. 📚ব্রহ্মা-সরস্বতীর পৌরাণিক কাহিনী কি সত্য?📚
পৌরাণিক সনাতনীদের মান্য প্রচলিত পুরাণে - অশ্লীলতাপূর্ণ অনেক মিথ্যা লীলাকাহিনির উল্লেখ দেখা যায়। যা দ্বারা আমাদের পূর্বপুরুষ ঋষি-মহর্ষি আদি বিভিন্ন মহাপুরুষদের চরিত্রহীন প্রমাণ করার চেষ্টা করা হয়েছে। ইহার ন্যায় ব্রহ্মা ও সরস্বতীকে নিয়ে পুরাণে একটি অশ্লীল কাহিনী রয়েছে। কাহিনীটি নিম্নরূপ -
শ্রীল প্রভুপাদ ভাষ্যম্, শ্রীমদ্ভাগবত পুরাণ -৩/১২/২৮-৩৩
বাচং দুহিতরং তন্বীং স্বয়ম্ভূর্হরতীং মনঃ ।
অকামাং চকমে ক্ষত্তঃ সকাম ইতি নঃ শ্রুতম্ ॥ ২৮
অনুবাদ : হে বিদুর! আমরা শুনেছি যে, ব্রহ্মার বাক্ নাম্নী এক কন্যা ছিলেন, যিনি তাঁর শরীর থেকে উৎপন্ন হয়েছিলেন। ব্রহ্মা কামে উন্মত্ত হয়ে তাঁকে অভিলাষ করেছিলেন, কিন্তু সেই কন্যা নির্বিকারা ছিলেন।
অনুবাদ : মরীচি প্রমুখ ব্রহ্মার পুত্রেরা এইভাবে তাঁদের পিতাকে বিভ্রান্ত হয়ে অনৈতিক আচরণ করতে দেখে, গভীর শ্রদ্ধা সহকারে তাঁকে বললেন।
অনুবাদ : হে পিতা! এই প্রকার কর্ম যার ফলে আপনি নিজেকে সমস্যাগ্রস্ত করছেন, তা পূর্বে কোন ব্রহ্মা কখনও করেননি, অন্য কেউ করেনি, অথবা পূর্ব কল্পে আপনিও করেননি, এবং ভবিষ্যতেও কেউ তা করতে সাহস করবে না। এই ব্রহ্মাণ্ডে আপনি হচ্ছেন সর্বশ্রেষ্ঠ প্রাণী, তাহলে কিভাবে আপনি আপনার কন্যার সঙ্গে যৌন সম্পর্কে লিপ্ত হতে চান, এবং আপনার সেই বাসনাকে সংযত করতে পারেন না?
তেজীয়সামপি হোতন্ন সুশ্লোক্যং জগদ্গুরো ।
যদ্বৃত্তমনুতিষ্ঠন্ বৈ লোকঃ ক্ষেমায় কল্পতে॥ ৩১
অনুবাদ : আপনি যদিও সবচাইতে শক্তিশালী ব্যক্তি, তবুও এই আচরণ আপনার শোভা পায় না কেননা পারমার্থিক উন্নতি সাধনের জন্য জনগণ আপনার চরিত্রের অনুসরণ করে।
তস্মৈ নমো ভগবতে য ইদং স্বেন রোচিষা ।
আত্মস্থং ব্যঞ্জয়ামাস স ধৰ্মং পাতুমর্হতি॥ ৩২
অনুবাদ : আমরা পরমেশ্বর ভগবানকে আমাদের সশ্রদ্ধ প্রণতি নিবেদন করি, যিনি আত্মস্থ হওয়া সত্ত্বেও তাঁর স্বীয় জ্যোতির দ্বারা এই জগৎ সৃষ্টি করেছেন। সর্বাঙ্গীণ কল্যাণের জন্য তিনি যেন দয়া করে ধর্মকে রক্ষা করেন।
স ইথং গৃণতঃ পুত্ৰান্ পুরো দৃষ্ট্বা প্রজাপতীন্ ।
প্রজাপতিপতিস্তম্বং তত্যাজ ব্রীড়িতস্তদা ।
তাং দিশো জগৃহুর্ঘোরাং নীহারং যদ্বিদুত্তমঃ॥ ৩৩
অনুবাদ : প্রজাপতিদের পিতা ব্রহ্মা তাঁর পুত্র সমস্ত প্রজাপতিদের এইভাবে বলতে দেখে অত্যন্ত লজ্জিত হয়েছিলেন এবং তৎক্ষণাৎ তিনি তাঁর শরীর ত্যাগ করেছিলেন। তাঁর সেই শরীর তখন সর্বদিকে অন্ধকারে ভয়ঙ্কর কুটিকারূপে প্রকাশিত হয়েছিল।
- এই কল্পিত কাহিনীটির উল্লেখ অন্য পুরাণেও পাওয়া যায়। ইসকনের অনেক ভক্তই দাবী করেন যে, এই কাহিনীটিতে শ্রীল প্রভুপাদ কোন শরীরধারী ব্রহ্মাকে বুঝায়নি এবং কোন শরীরধারী সরস্বতীকে বুঝায়নি। কিন্তু আমায় মনে হয়, যারা এরূপ বলে তাদের কেহ প্রভুপাদ ভাষ্য না পড়েই অন্ধভক্তি প্রকাশ করে। প্রভুপাদ তাৎপর্যে খুব ভালোভাবেই তাদের দুজনকে শরীরধারী উল্লেখ করে তাৎপর্য লিখেছেন। এই অশ্লীল কাহিনীটি মূলত ঐতরেয় ব্রাহ্মণ- তৃতীয় পঞ্চিকা/ত্রয়স্ত্রিংশ এবং চতুস্ত্রিংশ খণ্ডের কণ্ডিকাসমূহেরই বিকৃত করা মনগড়া কাহিনী। ত্রয়োত্রিংশ খণ্ডের কণ্ডিকা নিম্নরূপ -
🔸প্রজাপতির্বৈ স্বাং দুহিতরমভ্যধ্যায়ত্, দিবমিত্যন্য আহুঃ, উষসমিত্যন্যে, তামৃশ্যো ভূত্বা রোহিতম্ ভূতামভৈত্, তং দেবা অপশ্যন্। অকৃতং বৈ প্রজাপতিঃ করোতীতি তে তমেচ্ছন্, য এনমারিষ্যত্যেতমন্যোন্যস্মিন্নাবিন্দন্, তেষাম্ যা এব ঘোরতমাস্তন্ব আসংস্তা একধা সমবরন্, তা সম্ভৃতা এষ দেবোऽভবত্ তদস্যৈতদ্ ভূতবন্নাম্।। (ঐ০ ব্রা০-৩/৩৩/১)
আচার্য সায়ণ উক্ত কণ্ডিকার ভাষ্য প্রায় উপরে দেওয়া পুরাণের কাহিনীর ন্যায়ই করেছেন।
ব্রাহ্মণ গ্রন্থ সম্পর্কে পণ্ডিত ভগবদ্দত্ত (Research Scholar) লিখেছেন -
ব্রাহ্মণ গ্রন্থের প্রধান বিষয় আধিদৈবিক তত্ত্বের বর্ণন করা। আধিদৈবিক তত্ত্বের বর্ণন করার সময় প্রসঙ্গতঃ আধ্যাত্মিক তত্ত্বেরও উদ্ধৃত করা হয়েছে।.........।
বৈদিক বাঙ্ময় কা ইতিহাস/দ্বিতীয় ভাগ/পৃষ্ঠা-১৬৮
ঋষি দয়ানন্দ ঋগ্বেদাদিভাষ্য ভূমিকায় - গ্রন্থ প্রামাণ্যাপ্রামাণ্য বিষয়ক লিখনীতে এই প্রসঙ্গে আধি দৈবিক অর্থে কি বুঝায় তা উদ্ধৃত করেছেন। তিনি লিখেছেন -
নবীন গ্রন্থকারগণ নিম্নলিখিত রূপকালঙ্কার বুঝিতে না পারিয়া, ভ্রান্তিবশতঃ মিথ্যারূপে বর্ণন করিয়াছেন যথা:-
(প্রজাপতির্বৈ স্বাং দুহিতরম্ ইত্যাদি) অর্থাৎ প্রজাপতি শব্দে সূর্য্য বুঝায়। প্রমাণ দিয়েছেন - প্রজাপতির্বৈ সুপর্ণো গরুত্মানেষ সবিতা।। (শত০ ব্রা০ -১০/২/২/৪)।
➤কয়েকটি প্রশ্নোত্তর দ্বারা জেনে নিই -
- প্রজাপতি কাকে বলে?
- প্রজাপতির্বৈ সবিতা (তা০ ব্রা০-১৬/৫/১৭)
- অর্থাৎ 'সবিতা'ই প্রজাপতি।
- সবিতা কাকে বলে?
- আদিত্যোহপি সবিতোচ্যতে (নিরুক্ত-১০/৩২)
- অর্থাৎ আদিত্যকেও সবিতা বলা হয়।
- আদিত্য কাকে বলে?
- সূর্যমাদিতেয়ম্ (ঋগ্বেদ-১০/৮৮/১১)
- অর্থাৎ অদিতিপুত্র সূর্য্যই আদিত্য।
সূর্য্যের দুইটি কন্যা - ১. প্রকাশ ২. ঊষা।
যে দ্রব্য যাহা হইতে উৎপন্ন হয়, তাহাকে উক্ত দ্রব্যের সন্তান বলা যায়।এজন্য ঊষা যাহা তিন বা চারি ঘটিকার সময় রাত্রিশেষে পূর্ব দিশায় রক্তবর্ণ দৃষ্টিগোচর হয়, তাহা সূর্য কিরণ হইতে উৎপন্ন হেতু উহার কন্যা বলিয়া অভিহিত হয়। ঊষার সম্মুখে প্রথমে যে সূর্য্য কিরণ পতিত হয়, তাহাতেই বীর্য স্থাপন রূপ কাৰ্য্য হইয়া থাকে, এই দুইয়ের সংযোগ দ্বারা পুত্র অর্থাৎ দিবস উৎপন্ন হইয়া থাকে।
ঋগ্বেদ-৩/৩১/১ মন্ত্রের ভাবার্থেও লিখেছেন -
হে মনুষ্য! যেরূপ পিতা হইতে কন্যা উৎপন্ন হয়, সেরূপ সূর্য্য হইতে প্রাতঃকালের বেলা প্রকট হয়। যেরূপ পতি নিজ পত্নীর মধ্যে গর্ভধারণ করায়, সেরূপ কন্যাসদৃশ বর্তমান প্রাতঃকালের বেলার মধ্যে, সূর্য্য- কিরণরূপ বীর্য্য ধারণ করায়, এর দ্বারা দিবসরূপ পুত্র উৎপন্ন হয়।
নিরুক্তেও (নিরুক্ত-৪/২১) ব্যাখ্যান পাওয়া যায় যে - পিতা দুহিতাকে (কন্যাকে) গর্ভধারণ করিয়েছে। কিন্তু এখানে পৌরাণিক কাল্পনিক ৪/৫ মস্তকযুক্ত কোন দেহধারী পিতা এবং কোন দেহধারী দুহিতাকে বুঝায়নি।
- এখানে পিতা বলতে পর্জন্য বুঝানো হয়েছে এবং দুহিতা বলতে পৃথিবীকে বুঝানো হয়েছে। অর্থাৎ পর্জন্য পৃথিবীতে গর্ভাধান করেছে, যার ফলস্বরূপ তৃণলতাদি সন্তান উৎপন্ন হয়। আর এই পর্জন্য (মেঘ বা জল) ও পৃথিবীর পারস্পরিক সম্বন্ধ পিতা-পুত্রী তুল্য।
এরূপ বিভিন্ন জ্ঞানগম্ভীর আলঙ্কারিক বিষয়ের বিকৃতরূপ মিথ্যা কল্পকাহিনী পুরাণাদিতে পাওয়া যায়, যা সনাতনীদের জন্য বিভিন্নভাবে হানিকারক।
©️অমৃতস্য পুত্রাঃ