![]() |
প্রাচীন ভারতে অর্থশাস্ত্রের পরম্পরা ও ইতিহাস |
অর্থশাস্ত্র যার অপরনাম দণ্ডনীতিশাস্ত্র বা রাজনীতিবিদ্যা এই শাস্ত্রের একটি সুপ্রাচীন পরম্পরা রয়েছে। বর্তমানে আমরা একটিমাত্র অর্থশাস্ত্র পাই তা হলো ভগবান কৌটিল্যের প্রণীত "কৌটিল্য অর্থশাস্ত্র"। ভগবান কৌটিল্য তার অর্থশাস্ত্রের শুরুতেই বলেছেন -
পৃথিব্যা লাভে পালনে চ যাবন্ত্যর্থশাস্ত্রাণি পূর্বাচার্যৈঃ
প্রস্তাবিতানি প্রায়শস্তানি সংহৃত্যৈ কমিদমর্থশাস্ত্রং কৃতম্।।১।।
বিনয়াধিকারিক - প্রথম অধিকরণ - ১ম সূত্র
অনুবাদঃ পৃথিবীর লাভ ও পালনাদির জন্য পূর্বাচার্য্যগণ যে সমস্ত অর্থশাস্ত্র প্রণয়ন করেছিলেন, প্রায়শঃ সেই সকল গ্রন্থ একত্রে সঙ্কলিত করিয়া এই অর্থশাস্ত্র তৈরি করা হলো।।
এখান থেকে স্পষ্ট যে, পূর্বেও অনেক অর্থশাস্ত্র ছিল যেগুলো থেকেই আচার্য্য কৌটিল্য তার অর্থশাস্ত্র নির্মাণ করেছিলেন। কৌটিল্যের পূর্ববর্তী অর্থশাস্ত্রগুলো এখন হয়তো আমাদের কাছে উপলব্ধ নয়। কিন্তু মহাভারতে সেসকল অর্থশাস্ত্র এবং অর্থশাস্ত্রকারদের বিষয়ে আলোচনা করা হয়েছে। মহাভারতের শান্তিপর্ব রাজধর্মানুশাসন ৫৬-৫৯ তম অধ্যায় দ্রষ্টব্য --
গীতাপ্রেস গোরক্ষপুর মহাভারত শান্তিপর্ব রাজধর্মানুশান পর্ব ৫৮তম অধ্যায়
ভীষ্ম উবাচ-
"এতৎ তে রাজধর্মানাং নবনীতং যুধিষ্ঠির।
বৃহস্পতির্হি ভগবান্ ন্যায্যং ধর্মং প্রশংসতি"।।১।।
- যুধিষ্ঠির! এই পর্যন্ত! আমি তোমাকে যা কিছু বললাম, সেসব রাজধর্মরূপী দুধের মাখন। ভগবান বৃহৎপতি এই ন্যায়ানুকূল ধর্মেরই প্রশংসা করেছেন ॥১॥
বিশালাক্ষশ্চ ভগবান্ কাব্যশ্চৈব মহাতপাঃ।
সহস্রাক্ষো মহেন্দ্রশ্চ তথা প্রাচেতসো মনুঃ ॥২॥
ভরদ্বাজশ্চ ভগবানস্তথা গৌরশিরা মুনিঃ।
রাজশাস্ত্র প্রণেতারো ব্রহ্মণ্যা ব্রহ্মবাদিনঃ ॥৩॥
রক্ষামেব প্রশংসন্তি ধর্মং ধর্মধৃতাং বর।
রাজ্ঞাৎ রাজীবতাম্রাক্ষ সাধনং চাত্র মে শৃনু ॥৪॥
অনুবাদঃ বৃহস্পতিদেব ছাড়াও ভগবান বিশালাক্ষ, মহাতপস্বী শুক্রাচার্য, সহস্রাক্ষ ইন্দ্র, প্রাচেতস মনু, ভগবান ভরদ্বাজ এবং মুনিবর গৌরশিরা ইহারা সকলে ব্রাহ্মণভক্ত ও ব্রহ্মবাদী ছিলেন এবং রাজশাস্ত্রের প্রণেতা ছিলেন। তাহারা সকলে রাজার জন্য প্রজাপালনরূপ ধর্মেরই প্রশংসা করে থাকেন। ধর্মাত্মাদের মধ্যে শ্রেষ্ঠ কমলানয়ন যুধিষ্ঠির! এই রক্ষাত্মক ধর্মের সাধনসমূহের বর্ণনা করছি, শ্রবণ করো ॥২-৪
৫৯ তম অধ্যায়-
"ততোধ্যায়সহস্রানাং শতং চক্রে স্ববুদ্ধিজম্ যত্র ধর্মস্তথৈবার্থঃ কামশ্চৈবাভিবর্ণিতঃ।।২৯৷৷
তদন্তর ব্রহ্মাজী নিজবুদ্ধিপূর্বক এক লক্ষ অধ্যায়ে এমন এক নীতিশাস্ত্র রচনা করলেন, যাহাতে ধর্ম, অর্থ ও কামের বিস্তারপূর্বক বর্ণনা করেন।।
ভগবান ব্রহ্মা তার এই শাস্ত্রে আত্মা, দেশ, কাল, উপায় কার্য ও সহায়ক- এই ছয়টি বর্গের আলোচনা করেছেন। এই গ্রন্থে বেদত্রয়ী, আন্বীক্ষিকর, বার্তা এবং দন্ডনীতি ইত্যাদি বিদ্যার নিরুপন করা হয়েছে। তাছাড়া মন্ত্রীদের রক্ষা, প্রনিধি, রাজপুত্রের লক্ষণ, গুপ্তচরদের বিচরণের বিবিধ উপায়, বিভিন্ন স্থানে বিভিন্ন প্রকারের গুপ্তচরদের নিযুক্তি, সাম, দান, ভেদ, দন্ড ও উপেক্ষা - এই পঞ্চ উপায় পূর্ণরূপে বর্ণনা করেছে।
এ বিষয়ে আরো বিস্তারিত জানতে মহাভারতের শান্তিপর্বের ৫৯ তম অধ্যায় দ্রষ্টব্য।।
ততস্তাং ভগবান নীতিং পূর্বং জগ্রাহ শঙ্করঃ।
বহুরূপো বিশালাক্ষঃ শিবঃ স্থানুরূমাপতিঃ ॥৮০৷৷
প্রঙ্গনামায়ুষো হ্রাসং বিজ্ঞায় ভগবান শিবঃ।
সঞ্চিক্ষেপ ততঃ শাস্ত্রং মহাস্ত্রং ব্রহ্মণা কৃতম্ ॥৮১॥
বৈশালাক্ষমিতি প্রোক্তং তদিন্দ্রঃ প্রত্যপদ্যত।
দশাধ্যসহস্রাণি সুব্রহ্মণ্যে মহাতপাঃ।।৮২।।
ভববানপি তচ্ছাস্ত্রং সঞ্চিক্ষেপ পুরন্দরঃ।
সহস্রৈঃ পঞ্চভিস্তাত যদুক্তং বাহুদন্তকম্।।৮৩।।
অধ্যায়ানাং সহস্রৈস্তু ত্রিভিরেব বৃহস্পতিঃ।
সঞ্চিক্ষেপেশ্চরো বুদ্ধ্যা বার্হস্পত্যং তদুচ্যতে।। ৮৪।।
অধ্যায়ানাং সহস্রেণ কাব্যং সংক্ষেপমব্রবীৎ।
তচ্ছাস্ত্রমমিত প্রজ্ঞো যোগাচার্যা মহাযশাঃ।। ৮৫।।
এবং লোকানুরোধেন শাস্ত্রমেতন্মহর্ষিভিঃ।
সংক্ষিপ্তমায়ুর্বিজ্ঞায় মর্ত্যানাং হ্রাসমেব চ।।৮৬।।
অনুবাদঃ তদন্তর সর্বপ্রথম ভাবান শঙ্কর এই নীতিশাস্ত্রকে গ্রহন করেন। তিনি বহুরূপ, বিশালাক্ষ, শিব, স্থাণু, উমাপতি আদি নামে প্রসিদ্ধ।।৮০।।
বিশালাক্ষ ভাবান শিব প্রজাবর্গের আয়ু হ্রাস হতে দেখে ব্রহ্মাজীর রচিত এই মহান অর্থপূর্ণ শাস্ত্রকে সংক্ষিপ্ত করেছিলেন। এই জন্য তার নাম "বৈশালাক্ষ" হয়ে যায়।। ৮১।।
মহাতপস্বী সুব্রহ্মণ্য ভগবান পুরন্দর যখন ইহা অধ্যয়ন করেছিলেন, সেসময় এতে দশ হাজার অধ্যায় ছিল। তারপর তিনিও এটিকে সংক্ষেপ করেন, যার ফলে এটি পাঁচ হাজার অধ্যায়ের গ্রন্থে পরিণত হয়। সে-ই গ্রন্থ "বাহুদন্তক" নামক নীতিশাস্ত্রের রূপে বিখ্যাত হয়৷। ৮২-৮৩।।
তারপর সামর্থ্যবান বৃহস্পতিদেব নিজবুদ্ধি দ্বারা সংক্ষিপ্ত করে, তখন থেকে এর মধ্যে তিন হাজার অধ্যায় থেকে যায়। একেই "বার্হস্পত্য" নামক নীতিশাস্ত্র বলে। ৮৪॥ পুনরায় মহাযশ্বসী, যোগশাস্ত্রের আচার্য্য তথা অমিত বুদ্ধিমান শুক্রাচার্য এক হাজার অধ্যায়ে বৃহৎপতিদেবের নীতিশাস্ত্রকে সংক্ষেপ করেন ৷৷৮৫৷৷ এইভাবে, মনুষ্যের আয়ু হ্রাস পাবে এটা জেনে, জগতের হিতের জন্য মহর্ষিগণ শুক্রাচার্যের নীতিশাস্ত্রকেও সংক্ষিপ্ত করেন।।৮৬।।
তারপর অন্য অনেকের প্রণীত ধর্মশাস্ত্র বা নীতিশাস্ত্রের কথা মহাভারতে উল্লেখ রয়েছে। যেসব শাস্ত্রে রাজনীতি বা দণ্ডনীতিবিদ্যার বিবিধ আইন-কানুনের কথা বিদ্যমান ছিল। যেমনঃ প্রাচেতস মনুর মানবীয় ধর্মশাস্ত্র বা অর্থশাস্ত্র হতে দুটি নীতি মহাভারত শান্তিপর্বের ৫৭ তম অধ্যায়ে উদ্ধৃত রয়েছে -
"প্রাচেতসনে মনুনা শ্লোকৌ চেমাবুদাহৃতৌ
রাজধর্মেষু রাজেন্দ্র তাবিহৈকমনাঃ শৃণু॥৪৩৷৷
ষড়েতান্ পুরুষো জহ্যাদ্ ভিন্নাং নাবমিবার্ণবে
অপ্রবক্তারমাচার্যমনধীয়ানমৃত্বিজম।। ৪৪।।
অরক্ষিতারং রাজানং ভার্যাং চাপ্রিয়বাদিনীম্।
গ্রামকামং চ গোপালং বনকামং চ নাপিতম্"॥৪৫॥
ভারতাচার্য্য দ্রোণ কৌরবপক্ষের সেনাপতি হইয়া যে অভিভাষণ প্রদান করিয়াছিলেন, তাহাতে তিনি বলেছেন - " আমি যেমন ষড়ঙ্গবেদ অবগত আছি৷ এইরূপ মানবীয় অর্থশাস্ত্রও অবগত আছি " (দ্রোণপর্ব ৭ অধ্যায় ১ম শ্লোক)
এই মানব অর্থশাস্ত্র প্রাচেতস মনুর বিরচিত। মনে করা হয় দক্ষ প্রজাপতিকেই প্রাচেতস মনু বলে অভিহিত করা হয়।
ভরদ্বাজ নীতি
ভগবান বৃহস্পতিদেবের পুত্র ভরদ্বাজ প্রোক্ত নীতির আলোচনা করা হয়েছে মহাভারত শান্তিপর্বের ১৪০ তম অধ্যায়ে ব্যক্ত করা হয়েছে। ভরদ্বাজ নীতির কথাগুলো বলেছেন পিতামহ ভীষ্ম যুধিষ্ঠিরের নিকট।
শম্বরনীতি
অসুরদের গুরু শুক্রাচার্যের প্রণীত নীতিশাস্ত্র বা দণ্ডনীতি শাস্ত্র অসুরদের মধ্যে প্রসারলাভ করেছিল। তারই মধ্যে একজন অসুর হলে শম্বরাসুর। শম্বরাসুরও নীতিশাস্ত্র প্রণয়ন করেছিল। শম্বরাসুরের নীতির কথা মহাভারতের বিবিধস্থলে আলোচিত হয়েছে। যেমনঃ মহাভারত শান্তিপর্বের ১০২ ও ১৩০ নং অধ্যায়ে আবার মহাভারত উদ্যোগপর্বের ৭২ ও ১৩৪ নং অধ্যায়ে।
মাতঙ্গনীতি
মহাভারতের উদ্যোগপর্বের ১২৭ অধ্যায়ে মহর্ষি মাতঙ্গের নীতিবাক্য উদ্ধৃত হয়েছে।
কালবৃক্ষীয় নীতি
মহাভারত শান্তিপর্বের ৮২ অধ্যায়ে এবং ১০৪ অধ্যায় হতে ১০৬ অধ্যায়ে কালবৃক্ষীয় মুনি কর্তৃক রাজধর্ম ব্যাখ্যাত হইয়াছে।
কণিক নীতি
কণিক ছিলেন মহারাজ ধৃতরাষ্ট্রের কুট মন্ত্রী - তিনি ধৃতরাষ্ট্রের অমাত্যগণের মধ্যে একজন অমাত্য। তিনি ব্রাহ্মণ ছিলেন। তার নীতিমালা অনেকটা ভরদ্বাজ নীতির মতোই। মহাভারত শান্তিপর্বের ১৪০ তম অধ্যায়ে কণিক নীতি বর্ণিত হয়েছে।
মহাভারতকালীন সময়তে এসব নীতিশাস্ত্র তথা অর্থশাস্ত্র পঠন-পাঠন করা হতো যেমন শান্তিপর্বের ৩৭ অধ্যায়ে বলা হয়েছে যে - ভীষ্ম যে সমস্ত আচার্য্যগণের নিকট থেকে নানাবিদ্যা গ্রহণ করেছিলেন তাহাতে বৃহস্পতি ও শুক্রাচার্যের বা উশনার নিকট হতে রাজনীতি শাস্ত্র অধ্যয়ন করেছিলেন। আবার বনপর্বের ৩২ অধ্যায়ে বলা হয়েছে দ্রৌপদী মহারাজ যুধিষ্ঠিরকে বলেছিলেন যে - আমার পিতা দ্রুপদ আমার ভাতৃগণের রাজনীতি অধ্যয়নের জন্য অতিবিচক্ষণ এক ব্রাহ্মণকে নিযুক্ত করেছিলেন, এই ব্রাহ্মণ আমার ভাতৃগণকে বৃহস্পতি প্রোক্ত রাজনীতিশাস্ত্র পড়িয়েছিলেন।। (৬০-৬১ শ্লোক)
বায়ুপুরাণের ৭৯ তম অধ্যায় অনুসারে সেসময়কালের ব্রাহ্মণরা ভগবান বৃহস্পতিদেবের প্রণীত রাজনীতি শাস্ত্র আদি পাঠ করতেন এবং তাদের পঙক্তিপাবন বলা হতো -
ত্রিনাচিকেতস্ত্রৈবিদ্যো যশ্চ ধৰ্ম্মান্ পঠোদ্দুজঃ বার্হস্পত্যে তথা শাস্ত্রে পারং যশ্চ দ্বিজো গতঃ সর্ব্বে তে পাবনা বিপ্রাঃ পঙক্তীনাং...."
যে দ্বিজ বর্হিস্পত্য শাস্ত্রের পারদর্শী, তিনিও পঙক্তিপাবন।।
রামায়ণকালীন সময়তে বামদেব, মৌদ্গল্য, বশিষ্ঠ, মার্কণ্ডেয় প্রভৃতি ব্রাহ্মণগণ রাজ্যের রাজধর্ম বিষয়ক নীতিমালা প্রণয়ন করতেন। যার ফলে রাজা দশরথ ও শ্রীরামচন্দ্রের রাজ্যব্যবস্থা ছিল সুশৃঙ্খল। তবে দুঃখের বিষয় ধীরে ধীরে এইসকল অর্থশাস্ত্র তথা রাজধর্মবিষয়ক গ্রন্থের অনাদার শুরু হয় এবং এই সকল শাস্ত্রও ধীরে ধীরে লুপ্ত হতে শুরু করে। মানুষ শুধু আধ্যাত্মবিদ্যাতেই অধিকতর মনোনিবেশ করতে থাকে। পাশাপাশি ব্রাহ্মণগণও আর রাজধর্ম বিষয়ক কার্যে নিজেদের নিযুক্ত করে না বা করার সুযোগ হয়তো আর পায় না। তাই অর্থশাস্ত্রের পরম্পরাও ধীরে ধীরে ছিন্ন হয়ে যায়।
এবিষয়ে বিস্তারিতভাবে জানতে মহামহোপাধ্যায় শ্রী যোগেন্দ্রনাথ তর্ক-সাংখ্য-বেদান্ততীর্থ জীর লিখিত "প্রাচীন ভারতের দণ্ডনীতি" বইটি পড়ুন।।
নমস্কার
©️অমৃতস্য পুত্রাঃ