহ্ম পদও শরীর, জীব এবং ঈশ্বর এই তিনেরই বাচক।] 
পরন্তু যেখানে‌ কেবল‌ "পরমব্রহ্মের"  নির্দেশ অভিপ্রেত হয়, সেখানে স্পষ্টতার জন্য "মহৎ‌" "বৃহৎ‌" "খং" আদি‌ কোননা কোন বিশেষণ‌ অবশ্য‌ই প্রযুক্ত‌ হয়। খং নাম আকাশের, অত‌ঃ "খং ব্রহ্ম" এর অর্থ হলো খ‌ = আকাশের ন্যায় সর্বব্যাপক ব্রহ্ম । তদনুসার সর্বব্যাপক ব্রহ্মের নাম ও৩ম্। আদিত্য‌ (সত্য‌) অর্থাৎ, ব্রহ্মগুহায়  বর্তমান যে‌ পুরুষ বিদ্যমান, তা ক্রতু = কর্মশীল জীব। সন্ধ্যার মার্জন মন্ত্রে‌ও এই ভাবকে ব্যক্ত করা হয়েছে ‌। সেখানে মহাব্যাহৃত্যাত্মক সপ্ত স্বর্গলোকের নির্দেশ করে  অন্তে "খং ব্রহ্ম পুনাতু সর্বত্র" মন্ত্রে ব্রহ্মকে সর্বব্যাপক অর্থাৎ কোন এক লোক বিশেষে অসম্বদ্ধ বুঝানো হয়েছে ।
‌ ‌ ‌ ‌ ‌ ‌ ‌ ‌ ‌ ‌ ‌ ‌ ‌ ‌‌ ‌ ‌ ‌ ‌ ‌ ‌ ‌ ‌‌ ‌ ‌‌ ‌         "কং ব্রহ্ম"
'খ‌' এর পূর্ববর্তী বর্ণ 'ক'। এটি মস্তকের জন্য প্রযুক্ত‌ হয়ে থাকে [দ্র০–"কং সমারভ্য মেধাবী ততো হ্যঙ্গানি বিন্যসেত্। ভবিষ্যপুরাণের নামে বীরমিত্রোদয় পূজাপ্রকাশ ২০২নং পৃষ্ঠায় উদ্ধৃত।  সেখানে "কং শিরঃ" এরূপ ব্যাখান করা হয়েছে। "কং মস্তকে" দ্র০–হৈমলধুন্যাস্, পৃষ্ঠা-২২ খ, অব্যয়ার্থতে] কেশকে‌ মাথার চুল বলা হয় -- "কে শেরতে‌ কেশাঃ" মাথায়‌ উৎপন্নজাত। [দ্র০–ক্ষীরস্বামী, অমর‌ টীকা-২/৬/৯৫ ]  'ক‌' এর সাথেই 'কায়‌' শব্দের সম্বন্ধ রয়েছে । কপাট শব্দের মধ্যে বর্তমান 'ক' দ্বারাও মস্তক বুঝায় – "ক‌ শিরঃ পাটয়তীতি কপাট‌" [দ্র০–ক্ষীরস্বামী, অমরটীকা] এজন্য  "কং ব্রহ্ম খং ব্রহ্ম" ( ছান্দোগ্য উপনিষদ-৪/১০/৫ ) শ্লোকে "ক‌" ব্রহ্ম মস্তক স্থানীয় জীবাত্মা এবং "খ" ব্রহ্ম আকাশবৎ‌ সর্বব্যাপক ব্রহ্ম পরমাত্মা ।
এই প্রকার অথর্ববেদের মন্ত্রসমূহ দ্বারা স্পষ্ট হয়ে যায় যে‌, শরীরে জীবের নিবাসস্থান মস্তিষ্কান্তর্গত দুই আজ্ঞাকেন্দ্রের মধ্যে বর্তমান ব্রহ্মগুহা'ই । শরীরে উক্ত অবয়বাতিরিক্ত অন্য‌ কোনো এরূপ অবয়ব নাই, যা‌ বেদের অনুকূল –
তস্মিন্ হিরণ্ময়ে কোশো‌ ত্র্যরে ত্রিপ্রতিষ্ঠিতে ।
তস্মিন্ যদ্‌ যক্ষমাত্মন্বদ্‌ তদ্বৈ ব্রহ্মবিদো‌ বিদুঃ ।।
                                               (অথর্ববেদ-১০/২/৩)
এখন‌ কেবল‌ একটি বিষয়ে‌র উপর‌ বিচার করা বাকি রয়েছে যে, যে‌সব বচনে আত্মার নিবাসস্থান "হৃদয়" বলা হয়েছে, সেখানে হৃদয় শব্দের বাচ্য‌ বক্ষস্থানীয় লোকপ্রসিদ্ধ শরীরাবয়ব‌ই বা অন্য‌?
 ‌ ‌ ‌ ‌ ‌ ‌ ‌ ‌ ‌ ‌ ‌ ‌ ‌ ‌        "হৃদয় শব্দের মীমাংসা"
হৃদয় শব্দের অর্থ — আমাদের বিচার এই যে‌, বৈদিক বাঙ্ময়ে‌ প্রত্যেক শব্দ প্রকরণ বিশেষ‌ ব্যতীত সম্প্রতি লোকপ্রসিদ্ধ অর্থ গ্রহণ করা অন্যায় । যদি দুরাগ্রহ করা হয় তাহলে মহর্ষি যাস্ক কৃত "সমুদ্র" শব্দের  অর্থ অন্তরিক্ষ‌ 
[দ্র০– নিঘণ্টু-১/৩ ; নিরুক্ত-২/১০ ] 
করা অযৌক্তিক হবে, কেননা লোকপ্রসিদ্ধ অর্থে সমুদ্র‌ পদ পার্থিব সমুদ্র‌ অর্থেই প্রযুক্ত হয়ে থাকে। সেই অবস্থায় "স‌ উত্তরস্মাদধরং  সমুদ্রম্" (ঋগ্বেদ-১০/৯৮/৫) মন্ত্রের কোন ব্যাখ্যা‌ই করা যাবেনা। এই প্রকার 'বৃত্র' শব্দের লোকপ্রসিদ্ধ (লৌকিক) অর্থে ত্বষ্টা নামক অসুরের পুত্র‌ অর্থে প্রসিদ্ধ, পরন্তু নৈরক্ত 'বৃত্র' শব্দের অর্থ "মেঘ" করেছেন 
[দ্র০–নিঘন্টু-১/২০ ; নিরুক্ত-২/১৬] 
বেদে 'বৃত্র' শব্দ ত্বাষ্ট্র অসুর শব্দের বাচক‌ নয়,অপিতু মেঘ‌ এরই বাচক‌। মহর্ষি যাস্ক‌ অত্যন্ত প্রবল‌ প্রমাণ দ্বারা এর সিদ্ধি করেছেন। এরূপ অনেক উদাহরণ দেওয়া যাবে, যার দ্বারা স্পষ্ট হ‌য়ে যায় যে‌, বেদার্থে কেবল সম্প্রতি লোকপ্রসিদ্ধ (লৌকিক) অর্থ‌ই নেওয়া যাবে না। এখানে এটাও বিচারণীয় যে‌, উপনিষদের সেই বচনে, যেখানে আত্মার নিবাস-স্থান হৃদয়ে বলা হয়েছে– 'হৃদয়' শব্দের লোকপ্রসিদ্ধ (লৌকিক) অর্থ বক্ষস্থানীয় প্রসিদ্ধ শরীরাবয়ব‌ই বুঝা উচিত অথবা অন্য‌ কোন বাচ্য পদার্থ? 
পূর্বোক্ত অথর্ববেদের মন্ত্রসমূহ দ্বারা খুব স্পষ্ট যে জীবের নিবাস লোকপ্রসিদ্ধ বক্ষস্থানীয় শরীরাবয়বে নয়, জীবের নিবাস মস্তিষ্কে। এমন পরিস্থিতিতে উপনিষদের বচন‌ কি বেদবিরুদ্ধ‌ বলে গণ্য হবে, নাকি 'হৃদয়' শব্দের অন্যার্থ অনুসন্ধান করা উচিত? 
এই বিষয়ে বিচার করার‌ পূর্বে, এটা বিচার করা আবশ্যক‌ যে‌, হৃদয় শব্দের মূল অর্থ কি ? শতপথ ব্রাহ্মণ (১৪/৮/৪/১) এ হৃদয় শব্দের নিরুক্তি 'হৃ দ য়ম্' এই তিন‌ শব্দ দ্বারা মানা হয়েছে। তদনুসার এর অর্থ —
হৃ — হৃঞ হরণে‌ = হরণ‌ করা, নেওয়া।
দ — ডুদাঞ্র দানে = দেওয়া।
য়ম্‌ — য়মু উপরমে‌ = থামানো।
অর্থাৎ যে‌ শরীরাবয়ব এই তিনটি ক্রিয়া করে, তা‌কে হৃদয় বলা হয় ।  ভারতীয় আধ্যাত্মবিদদের সামান্য‌ এক সুত্র — "য়দ্ ব্রহ্মাণ্ডে তৎপিণ্ডে"  এই তত্ত্বের মূলভূত যাজুষ মন্ত্র এই প্রকার‌–
অন্তস্তে দ্যাবাপৃথিবী দধা‌ম্যন্তর্দধাম্যুর্বন্তরিক্ষম্।
স‌জুর্দেবেভিরবরৈঃ পরৈশ্চান্তর্য়ামে মঘবন্ মাদয়স্ব ॥
‌ ‌ ‌ ‌ ‌ ‌ ‌                                                  ‌ ‌ ‌(যজুর্বেদ-৭/৫)
অর্থাৎ — হে মধবন‌্=ইন্দ্র=জীব ! তোমার শরীরের ভিতরেই দ্যুলোক, পৃথিবীলোক এবং বিস্তীর্ণ অন্তরীক্ষলোকের স্থাপিত করি ।তুমি অবর‌ এবং পর দেবগণের (কর্মেন্দ্রিয়সমূহ এবং জ্ঞানেন্দ্রিয়সমূহের) সহিত অন্তর্য়াম (সব ইন্দ্রিয়ের নিয়মনকারী) স্থানে বর্তমান‌ হও মুদ্রিত রও ।
এই আধ্যাত্মবিদদের দ্বারা জানা তত্ত্ব আধ্যাত্ম জ্ঞানের বাস্তবিক‌ কুঞ্জি। এর মাধ্যমে আধ্যাত্মসম্বন্ধী অনেক রহস্য উদ্-ঘাটিত হয়ে যায়। হৃদয় শব্দের অর্থের সমস্যা‌ও উক্ত তত্ত্বকে স্বীকার করে নিলে বড়ই সুগমতার সহিত মীমাংসিত হয়ে যায়।
 ‌ ‌ ‌ ‌ ‌ ‌ ‌ ‌   ‌ ‌  ‌ ‌   "হৃদয় এবং সমুদ্রের সাম্য‌"
এই শরীরে বক্ষস্থানীয় হৃদয়ের যে কার্য্য এবং মহত্ত্ব রয়েছে, তা এই ব্রহ্মাণ্ডের সমুদ্রের কার্য্য । মহর্ষি যাস্ক সমুদ্র‌ শব্দের নির্বাচন করেছেন – "সমুদ্রবন্ত্যস্মাদাপঃ, সমুদ্রবন্ত্যেনমাপঃ (নিরুক্ত‌ ২/১০), অর্থাৎ যেখান থেকে আপঃ (জল‌) গমন করে থাকে, এবং যাহার‌ প্রতি‌ আপঃ (জল) গমন করে, তাহাই সমুদ্র। পার্থিব সমুদ্রের প্রতি সমস্ত আপঃ গমন করতে থাকে এবং এর‌ দ্বারা বাষ্পরূপ হয়ে‌ আপঃ [উপরের দিকে] গমন‌ করতে থাকে । এবং গমনাগমনের সাথে এর মধ্যে জল স্থির‌ও থাকে । উপরে শতপথ‌ ব্রাহ্মণ অনুসারে  হৃদয় শব্দের যে‌ অর্থ করা হয়েছে, তা পূর্ণরূপে সমুদ্রে ঘটিত হয়ে থাকে। "অত‌ঃ লোকসম্মিতোऽয়ং পুরুষঃ" (চরক‌সংহিতা,শরীরস্থান, অ‌ধ্যায়-৪/১৩ তথা‌ ৫/২-৪ ) এই মতানুসারে ব্রহ্মাণ্ডে যে সমুদ্র রয়েছে, তা শরীরের ক্ষেত্রে লোকপ্রসিদ্ধ হৃদয় । অত‌ঃ সামুদ্রিক মুক্তা‌ প্রবাল‌ আদি হৃদয়ের জন্য পরম ঔষধ‌ মানা হয়েছে।
◑সমুদ্র‌ এবং হৃদয়ের অনেকতা‌ – ব্রহ্মাণ্ডে তিনটি সমুদ্র রয়েছে -  "ত্রীন্তসমুদ্রান্তসমসৃপৎ স্বর্গান্" (যজুর্বেদ-১৩/৩১) তিনটি সমুদ্র - এক পার্থিব (পৃথিবীস্থানীয়), দ্বিতীয় অন্তরিক্ষস্থ, তৃতীয় দ্যুস্থ (নিঘন্টু, অধ্যায় ৬এ সমুদ্র দ্যুস্থানীয় দেবতাসমূহের মধ্যেও অন্তর্গত)। প্রথমটিতে জল‌ স্থূলরূপে রয়েছে এবং দ্বিতীয়টিতে বাষ্পরূপে রয়েছে। দ্যু এর মধ্যে আপঃ সোম‌ রয়েছে – "আপো‌ বৈ সোমঃ" ( তুলনা - শতপথ ব্রা‌হ্মণ- ৭/১/১/২২ )। প্রথম এবং দ্বিতীয় সমুদ্রের‌ বর্ণন‌ "স ‌উত্তরস্মাদধরং সমুদ্রম্" ( ঋগ্বেদ-১০/৯৮/৫ ) মন্ত্রে স্পষ্ট উল্লেখ রয়েছে। যাস্কীয় নির্বচন‌ এই দুই সমুদ্রকে লক্ষিত করে‌ই করা হয়েছে।  দ্যুলোকস্থ আদিত্য‌ই তৃতীয় সমুদ্র। এর কিরণ‌‌ও পার্থিব জলকে হর‌ণ করে তাকে সূক্ষ্ম সূক্ষ্মতর সূক্ষ্মতম‌ করে অর্থাৎ সোমরূপে পরিণত করে সূর্য পর্যন্ত পৌঁছিয়ে থাকে এবং অগ্নিতে প্রজ্বলিত হয়ে অত্যন্ত সূক্ষ্মরূপে সেই সোম কিরণের দ্বারা পৃথিবীতে ফিরে আসে, যা দ্বারা প্রাণী এবং ঔষধি বনস্পতিসমূহ জীবন‌ ধারণ‌ করে থাকে। বেদে‌ সোমের স্থিতি সূর্যেই বলা হয়েছে – "সোমো‌ গৌরী অধিশ্রিতঃ" (ঋগ্বেদ-৯/১২/৩)। গৌর‌ আদিত্যের নাম, তার‌ই স্ত্রীলিঙ্গ গৌরী। যথা সূর্যের‌ সূর্যারূপ । শতপথ ব্রাহ্মণ-৯/৪/২/৫এ বলা হয়েছে — "অসৌ‌ বৈ (দ্যুঃ) লোকঃ সমুদ্রো নভস্বান্"। 'নভ' শব্দের নির্বচন মহর্ষি যাস্ক (নিরুক্ত- ২/১৪) কাণ্ডে ভন‌ (ভা দীপ্তৌ + ক্যুন্) এর আদ্যন্তবিপর্যয় দ্বারা দর্শিয়েছেন। অত‌ঃ নভস্বান্‌ এর অর্থ — দীপ্তিমান্।
"য়দ‌্ ব্রহ্মাণ্ডে তৎপিণ্ডে" অথবা "লোকসম্মিতোऽয়ং পুরুষঃ" অনুসারে ব্রহ্মাণ্ডে আদান-প্রদানকারী তিনটি সমুদ্র রয়েছে, অতঃ এই শরীরে‌ও আদান-প্রদানকারী তিনটি হৃদয় অবশ্যই থাকা উচিত্। তদনুসার শরীরে দ্যু স্থানীয় সমুদ্র‌ মস্তিষ্কান্তর্গত। ইহাই সম্পূর্ণ শরীরে ব্যাপ্ত জ্ঞানতন্তু এবং কর্মতন্তু, যা‌ আদান-প্রদান করতে থাকে। পা কোন কাটার উপর পরতে না পরতে তুরন্ত সরিয়ে নিলে। পা কাটার উপর পরার সংকেত মস্তিষ্কে পৌঁছায় এবং তাৎক্ষণিক মস্তিষ্ক আদেশে পা সরে গেল বা সরিয়ে নিলে। এর সাথে‌ই মস্তিষ্কে‌ হিরণ্যবর্ণ = হালকা পীত‌ বর্ণের দ্রব দ্রব্য‌ রয়েছে  
[দ্র০– পূর্বে লিখিত হিরণ্ময়কোষের ব্যাখান]  
যাকে‌ আর্য়ুবেদে "ওজ‌" বলা হয়েছে 
[দ্র০–হৃদি তিষ্ঠতি যচ্ছুদ্ধং রক্তমীষত্সপীতকম্।  ওজঃ শরীরে সমাখ্যাতং তন্নাশাত্ না বিনশ্যতি। (চরকসংহিতা,সূত্রস্থান-১৭/৭৫) কোথাও-কোথাও সপির্বর্ণম পাঠ রয়েছে। এর তাৎপর্য গো-ঘৃতের বর্ণের সাথে। তাহাই পীতাভ হয়। ওজ বিষয়ে চরকসংহিতা সূত্রস্থান-৩০/১-১৪ শ্লোকাদিও দ্রষ্টব্য।] 
এবং ব্রাহ্মণ গ্রন্থসমূহে ইহাকেই সোমরূপে বর্ণন করা হয়েছে। [দ্র০–এতদ্বৈ দেবানাং পরমন্নং যৎসোমঃ। (তৈত্তিরীয় ব্রাহ্মণ-১/৩/২/২) ব্রহ্মাণ্ডে এই সোমদেব = রশ্মিসমূহের অন্ন। ইহাই জ্বলিত হওয়ায় সূর্য্যে প্রকাশ বা তাপের উৎপত্তি হয়।শরীরে এই সোমই 'ওজ'। ইন্দ্রিয়ের এই অন্নই ভক্ষ্য। এর কারণেই ইন্দ্রিয় বলবান হয়। এই কথনই "সোমঃ সর্বাভ্যো দেবতাভ্যো জুহ্বতি" (শতপথব্রাহ্মণ-১/৬/৩/২১) তেও বলা হয়েছে।] 
ইহা বীর্যরূপ আপঃ এর সূক্ষ্মতমরূপ, যা সুষুম্না নাড়ী দ্বারা মস্তিষ্কে ক্ষরিত হয়। ইহাই ঋগ্বের নবম মণ্ডলে পঠিত পবমান সোম, যার গুণগান সম্পূর্ণ মণ্ডলেই বারংবার করা হয়েছে। ইহাই 'ওজ' বা 'সোম' মস্তিষ্ক হইরে বের হয়ে সম্পূর্ণ শরীরে ব্যাপ্তশীল তন্তুজাল দ্বারা শরীরের সর্বত্র পৌঁছে শরীরকে ওজস্বী বানায়। 'মরণং বিন্দুপাতেন' এর নির্দেশ এই  ওজরূপ অষ্টম ধাতুর জন্যই। 
[দ্র০–পূর্বে দেওয়া চরক সংহিতা সুত্রস্থানের পাঠ]  
লোকপ্রসিদ্ধ হৃদয়েরও এরূপ কার্য্য যে, ইহা শরীর হইতে দূষিত  রক্ত গ্রহণ করে আর শুদ্ধ করে ফিরিয়ে দেয়। এইপ্রকারে শরীর এবং সমুদ্রের একরূপ কার্য্যই। 
[দ্র০–ঋগ্বেদ-৪/৫৮/৫ তথা যজুর্বেদ-১৭/৯৩ মন্ত্রে হৃদ্য সমুদ্র অসংখ্য মার্গে বিদ্যমান নাড়ি, সোমরূপী ঘৃতের ধারার এবং ইহাদের মধ্যে হিরণ্ময় বেতস এর উল্লেখ রয়েছে] 
যেরূপ ব্রহ্মাণ্ডে তিন সমুদ্র রয়েছে, সেরূপ পিণ্ড=শরীরেও তিন সমুদ্র রয়েছে  ১.নাভি, ২.হৃদয় এবং ৩.মস্তিষ্ক।  
নাভির কার্য্য – জঠরাশয় হইতে নিষ্পন্ন রস গ্রহণ করা আর ২৪ মুখ্য ধমনিসমূহ দ্বারা সম্পূর্ণ শরীরে পৌঁছানো।
হৃদয়ের কার্য্য – পূর্বে লিখা হয়েছে।
মস্তিষ্কের কার্য্য – শরীরে ব্যাপ্ত জ্ঞানতন্তুসমূহ দ্বারা শরীরের প্রত্যেক স্থান হইতে জ্ঞানের আহরণ করে মস্তিষ্ক পর্যন্ত পৌঁছানো এবং চেষ্টাবাহক তন্তুসমূহ দ্বারা শরীরাবয়বকে যথাযোগ্য পরিচালনা করানো।
পূর্বে উদ্ধৃত অথর্ব শ্রুতিতে এই দেহপুরী অযোধ্যাকে অষ্টচক্রা বলা হয়েছে। চক্রের অভিপ্রায় ইহাই হয় যে এক স্থান হইতে চলমান হয়ে পুনঃ ওই স্থানেই পৌঁছে যাওয়া। এই ক্রিয়ার সাধন  এই আট শরীরাবয়ব চক্র হৃদয়পদবাচ্যও। এইজন্য শতপথ ব্রাহ্মণ-৯/১/২/৪০ এ বলা হয়েছে – "নিকক্ষে নিকক্ষে হৃদয়ম্"। অর্থাৎ প্রত্যেক কক্ষ=শরীরবিভাগে হৃদয় রয়েছে। এই আট চক্ররূপী হৃদয়ে পূর্বোক্ত নাভি হৃদয় এবং মস্তিষ্করূপী সমুদ্র বা হৃদয় প্রধান।
হৃদয় শব্দের ব্যাখা করা হয়েছে। ইহাকে ব্রহ্মাণ্ডস্থ সমুদ্রের সহিত তুলনাও করা হয়েছে। এ হইতে স্পষ্ট হয়ে যায় যে, পিণ্ডেও ব্রহ্মাণ্ডের ন্যায় তিন সমুদ্র রয়েছে, যাকে শারীরিক পরিভাষায় হৃদয় বলা হয়। পরন্তু যে ব্যক্তি পূর্ব নির্দেশ দ্বারাও নাভি এবং মস্তিষ্ককে হৃদয় শব্দ বাচ্য মানতে রাজি না হয়, তার জন্য প্রাচীন শাস্ত্রপ্রমাণ উপস্থিত করছি। যা দ্বারা নাভি এবং মস্তিষ্ক হৃদয় পদ বাচ্য স্পষ্ট হয়ে যাবে।
নাভির জন্য হৃদয় শব্দের ব্যবহার – সুশ্রুতসংহিতা,সুত্রস্থান, অধ্যায়-১৪ তে এক বচন রয়েছে - 
"উপযুক্তস্যাহারস্য সম্যক পরিণতস্য যঃ তেজোভূতঃ সারঃ স রস ইতি উচ্যতে। তস্য চ হৃদয়ং স্থানম্। স হৃদয়াত্ চতুর্বিংশতিধমনীরনুপ্রবিশ্য......কৃত্স্নং শরীরমহস্তর্পয়তি"।
অর্থাৎ ভক্ষণকৃত আহার হইতে উত্তম প্রকারে উৎপন্ন হওয়া যে তেজরূপ সার, তাকে রস বলা হয়। ইহার স্থান হৃদয়। সেই রস হৃদয় হইতে ২৪ ধমনীতে প্রবিষ্ট হয়ে সম্পূর্ণ শরীরকে প্রতিদিন পুষ্ট করে থাকে।
পচনকৃত আহার হইতে নিষ্পন্ন রসের স্থান নাভি। লোকপ্রসিদ্ধ বক্ষস্থানীয় হৃদয় নয়, এটা সর্বলোকবিদিত। অতঃ এখানে হৃদয় শব্দ নাভি বাচকই। ইহার পক্ষে প্রমাণ সুশ্রুত সংহিতার, শরীরস্থানের নবম অধ্যায়েও পাওয়া যায়। সেখানে বলা হয়েছে-
"চতুর্বিংশত্যো ধমনয়ো নাভিপ্রভবা অভিহিতাঃ তাসাং তু নাভিপ্রভবাণাং ধমনীনাং উর্ধ্বগা দশ, দশ চাধোগামিন্যঃ চতস্রশ্চ তির্যগাঃ"।
অর্থাৎ নাভি হইতে ২৪টি যা বের হয়েছে তাকে ধমনী বলা হয়।.... সেই  নাভি হইতে বের হওয়া ধমনীর মধ্য থেকে দশটি ঊর্ধ্বগামী, দশটি নিম্নগামী বাকি চারটি তির্যক। 
সুশ্রুতকারের বলা 'নাভি হইতে বের হওয়া ২৪টি ধমনির' সংকেত পূর্বোক্ত– 'হৃদয় হইতে বের হওয়া ২৪টি ধমনিকেই সংকেত করে। এই দুই স্থলের তুলনা দ্বারা স্পষ্ট হয়ে যায়। আর সুশ্রুতসংহিতা, সুত্রস্থান অধ্যায়-১৪ ছাড়া কোথাও 'নাভি হইতে বের হওয়া ২৪ ধমনির বর্ণন নেই। 
[দ্র০–তুলনা করো - ধমন্যো নাভিতো জাতাশ্চতুর্বিংশতিসংখ্যয়া। দশোর্ধ্বগা দশাধোগাঃ শেষা নির্যগ্গতাঃ স্মৃতাঃ ॥ ভাবপ্রকাশ পূর্ব খণ্ড গর্ভপ্রকরণ-২৬৪।] 
অতঃ অভিহাতাঃ এর সংকেত উক্ত হৃদয়-পদ-ঘটিত বাক্যের দিকেই, এটা স্পষ্ট। ভিষকপ্রবর গণনাথ সেন "হৃদয়" শব্দকে কেবল লোকপ্রসিদ্ধ অর্থ বাচক না  মেনে ইহার মস্তিষ্ক অর্থও দর্শিয়েছেন। পরন্তু তিনি সুশ্রুত (সুত্র. অ. ১৪) এর প্রথম উদ্ধৃত বচনে হৃদয় শব্দকে লোকপ্রসিদ্ধ বক্ষস্থানীয় অবয়ব বাচক মেনে সুশ্রত সংহিতার উপযুক্ত দুই পাঠের মধ্যে বিরোধ দর্শিয়েছেন। তিনি লিখেছেন– 
"শ্চোক্তিবিরোধশ্চ সংজ্ঞার্থব্যকুলীভাবনিমিত্তঃ সুশ্রুতে। যথা সুত্রস্থানে হৃদয়াচ্চতুর্বিংশতিধমনীরনুপ্রবিশ্য' ইত্যভিধায় পুনঃ শরীরে চতুর্বিংশতির্ধমন্যো নাভিপ্রভবা অভিহিতাঃ ইতি সুচনম্"। প্রত্যক্ষশারীরভাগ-১, উপোদ্-ঘাত পৃষ্ঠা-৬৬ সংস্করণ ২।
যদি গণনাথ সেন জী সুশ্রুত সংহিতার পাঠকে সুক্ষ্মভাবে তুলনা করতেন এবং বিচার করতেন তাহলে এই দুই পাঠের মধ্যে বিরোধ দেখানোর ভুল করতেন না।
মস্তিষ্কের জন্য হৃদয় শব্দের ব্যবহার – আধ্যাত্মিক পরিষায় আদিত্য পদ মস্তিষ্কের বাচক। যজুর্বেদ-৪০/১৭ মন্ত্রে বলা হয়েছে - যোऽসাবাদিত্যে পুরুষঃ সোऽসাবহম্। প্রকরণ আত্মা হওয়ায় এখানে 'অহং' পদবাচ্য আত্মা'ই। এই আত্মারূপী ব্রহ্ম হইতে পরব্রহ্মকে পৃথক দর্শানোর জন্য পরে বলা হয়েছে- 'ও৩ম্ খং ব্রহ্ম্', ও৩ম্ খং = আকাশের ন্যায় সর্বব্যাপক ব্রহ্ম। উক্ত যাজুষ মন্ত্রে উক্ত আধ্যাত্মিক আদিত্যকে শতপথব্রাহ্মণ- ৯/১/৩/৩৪ এ হৃদয় বলা হয়েছে - "অসো বা আদিত্য হৃদয়ম্"। মৈত্রায়ণী আরণ্যক ৬/৩৪ এ হিরণ্যবর্ণ শকুন = পক্ষী = 
[দ্র০– আত্মার জন্য পক্ষী শব্দের প্রয়োগ সন্তদের বাণীতে প্রায়ঃ মিলে। লোকমধ্যেও এই অর্থে প্রসিদ্ধ।] 
আত্মাকে আদিত্যরূপ হৃদয়ে প্রতিষ্ঠিত বলা হয়েছে- "হিরণ্যবর্ণঃ শকুনঃ হৃদি আদিত্যে প্রতিষ্ঠিতঃ"। এই বচনে হৃদ্ (হৃদয়) এবং আদিত্য দুটো পদ'ই উল্লেখ করে সম্পূর্ণ সমস্যারই সমাধান করে দিয়েছে।
অথর্ববেদ-১৯/৯/৫ নং মন্ত্র–
"ইমানি যানি পঞ্চেন্দ্রিয়াণি মনঃষষ্ঠানি  মে হৃদি ব্রহ্মণা সংশ্রিতানি..."।
এই মন্ত্রে মনের সহিত পঞ্চ জ্ঞানেন্দ্রিয়কে ব্রহ্ম = আত্মার সাথে হৃদ্ (হৃদয়) এর মধ্যে স্থিত বলা হয়েছে। 
[দ্র০– তুলনা করো - ষডঙ্গমঙ্গ বিজ্ঞানমিন্দ্রিয়াণ্যর্থপঞ্চকম্। আত্মা চ সগুণশ্চেতঃ চিন্ত্যং চ হৃদি স্থিতম্ চরকসংহিতা সুত্রস্থান-৩০/৪। বিজ্ঞান, ইন্দ্রিয়সমূহ,পঞ্চ অর্থ (রূপ আদি), আত্মা, চেতঃ (মন), চিন্ত্য এই ছয়টি হৃদয়ে স্থিত। এইজন্যই একে হৃদয়াঙ্গ ষডঙ্গ  বলা হয়ে থাকে।] 
এই ইন্দ্রিয়সমূহের স্থান মস্তক। এইসকলের তন্তুসমূহের সম্বদ্ধ মস্তিষ্ক = ব্রহ্মরন্ধ্র বা ব্রহ্মগুহার সাথে সর্ববাদীসম্মত। সেই ইন্দ্রিসমূহের স্থান এই বচনে হৃদ্ (হৃদয়) বলা হয়েছে এবং সেখানেই আত্মার নিবাস বলা হয়।
নিরুক্ত-৪/১৩ খণ্ডে ইন্দ্রিয়সমূকে মস্তকে সমাশ্রিত বলা হয়েছে – "ইদমপি ইতরচ্ছির এতস্মাদেব। সমাশ্রিতান্যেতদিন্দ্রিয়াণি ভবন্তি"। ঋগ্বেদ-১/১৬৪/২১ মন্ত্রে "যত্রা সুপর্ণাঃ.. " মন্ত্রের ব্যাখ্যান মহর্ষি যাস্ক আধিদৈবিক এবং আধ্যাত্মিক দুই পক্ষেই করেছেন। অধিদৈবতে সুপর্ণ আদিত্যের রশ্মিসমূহ, এর গোপা = রক্ষম আদিত্য। আধ্যাত্মে সুপর্ণ ইন্দ্রিয়সমূহ, এর গোপা আত্মা। [দ্র০– নিরুক্ত-৩/১২] এর ব্যাখায় দুর্গাচার্য লিখেছেন-  "অধ্যাত্মেऽপি হৃদ্যাকাশাত্ যানি ইন্দ্রিয়াণি প্রসর্পন্তি, ত এব রশ্ময়ঃ"। অর্থাৎ আধ্যাত্মিক অর্থে হৃদ্ (হৃদয়) আকাশে যে ইন্দ্রিয়সমূহ গতি করে, তা সেই রশ্মিসমূহ। অধিদৈবত অর্থে রশ্মিসমূহের প্রসরণের স্থান আদিত্য। অতঃ আধ্যাত্মে ইন্দ্রিয়সমূহের প্রসরণের স্থান হৃদয়রূপী আদিত্য = মস্তিষ্ক'ই এটি স্পষ্ট।
             "আয়ুর্বেদোক্ত চেতনাস্থানীয় হৃদয়"
চরকসংহিতা, সুত্রস্থানের ১৭নং অধ্যায়ে স্পষ্ট বলা হয়েছে–
প্রাণাঃ প্রাণমৃতাং যত্র শ্রিতাঃ সর্বেন্দ্রিয়াণি চ।
যদুত্তমমঙ্গমঙ্গানাং          শিরস্তদভিধীয়তে॥
অর্থাৎ ইন্দ্রিয়সমূহের স্থিতি মস্তকে। ইহাকেই আধ্যাত্মবিদ্ "হৃদয়" বলে। চরকসংহিতা, সুত্রস্থান-৩০/৭ শ্লোকে বলা হয়েছে- "তৎপরমমোজসঃ স্থানং যত্র চৈতন্যসংগ্রহঃ"। এখানে যেখানে চৈতন্যের স্থিতি বলা হয়েছে , তাকে পরম 'ওজ' এর স্থান বলা হয়েছে। এই পরম 'ওজ'ই সেই গোঘৃতবর্ণ ঈষত্পীতক [দ্র০–হৃদি তিষ্ঠতি যচ্ছুদ্ধং......পূর্বে লিখিত টিপ্পনী] দ্রব দ্রব্য, যা ব্রহ্মগুহায় বিদ্যমান থাকে। অতঃ উক্ত বচন অনুসারে মস্তিষ্কই আত্মার নিবাস্থান। "হৃদয়ে চিত্তসংবিত্" (যোগদর্শন-৩/৩৪) এই যোগসূত্রে তদা তদ্ (হৃদয়ং) বিশেষণ 'চেতনাস্থানম' এই সুশ্রুত (শারীর০-৪/৩১) বচনে ওজ এর স্থানরূপ হৃদয়ে চেতনার স্থিতি বলা হয়েছে। চরক নিদানস্থান ৮/৩ এ বলা হয়েছে- "আত্মনঃ শ্রেষ্ঠমায়তনং হৃদয়ম্"।
এইপ্রকার উপযুক্ত চরক, সুশ্রুত এর বচন মিলিয়ে বিচার করলে বিদিত হয় যে, আত্মার নিবাস্থান হৃদয় লোকপ্রসিদ্ধ হৃদয় নয়। 
সুশ্রুত (শারীরস্থান, অ০-৪) এ স্পষ্ট বলা হয়েছে–
পুণ্ডরীকেণ সদৃশং হৃদয়ং স্বাদধোমুখম্।
জাগ্রতস্তদ্বিকসতি স্বপতশ্চ  নিমীলতি॥
অর্থাৎ হৃদয় কমলের ন্যায় অধোমুখ। জাগ্রত অবস্থায় তা বিকসিত এবং নিদ্রাবস্থায় তা সংকুচিত হয়।
এই সুশ্রুত বচনে হৃদয়ের যে অবস্থাভেদে সংকোচ-বিকাস ধর্ম বলা হয়েছে, তা লোকপ্রসিদ্ধ বক্ষস্থানীয় অবয়বের নয়, কেননা তা তো জাগ্রত বা স্বপ্নাবস্থা দুই অবস্থায়ই একরকম থাকে। মস্তিষ্কের এই দুই ধর্ম হয়ে থাকে। স্বপ্নাবস্থায় কমলের ন্যায় সংকুচিত হওয়ায় ইন্দ্রিয়সমূহ বাহ্যমুখী থাকেনা, তা একপ্রকার বন্ধের ন্যায় হয়ে হয়ে যায়। এ থেকে স্পষ্ট যে এখানে হৃদয় শব্দ মস্তিষ্ক এরই বাচক। এখন এই বিষয়ে আয়ুর্বেদী শল্যতন্ত্রের পুনরুদ্ধারক ভিষকপ্রবর গণনাথ সেনজীর সম্মতি উদ্ধৃত করছি। গণনাথ সেনজীর স্ববিরচিত 'প্রত্যক্ষ শারীর' এর নাড়ীখণ্ডের প্রথম পৃষ্ঠায় "তত্র সাঙ্গোপাঙ্গ মস্তিষ্কং সহস্রদল্পদ্মসদৃশত্বাত্ সহস্রাকারমিতি মন্যন্তে যোগিনঃ"  এই পাদ টিপ্পনীতে লিখেছেন – 
"যত্ত বৈদ্যকে - বুদ্ধ নিবাসং হৃদয়ং প্রদুষ্য" (চরক) ইত্যাদি বিরুদ্ধপ্রায়বচনম্ তন্মস্তিষ্কমুলস্থিতাজ্ঞাচক্রাশভূতব্রহ্মহৃদয়াভিপ্রায়েণ। যোগিনো হি ষট্চক্রমুপকম্য এতত্পদমান্তরালে নিবসতি চ মনঃ সূক্ষরূপং প্রসিদ্ধম্ ইতি স্পষ্টমাহুঃ ; ন চ মনোবিরহিতা বুদ্ধিরস্তি। শ্রুতিশ্চ – 'হৃদয়ং চেতনাস্থানম' 
[দ্র০–তদ্ হৃদয়ং বিশেষেণ চেতনাস্থানম (সুশ্রুত. শারীর. - ৪/৩১)] 
ইত্যাদি প্রাচীনবচনম্। তদপি তবভিপ্রায়কমেব। "জাগ্রতস্তদ্বিকসতি" [দ্র০– সুশ্রুত. শারীর. অধ্যায়-৪] ইত্যাদি নির্দেশাত্ ইতি বিক। ন চ মাংসময়মেব হৃদয়যন্ত্র তদিতি বাচ্যম্? তদ্ধি ন কথমপি তাবৃগ্লক্ষণাবিধেয়ং ভবিতুভর্হতি, অসম্ভবাত্। তবেতদখিলমস্মদীয়ে শারীরমীমাংসাখ্যে গ্রন্থে বিস্তরেয় স্ফুটীকৃতং দ্রষ্টব্যম্।
অর্থাৎ সকল প্রকার জ্ঞানের স্থান মস্তিষ্ক। ইহা বৈদ্যক এর 'বুদ্ধির নিবাস্থান হৃদয়কে দূষিত করে' এই বচনের বিরুদ্ধ নয়। বৈদ্যক-বচনে হৃদয় শব্দ দ্বারা মস্তিষ্কের মূলে স্থিত আজ্ঞাচক্র (আজ্ঞাকন্দ) এর অংশরূপ ব্রহ্ম-হৃদয় অভিপ্রেত। যোগীলোক ষট্ চক্রের নিরূপণ প্রসঙ্গে মস্তিষ্কের মূলে অবস্থিত আজ্ঞাচক্রের বর্ণন করে 'এই পদম এর ভিতর সূক্ষরূপ মন নিবাস করে' এরূপ বলেছেন। মনরহিত বুদ্ধি রয়না। উপনিষদেও – "এই হৃদয়ের মধ্যে যে আকাশ রয়েছে সেথায় মনোময় পুরুষের নিবাস" এরূপ বলা হয়েছে। সুশ্রুতাচার্য যে 'হৃদয়' চেতনার স্থান, ইত্যাদি প্রাচীন আচার্য্যের মত উদ্ধৃত করেছেন তাও এই অভিপ্রায়ার্থক (অর্থাৎ সেখানেও মস্তিষ্কাবয়বভূত ব্রহ্ম'ই অভিপ্রেত)। কেননা উহার জন্য সুশ্রত সংহিতায় "তা জাগ্রত অবস্থায় বিকসিত হয় এবং স্বপ্নাবস্থায় সংকুচিত হয়" এরূপ বলা হয়েছে। মাংসময় হৃদয়-যন্ত্রই অহাং অভিপ্রেত এরূপ বলা যাবেনা। কেননা তাতে উক্ত লক্ষণ সম্ভব নয় (অর্থাৎ তাহাতে জাগ্রত অবস্থায় বিকসিত হওয়া বা নিদ্রাবস্থায় সংকুচিত হওয়ার লক্ষণ পাওয়া যায়না। তা তো দুই অবস্থাতেই সমানরূপে কার্য্য করে॥
                  "উপনিষদ্-বচনের মীমাংসা"
এখন বাকি রয়ে যায় তৈত্তিরীয় উপনিষদের এক বচন, যেটাকে বক্ষস্থানীয় হৃদয়রূপী অবয়বে আত্মার নিবাস মান্যকারী সজ্জন উপস্থিত করে থাকে। সেই বচন এইপ্রকার–
"স য এষোহন্তহৃদয় আকাশঃ তস্মিন্নয়ং পুরুষো মনোময়ঃ অমৃতো হিরন্ময়ঃ। অন্তরেণ তালুকে য এষ স্তন ইবাবলম্বতে স ইন্দ্রযোনিঃ। যত্রাসৌ কেশান্তো বিবর্ততে ব্যপোহা শীর্ষকপালে ভূরিত্যগ্নৌ প্রতিতিষ্ঠতি"।
 (তৈত্তিরীয় উপনিষদ-১/৬/১)
অর্থাৎ হৃদয়ের মধ্যে যে আকাশ রয়েছে, তাতে মনোময় (বিজ্ঞানময়) নাশরহিত হিরণ্ময় (জ্যোতি দ্বারা আবৃত) পুরুষ থাকে। যে তালুদ্বয়ের মধ্যে স্তনের ন্যায় লটকে আছে। তা ইন্দ্রের (জীব) যোনি (নিবাস্থান)। যেখানে সে কেশদ্বয় শীর্ষকপালকে ভেদ করে মূলবিভাগে থাকে অর্থাদি মূর্ধপ্রদেশে। 
[দ্র০– তৈত্তিরীয় উপনিষদ শাঙ্করভাষ্য (দশোপনিষদ্ শাঙ্করভাষ্য) বানারস হিতচিন্তক মুদ্রালয় হইতে মুদ্রিত ২৬৭ নং পৃষ্ঠায় উপনিষদের - "কেশান্তঃ" পদের টিপ্পনী – কেশান্তঃ মুর্ধানমারভ্যোপরিষ্টাদ্ দশাঙ্গুলপরিমিতো দেশঃ। তুলনা করুন–"অত্যতিষ্ঠদ্ দশাঙ্গুলম্" (যজুর্বেদ-৩১/১)]  
এই বচনে হৃদয়ে 'হৃদয়ে পুরুষের নিবাস' বলে পরের বাক্যেই 'তালু হইতে কপালের শীর্ষপর্যন্ত ভাগকে ইন্দ্রের ঘর বলা হয়েছে। এই ব্যাখা হইতে স্পষ্ট হয় যে এখানে হৃদয় শব্দ বক্ষস্থানীয় অবয়বের বাচক নয়। ইন্দ্র জীববাচক, এটি পাণিনি মুনি "ইন্দ্রিয়মিন্দ্রদৃষ্টম্" (৫/২/৯৩) সুত্রে স্পষ্ট বলেছেন।
এইসকল প্রমাণ দ্বারা স্পষ্ট যে হৃদয় শব্দ মস্তিষ্কেরও বাচক, কেবল বক্ষস্থানীয় মাংসময় অবয়বের নয়। "অঙ্গুষ্ঠমাত্রঃ পুরুষঃ সদা জনানাং হৃদয়ে সন্নিবিষ্টঃ" (কঠোপ০-৬/১৭) ইত্যাদি প্রমাণ দ্বারা লোকপ্রসিদ্ধ হৃদয় অবয়বকে আত্মার নিবাসস্থান মানা কেবল অনুচিত নয় অপিতু বেদ এবং শরীরবিজ্ঞানের বিপরীত। এইজন্য উক্ত কঠাদি উপনিষদেও হৃদয় শব্দের অর্থ মস্তিষ্কান্তর্গত আজ্ঞাকন্দের মধ্যে বর্তমান 'ব্রহ্মগুহা' [দ্র০–আজ্ঞাকন্দের আকৃতি মনুষ্যের অঙ্গুষ্ঠের সাথে মিলে, দ্র.-প্রত্যক্ষ শারীরভাগ-৩ পৃষ্ঠা-৮৫ সংখ্যা-২২১] করা'ই উচিত।
এখন বাকি থাকে তৃতীয় মত – জীবাত্মা সুষুম্নাতে নিবাস করে। এই প্রসিদ্ধির মুল কারণ এটাই যে, সুষুম্নার শীর্ষভাগ ব্রহ্মগুহার সহিত সম্বদ্ধ। এইজন্য ব্রহ্মগুহায় যে জল রয়েছে, তাকে শারীর পরিভাষায় 'মস্তিষ্কসুষুম্নান্তরীয় জল' [দ্র০– প্রত্যক্ষ শারীরভাগ-৩ পৃষ্টা-৮৩] সংজ্ঞায় বলা হয়। ইহাই ওজরূপ অষ্টম ধাতু, যার দ্বারা দেহ ওজস্বী হয়। এই জলেই আত্মার নিবাস। অতঃ সুষুম্না নাড়ীর সহিত সম্বন্ধ আত্মার নিবাস সুষুম্নায় মানা হয়।
এরূপ বৈদিক বচনসমূহ বিচার করলে স্পষ্ট হয়ে যায় যে লোকপ্রসিদ্ধ হৃদয় বা সুষুম্না নাড়ী এই দুটির কোনটিই মূলত আত্মার নিবাসস্থান নয়। আত্মার নিবাস বস্তুত মস্তিষ্কান্তর্গত আজ্ঞাচক্রের (কন্দের) মধ্যে ব্রহ্মগুহায়। বেদে আত্মনিবাস্থান নিয়ে যে বর্ণন রয়েছে, তা শরীরের অন্য কোন অবয়বের সাথে মিলবেই না। অতঃ বেদের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী আত্মার নিবাসস্থান ব্রহ্মগুহা প্রমাণিত হয়। উপনিষদ বচনের অভিপ্রায়ও তাহাই। বৈদিক বাঙ্ময়ে মস্তিষ্ককেও হৃদয় বলা হয়।  সুষুম্না নাড়ীর মূল সম্বন্ধও সেখানেই। অতঃ লোকপ্রসিদ্ধতারও এই অর্থে অনুগমন হয়ে যায়।
মূল লেখক : পণ্ডিত যুধিষ্ঠির মীমাংসক                         
ভাষান্তর : অমৃতস্য পুত্রাঃ
 আর্য প্রতিনিধি সভা বাংলাদেশ 

Post a Comment

0Comments

Please Select Embedded Mode To show the Comment System.*