প্রচলিত অষ্টাদশ পুরাণ কতটুকু মান্য?

0

প্রচলিত অষ্টাদশ পুরাণ কতটুকু মান্য?

পর্বঃ১

(১)"পুরাণ" সংজ্ঞা বিচার।

(২)বর্তমানে প্রচলিত পুরাণসমূহের নাম এবং রচয়িতা নিয়ে সংশয়।

প্রথমেই জেনে নেওয়া যাক "পুরাণ" বলতে কি বোঝায়?

★আর্যভাষ্য অনুসারেঃ

পুরাণঃ=প্রাচীণ।অথর্ববেদ(২০/১৭/৫);
ভাষ্যঃক্ষেমকরণদাস ত্রিবেদী।
পুরাণম্=পুরাতন।অথর্ববেদ(১০/৭/২৬);
ভাষ্যঃক্ষেমকরণদাস ত্রিবেদী।
পুরাণম্=প্রবাহরূপ(প্রথম অবস্থা) থেকে সনাতন(চিরন্তন)।অথর্ববেদ(১০/৭/২৬);
ভাষ্যঃহরিশরণ সিদ্ধান্তলংকার।

পুরাণবত্=প্রথম এর সমান বা প্রথম এর মত।অথর্ববেদ(২০/১৭/৯);ভাষ্যঃক্ষেমকরণদাস ত্রিবেদী।

পুরাণী=সনাতন কাল হতে চলে আসা শক্তি।অথর্ববেদ(১০/৮/৩০);ভাষ্যঃহরিশরণ সিদ্ধান্তলংকার।

পুরাণীঃ=পুরাতন নদীসমূহ।অথর্ববেদ(১২/২/৪১);ব্যাখ্যাঃপণ্ডিত দামোদর সাতবলেকর।

সায়ণাচার্য্যের মতেঃ

পুরাণানি=সৃষ্ট্যাদিপ্রতিপাদকানি পুরাণানি।কৃষ্ণযজুর্বেদীয় তৈত্তিরীয় আরণ্যক(২/৯);ভাষ্যঃসায়ণাচার্য্য।

আদি শঙ্করাচার্য্যের মতেঃ

পুরাণম্="অসদ্বা ইদমগ্র আসীত্" অর্থাৎ শুরুতে যা অসৎ ছিল ইত্যাদি।

 বৃহদারণ্যক উপনিষদ(২/৪/১০), গীতাপ্রেস(শঙ্করভাষ্য)।

নিঘন্টু অনুসারেঃ

প্র॒ত্নম্ । প্র॒দিবঃ॑ । প্রব॑য়াঃ । সনৈমি । পূর্ব্যম্ (২) ।
অহ্নায় । ইতি ষট্ পুরাণনামানি ॥নিঘন্টু(৩/২৭)

অর্থাৎ প্রত্নম্,প্রদিবঃ,প্রবয়াঃ,সনৈমি,পূর্ব্যম্(২),অহ্নায় এই ছয়টি পুরাণের নাম।

উপরোক্ত প্রমাণ অনুসারে "পুরাণ" হল পুরাতন,সৃষ্টিবিদ্যা বিষয়,পুরাতন নদীসমূহ নতুন হয়ে প্রবাহিত হয়,সনাতন কাল হতে চলে আসা শক্তি।

কিন্তু দুঃখের বিষয় আমরা বর্তমানে "পুরাণ" বলতে বুঝি প্রচলিত অষ্টাদশ পুরাণ নামে খ্যাত গ্রন্থগুলোকে।

★বিষয় (২)

প্রচলিত অষ্টাদশ পুরাণের সংখ্যা,নাম এবং রচয়িতা নিয়ে সংশয়।

(ক)আমরা সবাই জানি পুরাণ হল ১৮ টি।যদিও কেউ কেউ মহাপুরাণ এবং উপপুরাণ নাম দিয়ে তাদের আলাদা করে বলে কিন্তু সেই সংখ্যাটি নিয়েও আটকে যায়।কেউ বলে ১৮ টি মহাপুরাণ,১২ টি উপপুরাণ!মজার বিষয় হল কেউ কেউ আবার ১৮ টি উপপুরাণ মানেন।তাই আগে প্রচলিত পুরাণগুলোর সংখ্যা সঠিকভাবে উপস্থাপন করা দরকার।

(খ)প্রচলিত পুরাণগুলোর নাম নিয়েও আছে সংশয়,সেগুলো আজকে পুরাণ থেকেই জানবো।

প্রথমেই দেখি নামধারী বৈষ্ণব মান্যতার শ্রেষ্ঠ পুরাণ শ্রীমদ্ভাগবত পুরাণ থেকে।

ব্রাহ্মং পাদ্মং বৈষ্ণবং চ শৈবং লৈঙ্গং সগারুড়ম্ ।
নারদীয়ং ভাগবতমাগ্নেয়ং স্কান্দসংজ্ঞিতম্ ॥ 
ভবিষ্যৎ ব্ৰহ্মবৈবর্তং মার্কণ্ডেয়ং সবামনম্ ।
বারাহং মাৎস্যং কৌর্মং চ ব্রহ্মাণ্ডাখ্যমিতি ত্ৰিষট্ ৷৷ 
শ্রীমদ্ভাগবতপুরাণ(১২/৭/২৩-২৪),প্রভুপাদ ভাষ্য

অনুবাদঃআঠারটি মুখ্য পুরাণ হচ্ছে, ব্রহ্মা, পদ্ম, বিষ্ণু, শিব, লিঙ্গ, গরুড়, নারদ, ভাগবত,অগ্নি, স্কন্ধ, ভবিষ্য, ব্রহ্মবৈবর্ত্ত, মার্কণ্ডেয়, বামন, বরাহ, মৎস্য, কূর্ম এবং ব্রহ্মাণ্ডপুরাণ।

এই শ্লোকগুলো সত্য হওয়ার প্রমাণ—

তাৎপর্যঃশ্রীল জীব গোস্বামী বরাহ পুরাণ, শিব পুরাণ এবং মৎস্য পুরাণ থেকে উদ্ধৃতি

দিয়ে উপরোক্ত দুটি শ্লোককে সমর্থন করেছেন।

এবার অন্যপুরাণ কি বলছে দেখে আসি।

ব্রাহ্মং পাদ্মং বৈষ্ণবঞ্চ শৈবং ভাগবতং তথ্য ।
 তথৈব নারদীয়ন্ত মার্কণ্ডেয়ন্তু সপ্তমম্ ॥ ১৪
 আগ্নেয়মষ্টমং প্রোক্তং ভবিষ্যৎ নবমং তথা।
দশমং ব্রহ্মবৈবর্ত্তং লৈঙ্গমেকাদশঃ স্মৃতম্ ॥ ১৫ 
দ্বাদশক বারাহক বামনঞ্চ ব্রয়োদশম্ । 
কৌর্য চতুৰ্দ্দশ: প্রোক্তং মাধ্যং পঞ্চদশঃ স্মৃতম্ ॥১৬
ষোড়শং গারুড়ং প্রোক্তং স্কান্দং সপ্তদশং স্মৃতম। 
অষ্টাদশপ্ত ব্রহ্মাণ্ডং পুরাণাণি যথাক্রমম্ ॥ ১৭
পদ্মপুরাণ,উত্তরখন্ড,অধ্যায়ঃ২৩৬

প্রথম ব্রাহ্ম, দ্বিতীয় পাদ্ম, তৃতীয় বৈষ্ণব, চতুর্থ শৈব, পঞ্চম ভাগবত, ষষ্ঠ নারদীয়, সপ্তম মার্কণ্ডেয়, অষ্টম আগ্নেয়, নবম ভবিষ্য, দশম ব্রহ্মবৈবর্ত্ত,একাদশ লৈঙ্গ, দ্বাদশ বরাহ, ত্রয়োদশ বামন, চতুর্দ্দশ কৌর্ম্ম, পঞ্চদশ মাৎস্য, ষোড়শ গারুড়, সপ্তদশ স্কান্দ এবং অষ্টাদশ ব্রহ্মাণ্ড যথাক্রমে এই অষ্টাদশ পুরাণ বর্ণিত হইয়াছে।

শ্রীমদ্ভাগবত পুরাণ এবং পদ্মপুরাণে বর্ণিত পুরাণসমূহের নামের মিল আছে।পদ্মপুরাণের অন্য একটি শ্লোক দেখাযাক—

মাৎস্যং কৌৰ্ম্মং তথা লৈঙ্গং শৈবং স্কান্দ তথৈব চ ।
অগ্নেয়ক ষড়েতানি তামসানি নিবোধ যে ॥ ১৮ 
বৈষ্ণবং নারদীয়ঞ্চ তথা ভাগবতং শুভম্ ।
 গাড়ক তথা পাদ্মং বারাহং শুভদর্শনে ॥ ১৯
সাত্ত্বিকানি পুরাণানি বিজ্ঞেয়ানি শুভানি বৈ । 
ব্রহ্মাণ্ডং ব্রহ্মবৈবর্তং মার্কণ্ডেয়ং তথৈব চ ॥ ২০ 
ভবিষ্যৎ বামনং ব্রাহ্মং রাজসানি নিবোধ যে।
পদ্মপুরাণ,উত্তরখন্ড,অধ্যায়ঃ২৩৬

অনুবাদঃএতন্মধ্যে মংস্য, কুৰ্ম্ম, লিঙ্গ, শিব, স্কন্দ ও অগ্নি এই ছয়খানি পুরাণ তামস বলিয়া বিদিত। হে শুভাননে! বিষ্ণু, নারদীয়, শুভ ভাগবত, গরুড়, পদ্ম ও বরাহ— এই শুভ সপ্ত পুরাণ সার্বিক বলিয়া জ্ঞাত হও। ব্রহ্মাণ্ড, ব্রহ্মবৈবর্ত্ত, মার্কণ্ডেয়, ভবিষ্য, বামন ও ব্রহ্ম এই সকল পুরাণ রাজস বলিয়া জানিবে ।

★লিঙ্গপুরাণ কি বলে সেটাও দেখা যাক—

ব্রহ্ম, পদ্ম,বিষ্ণু, শিব, ভাগবত, . ভবিষ্য, নারদ্বীয়, মার্কণ্ডেয়,অগ্নি, ব্রহ্মবৈবর্ত্ত, লিঙ্গ, বরাহ, বামন, কুর্ম্ম, মৎস্য,গারুড়, স্কন্দ, ব্রহ্মাণ্ড, এই সকল সেই পুরাণের কথিত আছে ; সেই অষ্টাদশ পুরাণের মধ্যে এই লিঙ্গ-পুরাণ একাদশ।লিঙ্গপুরাণ,পূর্বভাগ(৩৯/৬১-৬২)

উপরোক্ত শ্লোকগুলোতে "ভাগবত" নাম দ্বারা কোন পুরাণের কথা বলা হয়েছে?কারণ,ভাগবত নামে ৩টি পুরাণ আছে।১ঃশ্রীমদ্ভাগবত,২ঃদেবী ভাগবত এবং ৩ঃমহাভাগবত।

এবার দেখি দেবীভাগবত পুরাণ কি বলে—

মৎস্য,মার্কন্ডেয়,ভবিষ্য,ভাগবত,,ব্রহ্ম,ব্রহ্মান্ড,ব্রহ্মবৈবর্ত্ত,বামন,বায়ু,বিষ্ণু,বরাহ,অগ্নি,নারদীয়,পদ্ম,লিঙ্গ,গৌবিন্দ,কুর্ম্ম,স্কন্দ এই আঠারো পুরাণ।

দেবীভাগবত পুরাণ(১/৩/৪-৮)

দেবীভাগবত পুরাণের শ্লোক অনুসারে উপরোক্ত শ্রীমদ্ভাগবত এবং পদ্মপুরাণে উল্লেখিত পুরাণের নামসমূহে পরিবর্তন দেখা যায়।যেমনঃ

(১)শৈব বা শিব পুরাণের উল্লেখ নেই।

(২)গরুড় পুরাণেরও উল্লেখ নেই।

(৩)নতুন পুরাণের উল্লেখ।যেমনঃগৌবিন্দ পুরাণ।

সংশয়ঃ—

(১)দেবী ভাগবত পুরাণেও "ভাগবত" পুরাণ বলতে কোন পুরাণকে নির্দেশ করেছে স্পষ্ট নয়,কারণ কি?

(২)পদ্মপুরাণ অনুসারে "গৌবিন্দ পুরাণ" না সাত্ত্বিক,না রাজসিক আর না তামসিক।তাহলে এই পুরাণের অবস্থা কি?

প্রামাণিকভাবে এটাই বুঝা যায় যে,অষ্টাদশ পুরাণ সবগুলোই একজন ব্যক্তির লেখা নয়।

এখন দেখা যাক প্রচলিত অষ্টাদশ পুরাণের রচয়িতা কে?

পূর্বাভাস—ভগবান বেদব্যাস সকল বেদের সার সংগ্রহ করার উদ্দেশ্যে মহাভারত প্রণয়ন করেছিলেন।তারপর তিনি বেদান্তের সার সংগ্রহের জন্য এবং দেবর্ষি নারদের উপদেশে মুমুক্ষুদের অনুগ্রহ করার জন্য কল্পবৃক্ষের মতো অভাঃপ্রদ শ্রীমদ্ভাগবত নামক মহাপুরাণ প্রণয়ন করতে প্রবৃত্ত হন।

শ্রীমদ্ভাগবত পুরাণ,মঙ্গলাচরণ(১/১/১),প্রভুপাদভাষ্য
অষ্টাদশ পুরাণানি কৃত্বা সত্যবতীপুতঃ।
ভারতাখ্যানমখিলং চক্রে তৎপরংহিতম্।
মৎস্য পুরাণ(৫৩/৬৯)

অনুবাদঃসত্যবতী নন্দন বেদব্যাস অষ্টাদশ পুরাণ প্রণয়ন করিয়া তহুপরংহিত মহাভারত প্রণয়ন করেন।

পয়েন্টঃ

(১)শ্রীমদ্ভাগবত পুরাণ অনুসারে বেদব্যাস প্রথমে মহাভারত রচনা করেন পরে শ্রীমদ্ভাগবত পুরাণ রচনা করেন।

(২)মৎস্য পুরাণ অনুসারে বেদব্যাস প্রথমে অষ্টাদশ পুরাণ রচনা করে পরে মহাভারত রচনা করেন।

সংশয়ঃ

(১)শ্রীমদ্ভাগবত পুরাণের কথা সত্য হলে মৎস্যপুরাণের কথা ভূল।

(২)মৎস্যপুরাণ সঠিক হলে শ্রীমদ্ভাগবত পুরাণ অষ্টাদশ পুরাণেরই অন্তর্গত নয়।কারণ,শ্রীমদ্ভাগবত পুরাণ অনুসারে মহাভারত রচনার পরেই বেদব্যাস শ্রীমদ্ভাগবত পুরাণ প্রণয়ন করেন।

(৩)একই লেখকের দুই বইয়ে ভিন্ন কথা আসার কারণ কি?

আবার,

অনন্তর বদতাংবর ভগবান্ বসিষ্ঠ বলিলেন, পুলস্ত্য যাহা বাললেন, এতৎসমস্তই সফল হইবে। অনস্তর,

পুলস্ত্য এবং জ্ঞানী বসিষ্ঠের প্রসাদে পরাশর ছয়অংশে বিভক্ত সর্ব্বার্থসাধক নিখিলজ্ঞানের আধারভূত বিষ্ণুপুরাণ রচনা করেন। এই বিষ্ণুপুরাণ ষট সহস্ৰ শ্লোকায়ক। নিখিল বেদার্থপূর্ণ, পুরাণের মধ্যে চতুর্থ এবং সংহিতা সকলে রমধ্যে সুশোভন ।

লিঙ্গপুরাণ,পূর্বভাগ(৬৪/১১৮-১২৪)
গরুড়পুরাণ স্বাক্ষ্য দেয়,

এই সময়ে ব্যাস রূপধারী, বিষ্ণু এক বেদকে চতুর্ভাগে বিভক্ত করিয়া অষ্টাদশ পুরাণ ও অষ্টাদশবিদ্যা প্রণয়ন করেন।

গরুড়পুরাণ(৮৭/৬০)

সংশয়ঃ

(১)লিঙ্গপুরাণ অনুসারে বিষ্ণু পুরাণ অষ্টাদশ পুরাণের অন্তর্গত আর শ্রীমদ্ভাগবতপুরাণ অনুসারে বিষ্ণুপুরাণ সাত্ত্বিক পুরাণ।তাহলে বিষ্ণু পুরাণের রচয়িতা মূলত কে,ব্যাসদেব নাকি তার পিতা পরাশর?

(২)লিঙ্গপুরাণ অনুসারে পরাশর বিষ্ণুপুরাণ লিখেন আবার মৎস্য পুরাণ অনুসারে ব্যাসদেবই অষ্টাদশ পুরাণের রচয়িতা।কোনটি সত্য,লিঙ্গপুরাণ নাকি মৎস্যপুরাণ?

(৩)গরুড় পুরাণ অনুসারে বিষ্ণুই ব্যাসরুপে অষ্টাদশ পুরাণ প্রণয়ন করেন কিন্তু লিঙ্গপুরাণ বলছে ঋষি পরাশর বিষ্ণুপুরাণ লিখেন।তাহলে বিষ্ণুর সত্যিকার অবতার কে ছিলেন,ব্যাসদেব নাকি তার পিতা পরাশর?

বিচারঃউপরোক্ত প্রমাণের ভিত্তিতে বুঝা যায় যে,ব্যাসদেব "প্রচলিত অষ্টাদশ পুরাণ" এর রচয়িতা নন।এই বিষয়ে পরবর্তীতে আরো তথ্য প্রদান করবো।

পরবর্তী পর্বে পুরাণের সংখ্যা,পুরাণের শ্লোকসংখ্যা,রচনাকাল এই বিষয়গুলো নিয়ে আলোচনা করবো।

বি.দ্রঃভূল ত্রুটি ক্ষমা সুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন,যদি কোন তথ্য ভূল মনে হয় তবে কমেন্টে জানিয়ে দিবেন।

আর্য প্রতিনিধি সভা বাংলাদেশ।

Post a Comment

0Comments

Please Select Embedded Mode To show the Comment System.*