ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণের প্রাচীনতা
গাড়ুর, ব্রহ্মবৈবর্ত,ব্রহ্মাণ্ড পুরাণের বিষয়ে লিখতে গিয়ে, তিনি বলেছেন–
প্রাচীন ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণ এখন বিদ্যমান নাই।
শ্রী
রাধার বিষয়ে লিখতে গিয়েও তিনি একই কথা লিখেছেন –
পণ্ডিত বাবুরাম উপাধ্যায়কৃত অনুবাদিত
ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণের ভূমিকাংশে বিভিন্ন তথ্য সহ বলা হয়েছে যে –
প্রচলিত ব্রহ্মবৈবর্তপুরাণ মূল ব্রহ্মবৈবর্ত
পুরাণ নয়। কারণ মৎসপুরাণ একে রাজস পুরাণ মানে, যাতে ব্রহ্মার স্তুতি
করা হয়েছে–
ব্রহ্মাণ্ডং ব্রহ্মবৈবর্ত
মার্কণ্ডেয়ং তথৈব চ ।
স্কন্দপুরাণীয় 'শিবরহস্য'
খণ্ড অনুসারে এই পুরাণ সবিতার (সূর্যের) প্রতিপাদক মানা হয়।
মৎসপুরাণ অনুসারে এই পুরাণের দানকর্তা ব্রহ্মলোকে নিবাস করেন। এইপ্রকার ব্রহ্মলোক
কে ব্রহ্মার প্রতিপাদক পুরাণ দ্বারা উচ্চতম মানা স্বাভাবিক। মৎস্যপুরাণ অনুসারে 'রাজস' পুরাণে ব্রহ্মারই স্তুতি প্রাধান্যেন
নিবিষ্ট থাকে – 'রাজসেষূ চ মাহাত্ম্যমধিকং ব্রহ্মণো বিদুঃ'
(মৎস০ ৫৩/২৮)। এই দুই বাক্যকে একবাক্যতা করলে ব্রহ্মবৈবর্ত মূলতঃ
ব্রহ্মার প্রতিপাদক পুরাণ প্রতীত হয়। এই তথ্যের সমর্থন এই কথন দ্বারাও হয় যে,
ব্রহ্মবৈবর্ত দাতা ব্রহ্মলোকে পূজিত হয়–
পুরাণং ব্রহ্মবৈবর্ত যো
দদ্যান্মাধমাসি চ ।
স্কন্দপুরাণ (৭,১,২,৫৩) এও এই শ্লোক উপলব্ধ হয়। ফলতঃ পুরাণের
দৃষ্টিতে মূল ব্রহ্মবৈবর্ত ব্রহ্মার স্তুতি তথা মাহাত্ম্যের প্রতিপাদক পুরাণ
নিশ্চিত হয়। এই প্রসঙ্গে স্বয়ং ব্রহ্মবৈবর্তপুরাণের কথনও দ্রষ্টব্য–
'বিবৃতং ব্রহ্ম
কার্ৎস্ন্যেন কৃষ্ণেন যত্র শৌনক ।
উপর্যুক্ত
শ্লোকানুসারে একে মাৎস ও শৈববর্ণিত ব্রহ্মবৈবর্ত মানা যায়না। আবার প্রচলিত
ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণে এত কৃত্রিম বিষয়ের সমাবেশ হয়ে গেছে, তারমধ্যে আদি এবং কৃত্রিম বিষয় বের করা অসম্ভব এর মতো।
কিছু বিদ্বান্ বলেন যে, মুসলমানকালে কোন বাঙ্গালি বিদ্বান্ দ্বারা প্রচলিত ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণে বহু শ্লোক সমাবিষ্ট করানো হয়েছে। যেমনটা ব্রহ্মখণ্ডের বচন দ্বারা জ্ঞাত হয়–
'ম্লেচ্ছাৎ কুবিন্দকন্যায়াং জোলাজাতির্বভূব হ' (১০/১২১)
অর্থাৎ
ম্লেছের ঔরস এবং কুবিন্দ-কন্যার গর্ভ দ্বারা জোলা (জুলাহা) জাতি উৎপন্ন হয়েছে।
কেবল বঙ্গদেশে জুলাহে কে জোলা বলা হয়। পশ্চিমাঞ্চলে তো জোলাহা নামেই প্রচলিত। এই
কারণই যে শঙখচূড়ের যুদ্ধে 'রাঢ়ীয়' এবং 'বারেন্দ্র'
বীরেদের নাম এসেছে।
এবং স্মৃতিচন্দ্রিকা,
হেমাদ্রির চতুর্বর্গচিন্তামণি, রঘুনন্দনের
স্মৃতিতত্ত্ব আদি নিবন্ধে তত্তৎ লেখকরা ব্রহ্মবৈবর্ত থেকে বিপুল বচন উদ্ধৃত
করেছেন। বচনের সংখ্যা ১৫০০ পঙ্তির আশেপাশে, পরন্তু
প্রচলিত ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণে কেবল ৩পঙ্তি প্রাপ্ত হয়। ইহা স্পষ্টতঃ সূচিত করে যে,
প্রচলিত ব্রহ্মবৈবর্ত মূল পুরাণ নয়।
ডা. উমাশঙ্কর শর্মা 'ঋষি'
সংস্কৃত সাহিত্য কা ইতিহাস গ্রন্থে- ডা. আর. সী. হাজরার উদ্ধৃত করেছেন, লিখেছেন
যে, আধুনিক ভারতীয় বিদ্বানরা পুরাণ-সমূহের রচনা-কালের
বিষয়ে পর্যাপ্ত অনুসন্ধান করেছেন, যার মধ্যে ডা. আর. সী.
হাজরার যোগদান বহুমূল্য। ডা. হাজরা লিখেছেন যে- ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণের রচনা ৭০০খ্রিষ্টাব্দে হয়ে গিয়েছিলো, কিন্তু এর
বর্তমান রূপ ১৬০০ খ্রিষ্টাব্দে প্রাপ্ত হয়েছিলো।
ডা. রাধাবল্লভ ত্রিপাঠীও 'সংস্কৃত
সাহিত্য কা অভিনব ইতিহাস' গ্রন্থেও ডা.হাজরার
উদ্ধৃত দিয়ে লিখেছেন যে তিনি মহত্ত্বপূর্ণ শোধকার্য করেছেন।
পদ্মভূষণ শ্রী বলদেব উপাধ্যায় সম্পাদিত 'সংস্কৃত
বাঙ্ময় কা বৃহৎ ইতিহাস' গ্রন্থের ত্রয়োদশ খণ্ডে-
ডা. সূর্যকান্তকৃত 'বৈদিক বাঙ্ময় কা ইতিহাস' গ্রন্থের রেফারেন্স দিয়ে লিখেছেন যে - ব্রহ্মবৈবর্ত এর বিষয়ে বিদ্বানদের
কথন এই যে, ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণের রচনা ৭০০খ্রিষ্টাব্দে
পূর্ণ হয়ে গিয়েছিলো, কিন্তু এর বর্তমান রূপ ১৬০০
খ্রিষ্টাব্দে প্রাপ্ত হয়েছিলো।
ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণে বেদবিরোধী, অযৌক্তিক, অশ্লীলতা, গোমাংসাদি ভক্ষণের উল্লেখ দ্বারা অন্ততপক্ষে এই পুরাণ অর্বাচীন বা প্রক্ষিপ্ত মানতেই হয়। আর যদি প্রক্ষিপ্ত হয় তো আগে সঠিকটা আনা উচিৎ, এবং তাতেই দেখা যাবে রাধার বিবাহ সত্য কি মিথ্যা।
অমৃতস্য পুত্রাঃ