সর্বশক্তিমান মানে কি?

 সর্বশক্তিমান  

উপরোক্ত এই বিষয়ক কথন হলেই  পৌরাণিক অনেকে প্রশ্ন করেন যে, ঈশ্বর তো সর্বশক্তিমান, তাহলে তিনি নিরাকার থেকে সাকার কেন হতে পারবেন না, অবতার কেন হতে পারবেন না? যদি না হতে পারেন তাহলে তো তিনি আর সর্বশক্তিমান হলেন না। অর্থাৎ তাদের কথা হলো ঈশ্বর সবকিছুই করতে পারেন, করেন তাই ঈশ্বর সর্বশক্তিমান। আচ্ছা তাহলে ঈশ্বর কি নিজের মতো অন্য  ঈশ্বর বানাতে পারবেন? যদি বলেন না তাহলে তিঁনি সর্বশক্তিমান রইলেন না। যদি বলেন হ্যাঁ, তাহলে ঈশ্বর একের অধিক হয়ে যাবে, এবং দ্বিতীয়  ঈশ্বর বানানো হলেও তিঁনি প্রথম ঈশ্বরের মতো কখনোই হবেন না, দ্বিতীয় ঈশ্বর প্রথম ঈশ্বরের মতো অনাদি হবেন না, নতুন হবেন, এরূপ বিবিধ অমিল হবে।  এরূপ প্রশ্নও দেখা যায় যে - ঈশ্বর কি এমন এক বস্তু নির্মাণ করতে পারবেন যা তিঁনি বহন করতে পারবেন না, ভাঙ্গতে পারবেন না? যদি বলা হয় হ্যাঁ, তাহলে শক্তিহীনতার বিষয় চলে আসবে, যদি বলা হয় না তাহলেও শক্তিহীনতার বিষয় চলে আসবে। একেই বলে 'উভয়তঃ পাশা রজ্জুঃ' হ্যাঁ বললেও ছাড় নেই, না বললেও ছাড় নেই, উভয় দিকেই সমস্যা। এমনই অনেক প্রশ্ন আসবে যদি পৌরাণিকদের দৃষ্টিকোণ অনুযায়ী ঈশ্বরকে সর্বশক্তিমান বলা হয়। এই বিষয়ে ঋষি দয়ানন্দ সত্যার্থ প্রকাশেও লিখেছেন, যা পড়লে ঈশ্বরকে কেন সর্বশক্তিমান বলা হয় তা বুঝতে পারবেন। তা এরূপ –

প্রশ্ন- ঈশ্বর সর্বশক্তিমান কি না?

উত্তর- হ্যাঁ, কিন্তু তুমি সর্বশক্তিমান শব্দের অর্থ যাহা জানো তাহা নহে। 'সর্বশক্তিমান' শব্দের অর্থ এই যে, ঈশ্বর স্বীয় কর্ম অর্থাৎ সৃষ্টি স্থিতি প্রলয়াদি এবং সর্বজীবে পাপ পুণ্যের যথাযোগ্য ব্যবস্থা করিতে, কাহারও কিছুমাত্র সহায়তা গ্রহণ করেন না। অর্থাৎ তিনি তাঁহার অনন্ত সামর্থ্য দ্বারা নিজের যাবতীয় কর্ম পূর্ণ করিয়া থাকেন।

প্রশ্ন- এইরূপ মানি যে, ঈশ্বর যাহা ইচ্ছা তাহাই করেন। কারণ তাঁহার উপর দ্বিতীয় কেহই নাই।

উত্তর- তিনি কী ইচ্ছা করেন? যদি তুমি বল যে, তিনি সমস্তই ইচ্ছা করেন, সমস্তই করিতে পারেন, তবে আমি তোমাকে জিজ্ঞাসা করি, পরমেশ্বর কি আত্মহত্যা করিতে পারেন? তিনি বহু ঈশ্বর সৃষ্টি করিতে পারেন? পরমেশ্বর মূর্খ হইতে পারেন? পরমেশ্বর কি চুরি, ব্যভিচারাদি পাপকর্ম করিয়া দুঃখী হইতে পারেন? যদি এই সকল কর্ম ঈশ্বরের গুণকর্ম ও স্বভাব বিরুদ্ধ হয়, তাহা হইলে তুমি বলিতেছ-'তিনি সবকিছু করিতে পারেন', এ উক্তি কখনও প্রযুক্ত হইতে পারে না। সুতরাং আমি সর্বশক্তিমান্ শব্দের যে অর্থ করিয়াছি, তাহাই ঠিক্।
             (সত্যার্থ প্রকাশ,সপ্তম সমুল্লাস)

প্রথম সমুল্লাসেও লিখেছেন – 
'সর্বাঃশক্তয়োঃ বিদ্যন্তে য়স্মিন স সর্বশক্তিমানীশ্বরঃ'। যিনি স্বকার্য সাধনে অন্য কাহারও সহায়তা ইচ্ছা করেন না, কিন্তু নিজ সামর্থ্য দ্বারাই স্বীয় সর্ব কার্য্য পূর্ণ করেন, এই কারণে সেই পরমেশ্বরের নাম 'সর্ব্বশক্তিমান'।

কোন কোন পৌরাণিক আবার বলেন যে, যদি জীব অজ হওয়া সত্ত্বেও জন্ম নিতে পারে, তবে পরমাত্মা পারবে না কেন? তোমাদের (আর্য সমাজের) পরমাত্মা কি জীব অপেক্ষাও অল্প শক্তিবিশিষ্ট?

জীবের জন্ম বলতে দেহে প্রবেশ বা দেহ ধারণ করা। একটা বিষয় জেনে রাখা উচিৎ যে, জীবাত্মা অসংখ্য এবং অতিব ক্ষুদ্র তথা সূক্ষ্ম। এতটাই ক্ষুদ্র ও সূক্ষ্ম যে পিপীলিকার চেয়ে আরো ক্ষুদ্র দেহেও আত্মা থাকার জন্য যথেষ্ট স্থান হয়ে যায়। আর পরমাত্মা এতটাই বিশাল যে কোন উপমা দিয়েও বুঝানো সম্ভব না, সম্পূর্ণ বিশ্ব ব্রহ্মাণ্ডই কিন্তু পরমাত্মার মধ্যে অবস্থিত - ব্রহ্মাণ্ড কত বড় অনুমান করতে পারেন? 

এবার ধরুন আপনার হাতে খুবই ছোট একটি শিশি আছে, তাতে অনায়াসে একটি পিঁপড়েও প্রবেশ করতে পারবে এবং খুব ভালোভাবেই শিশিটির ভিতর থাকতে পারবে। কিন্তু আপনি কি এর ভিতরে প্রবেশ করতে পারবেন? যদি না পারেন তাহলে এর মানে কি মনুষ্য অপেক্ষা পিঁপড়ে অধিক শক্তিমান প্রমাণিত হয়ে যাবে?

সর্বব্যাপক পরমাত্মার তুলনায় সকল জীবদেহই অতিব ক্ষুদ্র আর জীবাত্মার তুলনায় যথেষ্ট।

এভাবে বুঝুন– রাষ্ট্রের সংবিধান একবার নির্মিত হয়ে গেলে, তা রাজা বা প্রজা কারো জন্যই তা লঙ্ঘনীয় নয়। যদি কেউ এর লঙ্ঘন করে, তাহলে উচ্চতম ন্যায়ালয়  তাৎক্ষণিকভাবে তাকে অবৈধ ঘোষণা করে এবং অবৈধ কাজে যুক্ত ব্যক্তিকে শাস্তিপ্রদান করা হয়। যদি চোর-ডাকাতরাও স্বাধীনতার অধিকারের জন্য আবেদন জানাতে শুরু করে, তাহলে কোনও রাজ্যেই ন্যায়বিচার ও শৃঙ্খলা বজায় রাখা সম্ভব হবে না। একইভাবে, 'বিষমপ্যমৃত ক্বচিদ্ ভবেদমৃত বা বিষমীশ্বরেচ্ছ্যা' - যখনই, ঈশ্বরের ইচ্ছায়, অমৃত বিষে পরিণত হয় বা বিষ অমৃত হয়ে যায় - তখন, বিশ্বের সমস্ত ডাক্তার কোনও রোগ নিরাময় করতে পারবে না। সৃষ্টি-রচনার জন্য, সৃষ্ট প্রতিটি পদার্থের জন্য এক বিশেষ নিয়ম অথবা উদ্দ্যেশ্য রয়েছে - তাকেই  সৃষ্টি-রচনার সংবিধান বলা হয়। সৃষ্টির শুরুতে, ঈশ্বর নিজেই সেই সংবিধান তৈরি করে দিয়েছেন। ঈশ্বর নিজের বা তাঁর প্রজাদের উভয়ের জন্যই এই সংবিধান অলঙ্ঘনীয়। রাষ্ট্রীয় সংবিধানে বিবিধ সময় বিবিধ সংশোধন করা হয়। কিন্তু ঈশ্বরের সৃষ্টির সংবিধান সংশোধন করতে হয়না। যা আছে, তাই। কারণ সংশোধন বলতে অসম্পূর্ণতা বোঝায়, এবং ঈশ্বরের সংবিধানে কোনও অসম্পূর্ণতা থাকতে পারে না, তাই ইহা সংশোধন করতে হয়না। ঐশ্বরিক সংবিধান একই থাকবে। ঈশ্বরের তাৎপর্য এই যে, পৃথিবীর সমস্ত নক্ষত্র, গ্রহ এবং জড় বস্তু তাঁর তৈরি নিয়ম অনুসারে গতি করতে থাকে। যদি নিয়ম লঙ্ঘন করা হয় তাহলে সৃষ্টিচক্র ব্যাহত হবে। তিঁনি নিয়ামক হয়ে যদি নিজেই নিয়ম ভঙ্গ করেন তাহলে তাঁর মহত্ত্ব বৃদ্ধি হয়না বরং নিয়মভঙ্গের দোষী হয়। আর বেদে যে ঈশ্বরকে শরীররহিত, জন্মরহিত বলা হয়েছে তার প্রমাণ পূর্বেই দিয়েছি।

📚পুরাণ বিমর্শ
🖋️প্রিয়রত্ন বিদ্যার্থী
©️অমৃতস্য পুত্রাঃ 

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Please Select Embedded Mode To Show The Comment System.*

নবীনতর পূর্বতন