বেদ মন্ত্রের অর্থ অনুসন্ধানে সমকক্ষবাদ

0

বেদ মন্ত্রের অর্থ অনুসন্ধানে সমকক্ষবাদ

 সমকক্ষবাদ

সমকক্ষবাদ- উপনিষদে বলা হয়েছে - "অনন্তা বৈ বেদাঃ" স্কন্দ আদি ভাষ্যকারগণও বেদমন্ত্রের আধিভৌতিক, আধিদৈবিক, আধ্যাত্মিক তিন অর্থ বলেছেন। বস্তুতঃ এই তিন অর্থই কেন, বেদের একটি মন্ত্রেরই অনন্ত অর্থ হতে পাড়ে, পরন্তু এই সকল অর্থসমূহে এক ব্যবস্থা কাজ করছে। সত্যি বলতে পুরুষ-সূক্ত হলো বেদের চাবকাঠি। এই ব্রহ্মাণ্ডে যে সূর্য, চন্দ্রাদি দেব রয়েছে, তাদের কল্পনা মনুষ্য শরীরেতে করে তারপর সেসবের প্রতিনিধি মানব-সমাজে অন্বেষণ করা, এটিই পুরুষ-সূক্তের মূলতত্ত্ব। বিষয় হচ্ছে যে এই জগতে যতপ্রকারের যন্ত্র বিজ্ঞান দ্বারা প্রযুক্তি তৈরি করা সম্ভব, সে সমস্ত কিছু মানুষের কোনো না কোনো ইন্দ্রিয়ের সহায়তার জন্যই হয়ে থাকে, সেসকল যন্ত্রে প্রাণ, চিন্তন, মননাদি শক্তিসমূহ থাকে না, এজন্য সেগুলো মানুষের থেকে কিছু কমই কাজ করবে, অধিক করতে পাড়বে না। হ্যাঁ, মাত্রাতে সেসব মনুষ্য-শক্তির বহুগুণ বেশি করতে পাড়বে। সুতরাং, আমরা যেই বিদ্যারই অন্বেষণ করতে চাই সেটাকে একজন পুরুষ কল্পনা করে পুরুষের অঙ্গ তাতে অন্বেষণ করে উৎপন্ন করে দেওয়া যাবে। তাই অগ্নি সোমাদি যেসকল দেবতা ব্রহ্মাণ্ডে আছে তা মনুষ্য দেহেও আছে। তাদেরকেই আমাদের সর্বত্র উৎপন্ন করে দিতে হবে। উদাহরণের জন্য, আমি অগ্নি তথা সোম কে নিচ্ছি। 

শতপথ ব্রাহ্মণে বলা হয়েছে -

দ্বয়ং বা ইদং ন তৃতীয়মস্তি আদ্রং চৈব শুষ্কঞ্চ যচ্ছুষ্কং তদাগ্নেয়ং যদাদ্রং তৎ সৌম্যম্।। - শত০ ১/৬/৩/২৩

তারপর পরবর্তী কণ্ডিকাতেই বলা হয়েছে -

সূর্য্য এবাগ্নেয়ঃ চন্দ্রমাঃ সৌম্যোহহরেবাগ্নেয়ং রাত্রিঃ সৌম্যা। 

এ দ্বারা স্পষ্ট হয় যে, ব্রহ্মাণ্ডে সূর্যের উদয় হলে পড়ে যে শুষ্কতা আসে, তাহা আগ্নেয়। চন্দ্রোদয় হলে পড়ে, যে আদ্রতা আসে তাহা সোম্য। যেখানে শুষ্কতা রয়েছে সেখানে অগ্নি রয়েছে, যেখানে আদ্রতা রয়েছে সেখানে সোম আছে। সুতরাং এই ব্রহ্মাণ্ড আদ্র তথা শুষ্ক এই দুইয়ে বিভক্ত রয়েছে। তৃতীয় কোনোটিতে নয়। এখন রুটিতে আটা আগ্নেয় আর জল বা ঘৃত হলো সৌম্য। শরীরে পিত্ত আগ্নেয়, কফ সৌম্য, একারণে সুশ্রত সংহিতাতে মানব-শরীরকে অগ্নীষোমীয় বলা হয়েছে। ঐতরেয়-ব্রাহ্মণ অধ্যায় ৬, খণ্ড ৩ তে আছে -- 

নাগ্নীষোমীয়স্য পশোরশ্নীয়াৎ পুরুষস্য বা এষোহশ্নাতি যোহগ্নীষোমীয়স্য পশোরশ্নাতি।। 

এভাবে চরক-সংহিতা শরীর-স্থান পঞ্চমাধ্যায়ের আরম্ভ এই প্রকার হয়েছে - 

পুরুষোহয়ং লোক-সম্মৃিতঃ।..... তস্য পুরুষস্য পৃথিবী মূর্ত্তিঃ আপঃ ক্লেদঃ তেজোহভিসন্তাপঃ বায়ুঃ প্রাণঃ বিয়ৎসুষিরাণি, ব্রহ্মান্তরাত্মা, যথা খলু ব্রাহ্মী বিভূতির্লোকে তথা পুরুষেহন্তরাত্মনো বিভূতিঃ ব্রহ্মণো বিভূতির্লোকে প্রজাপতিরন্তরাত্মনো বিভূতিঃ পুরুষে সত্ত্বম্। যস্ত্বিন্দ্রো লোকে স পুরুষেহহঙ্কারঃ আদিত্যস্ত্বাদানং রূদ্রো রোষঃ সোমঃ প্রসাদঃ।। 

এভাবে সূত্র-স্থান অধ্যায় ৬ তে লেখা আছে - 

বিসর্গঃ সৌম্যঃ। আদানম্ পুনরাগ্নেয়ম্।।

এভাবে আমরা দেখলাম যে দিন, রাত, সূর্য, চন্দ্র, গ্রীষ্ম, বর্ষা, কফ, পিত্ত এই সবগুলোকে অগ্নি তথা সোম বলা হয়েছে, কিন্তু এতে এতটুকু স্পষ্ট যে একটি ক্ষেত্রে অগ্নির একটিই অর্থ হবে আর তাহাতে এই নিয়মই প্রযোজ্য হবে যে -

যদৈব শুষ্কং তদাগ্নেয়ং যদাদ্রং তৎ সৌম্যম্।।

এভাবে লোকসমাজে অগ্নি হলো অগ্নি, জল সোম; আকাশে সূর্য অগ্নি, চন্দ্র সোম। এমনটা নয় যে চন্দ্রের নাম অগ্নি হয়ে যাবে। শরীরেতে পিত্ত অগ্নি তো কফ সোম। আমরা শুষ্কম ও আদ্রম - এর নিয়মানুসারে যখন কোনো এক ক্ষেত্রে অগ্নি এবং সোমের অর্থ অনুধাবন করে নেই তো অন্য সকল ক্ষেত্রে তাদের সমকক্ষ অগ্নি ও সোম বলা হবে। এরই নাম সমকক্ষবাদ। এভাবেই যদি আমরা বেদের কোনো এক ক্ষেত্রতে অর্থ ঠিক-ঠিক ভাবে জেনে যাই তবে প্রতি ক্ষেত্রে সেই শব্দসমূহের অর্থ জানতে সুগম হবে। এই কথনকে আমরা মানচিত্রের দৃষ্টান্ত দিয়ে উত্তমরূপে বোঝতে পাড়ি। আমরা একটি মানচিত্রের ছোট বড় অনেক মানচিত্র তৈরি করতে পাড়ি, কিন্তু তার প্রতিটিতে কলকাতা থেকে দিল্লীর দূরত্বের অনুমান সদা এক থাকবে। 

সমকক্ষবাদের একটি সুন্দর উদাহরণ শতপথ-ব্রাহ্মণে ক্রতু, দক্ষ শব্দের ব্যাখাতে দেখা যায় -

ক্রতুদক্ষৌ হ বা অস্য মিত্রাবরুণৌ। এতন্ন্বধ্যাত্মং স যদেব মনসা কাময়ত ইদং মে স্যাদিদং কুর্বীয়েতি স এব ক্রতুরথ যদস্মৈ তৎ সমৃধ্যতে স দক্ষো মিত্র এব ক্রতুর্বরুণো দক্ষো ব্রহ্মৈব মিত্রঃ ক্ষত্রং বরুণোহভিগন্তৈব ব্রহ্ম কর্ত্তা ক্ষত্রিয়ঃ। 

ক্রতু ও দক্ষের অর্থ হলো মিত্র এবং বরুণ। নিজের অন্তরে দেখলে পড়ে এর অর্থ হবে যে, যা মনে চিন্তা করা হয় - আমার এটা প্রাপ্ত হোক এবং তার জন্য আমি এটা করব তাহা ক্রতু আর যখন তার সেই সংকল্প ফল-সমৃদ্ধ হয় তখন সেটিকে দক্ষ বলা হয় (দক্ষ সমৃদ্ধৌ) মিত্র ক্রতু, বরুণ দক্ষ। ব্রাহ্মণ হলো মিত্র, ক্ষত্রিয় বরুণ, কারণ মার্গদর্শক বিধান প্রণয়নকারী হলো ব্রাহ্মণ, যে সম্মুখে চলে, সে ব্রহ্ম। সেই কার্য সম্পাদক হলো ক্ষত্রিয়। 

এই মিত্র-বরুণ কে প্রথম কাণ্ডে - 

"প্রাণোদানৌ বৈ মিত্রাবরুণৌ" - শত০ ১/৮/৩/৭২

এই প্রকার আধিদৈবিক পক্ষে যে প্রাণ ও উদান আছে তাহাই অধিরাষ্ট্র পক্ষতে ব্রাহ্মণ ও ক্ষত্রিয় এবং তাহাই অধ্যাত্ম-ক্ষেত্রে সংকল্প তথা প্রযন্ত। এই তিন ক্ষেত্রতে এদের নাম ক্রতু-দক্ষ অথবা মিত্র-বরুণ। তাই, মিত্র তথা বরুণ একটি ক্ষেত্রে একই থাকে, কিন্তু ক্ষেত্র ভেদে তা সংকল্প তথা প্রযন্ত, ব্রাহ্মণ তথা ক্ষত্রিয়, প্রাণ তথা উদান এই তিন। হ্যাঁ, তাতে সমকক্ষ-ভাব রয়েছে, একজন অভিগন্তা, অন্যজন কর্ত্তা। 

একইভাবে, ছান্দোগ্য উপনিষদ দ্বিতীয়াধ্যায় দশম হতে একুশ নং খণ্ড পর্যন্ত হিঙকার, প্রস্তাব, উদগীথ, প্রতিহার এবং নিধন এই পঞ্চ সংগীতের অঙ্গগুলোকে ভিন্ন-ভিন্ন ক্ষেত্রে সমকক্ষবাদের আধারে দেখানো হয়েছে। 

সংগীতের শুরুতে যে রাগ- এর মনে মনে আস্বাদন করা হয়, মনে মনে গুণগুণ করা হয় তা হিঙকার। রাগের স্থায়ী হলো প্রস্তাব, তান অলাপের ফৈলাব হলো উদগীথ, ধীরে ধীরে সমাপ্তির পর্যায়ে নেমে আসার নাম প্রতিহার এবং সুন্দর সমাপ্তির নাম নিধন। এই পঞ্চ অঙ্গ মানসিক ক্ষেত্রতে অগ্নি-প্রজ্বালন, স্ত্রী-সহবাস, সূর্যোদয়, মেঘ-বৃষ্টি, ঋতুপরিবর্তন, দ্যৌঃ-পৃথিবী, পশুমণ্ডল, শরীর-রচনা, চন্দ্রোদয়, অগ্নি-বায়ু, আদিত্যাদি দেব-মণ্ডল এই ১১ টি ক্ষেত্রে দেখানো হয়েছে। এই প্রকরণগুলো থেকে সমকক্ষবাদ একদম স্পষ্ট হয়ে যায়। বেদে যে অনন্ত বিদ্যার উৎস রয়েছে তাহার এটাই রহস্য। আমরা যদি সমাজ-শাস্ত্রে অগ্নি সোম ইন্দ্র প্রভৃতির অর্থ ঠিক-ঠিক প্রকারে অনুধাবন করে নেই তাহলে যন্ত্র-বিদ্যাতে তার সমকক্ষ কি তা অবগত হয়ে, যন্ত্র-বিদ্যাও সেই সকল মন্ত্র দ্বারা জানা সম্ভব। এই বচন যৌগিকবাদের আধারেই দাঁড়িয়ে থাকতে পারে। যদি আমরা জেনে নেই যে, অগ্নি অর্থ অগ্রণী, তাহলে তো এইসব অর্থ ঠিকভাবে বোঝা যেতে পাড়ে, পড়ন্তু যদি আমরা অগ্নির রূঢ় অর্থ অঙ্গার দ্বারা প্রজ্জলনকারী অগ্নি গ্রহণ করি তবে আমরা বেদের রহস্য কিছুই জানতে পাড়ব না, ইহা সমকক্ষবাদই, যাহার আলোকে বেদকে সমস্ত বিদ্যার বীজরূপ জ্ঞানদাতা বলা হয়।।

🖋️অভিজিৎ রায়

আর্য প্রতিনিধি সভা বাংলাদেশ 

Post a Comment

0Comments

Please Select Embedded Mode To show the Comment System.*