বেদার্থের ত্রিবিধ-প্রক্রিয়া
বেদার্থ বিষয়ে এটা জানা আবশ্যক যে- আধ্যাত্মিক, আধিদৈবিক এবং আধিযাজ্ঞিক ভেদে বেদমন্ত্রের অর্থ ত্রিবিধ প্রক্রিয়ায় হয়। এর জন্য আমাদেরকে সায়ণাচার্য হইতে প্রাচীন বেদভাষ্যকারদের বেদার্থ গম্ভীরভাবে দেখা উচিৎ। আধ্যাত্মিক অর্থ করেছেন এমন অনেক বেদভাষ্যকারের নাম গণনা করা যাবে। যেমন– নিরুক্তসমুচ্চয়কার বররুচি, আত্মানন্দ (অস্যবামীয় ভাষ্যে), আনন্দতীর্থ (ঋগ্বেদের ৪০ সুক্তের ভাষ্যে), জয়তীর্থ নরসিংহয়তি (ছলারীটীকা), রাঘবেন্দ্রয়তি (মন্ত্রার্থমঞ্জরী), শত্রুঘ্নাচার্য (মন্ত্রার্থদীপিকা) ইত্যাদি অনেক ভাষ্যকারগণ, যারা সায়ণাচার্য হইতে পূর্ববর্তী, যারা ঋষি দয়ানন্দ হইতে বহুকাল পূর্বেই বেদমন্ত্রের আধ্যাত্মিক অর্থ করেছেন।
১.আত্মানন্দ লিখেছেন–
'অধিয়জ্ঞবিষয়ং স্কন্দস্বামিভাষ্যম্ । নিরুক্তমধিদৈবতম্ । ইদং তু ভাষ্যমধ্যাত্মবিষয়মিতি, ন ভিন্নবিষয়াণাং বিরোধঃ।' (আত্মানন্দ অস্যবামীয় ভাষ্য, পৃ০ ৫৪)
অর্থাৎ মন্ত্রের ত্রিবিধ প্রক্রিয়ায় অর্থ হয় আর আমি অধ্যাত্মপ্রক্রিয়ায় অর্থ করছি।
২. রাঘবেন্দ্রয়তি লিখেছেন–
অগ্ন্যাদিদেবতাপরত্বেন অধ্যাত্ম- পরত্বেন চেত্যেবং ত্র্যর্থপরতয়া ব্যাখ্যাতানি'।
'বিষ্ণুঃ সর্ববেদপ্রতিপাদ্যঃ, সর্ববেদানাং বিষ্ণ্বর্থত্বসিদ্ধেঃ' মন্ত্রার্থ- মঞ্জরী পৃ০ ১০৪ ॥২॥
অর্থাৎ বেদমন্ত্রের অধ্যাত্ম আদি তিন প্রকার অর্থ হয়।
৩.এই বিষয়ে দূর্গাচার্যের মত–
'তস্মাদেতেষু যাবন্তোঽর্থা উপপদ্যেরন্ আধিদৈবাধ্যাত্মাধিয়জ্ঞাশ্রয়াঃ সর্ব এব তে যোজ্যা নাত্রাপরাধোঽস্তি ॥' নিরু০ ২/৮ টী০ পৃ০ ১২৬।
'মন্ত্রার্থপরিজ্ঞানাদেব হ্যগ্নেরাধ্যাত্মাধিদৈবাধিভূতাধিয়জ্ঞেষ্ববস্থানং যাথাত্ম্যতো দৃশ্যতে' । (নিরু০ ৪/১৬; দুর্গ টী০ পৃ০ ৩১৫)।
অর্থাৎ 'আধিদৈবিক-আধ্যাত্মিক-অধিযজ্ঞ প্রক্রিয়ায় অর্থ করা উচিৎ। এতে কিঞ্চিৎ মাত্রও দোষ নাই।' অগ্নির অধ্যাত্ম-আধিদৈবিক-আধিভূত অধিযজ্ঞ সব প্রক্রিয়ায় অর্থ যথাবৎ দেখা যায়।'
আচার্য স্কন্দ স্বামীজীর লেখনী ত্রিবিধ প্রক্রিয়ার বিষয়ে এতটা বিস্পষ্ট যে, তা দেখলে তো এই বিষয়ে কোন শঙ্কাই থাকেনা যে বেদমন্ত্রের অর্থ ত্রিবিধ প্রক্রিয়ায় হয়। সায়ণাচার্য হইতে ৯০০বর্ষ পূর্বে বেদার্থের প্রক্রিয়া এত বিস্পষ্ট রূপে বিদ্যমান ছিল, এর যথাবৎ প্রমাণ পাওয়া যায়। আচার্য স্কন্দ স্বামীর উক্ত স্থল এইপ্রকার–
সর্বদর্শনেষু চ সর্বে মন্ত্রা যোজনীয়াঃ । কুতঃ ? স্বয়মেব ভাষ্য- কারেণ সর্বমন্ত্রাণাং ত্রিপ্রকারস্য বিষয়স্য প্রদর্শনায় 'অর্থ বাচঃ পুষ্প- ফলমাহ' ইতি যজ্ঞাদীনাং পুষ্পফলত্বেন প্রতিজ্ঞানাৎ।'
(নিরুক্ত ৭/৫, স্কন্দ টীকা পৃ০ ৩৬,৩৭)
অর্থাৎ 'সকল মন্ত্রের অর্থ সকল প্রক্রিয়ায় (অধ্যাত্ম-নৈরুক্ত-যাজ্ঞিক) ই করা উচিৎ। কেননা যাস্ক [ঋষির] এর সিদ্ধান্ত এই যে, সকল মন্ত্রের অর্থ সকল প্রক্রিয়ায় হয়।'
ত্রিবিধ প্রক্রিয়ায় বেদমন্ত্রের অর্থ করা বেদার্থ প্রক্রিয়ার মূলভূত প্রমুখ সিদ্ধান্ত। ইহা বুঝলে পরে বর্তমান সায়ণ আদি কৃত বেদভাষ্যের স্থিতির জ্ঞান সহজেই হয়ে যায় যে এরা কেবল যজ্ঞপরক অর্থই করেছে। আধ্যাত্মিক এবং আধিদৈবিক অর্থ তো বাকি থেকেই যায়। যদি তাদের যজ্ঞপরক অর্থ পূর্ণতয়া ঠিক মেনেও নিই [যজ্ঞপরকও তাদের অর্থ পূর্ণ নয়, এটি একটি আলাদা বিবেচনীয় বিষয়] তাহলেও দুই প্রকার বেদার্থ সায়ণভাষ্য ছাড়াও এখন লুপ্ত, ইহাই মানতে হবে।
©️অমৃতস্য পুত্রাঃ