সপ্ত ঋষি
সপ্ত-ঋষি কি? এটা এক বিচারণীয় বিষয়। সৃষ্টির আদিযুগে উৎপন্ন সপ্ত-ঋষিদের না নিয়ে আমি বেদান্তর্গত সপ্ত-ঋষির এক বিশিষ্ট স্বরূপ নিয়েই বিচার করছি। বেদে তো ঋষি অনেক আছে। তাদের পরস্পর গোত্র-সম্বন্ধও পূর্বাচার্যেরা নির্দেশ করেছেন। কিন্তু সপ্ত ঋষির সাহচর্য কোন সম্বন্ধকে দ্যোতিত করে, আর এই সাহচর্যের দৃষ্টিতে উহার বাস্তকিক স্বরূপ ও কার্য্য কি ইহা এক অত্যন্ত গম্ভীর বিষয়। অধিভূত, অধিদৈব ও অধ্যাত্মাদি তিন ক্ষেত্রেই এ নিয়ে বিচার হতে পারে কিন্তু আমি অধ্যাত্ম ক্ষেত্রেই সংক্ষেপে বিচার করার প্রযত্ন করছি। সপ্ত ঋষির সম্বন্ধে এক মন্ত্র যা এই প্রকার–
তদাসত ঋষয়ঃ সপ্ত সাকং যে অস্য গোপা মহতো বভূবুঃ॥ (অথর্ব০ ১০/৮/৯)
এ এক চমস যার ছিদ্র নিচের দিকে, আর মূল উপরের দিকে। তাতে বিশ্বরূপ যশ ভরপুর। এই চামচের মধ্যে সাত ঋষি একে অপরের সমীপে স্থিত, যারা সদা এর রক্ষা করে।
এই মন্ত্রে যা বলা হয়েছে তা সৌরমণ্ডল এবং মানবদেহ উভয়ের মধ্যে ঘটে। সৌরমণ্ডলে উর্ধ্ববুধ্ন চমস সূর্য, যার কিরণ নিচের দিকে প্রবাহিত হচ্ছে। এই সপ্তকিরণ সপ্তঋষি। শরীরে প্রতিষ্ঠিত এই সপ্তঋষির কেন্দ্র শরীরের মূর্ধা (মস্তক) , যাকে চমস বলা হয়েছে। এই চমস (মস্তক) এর পৃষ্ঠ উপরে এবং ছিদ্র (রন্ধ্র) নিচের দিকে। এই ছিদ্রের (রন্ধ্রের) দ্বারা মূর্ধায় ভরপুর বিশ্বরূপ যশ নিচের দিকে প্রবাহিত হয়। *সপ্তঋষি সাত ইন্দ্রিয়, যা এতে স্থিত হয়ে এর রক্ষা করেতেছে। এই সপ্তঋষি হলো দুই কান, দুই নাসাছিদ্র, দুই চক্ষুগোলক, ও এক মুখ। শতপথ ব্রাহ্মণ (১৪/৫/২) এ এই মূর্ধায় স্থিত এদেরই ঋষি বলা হয়েছে। এবং সেখানে বলা হয়েছে যে, দুই কান গৌতম এবং ভরদ্বাজ, দুই নাসিকা বসিষ্ঠ এবং কশ্যপ, দুই চক্ষু বিশ্বামিত্র এবং জমদগ্নি। আর মুখ হলো অত্রি। এখানে এটা ধ্যান রাখা আবশ্যক যে, কান বা নাসিকাদির গোলক সপ্তঋষি নয়, অপিতু মস্তকে বিদ্যমান এর কেন্দ্রগত শক্তি ঋষি। পরন্তু এই সম্বন্ধেও ইহা বিচারণীয় যে, সামান্য ব্যক্তিদের চক্ষু,কান আদি ইন্দ্রিয় শক্তি কি ঋষি? আমাদের বিচারে এমন নয়। যদি সকল মনুষ্যের ঐন্দ্রিয়িক শক্তিকে ঋষি বলতে শুরু করে তাহলে সকলে পারদৃশ্বা ঋষি হয়ে যাবে। শতপথ ব্রাহ্মণে★ বলা হয়েছে, মস্তকে যে সাত প্রাণ রয়েছে তা দ্বারা যখন স্তুতি করা হয় তখন সপ্তঋষি উৎপন্ন হয়। এই ইন্দ্রিয় কখন ঋষি হয়? এবং এর শক্তি কতটা ব্যাপক হয়, এর সুন্দর বিবেচন শতপথ ব্রাহ্মণে রয়েছে। এই◑ চক্ষু যখন সম্পূর্ণ জগৎকে দর্শন করতে শুরু করে, তখন তাকে জমদগ্নি ঋষি বলা হয়। স্বল্প প্রদেশ দর্শনকারী সামান্য ব্যক্তিদের চক্ষু ইন্দ্রিয় জমদগ্নি ঋষি নয়। যখন⊕ শ্রোত্র অনন্ত দিশার দূর হইতে শব্দ শ্রবণ করে নেয় এবং সকলদিক হইতে মিত্রবাক্যকেই শ্রবণ করে, তখন তাকে বিশ্বামিত্র ঋষি বলা হয়। এবং বাক্✪ বিশ্বকর্মা ঋষি সেই অবস্থায় হয়, যখন বাণীমাত্র উচ্চারণ দ্বারাই সকলকিছু উৎপন্ন বা সম্পন্ন হয়ে যায়। এইপ্রকার অন্য ইন্দ্রিয় সম্বন্ধে বলা হয়েছে। অতঃ আমরা এটা বলতে পারি যে, এই ইন্দ্রিয়সমূহের শক্তি যখন ব্যাপক হয়ে যায়, নিজ মূলস্রোতের সমান হয়ে যায়, তখন তাদের ঋষি বলা হয়। এক ইন্দ্রিয় অনেক ঋষি হতে পারে––
শাস্ত্রে এক ইন্দ্রিয়কে বিবিধ ঋষির নাম দেওয়া হয়েছে। বিশ্বামিত্র বাক্ও শ্রোত্রও। ভরদ্বাজ মনও এবং কানও। বাক্ বিশ্বামিত্র, বসিষ্ঠ এবং বিশ্বকর্মা এই তিন ঋষি। এইপ্রকার এই তথ্যের জ্বলন্ত উদাহরণ যে, এই ঋষি কোন ব্যক্তি নয়। বিশেষকরে বেদে তো ইহা বিভিন্ন-বিভিন্ন গুণ ও শক্তি আদির বাচক। এক ইন্দ্রিয়ে অনেকপ্রকার গুণ ও শক্তি উৎপন্ন হতে পারে, যার জন্য তাকে বিবিধ নামে স্মরণ করা যেতে পারে। হ্যাঁ! এখানে এটাকে আমরা অস্বীকার করিনা যে, এই বিশিষ্ট গুণ ও শক্তি ধারণকারী ঐতিহাসিক ঋষি পূর্বে জন্ম নিয়েছেন। পরন্তু বেদের এই ঋষিদের নিয়ে বিচার করার জন্য আমাদের ঐতিহাসিক ঋষি ব্যক্তিদের আবশ্যকতা নেই।
📗প্রমাণ সংগ্রহ–
*সপ্তঽঋষয়ঃ প্রতিহিতাঃ শরীরে সপ্ত রক্ষন্তি সদমপ্রমাদম্ । (যজুর্বেদ-৩৫/৫৫)
কঃ সপ্ত খানি বি ততর্দ শীর্ষণি কর্ণাবিমৌ নাসিকে চক্ষণী মুখম্। (অথর্ববেদ-১০/২/৬)
★য এবেমে সপ্তশীর্ষন্প্রাণাস্তৈরেব তদস্তুবত সপ্তর্ষয়োঽত্রাসৃজ্যন্ত । (শ০ প০ ৮।৪।৩।৬)
◑চক্ষুর্বৈ জমদগ্নির্ঋষির্যদেনেন জগৎ পশ্যতি । (শ০ প০ ৮।১।২।৩)
⊕শ্রোত্রং বৈ বিশ্বামিত্র ঋষির্যদেনেন সর্বতঃ শ্রৃণোত্যথো যদস্যৈ সর্বতোমিত্রং ভবতি তস্মাচ্ছোত্রং বিশ্বামিত্র ঋষিঃ । (শ০ প০ ৫।১।২।৬)
✪বাক্ বৈ বিশ্বকর্মর্ষি বাচা হীদং সর্বং কৃতম্ । (শ০ প০ ৮।১।২।৬)
©️অমৃতস্য পুত্রাঃ