মিত্র-বরুণ ও উর্ব্বশী
মিত্র-বরুণ ও উর্ব্বশীর বিষয়ে যা লিখেছিলাম তা বেদ ও বৈদিক শাস্ত্রোক্ত মিত্র-বরুণ ও উর্ব্বশীর আখ্যানের সাথে মিলানো নিরর্থক । বেদোক্ত বিষয়টি জ্ঞাত করানোর জন্য তথা বেদেও একই অশ্লীলতা আছে এই ভ্রম দূর করার জন্য অত্র এই বিষয়ে পণ্ডিত রামনাথ বেদালঙ্কারজীর সংক্ষিপ্ত লেখনী তুলে ধরছি–
মিত্রাবরুণ এবং উর্ব্বশী থেকে বসিষ্ঠের উৎপত্তি
বেদে বাসিষ্ঠের জন্ম সম্পর্কে লেখা আছে –
উতাসি মৈত্রাবরুণো বসিষ্ঠ উর্বশ্যা ব্রহ্মন্ মনসোঽধিজাতঃ ।ইপ্সং স্কন্ত্রং ব্রহ্মণা দৈব্যেন বিশ্বে দেবাঃ পুষ্করে ত্বাদদন্ত ॥
(ঋগ্বেদ-৭/৩৩/১১)
"হে বসিষ্ঠ, তুমি মিত্র ও বরুণের পুত্র, হে ব্রহ্মন্, তুমি উর্ব্বশীর মন থেকে উৎপন্ন হয়েছো।" কিন্তু এ কি পুরাণের সেই বসিষ্ঠ ঋষি, যার জন্ম সম্পর্কে লেখা আছে যে, উর্ব্বশী নামক অপ্সরাকে দেখে মিত্র-বরুণের বীর্য খলিত হয়ে যায়, তা কুম্ভে গিয়ে পতিত হয়, তা থেকে বসিষ্ঠ ঋষি উৎপন্ন হয়। ইহা কি সম্ভব? বেদের বসিষ্ঠ ঋষি তো অন্য কিছু। সম্পূর্ণ মন্ত্রের অর্থ দৃষ্টিপাত করুন–
(বসিষ্ঠ, উত মৈত্রাবরুণঃ অসি) হে বসিষ্ঠ, তুমি মিত্র ও বরুণের পুত্র, (ব্রহ্মন্, উর্বশ্যাঃ মনসঃ অধিজাতঃ) হে ব্রহ্মন্, তুমি উর্ব্বশীর মনঃকামনা হইতে উৎপন্ন হয়েছো। (দৈব্যেন ব্রহ্মণা) দিব্য নিয়মানুসারে (দ্রপ্সং স্কন্নং ত্বা) ফোঁটা রূপে নিম্নে পতিত তোমায় (বিশ্বে দেবাঃ পুষ্করে অদদন্ত) সকল দেবতা পুকুরে পৌঁছে দিয়েছে।
বেদের বসিষ্ঠ বৃষ্টির ফোঁটা নয়, তো আর কি? অথর্ববেদে স্পষ্টই বৃষ্টির জলকে মিত্র-বরুণের পুত্র বলা হয়েছে– "ন বর্ষং মৈত্রাবরুণং ব্রহ্মজ্যমভিবর্ষতি" (অথর্ববেদ-৫/১৯/১৫)। অন্যত্রও মিত্র ও বরুণকে বৃষ্টির অধিপতি মানা হয়েছে– মিত্রাবরুণৌ বৃষ্ট্যধিপতী (অথর্ববেদ-৫/২৪/৫)। এজন্য মিত্র-বরুণ থেকে উৎপন্ন এই বসিষ্ঠ বৃষ্টির জল'ই। এই মিত্র-বরুণ দুই বায়ু, যা বৃষ্টিতে সহায়ক হয়। উর্ব্বশী কি? উর্ব্বশী হলো "বিদ্যুৎ" তা ঋগ্বেদ-৫/৪১/১৯ থেকে স্পষ্ট। যখন মিত্র-বরুণ বায়ুর মিশ্রন হয় এবং আকাশে বিদ্যুৎ চমকায় তখন বৃষ্টি হয়। এইপ্রকার বৃষ্টির জল উর্ব্বশীর পুত্র হয় এবং মন্ত্রানুসারে ফোঁটারূপে পতিত হয়ে তা পুকুরাদিতে চলে যায়।
আপনি বলতে পারেন, আপনি তো অনেক হুঁশিয়ার। বেদেও তো লেখা আছে– কুম্ভে রেতঃ সিষিচতুঃ সমানম, মিত্র ও বরুণ কুম্ভে বীর্য সেচন করেন, ততো জাতমৃষিমাহুর্বসিষ্ঠম, তা থেকে বসিষ্ঠ ঋষি উৎপন্ন হয়। একে আপনি চুপচাপ এড়িয়ে গেছেন। না, এড়িয়ে যাইনি, সেই মন্ত্রও নিয়ে নিন–
সত্রে হ জাতাবিষিতা নমোভিঃ কুম্ভে রেতঃ সিষিচতুঃ সমানম্ । ততো হ মান উদিয়ায় মধ্যাৎ ততো জাতমৃষিমাহুর্বসিষ্ঠম্ ॥
(ঋগেদ৭/৩৩/১৩)
এখানেও বসিষ্ঠ বৃষ্টির ফোঁটা'ই। রেতস শব্দ নিঘণ্টু অনুসারে জলবাচী। 'কুম্ভ' সাধারণ কুম্ভকারের বানানো ছোট ঘড়া নয়, বরং মহান্ কুম্ভকার পরমেশ্বরের রচিত ভূতল-রূপ বৃহৎ কুম্ভ। এখন মন্ত্রের অর্থ দেখুন–
(সত্রে হ জাতৌ) আকাশে উৎপন্ন (ইষিতৌ) ঈশ্বরীয় নিয়ম দ্বারা প্রেরিত মিত্র-বরুণ বায়ু (সমানম্) একসাথে মিলে (কুম্ভে রেতঃ সিষিচতুঃ) ভূতল-রূপ কুম্ভে জলকে সিঞ্চন করে, অর্থাৎ ভূমিতে জল বর্ষন করে। (ততঃ মধ্যাৎ) সেই বর্ষন হওয়া জল থেকে (মানঃ) কিছু জল-পরিমাণ (উদিয়ায়) বাষ্প হয়ে আকাশে গমন করে, (ততঃ) তা হইতে (বসিষ্ঠম্ ঋষি জাতম্ আহুঃ) বসিষ্ঠ ঋষি জাত হয় বলা হয়।
এখানে এই প্রাকৃতিক নিয়মকে দর্শানো হয়েছে যে, মিত্র-বরুণ হাওয়ার কারণে যে জল পৃথিবীতে বর্ষন হয়, তা হইতে অনেকাংশ সূর্যতাপ দ্বারা বাষ্প হয়ে পুনঃ আকাশে চলে যায় এবং মেঘ হয়ে যায়। সেই মেঘ পুনঃ ফোঁটারূপে বর্ষিত বসিষ্ঠ বলা হয়। এই মন্ত্রকে নিয়েই বৃহদ্দেবতা গ্রন্থে এই আশয়ের কাহিনী রচনা করেছে যে, উর্ব্বশীর দর্শন দ্বারা মিত্র-বরুণের রেতঃ খলিত হয়ে কুম্ভে পতিত হওয়ায় বসিষ্ঠ ঋষি উৎপন্ন হয়। হয়তো তা লিখা হয়েছে বেদের বর্ণনকে রোচক বানানোর জন্য, কিন্তু এখন তো তা ভ্রান্তি উৎপন্ন করার কারণ হয়ে যাচ্ছে। সায়ণাচার্য বৃহদ্দেবতার কাহিনীকে উদ্ধৃত করেই সন্তোষ করে নিয়েছেন। ব্যস, মন্ত্রের ব্যাখ্যা হয়ে গেছে। সায়ণাচার্যও সন্তুষ্ট, পাঠকও সন্তুষ্ট ব্যস, সত্য-মিথ্যা যেমনই হোক এই কাহিনী, তা নিয়েই মন্ত্র রচিত হয়েছে, যদ্যপি কথা এর বিপরীত, অর্থাৎ মন্ত্রকে নিয়ে কাহিনী নির্মাণ করা হয়েছে।
📚পুরাণ বিমর্শ (২য় খণ্ড)
🖋️প্রিয়রত্ন বিদ্যার্থী
©️অমৃতস্য পুত্রাঃ
Tags:
পুরাণ বিমর্শ