পুরাণ বিমর্শ দশম পর্ব ('ত্রিদেব' চতুর্থ অংশ)

প্রিয়রত্ন বিদ্যার্থী
0
পুরাণ বিমর্শ দশম পর্ব
'ত্রিদেব' চতুর্থ অংশ


শিবও এদিকে পিছিয়ে থাকবে কেন। তিনিও জেনে বুঝে মোহিনী রূপী বিষ্ণুর সাথে কি করেছিলেন?

অসুরদের মোহিত করার জন্য একবার বিষ্ণু রমনীরূপ ধারাণ করেছিলেন, সেই স্ত্রীরূপ দেখার জন্য মহাদেব স্ত্রী সহ ভূতগণুকে নিয়ে বিষ্ণুর নিকটে যান এবং সেই রূপ দেখানোর অনুরোধ করেন কেননা তিনি তা দেখেননি মহাদেবের অনুরোধে বিষ্ণু সেই রূপ  দেখাবেন বলেন এবং তৎক্ষণাৎ সেখান থেকে অন্তর্হিত হয়েছিলেন এবং মহাদেব উমা চতুর্দিকে চক্ষু সঞ্চালন করে তাঁকে খুঁজতে লাগলেন। তারপর শ্রীমদ্ভাবতে যেমন আছে–

ততো দদর্শোপবনে বরস্ত্রিয়ং    
            বিচিত্রপুষ্পারুণপল্লবদ্রুমে।
বিক্রীড়তীং কন্দুকলীলয়া লসদ-
           দুকূলপর্যস্তনিতম্বমেখলাম্ ॥১৮॥

অনুবাদ– তারপর, নানাবিধ ফুল এবং অরুণবর্ণ পল্লবযুক্ত বৃক্ষশোভিত নিকটবর্তী একটি উপবনে মহাদেব এক অপূর্ব সুন্দরী রমণীকে কন্দুক নিয়ে খেলা করতে দেখলেন। তাঁর নিতম্বদেশ উজ্জ্বল বস্ত্রের দ্বারা আচ্ছাদিত এবং মেখলা শোভিত।


আবর্তনোদ্বর্তনকম্পিতস্তন-
            প্রকৃষ্টহারোরুভরৈঃ পদে পদে।
প্রভজ্যমানামিব মধ্যতশ্চলৎ-
            পদপ্রবালং নয়তীং ততস্ততঃ ॥১৯॥

অনুবাদ– সেই কন্দুকের অবক্ষেপণ এবং উৎক্ষেপণ করে সেই রমণীটি যখন খেলছিলেন, তখন তাঁর স্তনদ্বয় কম্পিত হচ্ছিল এবং তাঁর সেই স্তনের ভারে এবং ভারী ফুলমালার ভারে মনে হচ্ছিল তাঁর দেহের মধ্যভাগ যেন প্রতি পদক্ষেপে ভগ্ন হয়ে যাবে, এইভাবে তিনি তাঁর প্রবালতুল্য কোমল চরণ ইতস্তত সঞ্চালন করছিলেন।


দিক্ষু ভ্রমৎ কন্দুকচাপলৈভৃশং
           প্রোদ্বিগ্নতারায়তলোললোচনাম্।
স্বকর্ণবিভ্রাজিতকুগুলোেক্সসৎ-
            কপোলনীলালকমণ্ডিতাননাম্ ॥২০॥

অনুবাদ– সেই রমণীর মুখমণ্ডল আয়ত, সুন্দর, চঞ্চল চক্ষুর দ্বারা সুশোভিত ছিল, এবং তাঁর সেই নয়নযুগল কন্দুকের উৎক্ষেপণ এবং অবক্ষেপণের সঙ্গে সঙ্গে ঘুরছিল। দুটি অতি উজ্জ্বল কর্ণকুণ্ডল তাঁর উজ্জ্বল গণ্ডদেশকে নীলাভ প্রতিবিম্বের দ্বারা সুশোভিত করেছিল, এবং তাঁর এলোমেলো কেশরাশি তাঁর মুখমণ্ডলকে আরও দর্শনীয় করে তুলেছিল।


শ্লথদ দুকুলং কবরীং চ বিচ্যুতাং
            সন্নহ্যতীং বামকরেণ বন্ধুনা।
বিনিঘ্নতীমন্যকরেণ কন্দুকং
           বিমোহয়ন্তীং জগদাত্মমায়য়া ॥২১॥

অনুবাদ– সেই কন্দুক নিয়ে খেলতে খেলতে তাঁর গায়ের শাড়ি শ্লথ হয়েছিল এবং তাঁর কেশ স্খলিত হয়েছিল। তিনি তাঁর সুন্দর বাম হস্তের দ্বারা তাঁর কেশ বন্ধনের চেষ্টা করছিলেন, এবং সেই সঙ্গে তিনি তাঁর ডান হাত দিয়ে কন্দুকে আঘাত করে সেই কন্দুকটি নিয়ে খেলা করছিলেন। এইভাবে ভগবান তাঁর আত্মমায়ার দ্বারা সারা জগৎ বিমোহিত করেছিলেন।


তাং বীক্ষ্য দেব ইতি কন্দুকলীলয়েষদ-
           ব্রীড়াস্ফুটস্মিতবিসৃষ্টকটাক্ষমুষ্টঃ।
স্ত্রীপ্রেক্ষণপ্রতিসমীক্ষণবিহ্বলাত্মা
            নাত্মানমস্তিক উমাং স্বগণাংশ্চ বেদ ॥২২॥

অনুবাদ– মহাদেব যখন সুন্দরী রমণীটিকে কন্দুক নিয়ে খেলা করতে দেখেছিলেন, তখন সেই রমণীও তাঁর প্রতি কখনও কখনও দৃষ্টিপাত করেছিলেন এবং লজ্জায় ঈধৎ হেসেছিলেন। সেই সুন্দরী রমণীকে নিরীক্ষণ করে এবং সেই রমণীকে প্রতিনিরীক্ষণ করতে দেখে মহাদেব তাঁর পরমা সুন্দরী পত্নী উমা এবং নিকটস্থ তাঁর পার্ষদদের বিস্মৃত হয়েছিলেন।


তস্যাঃ করাগ্রাৎ সতু কন্দুকো
         যদা গতো বিদূরং তমনুব্রজৎস্ত্রিয়াঃ।
বাসঃ সসূত্রং লঘু মারুতোহহরদ্
           ভবস্য দেবস্য কিলানুপশ্যতঃ ॥২৩॥

অনুবাদ– তাঁর হাত থেকে কন্দুকটি যখন দূরে পতিত হল, তখন সেই রমণী তার পশ্চাদ্ধাবন করেছিলেন। তখন মহাদেবের সমক্ষেই বায়ু হঠাৎ কাঞ্চি সহ তাঁর কটিদেশের সূক্ষ্ম বস্ত্র উড়িয়ে নিয়ে গিয়েছিল।

এবং তাং রুচিরাপাঙ্গীং দর্শনীয়াং মনোরমাম্।
দৃষ্টা তস্যাং মনশ্চক্রে বিষজ্জন্ত্যাং ভবঃ কিল ॥২৪॥

অনুবাদ– মহাদেব দেখলেন, সেই রমণীর দেহের প্রতিটি অঙ্গ অত্যন্ত সুন্দর, এবং সেই সুন্দরী রমণীও তাঁকে নিরীক্ষণ করতে লাগলেন। তাই সেই রমণী তাঁর প্রতি আকৃষ্ট হয়েছেন বলে মনে করে, মহাদেব তাঁর প্রতি অত্যন্ত আসক্ত হয়েছিলেন।


তয়াপহৃতবিজ্ঞানস্তৎকৃতস্মরবিহ্বলঃ।
ভবান্যা অপি পশ্যন্ত্যা গতন্ত্রীস্তৎপদং যযৌ ॥২৫॥

অনুবাদ– সেই রমণীর সঙ্গে রমণ করার বাসনায় শিব তাঁর জ্ঞান হারিয়ে তাঁকে পাবার জন্য এমনই উন্মত্ত হয়েছিলেন যে, ভবানীর সমক্ষেই তিনি নির্লজ্জভাবে সেই সুন্দরীর কাছে গিয়েছিলেন।


সা তমায়ান্তমালোক্য বিবস্ত্রা ব্রীড়িতা ভূশম্।
নিলীয়মানা বৃক্ষেষু হসন্তী নাম্বতিষ্ঠত ॥২৬॥

অনুবাদ–সেই সুন্দরী রমণী ইতিমধ্যেই বিবসনা হয়ে পড়েছিলেন, এবং তিনি যখন দেখলেন শিব তাঁর দিকে এগিয়ে আসছেন, তখন তিনি অত্যন্ত লজ্জিত হয়ে হাসতে হাসতে বৃক্ষের অন্তরালে লুকিয়েছিলেন; তিনি এক জায়গায় দাঁড়িয়ে থাকেননি।


তামন্বগচ্ছদ ভগবান্ ভবঃ প্রমুষিতেন্দ্রিয়ঃ।
কামস্য চ বশং নীতঃ করেণুমিব যূথপঃ ॥২৭॥

অনুবাদ– মহাদেবের ইন্দ্রিয় তখন অত্যন্ত বিচলিত হয়েছিল। কামান্ধ হস্তী যেভাবে হস্তিনীর প্রতি ধাবিত হয়, মহাদেবও ঠিক সেইভাবে সেই সুন্দরীর প্রতি ধাবিত হয়েছিলেন।


সোহনুব্রজ্যাতিবেগেন গৃহীত্বানিচ্ছতীং স্ত্রিয়ম্।
কেশবন্ধ উপানীয় বাহুভ্যাং পরিষস্বজে ॥২৮॥

অনুবাদ– অত্যন্ত দ্রুতবেগে তাঁর পশ্চাতে ধাবিত হয়ে, মহাদেব সেই সুন্দরীর চুলের বেণী ধরে তাঁকে কাছে টেনে এনেছিলেন, এবং অনিচ্ছুক হলেও তাঁকে তাঁর বাহুর দ্বারা আলিঙ্গন করেছিলেন।


সোপগুঢ়া ভগবতা করিণা করিণী যথা।
ইতস্ততঃ প্রসপন্তী বিপ্রকীর্ণশিরোরুহা ॥২৯॥
আত্মানং মোচয়িত্বাঙ্গ সুরর্যভভুজান্তরাৎ।
প্রাদ্রবৎ সা পৃথুশ্রোণী মায়া দেববিনির্মিতা ॥৩০॥

অনুবাদ– হে রাজন, হস্তীর দ্বারা আলিঙ্গিতা হস্তিনীর মতো সেই ভগবানের যোগমায়া নির্মিতা স্কুল নিতম্বিনী সুন্দরী মহাদেবের দ্বারা আলিঙ্গিতা হয়ে, আলুলায়িত কেশে মহাদেবের বাহুপাশ থেকে নিজেকে মুক্ত করে দ্রুতবেগে পলায়ন করলেন।


তস্যাসৌ পদবীং রুদ্রো বিষ্ণোরস্তুতকর্মণঃ ।
প্রত্যপদ্যত কামেন বৈরিণের বিনির্জিতঃ ॥৩১॥

অনুবাদ– কামরূপ শত্রুর দ্বারা বিচলিত হয়ে শিব যেন অদ্ভুতকর্মা মোহিনীরূপী বিষ্ণুর পথ অনুসরণ করতে লাগলেন।


তস্যানুধাবতো রেতশ্চস্কন্দামোঘরেতসঃ।
শুষ্মিণো যূথপস্যেব বাসিতামনুধাবতঃ ॥৩২॥

অনুবাদ– মত্ত হস্তী যেমন ঋতুমতী হস্তিনীর অনুগমন করে, অমোঘবীর্ষ মহাদেবও তেমন সেই সুন্দরীর অনুসরণ করতে লাগলেন, এবং তখন তাঁর বীর্য স্খলিত হয়েছিল।
          (শ্রীমদ্ভাগবত পুরান - ৮/১২/১-৩২)


তিনি জেনে বুঝে  বিষ্ণু বা মোহিনীরূপী বিষ্ণুর সাথে এমন করলেন,এই অশ্লীলতাকে কেহ লীলা বলেন, কিন্তু লীলা বললেই কি তা আর অশ্লীল থাকেনা? কেহ আবার বিবিধ ব্যাখ্যা নিয়ে আসেন যে ব্যাখ্যায় তারা অজান্তে শিবজীকেই পরোক্ষভাবে কিছু সময়ের জন্য নিয়ন্ত্রণহীন অর্থাৎ পাগল প্রমাণ করে বসে। কেহ আবার আধ্যাত্মিক ব্যাখ্যা নিয়ে আসে কিন্তু তখন আবার বলেনা যে আধ্যাত্মিকতায় মোহিনী অবতার বলতে কি, শিব কি, উমা কি, কিছু বাস্তবিক স্বীকার করে আর কিছু মনগড়া অবাস্তব অর্থ করে অর্থাৎ তারা যে ব্যাখ্যা নিয়ে আসে প্রত্যেক ব্যাখ্যাতেই কোন না কোন সমস্যা থাকে। মহাদেব শুধু কি নিজেই এমন করেছে? ব্রহ্মবৈবর্ত্তপুরাণে  তিনি তো নিজ স্ত্রীকেও বিষ্ণুকে আলিঙ্গন করার জন্য বলেছেন। যেমন উল্লেখ আছে –


পুরা গণেশং দ্রষ্টুং চ প্রজগ্মুঃ সর্বদেবতাঃ ।
শ্বেতদ্বীপাৎ স্বয়ং বিষ্ণুর্জগাম শঙ্করাস্তবাৎ॥১৪৬॥
তং দৃষ্ট্বা পার্বতী তদা বিষ্ণোর্বদনেক্ষণা ।
মুখমাচ্ছাদং বাসসা ব্রীড়য়া সতী ॥১৫৪॥
অতীব সুন্দরং রূপং দর্শ দর্শ পুনঃ পুনঃ ।
দদর্শ মুখমাচ্ছাদ্য নিমেষরহিতা সতী ॥১৫৫॥
পরমদ্ভুতবেষং চ সস্মিতা বক্রচক্ষুষা ।
সুখসাগরসংমগ্না বভূব পুলকাঞ্চিতা ॥ ১৫৬॥
দৃষ্ট্বা তু পার্বতী ভক্ত্যা পুলকাঞ্চিতবিগ্রহা।
মনসা পূজয়ামাস পরমাত্মানমীশ্বরম্ ॥১৬১॥
দুর্গান্তরাভিপ্রায়ং চ বুবুধে শঙ্করঃ স্বয়ম্ ।
সর্বান্তরাত্মা ভগবানন্তর্যামী জগৎপতিঃ ॥১৫২॥
দুর্গাঞ্চ নির্জনীভূয় তমুবাচ হরঃ স্বয়ম্ ।
বোধয়ামাস বিবিধং হিতং তথ্যমখণ্ডিতম্ ॥১৬৩॥
নিবেদনং মদীয়ঞ্চ নিবোধ শৈলকন্যকে ।
শৃঙ্গারং দেহি ভদ্রং তে হরয়ে পরমাত্মনে ॥১৬৪॥

               (ব্রহ্মবৈবর্ত্তপুরাণ, শ্রীকৃষ্ণজন্মখণ্ড-ষষ্ঠ অধ্যায়)

শ্রীকৃষ্ণ বলিলেন, পূর্ব্বে এক সময়ে দেবগণ গণেশকে দর্শন করিবার নিমিত্ত কৈলাসে আগম করিয়াছিলেন, সেই সময়ে শঙ্করের স্তবের নিমিত্ত শ্বেতদ্বীপ হইতে বিষ্ণুও আগমন করিয়াছিলেন; তখন প্রসন্ন- বদন, পার্ব্বতী তাঁহাকে দেখিয়া অঞ্চল দ্বারা মুখ আচ্ছাদন করত অতি লজ্জিতা হইলেন। সতী পার্বতী সেই মনোহর রূপ পুনঃপুনঃ দর্শন করত মুখ আচ্ছাদন করিয়া নির্নিমেষ নয়নে তাঁহাকে দর্শন করিতে লাগিলেন। পার্ব্বতী সেই পরম অদ্ভুত বেশ কটাকে দর্শন করত পুলকাঞ্চিত কলেবরে সুখসাগরে মগ্না হইলেন,। তাঁহাতে দেখিয়া পার্ব্বতীর শরীর রোমাঞ্চিত হইল এবং তিনি মনে মনে সেই পরমাত্মা ঈশ্বরকে পূজা করিলেন। তখন জগৎপতি সর্ব্বান্তরাত্মা অন্তর্যানী ভগবান্ শঙ্কর দুর্গার অন্তরের ভাব বুঝিতে পারিয়া নির্জনে তাঁহাকে হিতকর সত্যস্বরূপ বিবিধ বাক্যে প্রবোধ দিলেন;- হে শৈলতনয়ে! তুমি আমার এক নিবেদন শ্রবণ কর, এই পরমাত্মা হরিকে [বিষ্ণুকে] তুমি আলিঙ্গন প্রদান কর।


পপদ্মপুরাণেও দেখা যায় যে, শিবজী যুবতী রূপবতী  নারীদের দেখে তাদেরকে মন্ত্রবলে আকর্ষিত করে.......(চলবে)

🖋️প্রিয়রত্ন বিদ্যার্থী
©️অমৃতস্য পুত্রাঃ

Post a Comment

0Comments

Please Select Embedded Mode To show the Comment System.*