সূর্যের সাথে সরণ্যুর মিলন!! অথর্ববেদ (১৮/২/৩৩) বিশ্লেষণ |
অপপ্রচারকারীদের দাবী - সূর্যের কি স্ত্রী থাকতে পারে?সূর্য কি সঙ্গম করতে পারে? সূর্যের কি সন্তান হতে পারে? এটা কতটুকু বিজ্ঞানসম্মত?
বিশ্লেষণ
সরণ্যু শব্দের বিশ্লেষণ - সরণ্যু শব্দের নির্বচন মহর্ষি যাস্ক "সরণাৎ"- করেছেন অর্থাৎ যা গমনশীল - নিরুক্ত (১২/৯)। নিরুক্তের উক্ত প্রকরণ উষাকালের।।
সেই উষাকালের সূর্যা, বৃষাকপায়ী তথা সরণ্যু আদি নামবিশিষ্ট বিভিন্ন অবস্থা রয়েছে। অতএব বাস্তবিকভাবে সরণ্যু শব্দ দ্বারা সূর্যোদয়ের পূর্বে উষাকাল বলা যায়। উষাকাল সকল প্রাণীর প্রবোধের কারণ হয়ে থাকে, এজন্য অন্য প্রাচীন সাহিত্যে ইহাকে সংজ্ঞা নামে অভিহিত করা হয়েছে। নিরুক্তকার স্বয়ং বর্ণনা করেছেন -
" মহতো জায়া বিবস্বতো ননাশ। রাত্রিরাদিত্যস্য, আদিত্যোদয়েহন্তর্ধীয়তে" ইতি -নিরুক্ত (১২/১১) - অর্থাৎ সূর্যোদয় হওয়ার ফলে রাত্রি (উষাকাল) নষ্ট হয়ে যায়।
সরণ্যু এবং বিবস্বানের অশ্বরূপ ধারণ করা-
এখন এই কথনের মূলভূত মন্ত্রসমূহের অর্থ করা আবশ্যক । প্রথম মন্ত্রের অর্থ বিশুদ্ধ অর্থ - ঋগ্বেদ (১০/১৭/১)
পদার্থঃ (ত্বষ্টা) উষাকালীন সূর্য (দুহিত্রে) তার দুহিতা= উষাকালের (বহতুম্) ধারণ অর্থাৎ বিবাহ বিবস্বানের সাথে (কৃণোতি) করান। (ইদম্) এই (বিশ্বম) সমস্ত (ভুবনম্) প্রাণী জগৎ (সমেতি) একত্রিত হয় অর্থাৎ শয়ন স্থানকে ত্যাগ করে নিজ-নিজ কাজে ব্যাপৃত হয় (য়মস্য) যম= অন্ধকারের (মাতা) মাতা এবং (পর্যুহ্যমাতা) প্রাপ্ত করানো হয় (মহঃ) মহান (বিবস্বতঃ) বিবস্বান্ আদিত্যের (জায়া) স্ত্রীরূপ রাত্রি সূর্যোদয় হওয়ার পর (ননাশ) নাশকে প্রাপ্ত হয়।
এই মন্ত্রে ঊষাকালরূপী রাত্রির বিবস্বানের সাথে বিবাহ তথা তার নাশের বর্ণন আলঙ্কারিক রূপে করা হয়েছে। এখানে "রাত্রিরাদিত্যস্য, আদিত্যোদয়েহন্তর্ধীয়তে" যাস্কের এই পদে বিশেষভাবে মনোযোগ দেওয়া আবশ্যক। বেদমন্ত্রে আদিত্যকে প্রাপ্ত হয়ে (সূর্যকে প্রাপ্ত হবার পূর্বেই) রাত্রির নাশের বর্ণন রয়েছে। অন্যাদি প্রাচীন সাহিত্যে "বিবাহের অনন্তর কিছু কাল আদিত্যের ঘরে অবস্থান করে সংজ্ঞা ঘোড়ার রূপ ধারণ করে পালিয়ে যায়" এমন অলঙ্কাররূপে বর্ণনা আছে। তথা পৌরাণিক গ্রন্থে যম-যমীর উৎপত্তি বিবস্বান থেকে বলা হয়নি। তবে সরণ্যুকে যমযমীর মাতা অবশ্য বলা হয়েছে। অতএব বেদমন্ত্রে যে বর্ণনা রয়েছে তা সর্বথা রূপালঙ্কারের অনুরূপ ; পুরাণেরটা নয়। পুরাণে এই আখ্যানকে রঞ্জিত করে।।
দ্বিতীয় মন্ত্রের অর্থ- ঋগ্বেদ (১০/১৭/২) এবং অথর্ববেদ (১৮/২/৩৩)
সূর্য কিরণসমূহ (অমৃতাম্) অমৃত তুল্য উষাকালরূপী রাত্রিকে (মর্ত্যেভ্যঃ) মরণশীল মনুষ্যের দৃষ্টি থেকে (অপাগূহন্) আড়াল করে দেয় এবং (সবর্ণাম) উষাকালের সদৃশ বর্ণবিশিষ্ট প্রভাকে (কৃত্বী) উৎপন্ন করে (বিবস্বতে) উদযাবস্থাযুক্ত আদিত্যের জন্য (অদদুঃ) প্রাপ্ত করেন। (যত্তদ্) সেই যে ঊষাকাল (আসীৎ) ছিল সে (অশ্বিনৌ) দিন ও রাতকে (অভরৎ) ধারণ করেন (উত) এবং (সরণ্যূ) সেই ঊষাকালই (দ্বা) দুই (মিথুনা) যুগলকে (অজহাত) ছেড়ে দেয় অর্থাৎ উৎপন্ন করে।
এই মন্ত্রে ঊষাকালের সূর্য কিরণ দ্বারা লুকায়িত তথা সবর্ণা-প্রভার উৎপন্ন হওয়ার বর্ণনা করা হয়েছে। বিবস্বান কিরণসমূহ দ্বারা যুক্ত প্রচন্ড সূর্যের নাম, দ্যুলোক হতে সূর্য যত-যত কিরণ দিতে থাকে ততই ঊষাকালের নাশ হতে থাকে। ঊষাকালের সমাপ্তি তথা সূর্যোদয়ের মাঝে যে প্রভারূপী সন্ধিকাল রয়েছে সেটাকেই নিরুক্তে সবর্ণা নামে বলা হয়েছে। কারণ হলো যেরকম কোনো পদার্থের ছায়া সর্বদা তার অনুরূপ হয় তেমনই প্রভা ঊষাকালের সদৃশ বর্ণবিশিষ্ট হওয়াতে সবর্ণা শব্দ বা ছায়া শব্দ দ্বারা অভিহিত করা হয়েছে। যাস্ক সবর্ণাতে মনুর উৎপত্তির কথা বলেছে, এখানে "মনু" শব্দের দ্বারা জ্ঞান বুঝায় । সম্যকতয়া জগৎ প্রকাশিত হবার পরই পদার্থের জ্ঞান হয় এবং সে সময়তে গায়ত্রী আদি জপের দ্বারা আত্মিক জ্ঞানের উদয় হয়। উপর্যুক্ত মন্ত্রে মনুর উৎপত্তির কোনো সংকেত নেই৷ মন্ত্রে অশ্বিনীর উৎপত্তি স্পষ্টরূপে বলা হয়নি, পরন্তু যাস্ক এবং পুরাণকারগণ অশ্বরূপিণী সরণ্যুতে অশ্বরূপধারী আদিত্য দ্বারা এদের উৎপত্তি বলা হয়েছে। অশ্ব শব্দের মূল অর্থ শীঘ্রগামী। উষাকাল ও সূর্য (উপচারিকভাবে) উভয়ই শীঘ্র প্রাপ্ত হয় এমন পদার্থ এই দুইয়ের সংযোগে অশ্বিনৌ= দিন ও রাত্রির উৎপত্তি হয় অর্থাৎ এদের দ্বারাই ২৪ ঘন্টা সময়কে দুইভাগে বিভক্ত করা হয়৷ বিবস্বানের সরণ্যুর পিছে ছুটাও এই প্রকরণে ঠিক উৎপন্ন হয়। সরণ্যু= উষাকাল আগে-আগে ছুটে আর সূর্য তার পিছে-পিছে উদয় হয়। আগে বলা হয়েছে যে সরণ্যু যুগল উৎপন্ন করল। সেই যুগলদ্বয় নৈরুক্তপক্ষে মাধ্যমিক ইন্দ্র= বিদ্যুৎ এবং সাথে অবস্থানকারী স্তনয়িন্তু বাণী । ঐতিহাসিক যম ও যমীর উৎপত্তির বর্ণন মানেন ; সেই যম ও যমী হলো তম তথা জ্যোতিঃ। ঊষাকালে তম এবং জ্যোতির অপূর্ব সংমিশ্রণ ঘটে। এরজন্যই এদের উৎপত্তি সরণ্যু= সংজ্ঞার থেকে বলা হয়েছে।
আর্য সমাজের আরেকজন বেদভাষ্যকার আচার্য বিশ্বনাথন বেদালংকারের অথর্ববেদ থেকে উক্ত মন্ত্রটির অর্থ দেওয়া হলোঃ-
অর্থঃ পরমেশ্বরীয় শক্তি (অমৃতাম্) ঊষাকে (মর্ত্যেভ্যঃ) মনুষ্যদের থেকে (অপাগূহান্) আড়াল করে দেয় এবং (সবর্ণাম্) ঊষাসদৃশ বর্ণবিশিষ্ট বা সূর্যের ন্যায় বর্ণবিশিষ্ট সৌর-প্রভাকে (কৃত্বা) প্রকট করে (বিবস্বতে) সূর্যের জন্য, পরমেশ্বরীয় শক্তিসমূহ (অদধুঃ) দান করে বা স্থাপিত করে। (উত) তদনন্তর (যৎ) যা সূর্যরূপ (আসীৎ) ছিল, (তৎ) তাকে সূর্যা (অজহাৎ) ত্যাগ করে দিল। তখন (সরণ্যূঃ) সরণ্যূরূপ ধারণ করে সে (অশ্বিনৌ) অশ্বিনীদের (অভরৎ) উৎপন্ন করে, যা ছিল (দ্বা) জোড়া, এবং (মিথুনা) পরস্পরে মিথুনরূপে ছিল।।
🖋️অভিজিৎ রায়