দেবর্ষি নারদ
পুরাণে নারদজীকে মিথ্যাবাদী হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে এবং শ্রীকৃষ্ণের সাথে নারী হয়ে মিলিত হয়েছে বলে উল্লেখ আছে। অন্যত্র বলা হয়েছে তিনি স্নানরত একা কুমারীর বস্ত্র ধরে বলেন যে আমি তোমার কটাক্ষপাতে অধীর হয়ে গেছি, আমার হাত গ্রহণ কর, এসব তথ্য প্রথম খণ্ডে উল্লেখ করেছি। তাছাড়াও নারদজীর বিষয়ে অনেকেই এরূপ ধারণা করে যে, তিনি একজনের সাথে আরেকজনের ঝগড়া লাগিয়ে দেন, তিঁনি লোভী যার ভিত্তি হলো হিন্দুদেরই বিভিন্ন প্রচার-প্রচারণা। যেখানে নারদজীকে এভাবেই তুলে ধরা হয় যেন তাহার কাজই এসব করা।
কিন্তু বাস্তবিকপক্ষে এমন ব্যক্তিরা কখনোই নারদ হতে পারেন না। যেমন ব্রহ্মার বিষয়ে লিখেছি যে ব্রহ্মা একটি পদবী অনুরূপ নারদ বিষয়ে বুঝতে হবে।
সংশোধিত বাল্মীকি রামায়ণ সংস্করণ এবং সংশোধিত মহাভারত সংস্করণে যশপাল শাস্ত্রীজি নারদ শব্দের ব্যাখ্যানে লিখেছেন–
নরাণাম্ সমূহঃ নারম্। তেভ্য যঃ উপদেশান্ যচ্ছতি, সুপরামর্শ দদাতি, সন্মার্গ চ দর্শয়তি সঃ নারদঃ।
অর্থাৎ মনুষ্যসমূহকে নার বলা হয়। এই মানব সমূহকে যিনি উত্তম উপদেশ প্রদান করেন, সন্মার্গ দেখান, উত্তম পরামর্শ দেন তাকে নারদ বলা হয়। এ থেকে বুঝা যায় পূর্বকালে নারদ কোন এক ঋষির নাম না হয়ে এক উপাধি ছিলো। নার শব্দের অর্থ আধ্যাত্ম জ্ঞানও।
বেদমন্ত্রের দ্রষ্টারূপেও নারদ ঋষির নাম উল্লেখ পাওয়া যায়। ঋগ্বেদ- অষ্টম মণ্ডলের ১৩নং সূক্তের ঋষি= নারদঃ কাণ্বঃ।
ঋগ্বেদ-নবম মণ্ডলের ১০৪নং সূক্তের ঋষি= পর্বতনারদৌ দ্বে শিখণ্ডিন্যৌ বা কাশ্যপ্যাবপ্সরসৌ।
ঋগ্বেদ-নবম মণ্ডলের ১০৫নং সূক্তের ঋষি= পর্বতনারদৌ
সামবেদ ৩৮১ নং মন্ত্রের ঋষি= নারদঃ কাণ্বঃ।
সামবেদ ৫৬৮ নং মন্ত্রের ঋষি= পর্বতনারদৌ কাণ্বৌ।
সামবেদের ৫৬৯, ৫৭৪, ৫৭৫, ৭৪৬, ৭৪৭, ৭৪৮, ১০৯৮, ১০৯৯, ১১০০, ১১৫৭, ১১৫৮, ১১৫৯, ১৬১১, ১৬১২, ১৬১৩ আদি মন্ত্রেরও এরূপ ঋষির নাম পাওয়া যায়।
অথর্ববেদের মন্ত্রেই নারদ শব্দের উল্লেখ পাওয়া যায়, যেমন - অথর্ববেদ-৫/১৯/৯, ১২/৪/১৬, ১২/৪/২৪, ১২/৪/৪১, ১২/৪/৪২, ১২/৪/৪৩ মন্ত্র।
এই মন্ত্রসমূহে নারদ পদের অর্থ আর্য বিদ্বানগণ - নরসমাজের শোধক, যথার্থ জ্ঞান প্রদানকারী বিদ্বান্.... আদি করেছেন। বেদ মন্ত্রে ঐতিহাসিক নারদ কিংবা অন্য কোন ব্যক্তিরই উল্লেখ নেই তার বিভিন্ন তথ্য' বেদে ইতিহাস' বিষয়ক লেখায় উল্লেখ করেছি।
বাল্মীকি রামায়ণের প্রথম কাণ্ডের প্রথম অধ্যায়ের প্রথম শ্লোকে নারদজীকে 'বেদাদি পাঠরত বিদ্বদ্বরেণ্য মুনিশ্রেষ্ঠ' বলা হয়েছে। ৫নং শ্লোকে মহর্ষি বাল্মীকি নারদ মুনিকে মহর্ষে বলে সম্বোধন করেছেন। ৬নং শ্লোকে ত্রিলোকজ্ঞ বলা হয়েছে।
মহাভারতের আদিপর্বের ২০৭নং অধ্যায়ে নারদজীর সম্পর্কে বলা হয়েছে যে–
পরেণ তপসা যুক্তো ব্রাহ্মেণ তপসা বৃত॥
নয়ে নীতৌ চ নিরতো বিশ্রুতশ্চ মহামুনিঃ।
বিপ্রবর নারদ সম্পূর্ণ বেদান্তশাস্ত্রের জ্ঞাতা তথা পারঙ্গত পণ্ডিত। তিঁনি পরমতপস্বী তথা ব্রহ্মতেজসম্পন্ন, ন্যায়োচিত বচনে তথা নীতিতে নিরন্তর নিরত স্থিত সুবিখ্যাত মহামুনি।
ভাবিতাত্মা গতরজাঃ শান্তো মৃদুর্ঋজুর্দ্বিজঃ।
ধর্মেণাধিগতঃ সর্বৈর্দেবদানবমানুষৈঃ ॥
অক্ষীণবৃত্তধর্মশ্চ সংসারভয়বর্জিতঃ ॥
সর্বথা কৃতমর্যাদো বেদেষু বিবিধেষু চ ॥
ঋক্সাময়জুষাং বেত্তা ন্যায়বৃত্তান্তকোবিদঃ॥ ঋজুরারোহবাঞ্ছুক্লো ভূয়িষ্ঠপথিকোঽনঘঃ ।
শ্লক্ষ্ণয়া শিখয়োপেতঃ সম্পন্নঃ পরমত্বিষা ॥
অবদাতে চ সূক্ষ্মে চ দিব্যে চ রুচিরে শুভে ।
মহেন্দ্রদত্তে মহতী বিভ্রৎ পরমবাসসী ॥
প্রাপ্য দুষ্প্রাপমন্যেন ব্রহ্মবর্চসমুত্তমম্ ॥
ভবনে ভূমিপালস্য বৃহস্পতিরিবাপ্লুতঃ ॥
তিঁনি ধর্মবল দ্বারা পরাৎপর পরমাত্মার জ্ঞান প্রাপ্ত করেছেন। তিঁজি শুদ্ধাত্মা, রজোগুণরহিত, শান্ত, মৃদু তথা সরল স্বভাবের ব্রাহ্মণ। তিঁনি দেবতা দানব মনুষ্য সকলের সহিত ধর্মতঃ প্রাপ্ত হন। তাঁহার ধর্ম ও সদাচার কখনোই খণ্ডিত হয়নি। তিঁনি সংসার ভয় হইতে সর্বথা রহিত। তিঁনি সর্বপ্রকারে বিবিধ বৈদিক ধর্মের মর্যাদা স্থাপিত করেছেন। তিঁনি ঋগ্বেদ, সামবেদ এবং যজুর্বেদের বিদ্বান্। ন্যায়শাস্ত্রের পারঙ্গত পণ্ডিত। তিঁনি সুজা এবং উঁচু তথা শুক্লবর্ণের। সেই নিষ্পাপ নারদ অধিকাংশ সময় যাত্রায় ব্যতিত করেন। তাঁহার মস্তকে সুন্দর শিখা শোভিত। তিঁনি উত্তম কান্তি দ্বারা প্রকাশিত হয়। অপরের জন্য দুর্লভ এবং উত্তম ব্রহ্মতেজসম্পন্ন তিঁনি বৃহস্পতির সমান বুদ্ধিমান।
দ্বিপদস্য চ ধর্মস্য ক্রমধর্মস্য পারগঃ ॥
গাথাসামানুধর্মজ্ঞঃ সাম্নাং পরমবল্গুনাম্ ।
আত্মনা সর্বমোক্ষিভ্যঃ কৃতিমান্ কৃত্যবিৎ তথা ॥
যোক্তা ধর্মে বহুবিধে মনো মতিমতাং বরঃ ।
বিদিতার্থঃ সমশ্চৈব ছেত্তা নিগমসংশয়ান্ ॥
অর্থনির্বচনে নিত্যং সংশয়চ্ছিদসংশয়ঃ ।
প্রকৃত্যা ধর্মকুশলো নানাধর্মবিশারদঃ ॥
লোপেনাগমধর্মেণ সঙ্ক্রমেণ চ বৃত্তিষু ।
একশব্দাংশ্চ নানার্থানেকার্থাশ্চ পৃথক্ছুতীন্ ॥
পৃথগর্থাভিধানাংশ্চ প্রয়োগাণামবেক্ষিতা ॥
সংহিতাশাস্ত্রে সবার জন্য স্থিত এবং উপস্থিত মানবধর্ম তথা ক্রমপ্রাপ্ত ধর্মের তিঁনি পারগামী বিদ্বান্। তিঁনি গাথা ও সামমন্ত্রসমূহে বলা আনুষঙ্গিক ধর্মেরও জ্ঞাতা তথা অত্যন্ত মধুর সামগানের পণ্ডিত। মুক্তিকামী সকলের হিতের জন্য নারদজী স্বয়ংই প্রযত্নশীল থাকেন। কখন কার কি কর্তব্য, এই বিষয়ে তাঁর পূর্ণ জ্ঞান আছে। তিঁনি বুদ্ধিমানের মধ্যে শ্রেষ্ঠ এবং মনকে নানাপ্রকার ধর্মে নিয়োজিত রাখেন। জানার যোগ্য সকল অর্থজ্ঞান আছে তাঁর। তিঁনি সকলের প্রতি সমভাব রাখেন এবং বেদবিষয়ক সম্পূর্ণ সন্দেহের নিবারণকারী। অর্থের ব্যাখ্যা করার সময় সদা সংশয়ের উচ্ছেদ করেন। তাঁর হৃদয়ে সংশয়ের লেশমাত্রও নেই। তিঁনি স্বভাবতঃ ধর্মনিপুণ তথা নানাধর্মের বিশেষজ্ঞ। লোপ, আগমধর্ম তথা বৃত্তিসংক্রমণদ্বারা প্রয়োগে আসা এক শব্দের অনেক অর্থ, পৃথক-পৃথক শ্রবণগোচর হওয়া অনেক শব্দের এক অর্থ তথা বিভিন্ন শব্দের ভিন্ন-ভিন্ন অর্থ তিনি পূর্ণরূপে দর্শন করেন এবং বুঝেন।
সর্ববর্ণবিকারেষু নিত্যং সকলপূজিতঃ ॥
স্বরেঽস্বরে চ বিবিধে বৃত্তেষু বিবিধেষু চ ।
সমস্থানেষু সর্বেষু সমাম্নায়েষু ধাতুষু ॥
উদ্দেশ্যানাং সমাখ্যাতা সর্বমাখ্যাতমুদ্দিশন্ ।
অভিসন্ধিষু তত্ত্বজ্ঞঃ পদান্যঙ্গান্যনুস্মরন্ ॥
কালধর্মেণ নির্দিষ্টং যথার্থে চ বিচারয়ন্ ।
চিকীর্ষিতং চ যো বেত্তা যথা লোকেন সংবৃতম্ ॥
বিভাষিতং চ সময়ং ভাষিতং হৃদয়ঙ্গমম্ ।
আত্মনে চ পরস্মৈ চ স্বরসংস্কারয়োগবান্ ॥
এষাং স্বরাণাং বেত্তা চ বোদ্ধা চ বচনস্বরান্ ।
বিজ্ঞাতা চোক্তবাক্যানামেকতাং বহুতাং তথা ॥
বোদ্ধা হি পরমার্থাশ্চ বিবিধাংশ্চ ব্যতিক্রমান্ ।
অভেদতশ্চ বহুশো বহুশশ্চাপি ভেদতঃ ॥
বচনানাং চ বিবিধানাদেশাংশ্চ সমীক্ষিতা ।
নানার্থকুশলস্তত্র তদ্ধিতেষু চ সর্বশঃ ॥
পরিভূষয়িতা বাচাং বর্ণতঃ স্বরতোঽর্থতঃ ।
প্রত্যযাংশ্চ সমাখ্যাতা নিয়তং প্রতিধাতুকম্ ॥
পঞ্চ চাক্ষরজাতানি স্বরসঞ্জ্ঞানি যানি চ।
সকল অধিকরণ এবং সমস্ত বর্ণের বিকারে নির্ণয় দেওয়ার নিমিত্তে তিঁনি সকলের জন্য প্রমাণভূত। সদা সকলে তাঁর পূজা করে। নানাপ্রকার স্বর, ব্যঞ্জন, বিবিধ ছন্দ, সমান স্থানের সকল বর্ণ, সমাম্নায় তথা ধাতু– এই সকলের উদ্দ্যেশ্যের নারদজী অতি উত্তম ব্যাখ্যান করেন। সম্পূর্ণ আখ্যাত প্রকরণ (ধাতুরূপ তিঙন্ত আদি) প্রতিপাদন করতে পারেন। সকলপ্রকার সন্ধিতে সম্পূর্ণ রহস্য জানেন। পদ এবং অঙ্কের নিরন্তর স্মরণ রাখেন, কাল ধর্ম দ্বারা নির্দিষ্ট যথার্থ তত্ত্বের বিচারশীল তথা তিঁনি লোকের মধ্যে লুকানো মনোভাব– তারা কি করতে চায় ইহাও উত্তমপ্রকারে জানেন। বিভাষিত (বৈকল্পিক), ভাষিত (নিশ্চয়পূর্বক কথিত) এবং হৃদয়ঙ্গম করার সময়ের যথার্থ জ্ঞানবান। তিঁনি নিজ তথা অপরের জন্য স্বরসংস্কার তথা যোগসাধনে তৎপর থাকেন। তিঁনি এই প্রত্যক্ষ চলমান স্বরকেও জানেন, বচন-স্বরের জ্ঞানও রাখেন, কথিত বচনের মর্মকে জানেন এবং এর একতা তথা অনেকতাকে বুঝেন। তাঁর পরমার্থের যথার্থ জ্ঞান রয়েছে। তিঁনি নানাপ্রকার ব্যতিক্রম (অপরাধ) সম্পর্কেও জানেন। অভেদ ও ভেদদৃষ্টি দ্বারাও বারংবার তত্ত্ববিচার করতে থাকেন। তিঁনি শাস্ত্রীয় বাক্যের বিবিধ আদেশেরও সমীক্ষক তথা নানাপ্রকার অর্থজ্ঞানে কুশল। তদ্ধিধ প্রত্যয়ের পূর্ণজ্ঞানী। তিঁনি স্বর, বর্ণ ও অর্থ এই তিন দ্বারাই বাণীকে বিভূষিত করেন। প্রত্যেক ধাতুর নিয়মপূর্বক প্রতিপাদনকারী। পাঁচ প্রকারের যে অক্ষর সমূহ তথা স্বর* তাহাও তিঁনি যথার্থরূপে জানেন।
*কণ্ঠ, তালু, মুর্ধা, দন্ত ও ওষ্ঠ– এই পাঁচ স্থান অথবা পাঁচ আভ্যন্তর প্রযত্নভেদ দ্বারা পাঁচপ্রকার অক্ষরসমূহ বলা হয়েছে। अ इ उ ऋ लृ এই পাঁচই মূল স্বর, অন্য স্বর এগুলোরই দীর্ঘ আদি ভেদ অথবা সন্ধিজ।
সভাপর্বের পঞ্চম অধ্যায়েও নারদজীর সম্বন্ধে বলা হয়েছে–
ইতিহাসপুরাণজ্ঞঃ পুরাকল্পবিশেষবিৎ॥
ন্যায়বিদ্ ধর্মতত্ত্বজ্ঞঃ ষডঙ্গবিদনুত্তমঃ ।
ঐক্যসংয়োগনানাত্বসমবায়বিশারদঃ॥
বক্তা প্রগল্ভো মেধাবী স্মৃতিমান্ নয়বিৎ কবিঃ। পরাপরবিভাগশঃ প্রমাণকৃতনিশ্চয়ঃ॥
পঞ্চাবয়বয়ুক্তস্য বাক্যস্য গুণদোষবিৎ।
উত্তরোত্তরবক্তা চ বদতোঽপি বৃহস্পতেঃ॥
ধর্মকামার্থমোক্ষেষু যথাবৎ কৃতনিশ্চয়ঃ।
তথা ভুবনকোশস্য সর্বস্যাস্য মহামতিঃ ॥
প্রত্যক্ষদর্শী লোকস্য তির্যগূর্ধ্বমধস্তথা।
সাঙ্খ্যযোগবিভাগজ্ঞো নির্বিবিৎসুঃ সুরাসুরান্॥
সন্ধিবিগ্রহতত্ত্বশস্ত্বনুমানবিভাগবিৎ।
পাঙ্গুণ্যবিধিয়ুক্তশ্চ সর্বশাস্ত্রবিশারদঃ॥
যুদ্ধগান্ধর্বসেবী চ সর্বত্রাপ্রতিঘস্তথা।
এতৈশ্চান্যৈশ্চ বহুভির্যুক্তো গুণগণৈর্মুনিঃ॥
লোকাননুচরন্ সর্বানাগমৎ তাং সভাং নৃপ।
নারদঃ সুমহাতেজা ঋষিভিঃ সহিতস্তদা॥
পারিজাতেন রাজেন্দ্র পর্বতেন চ ধীমতা।
সুমুখেন চ সৌম্যেন দেবর্ষিরমিতদ্যুতিঃ॥
সভাস্থান্ পাণ্ডবান্ দ্রষ্টুং প্রীয়মাণো মনোজবঃ।
জয়াশীর্ভিস্তু তং বিপ্রো ধর্মরাজানমার্চয়ৎ॥
বেদ ও উপনিষদের জ্ঞাতা, ঋষি, দেবগণ দ্বারা পূজিত, ইতিহাস-পুরাণের মর্মজ্ঞ, পূর্বকল্পের বিষয়ে বিশেষজ্ঞ, ন্যায়ের বিদ্বান্, ধর্ম তত্ত্বের জ্ঞাতা, শিক্ষা, কল্প, ব্যাকরণ, নিরুক্ত, ছন্দ এবং জ্যোতিষ– এই ছয় অঙ্গের পণ্ডিতগণের শিরোমণি, ঐক্য, সংযোগনানাত্ব এবং সমবায় জ্ঞানের বিশারদ, প্রগল্ভ বক্তা, মেধাবী, স্মরণশক্তিসম্পন্ন, নীতিজ্ঞ, ত্রিকালদর্শী, অপরব্রহ্ম এবং পরব্রহ্মকে বিভাগপূর্বক জ্ঞাতা, প্রমাণদ্বারা এক নিশ্চিত সিদ্ধান্তে স্থিত, পঞ্চাবয়ব বাক্যের গুণ-দোষের জ্ঞাতা, বৃহস্পতি যেমন বক্তার সাথে উত্তর-প্রত্যুত্তর করতে সমর্থ, ধর্ম, অর্থ, কাম এবং মোক্ষ– চারো পুরুষার্থ সম্বন্ধে যথার্থ নিশ্চয়কারী তথা এই সম্পূর্ণ ১৪ভুবনের উপর, নিচ আদি সকল দিক হইতে প্রত্যক্ষ দর্শনকারী, মহাবুদ্ধিমান, সাংখ্য এবং যোগের বিভাগপূর্বক জ্ঞাতা, দেবতা এবং অসুরদের মধ্যেও নির্বেদ (বৈরাগ্য) উৎপন্ন করতে ইচ্ছুক, সন্ধি এবং বিগ্রহ তত্ত্বের জ্ঞাতা,নিজের এবং শত্রুর শক্তি অনুমান করে শত্রুর মন্ত্রীদের মধ্যে ঐক্য ভঙ্গ করার জন্য অর্থ বিতরণ ইত্যাদির উপযুক্ত সুযোগের জ্ঞাতা, সন্ধি (মিলন), বিগ্রহ (ঝগড়া), যান (আরোহণ), আসন (নিজের জায়গায় চুপচাপ বসে থাকা), দ্বৈধিভাব (শত্রুদের বিভক্ত করা) এবং সমাশ্রয় (কোন বলবান রাজার আশ্রয় নেওয়া)– রাজনীতির এই ছয়টি অঙ্গের ব্যবহার সম্পর্কে জ্ঞানী, সকল শাস্ত্রের নিপুণ বিদ্বান্, যুদ্ধ ও সঙ্গীতের কলায় কুশল, সর্বত্র ক্রোধরহিত, এই উপরোক্ত গুণাবলী ছাড়াও অসংখ্য গুণাবলীতে সমৃদ্ধ: মননশীল, পরম কান্তিমান দেবর্ষি নারদ।
উপনিষদে স্বয়ং নারদজী বলেন যে–
হে ভগবন্! আমি ঋগ্বেদ, যজুর্বেদ, সামবেদ এবং চতুর্থ অথর্ববেদকে স্মরণ করে থাকি। এবং পঞ্চম ইতিহাস পুরাণ বেদানাংবেদং (ব্যাকরণ) পিত্র্য (পিতৃ-শুশ্রুষা বিজ্ঞান) রাশি (গণিত) দৈববিদ্যা, নিধিবিদ্যা, বাকোবাক্য (তর্কশাস্ত্র) একায়নবিদ্যা (নীতিশাস্ত্র) দেববিদ্যা, ব্রহ্মবিদ্যা, ভূতবিদ্যা, ক্ষত্রবিদ্যা, নক্ষত্রবিদ্যা, সর্পদেবজনিতবিদ্যা। এই সকল বিদ্যাকে হে ভগবন্! আমি স্মরণ করে থাকি। (ছান্দোগ্য উপনিষদ্- ৭/১/২)
[শ্লোক ও পদার্থ সহ প্রথম খণ্ডে দেওয়া হয়েছে]
তিঁনি ব্রহ্মার মানসপুত্র তথা অন্যান্য বিবিধ পরিচয় পুরাণাদিতেও পাওয়া যায়।
এসকল তথ্য থেকে বুঝা যায় যে নারদ কোন এক ব্যক্তির নাম না হয়ে উপাধি এটিই যুক্তিযুক্ত ও গ্রহণীয়। কেননা নারদ যদি কেবল একই ঋষির নাম হতো তাহলে রামায়ণকালেও নারদজীর উল্লেখ আবার মহাভারকালাদিতেও নারদজীর উপস্থিতির উল্লেখ পাওয়া যেতোনা। কেহ কেহ বলেন - নারদ কৃতযুগ হইতে পাণ্ডব যুধিষ্ঠিরাদির সময় পর্যন্ত বা তারও অধিক কাল জীবিত ছিলেন বা আছেন ইহা অযৌক্তিক ও অপ্রামাণিক বলিয়া পরিত্যাজ্য। তাছাড়া নারদ প্রণীত বিবিধ গ্রন্থাদি যা উপলব্ধ তা বিচার্য বিষয়, যেমন পূর্ব খণ্ডে উল্লেখ করেছি যে নারদপুরাণকে নারদ প্রণীত বলা হয়েছে যা সঠিক নয়।
পুরাণ বিমর্শ - (দ্বিতীয় খণ্ড)
✍️প্রিয়রত্ন বিদ্যার্থী